সুমিত ও গ্রাম || মঙ্গল মিদ্যা (রিপল) || প্রথম পর্ব




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

সুমিত ও গ্রাম

(প্রথম পর্ব)

 মঙ্গল মিদ্যা (রিপল)


সুমিতের জন্ম ও বড়ো হওয়া কলকাতাতে এবং ভেলুর থেকে ডাক্তারি পাশ করার পর সে চাইলে শহরের কোন নামী হসপিটালে কাজ নিতে পারতো। কিন্তু ঠাকুরদার স্বপ্ন - "নাতি ডাক্তার হয়ে গ্রামে আসবে আর সঠিক চিকিৎসা করে গ্রামের মানুষদের সারিয়ে তুলবে "। আর সুমিতও মনে মনে সেটাই চায়।

        তার ঠাকুরদা গ্রামের মেয়েকে বিয়ে করে ওখানেই থেকে গেলেন, শহরে আর এলেন না।

কিন্তু সুমিতের বাবা কলকাতার একটা হোমিওপাথি ডাক্তারের প্রতিবন্ধী কিন্তু শিক্ষিত মেয়েকে বিয়ে করে শহরেই থেকে গেলেন। সুমিতের মা চাইতো গ্রামে গিয়ে থাকতে কিন্তু শ্বশুরমশাই বললেন - "বউমা, তোমরা শহরেই থাকো এখানে পরিবেশ তোমার গা-শোয়া হয়ে গেছে তাই গ্রামের পরিবেশ তোমার মানিয়ে নিতে খুব অসুবিধা হবে, তার থেকে বরং আমার নাতি বা নাতনীকে ডাক্তার করে গ্রামে পাঠিও তাতে আমার নিজের ও গ্রামের মানুষদের সুবিধা হবে।"


বাস থেকে আচান্দা গ্রামে নেমে দেখি আমার শক্ত সামর্থ্য ঠাকুরদা ধূতি-পাঞ্জাবী পরে লাঠি ধরে দিব্বি দাঁড়িয়ে আছে। সত্যি গ্রামের জল-হাওয়া আর টাটকা জিনিস খেলে মানুষের আয়ু যে বেড়ে যায় তা ঠাকুরদাকে দেখেই বুঝতে পারছি। ঠাকুরদাকে প্রণামের পর ৩চাকা ভ্যানে উঠে জন্মভূমির ভিটেতে, না মানে ঠাকুরদার শ্বশুরের ভিটেতে চললাম।

গ্রামে যেমন ছাদ ফেলা দোতলা বাড়ি হয় তেমনই। আগেই বলে রাখি আমার ঠাকুরদা জমিদার ছিলেন না, তাই জমিদারদের মত ভাববেন না। আর আমার ঠাকুরমা বাপের একমাত্র মেয়ে ছিলেন না, তাই একটাই বাড়িতে হাজার গন্ডা ঝি চাকর থাকবে ভাববেন না। 

শুধু সুবিধার্থে বলে রাখি এখানে আশেপাশে আমার আত্মীয় অনেক আছে আর সবাই বেশ মানিয়ে গুছিয়েই বসবাস।


ঠাকুরদা, ঠাকুমাকে এখানে এখনো সবাই বেশ মান্নি করেই চলে দেখলাম। যাইহোক, আসল গল্পে আসি। 

সেদিন খাওয়া ঘুম আত্মীয়দের "ভালো আছি, বাবা-মা ভালো আছে " বলেই কেটে গেলো।

পরেরদিন সকালে ১টা বোন এসে ডেকে বললো - "ওই দাদা ওঠ, দাদু তোকে তৈরি হতে বললো মেয়ে দেখতে যাবে তোর বিয়ের !"

আমি ধড়পড় করে উঠে বোনের কানটা ধরে বললাম "আমার সাথে ফাজলামি করছিস....."

কথাটা শেষ হলো না, সে আমার চুল ধরে এমন টান দিলো যে তার কান ছাড়তে বাধ্য হলাম। তারপর সে চলে যেতে যেতে বললো - ওইতো দাদুকে জেনে দেখো।

ঠাকুরদা বললেন - "মেয়ে দেখতেই যাচ্ছি তবে বিয়ের জন্য নয়। তৈরি হয়ে অভিকের সাথে চলে আয়, আমি বরং এগিয়ে গিয়ে টিকিট পাই কি দেখি !"

