মাকড়সার রকমফের || সাবিত্রী ষন্নীগ্রহী




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

মাকড়সার রকমফের

সাবিত্রী ষন্নীগ্রহী

 রিটায়ার্ড করার পর বাড়িতে মন বসাতে পারিনি। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে বেড়ানোর নেশা পেয়ে বসেছিল। হঠাৎ সেটা ও বন্ধ হয়ে গেল ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে -করোণা আবির্ভাবে। প্রথম প্রথম মনটা ভেতরে ভেতরে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। নিজেদের বাগানটা হয়ে উঠলো বেড়ানোর প্রধান স্থান। সকাল আটটা থেকে দশটা-প্রত‍্যেকদিন। বাগানে হাঁটতে হাঁটতে মুখে-চোখে- মাথায়-হাতে মাকড়সার অদৃশ্য সূক্ষ্ম সূতো আটকে যেতো। সূতো ছাড়ানোর জন্য সে এক মহা ঝামেলা। মুখ থেকে ছাড়ালে হাতে লাগে, তো হাত থেকে ছাড়ালে মাথায় লাগে। সূতোর জট ছাড়াতে ছাড়াতে চোখে পড়লো--


 ১-"পুতুল মাকড়সা"-অতি ক্ষুদ্র এক মাকড়সা। ক‍্যামেরায় ধরা পড়লো ঠিক "পুতুল গড়ন"। কোথায় যায় দেখতে লাগলাম। চোখে সহজে দেখা যায় না এমন সূক্ষ সূতো বেয়ে আশ্রয় নিল "চিত্রা"-ভেষজ গুল্মের পাতার নিচে। ----

ক্রমশঃ আমার আকর্ষণ বাড়লো ঐ ছোট্ট মাকড়সার উপর। ঐদিন ওকে আর বিরক্ত করলাম না।

পরের দিন সকালে আবার ওকে দেখতে গেলাম। না সে নেই। আসলে এক জায়গায় শত্রুর (আমি) স্পর্শ পেয়ে ঐস্থান পরিত্যাগ করে অন‍্যস্থানে চলে গেছে।  আশেপাশে খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেলাম---


২-"অ্যারানাস"-মাকড়সা-

পিঠ বাদামি-সাদা নক্শাকাটা - উপাঙ্গ হালকা বাদামী রঙের। ক্ষুদিজাম গাছের পাতার উপর জড় হয়ে বসে আছে। কাঠি দিয়ে সরাতে চাইলাম- নড়লো না। একটু দূরে সরে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম--লক্ষ্য করলাম --ধীরে ধীরে উপাঙ্গ খুলছে। তড়িৎ গতিতে পাতার নীচে আশ্রয় নিল। 


৩-"বৃক্কমাকড়সা" - দারুচিনি- গাছের ছাল তুলতে যেয়ে আমার মাথায়-মুখে মাকড়সার জাল জড়িয়ে একাকার। একটি ডাল ঝুঁকে পড়েছে। সরুকান্ড -পাতা নিয়ে জাল বেছানো। জাল বরাবর চোখ বুলিয়ে পেলাম এক অদ্ভূত আকৃতি -রঙ্-নক্শা ছোট এক প্রানী। প্রথমে বুঝতে পারিনি কি ওটা? দেহের উপরের অংশ লম্বাটে-হালকা চকলেট রঙ্ -দেহের সংযোগস্থল কাঁচা হলুদ রঙ্। পেছনের অংশ গোলাকার-কিছুটা বৃক্বাকৃতি -সাদা রঙ্ -পিঠের উপর পুলিশের মোটা কালো গোঁফের মতো অর্ধচন্দ্রাকার কালো নক্শা।  পেছনের অংশে ঠিক যেন তুলি দিয়ে সূক্ষ রেখা টেনে সাদার উপর কালো আলপনা এঁকেছে। উপাঙ্গগুলি কচি কলাপাতা -সবুজ রঙের। নাম-"বৃক্ক মাকড়সা"। 

