২০২০-অতীত-ভবিষ্যৎ || সাবিত্রী জানা ষন্নিগ্রহী




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

২০২০-অতীত-ভবিষ্যৎ

সাবিত্রী জানা ষন্নিগ্রহী


জীবন চলে তার নিজের মতো। মন বাঁধা পড়ে পথ চলতি শোনা কথায়- বর্তমানের দোলায়- ভবিষ্যতের ভাবনায়- অভিজ্ঞতার চালুনীতে। বহুযুগ পর একটা বছর- ২০২০--করোণার সমাদর। ---সেই ১৯৪৭ সালের আগের কথা-ভারতের বতর্মান বাঁধা পড়েছিল বিদেশীদের হাতে--কত যন্ত্রণা-ব‍্যাথা পুঁতে দিয়েছিল মানুষের রক্তের কনায় কনায়। হাতে চাবুক-পায়ে বেড়ি-পিঠ ফালাফালা- গরাদের অন্তরালে।- -বসুন্ধরা উপহার দিয়েছে কত শস্য-নীল, মশলাপাতি, ভেষজ উপাদান। ভোগ করেছে বিদেশী-দুর্ভোগের শিকার হয়েছে ভারতবাসী।

১৯৪৭ এর পর-- ভারতমাতা হাসিমুখে মেনে নিল মানুষ ভাগাভাগি-ধর্ম হোল সম্পদ-কতশত জোয়ান পুরুষ, নারীর  হাসিমুখে আত্মবলিদানের উপহার-স্বাধীনতা।

---শুনেছি--১৯৫৬ সালের পর-দুর্ভিক্ষ-অনাহার-

অপুষ্টি-লঙ্গরখানা-

বাটিহাতে পাড়ার বৌদি এসে দাঁড়াতো মায়ের সামনে-একমুঠো ফেনাভাতের আশায়--দিন দিন--শীর্ণ জীর্ণ চেহারায় ছেঁড়া কাপড়ে নিজের লজ্জা ঢেকে। কাদায় মাখামাখি পথে চলা মানুষজন-দশ কিলোমিটার হেঁটে চলো কোথায় ডাক্তার আছে-ঘরের মানুষটির দু'দিন ধুম জ্বর। --কোন কষ্ট নেই তো। গ্রামে ওলাওঠা ধরেছে--হাতুড়ে ডাক্তারের এক পুরিয়া বড়ি--না বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কম‌। --হাইজিন তো আছে --গ্রামের গ্রামসেবক দাদু তো ঘরের চারদিকে পিচকিরি দিয়ে গ‍্যামাক্সিন ছড়িয়ে দিয়ে গেছে।--আর সেই যে আলোআলা হাতে ছোট্ট একটা হ‍্যারিক‍্যান নিয়ে রাত পাহারা দিত --সেই দাদু তো মাঝে মাঝে বিছানায় শুয়ে থাকে--আর চিরতা পাতার জল খায়। নতুন বাচ্চার কনুইয়ের উপরে কে যেন গোল যন্ত্রের আগায় চারটে ছোট 

সূঁচওয়ালা পিচকিরি দিয়ে চামড়ার উপর ঘুরিয়ে দিত। পিচকিরির ভেতর টিকার ঔষধ থাকতো।--চামড়া কেটে রক্ত পড়তো-ঘা হোত-ভালো ও হয়ে যেতো--চামড়ার উপর রেখে যেতো গোল ঘায়ের দাগ।--সবছিল তো-মানুষ খারাপ ছিল না তো। 

১৯৬০--দিকে দিকে খরা- বন‍্যা-গৃহস্থ ধানের বস্তা নিয়ে চলেছে অন‍্য কোথাও --লেভি দিতে হবে--বেশী ধানের খোঁজ পেলে কারা যেন চলে যাবে নিয়ে। ---লঙ্গরখানায় কুমড়ার তরকারি আর দু'টি রুটি জনাপ্রতি।--মাথার উপর ত্রিপলের ছাদ-- একসাথে শ্বশুর, ভাসুর, গরুবাছুর আর আঁতুড়ের মা- বাচ্চা।--ভোট আসছে- -বুথের দু'কিলোমিটার ব‍্যাপী--পতাকা-লাঙ্গল কাঁধে চাষী। আরো ছিল --লালরঙে কিছু আঁকা।

বেশ চলছিল তো। 

কারা যেন সহ‍্য করতে পারছিল না--মার মার কাট কাট--১৯৭০-অল্প অল্প চেঁচানি। মাঝে মাঝে থমমেরে বসে থাকতো গ্রামের সরল সহজ মানুষগুলো। কেন কে জানে?

