দর্পণ || মকর সংক্রান্তি,বনদেবতা ও খামার পূজা || ডাঃ সঞ্জয় কুমার মল্লিক




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

মকর সংক্রান্তি,বনদেবতা ও খামার পূজা ,কলমে ডাঃ সঞ্জয় কুমার মল্লিক

বাংলার গ্রামে গ্রামে মকর সংক্রান্তি ও পরের দিন বা ১লা মাঘ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।এই দুটো দিন সারা বাংলা ও বাঙালি তার আদি ও অনন্ত গ্রামীণ কালচার কে আপন করে নেয়।শহরে বসবাস করা পরিবারটিও চেষ্টা করে এই দুটি দিন তার গ্রামে গিয়ে কাটাতে।গ্রামের নদীতে মকরস্নান বা মকরডুব দিয়ে পিঠে খেয়ে গ্রামীণ মেলাতে ঘুরতে যাওয়ার লোভ কেউ ছাড়তে চায় না।গ্রামীণ মেলাগুলো সাধারনত কোন বনদেবতার পূজা উপলক্ষে হয়ে থাকে।গ্রামের একদিনের এই মেলারগুলোর আকর্ষণ নতুন তেলে তৈরি নানান মজাদার তেলেভাজা যেমন চপ, পাঁপড়, বেগুনি,গুলগুলা ও গরমগরম জিলিপি।অপেশাদার হাতে তৈরি ঘুগনি ও ডিম সেদ্ধ। আমাদের এলাকায় মকর সংক্রান্তি বলতে যেটুকু ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি তা হল,সকালে উঠে সকলেই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কুবাই নদীতে গিয়ে স্নান করতে যায়(যে যার সমানসামনি বয়ে যাওয়া নদীতে স্নান করে, কেউবা গঙ্গাসাগরে স্নান করতে যায়)নদীতে ডুব দেওয়ার সময় হাতে থাকে সর্ষেফুল, কুল,সিম,আমের মুকুল; যেগুলো পিছন দিকে ছুঁড়ে ডুব দেওয়া হয়,একেই মকরডুব বলে।

মকরডুব দিয়ে বাড়িতে এসে রোদে বসে বসে পিঠে খেয়ে দলবেঁধে পাশেই টুসুর(টুসু,মা লক্ষীরই এক রূপ)মেলা দেখতে যায়।সারা পৌষ মাস ধরে বাড়িতে অনেকেই টুসুর আরাধনা করে।মকর সংক্রান্তির দিন হয় টুসুর বিসর্জন।আগের দিন সারা রাত্রি ধরে চলে টুসুগান।টুসুগান গ্রামবাংলায় এতটাই জনপ্রিয় যে,বর্তমানে বাংলা সাহিত্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা করে নিয়েছে।গ্রামে যারা টুসু ঠাকুর তুলে তারা নিজেদের উদ্যোগে মাইক ভাড়া করে টুসু বেড়াতে বেরোয়।টুসুগানের মায়াবী সুরে আজও গ্রামের সবাই মজে থাকে।

       মকর সংক্রান্তির দিন বাড়ির মহিলারা বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি করে সুস্বাদু মকর।মকরের উপাদান হিসেবে থাকে,আতপ চাল বাটা,দুধ,ঘি,আখের গুড়, আখ,লেবু, আপেল, কুল,শাখআলু, লালআলু,মটরশুঁটি,কর্পূর,মধু ইত্যাদি।দুপুরে মকর পূজা হওয়ার পর মকর খাওয়ার রীতি আজও বিদ্যমান।

বিকেলে মেলাতে বিশেষ আকর্ষণ থাকে বিভিন্ন টুসুদল থেকে আনা বড়বড় মাইক সেট নিয়ে হওয়া প্রতিযোগিতা,যা আয়োজন করে মেলা কমিটি।দূর-দূরান্ত থেকে সেই প্রতিযোগিতা দেখার জন্য মানুষ ভিড় জমায় সদর ঘাটে বা নদীর তীরে মেলা প্রাঙ্গণে।ভিড় এখন এতটাই বেড়েছে যে পুলিশ উপস্থিত থাকতে হয় যাতে কোন গন্ডগোল না হয়।গ্রামবাসীরাও তৎপর থাকে যাতে কোন সমস্যা না হয়।