ওকে এনেছিলাম --পাতাজালসহ-

রেখেছিলাম আমার ছোট্ট প্লাসটিক জারে। জারের একদিকে মুখের রস দিয়ে গোলাকার বাসা তৈরী করলো। একদিকে ছোট একটি গলি রাখলো। ঐ গলি দিয়ে ঢোকা-বেরোনো চললো। দু'তিনদিন পর মাকড়সাটি চুপচাপ বসে আছে ভেতরে-ডিম পেড়েছে। মা মাকড়সা কি রসপান করে জানি না। মাঝে মাঝে বেরোয় আবার ঢুকে যায়। দু'চারটে জ‍্যান্ত পিঁপড়ে ভেতরে ছেড়ে দিলাম। অত্যন্ত দ্রুত গতিতে এসে উপাঙ্গ দিয়ে চেপে ধরলো। তারপর দেখতে পেলাম না। কিভাবে রসপান করলো। একদিন দেখলাম ডিম পেড়েছে। আটদিন পর বাচ্চা বেরোলো --একটি। মুখখোলা কৌটৌটি আমগাছের উপর রেখে এলাম। পরের দিন দেখি --আমপাতার লম্বালম্বি কিনারা বরাবর সাদা রশ্মি দিয়ে আটকে দিয়েছে। অন‍্যপ্রান্ত আটকেছে পাশে "শিউলি" গাছের শাখার সাথে। মাঝের অংশে গোলাকার জাল--পোকা ধরছে। খানিক সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম।  ভেতরে ঢুকছে বেরোচ্ছে

৪-"কাঁটাবিষাক্ত মাকড়সা"--শ্রাবনমাস,  দোলনচাঁপা গাছে এই প্রথম ফুল ফুটেছে। আগের রাতে বৃষ্টি হয়েছে। ফুলের গন্ধ চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ফুলের বিভিন্ন অংশ পর্যবেক্ষণ করতে করতে একটি মাকড়সা ছুটে চোখের আড়ালে লুকিয়ে গেল। গাছের পাতা ধীরে ধীরে উল্টে খুঁজতে লাগলাম। আকারে এক ইঞ্চির মতো বা একটু বড়। পেয়ে গেলাম পাতার পেছনে-দু'টি পাতা জড় করে মাঝে বসে আছে। একটু নাড়া দিতেই আবার আড়ালে। --তখনকার মতো ওকে বিশ্রাম দিলাম। বিকেলে যেয়ে খুঁজতে লাগলাম। সহজেই দেখা মিললো। জাল তৈরী করেছে পুরো দোলনচাঁপা গাছের পাতা নিয়ে। ব‍্যাঘাত না ঘটিয়ে আকৃতি দেখতে লাগলাম। হালকা সবুজ উপাঙ্গগুলোর দু'দিকে লম্বা সূঁচালো কাঁটায় ভর্তি। লালচে -হলুদ মোটা মাথার আগায় দু'টি কালো থলির মতো অংশ। থলির আগায় সূঁচ বসানো। মনে হচ্ছিল এই বুঝি সূঁচদুটো গায়ে বসিয়ে দেবে। তথ্য দেখলাম --এটি একটি বিষাক্ত মাকড়সা।


৫-"ছোট ট‍্যারান্টুলা"--বড় ট‍্যারান্টুলা জঙ্গলে দেখা যায়। বেশ বড় আকারের--মনে হয় বিষাক্ত নয়। আমাদের টাইলস্ মেঝের উপর এক কোনায় ডিম পেড়েছিল। মেঝে ঝাঁট দিতে দিতে দেখলাম মেঝেতে মাটি আটকে আছে। আমি তো কাজের মেয়েটির উপর একটু বিরক্ত হলাম। ঝাঁটাটি ভেতরে ঢোকায়নি বলে। --আমি ঝাঁটা দিয়ে সরাতে গেলাম কিন্তু উঠলো না। মনোযোগ দিয়ে দেখলাম মাটিটা উঁচু হয়ে আছে। বুঝলাম--কোন পতঙ্গ ডিম পেড়েছে। কারণ আমাদের বাড়ির চৌহদ্দির মধ‍্যে ২০০-৩০০ পতঙ্গের বসবাস-বংশবিস্তার--

