পোস্ট বার দেখা হয়েছে
|| গুরুরামানন্দ কথা ||
গুরু রামানন্দের জন্ম দক্ষিণ ভারতে । তিনি তামিল ভাষাভাষী ছিলেন। পরবর্তীতে বারাণসী এসে তিনি হিন্দি ভাষার প্রতি দক্ষতা অর্জন করলেও তাঁর মূল বিষয় ছিলো সংস্কৃত । তিনি ভক্তিবাদী আন্দোলনকে যথেষ্ট প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর তৈরী " রামানন্দী " সম্প্রদায়ের মূল বিস্তার উত্তর ভারতে । পূর্বে ভক্তি সম্বন্ধীয় সমগ্র কিছুই সংষ্কৃত ভাষায় লিখিত হতো, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রভাব খুব কম ছিলো, মূলত বোধগম্যতার অভাবে। গুরু রামানন্দই প্রথম এই পরম্পরায় পরিবর্তন আনেন এবং হিন্দি ভাষায় সাধারণ ভাবে ধর্মমত প্রচার শুরু করেন, যা সাধারনের অতি সহজে বোধগম্য হতে থাকে। রামানন্দের এই প্রচেষ্টা অনেকটাই সার্থক হয়েছিলো এবং বহু সাধারণ মানুষ প্রভাবিত হয়েছিলেন। রামানন্দের শিষ্যদের মধ্যে অনেকেই নীচ জাতি ছিলেন। রাজা, জাঠ, চামার, নাপিত এমনকি কবীর ( জোলা) তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন।
নীচু জাতি হলেও তাঁদের বোধ , জ্ঞান আদর্শে বলিয়ান ভারতীয় ভক্তি প্রচার। গুরু রামানন্দ জাত পাতের এই বিভাজনকে একত্রিত করে মানুষকে ভক্তির সঠিক দিশা দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন। কেবলমাত্র কবীর নয়, পঞ্চম শিখ গুরু অর্জুন, তাঁর আদি গ্রন্থ সাহেবে গুরু রামানন্দ ও তাঁর শিষ্যদের বহু বাণী , সঙ্গীত যুক্ত করেছিলেন।|| গুরু রামানন্দ ও কবীর ||
কবীরের উন্মুক্ত চেতনা বোধ তাঁকে সবার থেকে আলাদা করে রাখে আজও। কবীর কখনোই বেদ , পুরাণ, কোরাণ - ষড় দর্শন, উপনিষদ্ প্রভৃতির ধার ধারেননি।
তিনি এই ছয় রচয়িতাদের " ষড় ধীবর " অর্থাৎ জালিয়া বলে অভিহিত করেছিলেন। তিনি বলতেন এই ছয়জন জালিয়া অর্থাৎ ছয়টি জাল বানিয়ে মানুষ রূপী মৎসদের ভ্রমের দ্বারা আবদ্ধ করে রেখেছেন। কবীর শাস্ত্র পাঠ না করলেও তাঁর বাণী ও দোহায় সর্ব শাস্ত্রের মূল অর্থ পাওয়া যায়। তিনি তথাকথিত পণ্ডিতদের একদমই পছন্দ করতেন না , তাঁর মতে পণ্ডিতরাই মানুষকে সঠিক পথ থেকে বিভ্রান্ত করে রেখেছেন, কবীরের আদর্শ এবং পথ ছিলো নিরাকার সাধনা যা কেবলমাত্র সঠিক দিশায় মানুষকে নিয়ে যেতে পারে। জড়ের সাথে চৈতন্যের, সাকারের সাথে নিরাকারের একাত্মতাই কবীরের মূল আদর্শ ছিলো।
তবে গুরু রামানন্দের আদর্শে তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এবং মনে মনে ঠিক করেন তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করবেন, যা একদমই সহজ ছিলোনা । ভাবলেন, রামানন্দের গোপন মন্ত্রের অধিকারী হতে পারলেই তো তাঁকে শিষ্য করে নিতে বাধ্য হবেন এই সাধক। নদীর যে ঘাটে রোজ স্নানে আসেন রামানন্দ, তার সিঁড়ির উপর তখন শুয়ে কাটাতে লাগলেন কবীর।
ভোরের আবছায়ায়, অসাবধানে একদিন রামানন্দর পা পড়ল কবীরের গায়ে। আর চমকে সন্ন্যাসী বলে উঠলেন, ‘‘রাম রাম!’’কবীর বুঝলেন, রামানন্দের গোপন মন্ত্র এটাই। —‘রাম রাম’! সবাইকে তিনি বললেন, তিনি হয়ে গিয়েছেন রামানন্দের ‘চ্যালা’।
খবর জেনে হিন্দু আর মুসলমান দুই দলই গেল রামানন্দের কাছে। দু’দলেরই প্রশ্ন, এক ‘মুসলমান’কে কীভাবে দীক্ষা দিলেন রামানন্দ! রামানন্দের নির্দেশে হাজির কবীরও।
সন্ন্যাসী কবীরকে বললেন, ‘‘কবে আমি দীক্ষা দিলাম তোমায়?’’