সেই বোনটা আবার ফোড়ন কেটে বলে উঠলো "দাদু এয়ারপোর্টের টিকিট তো ?"

আমি আবারো ওকে মারতে যাবো ভাবছি তখন দাদু বলে উঠলো - "এয়ারপোর্টের নয় তো কি ফেরিঘাটের নাকি....! "

বোন আমার দিকে একটা চাউনি দিয়ে দেখলো তারপর বললো "আমাদের গ্রাম কতো উন্নতি করেছে তা বিদেশের বাবুরা জানবে কিকরে ", তারপর সেও চলে গেলো।

সুমিত তৈরি হয়ে নিচে নেমে দেখলো অভিক দাদা বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বোনটা আবারো বলে উঠলো - "অভিক'দা এয়ারপোর্টে ডাক্তারের হাত ধরে রাখিস নাহলে পাখার হাওয়াতে উড়ে যাবে "।

সুমিত কর্ণপাত করলো না, বাইকের পিছনে বসে চললো। মোড়ের কাছে একজনার সাথে দেখা হলো আমাদের বন্ধুর মতোই তাকেও দেখি অভিক'দা বললো এয়ারপোর্টে নিয়ে যাচ্ছি দাদুর সাথে কোথায় মেয়ে দেখতে যাচ্ছে নাকি।

     একসময় সুমিত জিজ্ঞাসা করেই ফেললো এয়ারপোর্ট ব্যাপারটা কি?

অভীক'দা বললো প্লেন ওঠা নামার জায়গা। আর কিছু বললো না। 

খানিক পরেই চলে এলো ফেরিঘাটের কাছে। ঠাকুরদা দাঁড়িয়ে আছে, সুমিত প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলো ওরকম উত্তর দিয়েছিলো কেনো বোন প্রীতিকে।

তিনি বললেন, প্রীতির মাথায় সবসময় ফাজলামি বুদ্ধি ঘুরে বেড়ায়, তাই তখন তিনিও মজা করে বলেছিলো।


ফেরি ছাড়ার সময় হয়ে গেছে, ঠাকুরদা আর সুমিত উঠে পড়লো তাতে, যাবে ওপাড়ে। তার পরিচিত একজনার মেয়েকে দেখতে। আসলে মেয়েটার অসুখটা কি বলা মুসকিল। এমনি সবকিছু ঠিকঠাক বাড়ির কাজ থেকে শুরু করে পড়াশোনা সবকিছুতে ভালো, স্বভাব আচরণ সবকিছু ভালো। রাস্তায় দেখা হলে পরিচিত হিসাবে ঠাকুরদার সাথে কথা বলে, শরীর কেমন আছে জানতে চায়। 

একদিন তেমনই ফেরিঘাটে হাসিমুখে কথা বললো তারপর চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর একটা হট্টগোল দেখে ঠাকুরদা গিয়ে দেখে মেয়েটা চেঁচামেচি করছে কারণ ১টা অনেক বয়ষ্ক লোক নাকি তাকে কুপ্রস্তাব দিয়েছে। বয়ষ্ক লোকটা এতোটাই থুতথুড়ে যে তার লাঠি ধরা হাতটা কাঁপছে, একটাও দাঁত তো নেই আর কথা বলতে গেলে থেমে থেমে বলতে হয়।

       মেয়েটার অভিযোগ মানা যায় না, কিন্তু মেয়েটাও যে মিথ্যা কথা বলে না কখনো সেটাও সত্যি। এইরকম অবস্থায় হঠাৎ মেয়েটা সপাটে ১টা চড় কষিয়ে দেয় বুড়ো লোকটার গালে। বুড়োটা মাটিতে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। তখন ঠাকুরদা মেয়েটাকে ওখান থেকে সরিয়ে নিয়ে বাড়ির দিকে চলে আসে।

মেয়েটার বাড়িতে এসে ঠাকুরদা জানতে পারে, মেয়েটা মাঝে মাঝে খুব ব্যাথা ব্যাথা বলে চিৎকার করে পেটে নয়, গুপ্তাঙ্গে। মেয়ের মা বা মহিলা ডাক্তার দেখেছে মেয়েটা এখনো কুমারীত্ব আছে।