---আগুন--আগুন--আগুন--স্কুল-কলেজে নাকি আগুন লেগেছে। কারা নাকি রাতের অন্ধকারে আগুন নিয়ে খেলা করে। পরীক্ষা চলছে--পড়াশোনা করে কি হবে? দেখে লিখে দাও--পাশ হয়ে যাবে।

---কেউ অস্থির নয়কো --এটাই নতুন নিয়ম --খারাপ হবে না--পরিবর্তন হবেই--ভালো থাকার আবাহন। 

সময় গড়িয়ে চলে-- পড়াশোনা করে মেধাবী ইঞ্জিনিয়াররা ঘরে বসে গুলতানিতে মেতেছে। বাবা-মায়েদের ভাবনা নেই। কি হবে ভেবে? এতদিন তো সুন্দর চলে যাচ্ছে--নাই বা থাকলো অনেককিছু। --পড়াশোনা করে ও মাঠে চাষের কাজে উৎসাহের অন্ত নেই যুবকগুলোর --পেট চলে যাবে- কাপড়চোপড় কতই বা লাগে।--নাই বা পায়ে চপ্পল- মাটিতে হাঁটা স্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী।

১৯৮০ কত বেকার চাকরি পেল-স্কুলে-কলেজে কিছু- কারিগরি বিদ‍্যা বোধহয় কেউ চায় না। ডাক্তাররা একটু সজাগ হয়ে চিকিৎসা করতে ব‍্যস্ত।--গবেষণায় কৃতীরা কলেজে চাকরির দরখাস্ত নিয়ে অফিসের দুয়ারে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত। --না সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। মামা-দাদা তো কলেজ দেখেনি। --

গ্রামের মেয়েরা ছোটবেলাটা স্কুলের মুখ দেখে--তারপর কোথায় যায়!! ঘোমটা দিয়ে পালকি চেপে--হেঁই-হো-হো গান শুনতে শুনতে দূরে কোন এক আত্মীয় বাড়িতে স্থায়ী আশ্রয় পায়--তারসাথে মাঝে মধ্যে পিঠে হয়তো হাতের পাঁচটা আঙ্গুলের ছাপ ও পড়ে--কাজ শেখেনি যে। তাও ভালোই থাকে। নিশ্চিত আশ্রয় -খাওয়া-পরা-সবাই মিলেমিশে পাশাপাশি কত গপ্পো।

১৯৯০ সালের একটু আগে কি যেন একটা অদলবদল হোল--পতপত করে উড়তে লাগলো লালপতাকা-তাতে আবার দা-হাতুড়ি-বা তারা আঁকা ছাপছাপ।

ইংরেজি পড়াটা তো চলবে না--ওটা বিদেশি ভাষা। --মাথায় মার তো একটা লাঠির ঘা--ইংরেজি পড়বে! কম্পিউটার শিখবে!! যত সব অপসংস্কৃতি --আধুনিকতা চলবে না। পাশ্চাত্য অনুকরণ রসাতলে নিয়ে যাবে- তোকে-আমাকে-তাকে।

তো স্থির হয়ে ভালো থাকো। তাই সই। ভালো থাকাই তো দরকার। 

--চাকরি করছিস তো কি হবে? বেতনটা পাবি ছয় -আটমাস পরে--একটু কষ্টে সিস্টে চালিয়ে নিতে হবে। --বাচ্চাদের ঠিক করে শিখাতে হবে তো। না খেয়ে ও শেখানো যায়। ঠিক শেখানো দরকার--ভালো থাকার জন্য।

--চলছে শান্তি--কলকাতা শহরে নাকি কত অশান্তি হচ্ছে। দলে দলে সব কোথায় যেন চলেছে -ঘেরাও হবে--ঘিরুক-- আমরা ভালো আছি। --

--আরে আরে গ্রামে গ্রামে মানুষগুলো আরো ভালো থাকতে চায়। ওরা কারা-- রাতের জাগরণে জেগে থাকে আর থালা হাতে ভিক্ষা খোঁজে--কিছু তো দাও--আরো ভালো রাখবো --মার্ মার্ ধর্ ধর্।

--পেরিয়ে গেল ভালো মন্দ মিশিয়ে বেশ কয়েকটা বছর--

বসুন্ধরা সম্মেলন তো হয়েছে সেই ১৯৭২, ১৯৯২----দূষণে জর্জরিত পৃথিবীর আকাশ বাতাস-- মুখস্থ করে ফেলো কিভাবে দূরীভূত হবে ঐ কালো বাতাস--পারো তো পাড়ায় পাড়ায় বলে দিও--ধূঁয়া মানুষকে কষ্ট দেয়--বিড়ি, সিগারেট, গুটকা -পানমশলাগুলো বাদ দিতে হবে। নতুন তোমার 

ফুসফুসটা কমজোরী হবে--ছাতিটা হাতুড়ির মতো ওঠানামা করবে। একমূহুর্তে স্পন্দনহীন ছাতিটা দেখে প্রিয়জনেরা মাথা খুঁড়বে।--একঘেয়েমি জীবন --কৃষকের মুখে কখনো হাসি তো কখনো চোখে কান্না--লাভ তো হোল না। ভাবতে হবে পরের বছর কিভাবে মুনাফা আসবে।

সব তো ঠিক ছিল--কিন্তু কোথায় যেন লুকিয়ে চুরিয়ে মায়ার খেলা চলছিল। বাচ্চাগুলোর পাঠের আস্থানার সংখ্যা বাড়লো। স্পেশাল স্কুল-স্পেশাল মানুষের স্পেশাল জ্ঞান বাচ্চাদের পড়াশোনার আগ্রহ বাড়িয়ে দিলে। অভিভাবকরা হাতজোড় করে "মাথা-মাষ্টার-মহাশয়ের" নিকট সবিনয়ে নিবেদন পেশ করলেন-অনুমতি দিয়ে দেন--আমাদের বাচ্চাগুলো বিশেষ ইস্কুলে যাবে। পরীক্ষার সময় আপনার ইস্কুলে আসবে। অলিখিত অনুমতিতে অলিতে-গলিতে বিশেষ ইস্কুলের রমরমা। --ভালোই চলছিল--কেউ তো খারাপ ছিল না!! 