উত্তরে কবীর বললেন, ‘‘শিষ্যদের কানে মন্ত্র দেন গুরুরা। আপনি সেদিন আমার মাথা ছুয়ে শিখিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর নাম— রাম!’’ রামানন্দের মনে পড়ে গেল স্নানঘাটের সেই ঘটনা।
মৃদু হেসে তিনি বললেন, ‘‘তবে সব প্রশ্নের ঊর্ধ্বে তুমি আমার শিষ্য।’’
পরবর্তীতে গুরু রামান্দের শ্রেষ্ঠ শিষ্য হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। কবীর হিন্দু ও মুসলমানদের একই সূত্রে গাঁথতে চেষ্টা করেছিলেন এবং তাঁর জন্য তাঁকে যথেষ্টই বেগ পেতে হয় তাই নয়, উভয় সম্প্রদায়ের কাছে প্রবল ক্ষোভের মুখে পড়তে হয়। তবু তিনি ছিলেন তাঁর বিশ্বাসে অটল। তাঁর বানী মুগ্ধ করতে থাকে বহু সাধারণ মানুষকে , পরবর্তীতে বহু হিন্দু মুসলিম তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে থাকেন।|| কবীরের সংসার ||
কবীরের জন্ম, মৃত্যু, জীবন, বচন, কল্পনা— জিজ্ঞাসা আর অনুমানের ধোঁয়াশায় ভরা। কিন্তু তার ভিতর থেকেই ভেসে আসে নিজের সময় আর স্রোতের বিপরীতে দাঁড়ানো ঠোঁটকাটা, নির্ভীক, খোলামেলা, সহজ, গভীর-দর্শন-সঞ্জাত সেরা এক কবির স্বর।
কবীরের বয়স তখন প্রায় তিরিশ।
গঙ্গার ধারে এক বনখন্ডি বৈরাগীর বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। গিয়ে বসলেন বাড়ির দাওয়ায়।
বছর কুড়ির একটি মেয়ে বেরিয়ে এল কিছুক্ষণ পর।
‘‘নাম কী? জাত-গোত্র?’’ — মেয়েটির এই দুই প্রশ্নের উত্তরেই কবীর বললেন, ‘‘আমার নাম কবীর।’’
সাত বাটি দুধ নিয়ে এল মেয়েটি। পাঁচ বাটি সাধুদের। একবাটি কবীরের আর অন্য বাটি নিজের জন্য।
কবীর ফিরিয়ে দিলেন তাঁর ভাগ। বললেন, ‘‘ ঈশ্বরের শব্দই আমার আহার্য।’’
মেয়েটি, যার নাম লোই, কবীরকে বলল, ‘‘স্বামী আমাকে এমন শিক্ষা দিন যা মনে শান্তি এনে দেয়।’’ সাধকদের সেবায় নিয়োজিত হয়ে তাকে সত্যনাম জপ করার পরামর্শ দিলেন কবীর। তাঁর সঙ্গে লোই এলেন কাশী, অর্থাৎ বারাণসীতে। কবীরের মা নিমা ভাবলেন ছেলে বুঝি বউ এনেছে বাড়িতে। কিন্তু দিন কতক তাদের ভাল করে লক্ষ করে কেমন যেন খটকা লাগল তাঁর। এক দিন বলেই ফেললেন, ‘‘বিয়ে করার অর্থ কি, যদি দুজন না-ই থাকে স্বামী-স্ত্রীর মতো।’’
উত্তর এল না কোনও।
স্বামী-স্ত্রীর মতো থাকেন না, অথচ কিছু দিনের মধ্যেই লোইয়ের কোল আলো করে এল এক ফুটফুটে শিশু।
সে’ও এক আশ্চর্য গল্প।
গঙ্গার ধারে হাঁটছিলেন কবীর। জলে ভেসে এল একটি মৃত শিশু। তার কানে কানে কিছু বললেন কবীর। প্রাণ ফিরে এল শিশুর। কবীর তার নাম দিলেন কমাল। আর লোইয়ের হাতে তুলে দিলেন তাকে।
