হিংসার কবলে || সাবিত্রী জানা ষন্নিগ্রহী




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

 বড়দিনের বেড়ানো

হিংসার কবলে

সাবিত্রী জানা ষন্নিগ্রহী


২০১১ সাল,-গৌহাটি থেকে মেঘালয় বেড়োনোর পরিকল্পনা হয়েছে। দু'দিনের মেয়াদ। প্রথম দিন-২৪শে ডিসেম্বর মেঘালয়ের রাজধানী-প্রায় পনেরশত উঁচু, পূর্ব খাসি পাহাড় জেলা সমৃদ্ধ পাইন অরণ্য ঘেরা-শিলং ছুঁয়ে চেরাপুঞ্জি দর্শন। শিলং এ ফিরে মেঘালয় টুরিজিম্ এর রিসর্ট এ ২৪ শে ডিসেম্বর রাত্রি যাপন। ২৫ শে ডিসেম্বর শিলংএর দর্শনীয় স্থান দেখে গৌহাটি ফিরে আসা।

গৌহাটি আই আই টি ক‍্যাম্পাসের ফ্ল‍্যাটের দুয়ারে ঠিক সাতটায় গাড়ি হাজির। আমরা স্বামী-স্ত্রী, আমাদের দুই পুত্র। সমতল থেকে পাহাড়ী পথে ওঠার আগে যুবক ড্রাইভার এক রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামিয়ে টিফিন খেয়ে নিতে বললো। এরপর নাকি গাড়ি আর থামবে না। একেবারে শিলংএর "উমিয়াম লেক" এর কিনারায়। বামে পাহাড় রেখে গাড়ি ক্রমশঃ উপরে উঠছে। পাহাড়ের গায়ে বিভিন্ন বাহারি ফুলের মেলা। মাঝে মাঝে এবড়ো খেবড়ো রাস্তা।  প্রায় তিনঘন্টা পর শিলং ঢোকার প্রায় চৌদ্দ কিমি আগে ব্রিজ পেরিয়ে বিশাল এক জলাশয়-"উমিয়াম লেকের" পাড়ে এসে গাড়ি বিশ্রাম নিল। একদিকে বিশাল বিশাল ঘন পাইন বৃক্ষ পাহাড়কে আঁকড়ে রেখেছে। অন‍্যদিকে লেকের স্বচ্ছজলে মৃদুঢেউ এদিক থেকে ওদিক ছন্দে ছন্দে এগিয়ে চলেছে। পাহাড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাইনের পুষ্পমঞ্জরী -তথা "স্ত্রীকোন" ও "পুরুষকোন" আলাদা ঝুলে পড়েছে  লেকের দিকে। আমি হাত দিয়ে ছু়ঁতে চাইলাম-ধরা দিল না। অগত্যা পথের উপর পড়ে থাকা কয়েকটি "কোন" হাতে তুলে নিয়ে পরম যত্নে ব‍্যাগে রাখলাম। "কোন"গুলো  আন্দোলিত হচ্ছে ঠান্ডা শিরশিরে হাওয়ায়-মনে হচ্ছে ওদের খুশির সীমা নাই। --জলাশয়ে নৌকায় ভ্রমণ প্রেমীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘন্টাখানেক ঘোরাঘুরি করে গাড়িতে উঠে বসলাম। পাহাড়-পাহাড়-পাহাড়--

পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে গাড়ি ছুটছে। পাহাড়ের গায়ে থরে থরে পাইন- -মাঝে মাঝে ঝর্ণার রুপালি ক্ষীণধারা পাহাড়ের বুক বেয়ে বয়ে চলেছে নিম্নমুখী হয়ে--পাহাড়ের কোলে কোলে ছোট্ট স্রোতস্বিনী তৈরী করেছে। পৌঁছলাম লাইমকেভের সামনে। রকমারি উদ্ভিদবৈচিত্র্য ঘেরা ভেজা রাস্তা ধরে এগিয়ে ঢুকলাম গুহার ভেতর। মাথা নিচু করে-- গুহার দেওয়াল ধরে ধরে আ়ঁকাব়াঁকা পথে এগোনো-- মনে হচ্ছিল দম্ আটকে আসবে। গুহার ভেতরে কোথাও কোথাও বড় বড় বৃক্ষের শেকড় দেওয়াল আঁকড়ে রেখেছে। উপরে উঠে প্রাণভরে শ্বাস নিলাম।  কিছুক্ষণ কাটিয়ে আবার এগোনো।   ঘন সবুজ --কুয়াশাঘেরা পাইন- আর হালকা রোদের ছোঁয়া উপভোগ করতে করতে পৌঁছলাম চেরাপুঞ্জির শুষ্ক অঞ্চলে। বইতে পড়া "বিশ্বের সর্বাধিক বৃষ্টিপাত অঞ্চল চেরাপুঞ্জি"--- মেলাতে পারলাম না চাক্ষুষ দেখা চেরাপুঞ্জিকে। চতুর্দিকে শুকনো খড়ের মতো রঙের গাছগাছালি। মনে হোল উদ্ভিদগুলো বেশ কষ্টে আছে। ঘন সবুজ পাইনসারির অদূরে খরাঞ্চল দেখে চেরাপুঞ্জিকে খুব দুখী মনে হোল। যতদূর চোখ যায় কেবল সবুজ হীন রুক্ষ জায়গা। জায়গাটির নাম "চেরাবাজার"। ছোট ছোট কয়েকটি গ্রাম - কতকগুলো ছোট ছোট খাওয়ার দোকান - হাতের তৈরী ঘর সাজানোর বস্তুর দু'একটি স্টল। কফি খেলাম --হাতে তৈরি দেওয়াল ম‍্যাট ও সুদৃশ্য গোটানো হাতপাখা কিনলাম। ---ফিরতে হবে শিলং--ঘড়িতে বিকেল তিনটে বাজে। ফেরার পালা। --সোজা শিলং--সেই সুদৃশ্য --মোহময় কুয়াশা ঘেরা পাহাড়ি খাদের ভয়াবহতা --বুকে ভয় নিয়ে সবুজের সজীবতা উপভোগ করতে করতে শিলংয়ে "মেঘালয় টুরিজিম্ গেষ্ট হাউসে"র লনে গাড়ি থামলো।

---কাঠের মেঝেতে ঠকঠক শব্দ করতে করতে রুমের ভেতর ঢুকলাম। দুটো রুম পাশাপাশি। ড্রাইভার কোথায় থাকলো জানিনা। খিদে লেগেছে-ঠান্ডায় হাত পা কনকনে। গরম জলে হাত মুখ ধুয়ে ডাইনিং টেবিলে গেলাম। কাঁচের জানালার ওপারে অদূরে ঘন পাইনবন। লনে বাহারি ফুলের বাগান। গরম গরম খাওয়ার খেয়ে রুমে ঢুকেই লেপের তলায় আশ্রয় নিলাম।----হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে রুমে কাঠের দেওয়াল কাঁপছে--আবার শব্দ--মনে হচ্ছে বোমা ফাটছে-- ঘন ঘন --একটানা একঘন্টা। ভয়ে জড় হয়ে শুয়ে আছি --কি চলছে বুঝতে পারছি না। অন্য রুমে দুই ছেলে-- ওরা কি করছে? ওরা ও ঠিক ভয় পেয়েছে--দরজা খুলে বাইরে বেরোবো সে ভরসা ও নেই। --কোথায় এলাম আমরা---কোন দুর্বৃত্তরা গেষ্ট হাউস আক্রমণ করেছে নাকি!!!সরকারি গেষ্ট হাউস--হতে ও পারে--পাহাড়ি অঞ্চল-- উপজাতিদের বসবাস-- আশঙ্কা ক‍রছি--ছেলেগুলো ঠিক আছে তো!!!---হঠাৎ সব থেমে চুপচাপ। কি হোল!!! ভাবতে ভাবতে আবার কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। আধঘুম-আধজাগা --ঘড়িতে দেখলাম ভোর পাঁচটা। বিছানা ছাড়লাম। ফ্রেশ হয়ে ছেলেদের ডাকলাম--ওরা আসছি বলায় নিশ্চিত হলাম--রাতে হয়তো অন‍্য কিছু প্রোগ্রাম ছিল।-- বাইরে বেরোলাম ---কেউ ওঠেনি--বিশাল লনে বাজি ফাটানোর পোড়া অংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। গেষ্ট হাউসের চারদিকে রঙিন পতাকা টাঙানো-টুনি বাল্ব দিয়ে সাজানো হয়েছে। আলো জ্বলছে। এতক্ষণে বোধগম্য হোল গতকাল ২৪ শে ডিসেম্বর রাত বারোটায় "খ্রীষ্টমাস ডে"--সেলিব্রেশন হয়েছে। বাজি ফাটানো- আলো জ্বালানো-শীতের আমেজে খাদ‍্য-পানীয় পান গ্রহণ করেছে।