        এই একটা দিন সারা গ্রাম মেলা,মাইক ও নাচ নিয়ে ব্যস্ত থাকে।মাইকের শব্দে কিছু মানুষের হয়তো একটু অসুবিধা হয় কিন্তু বাকি সবার একদিনের আনন্দে কেউ বাধা দেয় না।সবাই মিলে মিশে আনন্দে অংশগ্রহণ করে।

        পড়াশোনা চলাকালীন এই একটা দিন বাড়ির বাইরে থাকলে খুব মন খারাপ করত।এখন সে মনখারাপ আর নেই।চুটিয়ে প্রতি বছর আনন্দ উপভোগ করি।শুধু আমি নয় প্রতিটি এলাকার মানুষেরা সুন্দর ভাবে এই দিনটি উপভোগ করে থাকে।গ্রাম্য মাটির উৎসবে গ্রাম ছেড়ে থাকা খুব কষ্টকর।

আবার ১লা মাঘ দিনটি গ্রামবাংলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম দিন।কারন ঐদিন প্রায় প্রতিটি বাড়িতে খামার(ধানের খামারে মা লক্ষীর আসন পাতা হয়) পূজা হয়।

          সকাল থেকে প্রতিটি বাড়িতে ব্যস্ততার শেষ থাকে না।সারা বাড়ি,বাড়ির চারপাশ,ধানের খামারে ঝাঁট দিয়ে,গোবরের লাতা দিয়ে পরিষ্কার করা হয়। জামাকাপড় পরিষ্কার করা(বাসী জামাকাপড় পরে খামারে যেতে নেই)হয়।পূজার জোগাড় করা, আমের মুকুল, ঘুষঘুষি ফুল,জব গাছ,গাঁদা ফুল, বেলপাতা,দূর্বাঘাস ইত্যাদি পূজার সামগ্রী হিসেবে জোগাড় করতে হয়।

          ১ লা মাঘ প্রতিটি গ্রামে নানান বড়াম ঠাকুর বা বনদেবতাদের পূজা হয়।প্রতিটি বাড়ি থেকে মাটির হাতি-ঘোড়া,চাঁদমালা,কলা, দক্ষিনা ও চাল সহযোগে ভেটি নিয়ে যায় বনদেবতাদের মন্দিরে।কারো থাকে ক্ষীর ভোগের মানত সেসব পৌঁছানোর তাড়া থাকে।কোন দেবতার দিনের বেলা পূজা হয় আবার কোন দেবতার পূজা হয় রাত্রিতে। এই বনদেবতাগন খুবই জাগ্রত হয় সারা বছরে ওনাদের নানান কর্মকান্ডের সাক্ষী থাকে গ্রামবাসীরা।তাই ভয়ে বলুন আর ভক্তিতেই বলুন সব কাজ বয়ে গেলেও বনদেবতাদের মন্দিরে ভেটি পৌঁছে দেয় সকলে। এক্ষেত্রে আমিও ব্যতিক্রম নয়। জোড়া ঘড়া নিয়ে খালি পায়ে একাই দুপুরবেলা গ্রামের পাল্ট্যাশনি মন্দিরে হাজির হয়ে পৌঁছে দিয়ে এসেছি অনেকবার।কিছুক্ষণ পরে মা কয়েকটি ভেটি থালায় সাজিয়ে মন্দিরে পৌঁছিয়ে দিয়ে এসেছে।