বড় হতে হতে লোইকেই মা ভাবতে শিখল কমাল। আর লোইয়ের কোলে সন্তান দেখে সবাই ধরে নিল, এ বার নির্ঘাৎ বিয়ে হয়ে গেছে কবীরের।
‘পুত্র’র পর এ বার ‘কন্যা’ও।
পড়শির শিশুকন্যা মারা গেছে শুনে তার বাড়ি গেলেন কবীর। মৃত মেয়েটিকে নিয়ে এলেন নিজের বাড়ি আর তাঁর ‘শব্দ’ দিয়ে বাঁচিয়ে তুললেন তাকে। নাম দিলেন কমালী। কমালের পর কমালীও গেল লোইয়ের কোলে।
ধরে নেওয়া হয় কবীর ছিলেন নিরক্ষর। তিনি নিজেও বলেছেন, ‘‘কালি ছুঁই নি, কাগজও না/ এই হাত ধরেনি কলমও কোনও দিন।’’ মুখে মুখে ছড়িয়েছে কবীরের বচন— নানা সময় নানা ভাষায় নানা হাতে লেখাও হয়েছে তাঁর মৃত্যুর বহু পর। কিন্তু কবীরের নামে এযাবৎ চলে আসা সাহিত্যের কতটা কবীরের রচনা, তা নিয়ে অবশ্য সন্দেহ থেকেই যায়।
|| কবীর রচনা ও প্রভাব ||
এখনও অবধি তিনটি সংকলনে পাওয়া কবীরের বাণী প্রামাণ্য বলে ধরে নিয়েছেন গবেষকরা। পঞ্জাবের ‘গুরুগ্রন্থ’ অথবা ‘আদিগ্রন্থ’, রাজস্থানের ‘পঞ্চবাণী’, আর কবীরপন্থীদের সংকলিত ‘বীজক’।
অনুমান ‘বীজক’ আর ‘পঞ্চবাণী’ সপ্তদশ শতকের। ‘আদিগ্রন্থ’ পাওয়া যায় ১৬০৩ থেকে।
কেউ বলেছেন কবীর হিন্দি ভাষার প্রথম মুখ্য কবি। কিন্তু কবীরের সোজাসাপ্টা, রুক্ষ, তির্যক বচন গুলোকে অনেকের মনে হয়েছে একটু স্থূল এবং সাধারণ মানের।
কবির বদলে সমাজ সংস্কারকের আসনেই তাঁকে বসিয়েছেন অনেকে। আর কবীরের ধর্ম নিয়ে তো কত জনের কত মত!তাঁর কথামালার টান এত প্রবল, শিখ ধর্মগুরু গুরু অর্জন ‘আদিগ্রন্থ’ উজাড় করে দিয়েছেন কবীরের ভাবনায় ভাবনায়। আবার কবীর-পন্থায় প্রাণিত হয়ে জোট বেঁধেছেন সমমনস্ক অনুরাগীবৃন্দ, যাঁরা পরিচিত ‘কবীরপন্থী’ হিসেবে।
মিথ্যা থেকে, ধর্ম থেকে, আচার থেকে, প্রথা থেকে, আকার এবং মায়ায় অন্ধ পৃথিবীর প্রবঞ্চনা থেকে, অজ্ঞানের অন্ধকার, পুরোহিত তন্ত্র, সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন কবীর। ‘শব্দ’, ‘নাম’ আর ‘রাম’ এই মুক্তির পথে সঙ্গী হয়েছে কবীরের।
তবে কবীরের ‘রাম’ হিন্দু পুরানের রাম নয়, দশরথের পুত্রও নয়. কবীরের ‘রাম’ কবীরের নির্বিকল্প পরমতম তত্ত্ব। আত্মা যার অংশ। ভক্তি এবং ভালবাসায় মায়ার জীবনযাপন করে সেই পরম সত্যে বিলীন হওয়াই ছিল কবীরের সাধনা আর শিক্ষা।
( চলবে .........)
তথ্যসূত্র :
১| Wikipedia
২| কবীরের জীবনী ও বাণী , শ্রীপূর্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
৩| আনন্দবাজার
1 মন্তব্যসমূহ
মোহিত হয়ে পড়লাম কবীর কথা 🙏
উত্তরমুছুনঅপূর্ব সুন্দর ❤️❤️