হঠাৎ--২০২০--বিশ্ব সম্মেলনে কি আলোচনা হয়েছিল!! বসুন্ধরা আলোচনায় "ছোট্ট একটি জীবাণু" উপস্থিত ছিল। সে তো বহু আগেই বোধহয় ২০০৩ থেকে লুকিয়ে চুরিয়ে চোখের জলে হাবুডুবু খাচ্ছিল। সুযোগ বুঝে ঢুকে পড়েছে সমাজের সূক্ষ গর্তে।

 ---হায় হায়--করোণা এ কি করলি রে!! সব স্তব্ধ করে দিলি!! বিশ্বচক্রকে থমকে দিলি কেন?? --ফিরিয়ে দিলি সেই "পৌরাণিক" দিনগুলো!! কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন নেই--কি বাজারে-কি শিক্ষালয়ে-কি রেস্টুরেন্টে।-বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটালি-- না--"মন্ত্র দিলি---খালি হাতে একা এসেছো-খালি হাতে একা চলে যাও"--কি অদ্ভুত কৃষ্ণপ্রেম--মায়ামুক্ত চেতনা -আহা-আহা--

আগামীকাল ২০২০ সালটা বিদায় নেবে--কোথাও করুণ ক্রন্দন-কোথাও মনগুলো আঁকুপাঁকু -দেশের মাটি অপেক্ষা করছে তাদের পদধ্বনি শোনার জন্য।--

আচ্ছা--২০২০--আগামী বছরগুলো কিভাবে কাটবে বলতে পারবে??

মৃদুস্বরে জানান দিয়ে যাবে--২০২০--অনলাইন জেনারেশন--আঙুলে যন্ত্রের অক্ষর টেপো-সব পেয়ে যাবে। লেখাপড়া-কেনাকাটা-

ব‍্যবসাবানিজ‍্য-টাকাপয়সা লেনদেন-ইত্যাদি ইত্যাদি। যদিও এগুলো অনেক আগেই এসেছে ২০২০ সাল স্বীকৃতির ছাপ্পা দিয়ে দিল।

--আচ্ছা ভাবতে তো পারি--

পৃথিবীর তাপমাত্রা আর বাড়বে না-বরং কমবে-- Global dimming হবে-- আর তা হবে পৃথিবীর উপরে ধূলো ছিটিয়ে দিলে তো সূর্যের তাপমাত্রা পৃথিবীতে আসবে না।  

আচ্ছা এমন ও তো হতে পারে-২০২১ সাল থেকে ধীরে ধীরে আমরা হাতের কাছে সবকিছু পাবো। ব‍্যবহার্য সমস্তকিছু--খাদ‍্য-পানীয়-

ঔষধ-ডাক্তার-উকিল-নার্স-মাষ্টার-ইঞ্জিনিয়ার-। এমনকি সূর্য-চন্দ্র-তারা- গাছপালা-ইত্যাদি-

একনিমেষে--কিভাবে!!! মাথার ভেতর যদি একটা যন্ত্র থাকে তবে বেশ সুবিধা হয়। --যদি মনে করি ২০৩০ সালে দেখলাম আমার কিছুই নাই-এমনকি ঘরবাড়ি। কেবল মাথার ভেতর একটা যন্ত্র আছে। তার কাছে যা চাইবো সে তাই দেবে।

----হ‍্যাঁ ২০২০ "করোণা" বছর দিয়েছে অনেক কিছুই--তার সাথে দিয়েছে বেশকিছু গোপন অবান্তর ভাবনা। ভালো আছি ভাবাই ভালো। 

--"আমার শোনার ডায়েরিটা বেশ বড়ো-- নিশ্চয় আরো বড়ো হবে--আমার মৃত্যু পর্যন্ত"।।

জীবনটা নদীর মতো-- জলে ঢেউ ওঠে-ঢেউয়ের তালে তালে ভাবনা জাগে--এক একটা ঢেউ এক একটা ভাবনা--ঘুমের কোলে মিলিয়ে যায়। জল কখনো স্বচ্ছ-কখনো ঘোলা --কখনো চড়া পড়ে যায়--কেবল কাদা--কখনো বা উর্বর মাটিতে ফসল ফলে -- সজীবতার প্রতীক।

বিদায় নিক্ অভিশপ্ত ২০২০--আসুক সুসময় সবার জীবনে-ভালো থাকার বার্তা নিয়ে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