ওইদিন আমাদের গ্রামেও তিনটি বনদেবতার পূজা হয়।

এর পর সন্ধ্যা নামতেই ধানের খামারে আলপনা দিয়ে (আল্পনাতে থাকে লক্ষ্মী বন্দনা ও চাষের কাজে ব্যবহৃত নানান যন্ত্রপাতির ছবি, গরুর ছবি,মা লক্ষীর পায়ের ছাপ) ধানের গাদা থেকে ধানের আঁটি নামিয়ে,চালা, কুলা, মণ, ধানের উকুন ডান্ডা সহযোগে মা লক্ষীর আসন পাতা হয়।অঘ্রায়ন - পৌষ এই দুই মাস বাড়িতে যে ঘটে প্রতি বৃহস্পতিবার(অনেকে লক্ষীবারও বলে) লক্ষীমায়ের পূজা হত তা এখানে মায়ের পূজার ঘট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আল্পনায় আঁকা মা লক্ষীর পায়ের ছাপ খামার থেকে চলে যায় বাড়ির ভেতর পর্যন্ত,বাড়িতে যেখানে ধান থাকে।মনে করা হয়,খামার থেকে মা লক্ষী এ পথেই প্রতি বাড়িতে প্রবেশ করে।কিছু বাড়িতে আবার মকর সংক্রান্তির দিনে খামার পূজা হয়ে গেছে।

           কাঁসার গাড়ুতে রাখা থাকে অল্প গোবর মেশানো জল, এর পর যতবার লক্ষীপেঁচার ডাক ও শেয়ালের ডাক শুনতে পাওয়া যায় ততবার লক্ষী মায়ের পাতা আসনের চারিধারে জলের ধারা দেওয়া হয় সঙ্গে সঙ্গে হয় শঙ্খধ্বনি।এভাবেই যতবার ডাক শোনা যায় ততবার শঙ্খধ্বনি সহযোগে জলের ধারা দেওয়া চলতে থাকে, একাজে আমিও ব্যস্ত থাকি। রাত্রিতে পুরোহিত লক্ষ্মীপূজা সুসম্পন্ন করে।

         খামারে অবসর সময়ে বসার জন্য ত্রিপল,বাঁশ ও খড় সহযোগে তৈরি হয় অস্থায়ী কুড়ে ঘর।কনকনে শীতের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কড়াইতে রাখা থাকে জ্বলন্ত কাঠ কয়লার আগুন।বড়দের পাশাপাশি বাড়ির শিশুরাও কুড়ে ঘরের ভেতরে বসে খামার পূজার আনন্দ উপভোগ করে।ওদের আনন্দটাই বেশি হয়।

         এদিকে পাঁচ রকমের পুর সহযোগে চলে গরম গরম পুরপিঠে তৈরির কাজ।পূজা শেষ হবার পর খড় দিয়ে সমস্ত কিছু ঢাকা দিয়ে বাড়িতে যাওয়া হয়।তারপর কনকনে শীতে খেজুরগুড় বা আখেরগুড় দিয়ে খাওয়া হয় পুরপিঠে।ঐদিন খাওয়া দাওয়া পুরোপুরি নিরামিষ হয়, আমিষ কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ।

পরের দিন ২রা মাঘ চলে বিশ্রাম।খামারে কঠোর ভাবে প্রবেশ নিষেধ।ধান ও খড় পোড়ানো নিষেধ।৩রা মাঘ হয় বিসর্জন,পূজায় ব্যবহৃত ফুল,বেলপাতা, আমের মুকুল ও অন্যান্য ফুল পুকুরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।সমস্ত আলপনা মুছে দেওয়া হয়।ধানের আঁটি থেকে হাতে করে ধান আলাদা করে বাড়িতে রাখা হয়,তা থেকে পায়েস রান্না করে তৈরি হয় নবান্ন, মায়ের প্রসাদ হিসেবে তা বাড়ির সকলে মিলে খায়।

           এ ধারা যুগের পর যুগ টিকে থাক, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এ সবকিছুর সাক্ষী থাক।মা লক্ষীর কৃপায় সবার বাড়িতে ভাত ও অর্থের যোগান থাক,বনদেবতাদের কৃপাতে গ্রামের সবাই ভালো থাক এই কামনা করি।অবশ্যই নিজের জন্যও একমনে ওনাদের কাছে প্রার্থনা করি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. কি ভীষণ ভালো লাগলো এই সম্পূর্ন লেখাটি ... অনেক কিছু জানলাম 🙏 আর সত্যি অভিভূত হলাম !

    উত্তরমুছুন