আর বাকিটা সুমিতকে গিয়ে দেখতে বললো ঠাকুরদা। সুমিত সত্যি কিছুই বুঝতে পারলো না, অসুকটা কি! তবে একটা অনুমান করলো যে, রোগটা তার মনের আর ভাবনায়। ফেরি থেকে নেমে খানিকখন পা ভ্যানে যেতেই মেয়েটার বাড়ি পৌঁছে গেলো।

বাবার ডাকে মেয়েটা নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে প্রথমেই চমকে উঠলো। আর সুমিতের মনও কেমন যেনো একটা অচেনার মাঝে ভালোবাসার অনুভব করলো, সে নিজের অজান্তেই মেয়েটার দিকে দু পা এগিয়ে গেলো আর তখনই মেয়েটা ছুটে এসে সুমিতকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় যেনো ভেঙে পড়লো। ঠাকুরদা ও মেয়েটার বাবা-মা এমন দৃশ্য দেখার জন্য তৈরি ছিলেন না তাই দাঁড়িয়েই রইলেন।

একসময় সুমিত নিজেকে সরিয়ে নিলো আর বললো - "কে তুমি, আর আমার সাথে এরকম করছেন কেনো?"

মেয়েটার মুখ একটু অবাক হলো, তারপর চোখের জল মুছতে মুছতে বললো "আমি সুজাতা, তোমার সুজাতা "।

মেয়েটার বাবা-মা আরো অবাক হলো আর নিজেদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কারণ তাদের মেয়ের একটাই নাম "প্রিয়া"।

       সুমিত তখনও চিনতে অস্বীকার করতে সুজাতা "এই দেখো" বলেই সুমিতের মাথায় হাত রাখলো আর দুজনেই কেঁপে উঠলো। 

তারপর সুমিত জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলো - "সুজাতা আমি পারলাম না তোমাকে বাঁচাতে, তোমাকে পালিয়ে নিয়ে বিয়ে করে সংসার করতে, আমি পারিনি ওইসব সাম্প্রদায়িক গুন্ডাদের থেকে তোমাকে রক্ষা করতে, আমি পারিনি সুজাতা, আমি পারিনি !"

সুজাতা শান্তনা দিতে দিতে বললো - "চুপ করো চুপ, তুমি তো চেস্টা করেছিলে তাই আমার আগেই তোমার মরণ হয়েছিলো, জানো তো ওদের দেওয়া যন্ত্রনাটা এখনো মাঝে মাঝে অনুভব করি, আমি রক্তে ভেসে যাচ্ছিলাম তবুও ওরা আমাকে ভোগ করছিলো। ব্যাথা যন্ত্রনায় কখন যে অজ্ঞান হয়েছি আর কখন যে মারা গেছি বুঝতে পারিনি।   আমি আমার প্রতিশোধ নিয়েছি, পাপের ফল সবাই ভোগ করেছে, সে বুড়ো হয়ে গেলেও পাপ থেকে মুক্তি পায়নি।"


ঠাকুরদার তখন ফেরিঘাটের কথাটা মনে পড়ে গেলো। আর তারপর হঠাৎ সুজাতা জড়িয়ে থাকা থেকে নিজেকে মুক্ত করে সুমিতের থেকে দূরে সরে গেলো। যেনো সুমিতকে সে চেনে না, জানে না।  আর সুমিত খানিকটা বিষণ্ব হয়ে দু পা পিছুনে এসে দাঁড়িয়ে রইলো।

প্রিয়া "মা" বলে নিজের মায়ের কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো।

ঠাকুরদার হাতের স্পর্শে সুমিত নড়ে উঠে বললো "জল খাবো "।

গ্লাসে জল আসতে আসতে সুমিত ব্যাগ থেকে মাথা যন্ত্রনার ট্যাবলেট বের করলো আর জলের সাথে খেয়ে নিলো।

ঠাকুরদা সুমিতের হাতটা শক্ত কররে ধরে বললো - "দাদুভাই, ভালোবাসা কখনো ফুরায় না। ফুরায় শুধু দেহের আয়ু !"।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