উত্তরাধিকার সূত্রে। আমার দাপটে কেউ বিরক্ত করার সাহস পায় না। কারণ ওরা আমার নিকট পরিজন --অবসর সময়ের বন্ধু। ---যাইহোক সরু কাঠি দিয়ে একপাশে ফুটো করলাম --বেরোলো একটি অতি ক্ষুদ্র (চোখে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না) এক পোকা। কি পোকা বুঝতে পারলাম না। ক‍্যামেরায় ছবি নিলাম। বুঝলাম--ট‍্যারান্টুলার আকৃতি। একটু ভয় লাগলো --একে ঘরের মধ্যে রাখা ঠিক হবে কিনা। মেঝে থেকে মাটিসহ তুলে ছোট জারে রাখলাম। বড় হতে লাগলো। খুব বড় হোল না। নেট বাঁধা জারের মধ্যে ছুটাছুটি করছে। বাগানে ছেড়ে দিয়ে এলাম।


৬-"লম্বা লেজ মাকড়সা" -দেহের পেছন অংশ হালকা নকশা আঁকা।কালোর উপর পাঁশুটে রঙ দিয়ে আলপনা দেওয়া। -গোলাকার --দেহের নিচ থেকে বেরিয়েছে সূচালো দুটো দন্ড-প্রায় এক ইঞ্চি লম্বা। দেহের সামনের অংশ হালকা রঙের-উপাঙ্গ গুলো কালচে-পাঁশুটে রঙের রিবরিব।


---মাকড়সা প্রজাতির কত সব অদ্ভুত অদ্ভুত দেহের আকৃতি -বাচ্চা দেওয়ার কৌশল- খাদ‍্য সংগ্রহের প্রকৃতি- রসপানের কৌশল --- অবাক করে দেয়। 

মাকড়সা দেখে প্রায় সবাই ভয় পায়। এই ভয় পাওয়াকে ইংরেজীতে "আর্কনোভোবিয়া"- বলে। কিছু বিষাক্ত মাকড়সা আছে। গায়ে অন‍্যকিছু ছোঁয়া পেলে আত্মরক্ষার্থে হুল ফোটায়। নতুবা এদের ভড় পাওয়ার কোন কারণ নেই। আমার বাগানে -আমাদের এই পশ্চিম মেদিনীপুরের জঙ্গলে -অপরিচ্ছন্ন স্থানে বহু প্রজাতির মাকড়সার দেখা মেলে। বড় বড় উঁচু গাছের ডালের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা মিলবে বড়ো বড়ো মাকড়সা জাল বিছিয়ে রেখেছে খাদ‍্য সংগ্রহের অপেক্ষায়। দেখা পেয়েছিলাম এক কালো দৈত্যাকার মাকড়সার মুখটি চ‍্যাপ্টা-ভূতের মতো--ঠিক যেন দুটো চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। আবার কেউ বা সরু সূতোর মতো কালো। আবার কেউ সবুজ -পেছনের  সরু অংশ বেঁকিয়ে পিঠের দিকে বাঁকানো। আবার কারুর পিঠে সবুজ কুঁজ। এদের ডিমের থলির আকার ও আলাদা আলাদা আকারের। কোনকি চারকোনা-চ‍্যাপ্টা, আবার কারোর ডিমের থলি পরপর সাত থেকে আটটি। পুঁতির মালার মতো লম্বা। ডিম পাড়ার ধরণ ও আলাদা। কেউ বা একসাথে অনেক ডিম দেয়-কেউ বা আটদিন-দশদিন পরপর ডিম পাড়ে। কেউ আবার ডিমের থলি মুখে নিয়ে বা পেটের তলায় উপাঙ্গ দিয়ে আটকে ঘুরে বেড়ায় নিশ্চিত আশ্রয়ের খোঁজে।


--করোণার আবহাওয়ার আমি বাড়িতে বন্দি থেকে ওদের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলাম। ৩৩টি মাকড়সা প্রজাতির দেখা পেয়েছি। শুধু তাই নয় -প্রজাপতি-মথ--বিটল্--বহু প্রজাতি আমাদের এই পশ্চিম মেদিনীপুরের পতঙ্গ বৈচিত্র্য। প্রায় ৫০০ ভেষজ উদ্ভিদ প্রজাতির বিভিন্ন পতঙ্গের নিবিড় বন্ধুত্ব চোখে পড়ার মতো।---

ওরা নিশ্চিতে বেঁচে থাকুক -বংশপরম্পরায়--আমার চাওয়া।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