আসলে শিলংয়ে অধিবাসীদের মধ্যে প্রচুর "খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী" আছেন। ঠিক রাত বারোটায় ওরা "বড়দিন" --এর সূচনা করেছে-বাজি ফাটিয়ে-আলোর রোশনাই জ্বালিয়ে। তার ভয়াবহতা এতটাই ছিল যে গেষ্ট হাউসের কাঠের দেওয়াল- মেঝে কেঁপে কেঁপে উঠছিল।---

ঠিক আটটার সময় টিফিন সেরে বেরোলাম শিলংএর স্থানীয় বিশেষ স্থান পরিদর্শনে। --পরিষ্কার ঝকঝকে রাস্তা---যাচ্ছি মিউজিয়াম দেখতে। রাস্তার দুইদিকে ছোট ছোট বাড়ি--কুটির শিল্প--বাঁশের সোফা, মোড়া, চেয়ার, টেবিল তৈরী করছে। বাচ্চারা খেলা করছে-- গ্রামগুলো নাকি মেয়ে-শাষিত ও ছেলেরা নাকি বিয়ের পর মেয়েদের বাড়িতেই থাকে।

---গাড়ি নিচের দিকে নামছে---- হঠাৎ উল্টোদিক থেকে দ্রুত গতিতে আসা একটি ট‍্যাট্সি আমাদের গাড়ির গা ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। আমাদের গাড়ির আয়না গেল ভেঙ্গে। গাড়িটা কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরে আসছে। ড্রাইভার বিপদ বুঝে গাড়ি একধারে থামালো। অন‍্য গাড়ি থেকে একজন নেমে এসে সামনে বসে থাকা আমার ছোট ছেলেকে বাইরে বেরিয়ে আসতে বললো---আমরা জানালার কাঁচ তুলে দিয়েছি। ছেলেটি ঘনঘন কাঁচে আঘাত করছে। আমি প্রায় কাঁদো কাঁদো। ছেলেটি  স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। বোধহয় সারারাত সবাই মিলে বড়দিনের উৎসব পালন করেছে--সাথে পানীয়। অনান‍্য ছেলেরা আঁকড়ে ধরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। যুবক ড্রাইভারের চোখে-মুখে আতঙ্ক--থম্ মেরে আছে। 

অবশেষে কিছু না করতে পেরে গাড়ির পেছন কাঁচে সজোরে এক ঘুসি লাগালো। মনে হোল গ্লাস বোধহয় ফেটে গেল। প্রায় চ‍্যাংদোলা করে ছেলেটিকে ওর বন্ধুরা তুলে নিয়ে গেল।--ছেলেটির দাবি ---আমাদের গাড়ি নাকি ওদের গাড়িতে ধাক্কা দিয়েছে। কিন্তু তা নয় 

---আমাদের গাড়ির আয়না ভেঙে ওদের গাড়ি বেরিয়ে গেল--উল্টে হামলা। 

ঘটনার আকস্মিকতা কাটাতে একটু সময় লাগলো। আসলে আমাদের গাড়ি আসামের--ওদের নাকি একটা চাপা ক্রোধ আছে--মেঘালয়ের গাড়ি নিয়ে  ঘুরতে হবে।--সে কারণেই চোটপাট।

--যাক্। ছেলেদের গায়ে হাত তোলেনি এটাই রক্ষে।

ড্রাইভারবাবু বলে দিলেন- আপনারা একটু তাড়াতাড়ি করবেন--আজ তো উৎসবের দিন--অনেকেই অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় থাকবে। সন্ধ্যার আগেই গৌহাটি ঢুকতে হবে।

মিউজিয়াম দেখে আমরা গেলাম "শিলং পিক" -"এলিফ্যান্ট ফলস্" --দেখতে। পিচ্ছিল সরু পাহাড়ি ধাপ --একহাতে পাহাড়ের ধাপ ধরে ধরে নিচে নেমে যাওয়া। অপূর্ব দৃশ্য---কুলকুলিয়ে উপর থেকে জল নামছে প্রবল বেগে--আছড়ে পড়ছে ছোট্ট জলাশয়ে। কনকনে ঠান্ডা--হাড়কাঁপানি হাওয়া --শরীর-মন ভরিয়ে দিলে খুশিতে। মুখে কারোর কথা নেই--বোধহয় নীরবে হামলা হজম চলছে। ঝর্ণার শীতলতা পথে হামলার ভারাক্রান্ত মনটাকে শান্ত করলে-- কোথায় হারিয়ে গেল ঘটনার দৃশ্য। --ফেরার পথে নিয়ে গেল "পুলিশ বাজার"এ। পাহাড়ি নিম্নমুখী রাস্তার দু'ধারে সারি সারি দোকান। তবে সব বন্ধ কারণ ঐদিন পঁচিশে ডিসেম্বর --বড়দিন --উৎসবের দিন। বাজারে কি পাওয়া যায় দেখা হোল না। দেখার আগ্রহ ও নেই কারণ গৌহাটি ফিরতে হবে সন্ধ্যার আগে।----গৌহাটি ঢোকার প্রায় আধঘণ্টা আগে আবার বিপত্তি। লম্বা জ‍্যাম। রাস্তা তৈরী হচ্ছে-- -খোঁড়া হচ্ছে মাটি--বড় বড় যন্ত্র কাজ করছে- পুলিশ প্রহরায়। থমকে আছে সব যানবাহন। বিকেল তিনটে থেকে--- পাশাপাশি কোন দোকান নেই--রাস্তার পাশের গ্রামের কিছু মানুষ বালতিতে চা-হাতে বিস্কুট এনেছে-- বিক্রি করছে। একটু স্বস্তি লাগলো--চা বিস্কুট খেয়ে মাথাটা একটু চাঙ্গা হোল। কিন্তু ভয় তো কাটছে না--কখন পৌঁছবো গৌহাটি। প্রায় দু'ঘন্টা অপেক্ষা করার পর জ‍্যাম কাটলো। ফ্ল্যাটে ঢুকে মনে হোল একটি "ভুল সিদ্ধান্ত" নেওয়া হয়েছিল-- "বড়দিনে বেড়ানো"--।

গাড়ির উপর হামলা যেমন আতঙ্ক ছড়িয়েছে তেমনি পথে গ্রামের মানুষের চা বিস্কুট খাওয়ানো --আতিথেয়তা খুশী করেছে এই "শিলং-চেরাপুঞ্জি" ভ্রমণ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. খুব ভালো লাগলো ৷ মনে হল আবার ঘুরে এলাম ৷ তবে মাওলিলং গ্রামের কথা উল্লেখ থাকলে আরও ভালো লাগতো ৷ এশিয়ার সব থেকে পরিচ্ছন্ন গ্রাম...

    উত্তরমুছুন