করোণার অশরীরী আত্মা || সাবিত্রী জানা ষন্নিগ্রহী




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

করোণার অশরীরী আত্মা
সাবিত্রী জানা ষন্নিগ্রহী
 হঠাৎ টিউবলাইটটা নিভে গেল। ব‍্যাগটা গোছানো আর একটু বাকী। অন্ধকারে কোথায় দেশালাই কোথায় মোমবাতি কি জানি! মনে করার চেষ্টা করলাম কোথায় থাকতে পারে। হ‍্যাঁ মনে পড়েছে --আলমারির ড্রয়ারে। দুইহাত দুইদিকে মেলে এগোতে লাগলাম ড্রয়ার খুলে মোমবাতি দেশালাই নিয়ে জ্বালাবো। পেয়ে ও গেলাম। কি ব‍্যাপার!! এতো শিগগির পেয়ে গেলাম!! কোথাও ঠোকর খেলাম না। অন্ধকারে সোজা ড্রয়ারে হাত। হ‍্যান্ডেল ধরলাম --খুললাম--দুটোতে একসাথে হাত লাগলো। এনে জ্বালিয়ে ফেললাম। জানালার উপরে মোম ফেলে বসিয়ে দিলাম। বসে ও গেল। বিশাল হলঘরে আলোটা একেবারে ক্ষীণ। কেবল জানালার নীচ ও উপর আলোকিত হয়েছে। জানালার ওপারে ঝলমলে চাঁদের আলো। অদূরে ঘন জঙ্গল। মাঝে ধান কেটে নেওয়া একফালি মাঠ। মোমবাতির আলোটা কাঁপছে। কি রে বা-বা!! কোথাও হাওয়া নেই তো! জানালার ওপারে একটা জ্বলন্ত মোমবাতি--কে জ্বেলেছে?? মোমবাতির আলোর উপরে লাল অর্ধচন্দ্রাকার ছটা। ঐ ছটায় কিছু একটা নড়ছে। বোঝা যাচ্ছে না কি নড়ছে। আপন মনে বলেই ফেললাম --কি নড়ছে রে বাবা!!! কে যেন বলে উঠলো--করোণার আত্মা। সে আবার কি?? ২০২০ তো করোণা বছর। সবাই জানে। কত লোক মারা গেছে। এখনো ভুগছে অনেকেই। কেমন যেন বিরক্তি লাগছে। আমি তখন কেবল মোমবাতির লাল ছটাটাই দেখতে পাচ্ছি। ছটার ভেতর কেবল নড়াচড়া করছে কতকগুলো কি যেন। সমস্বরে বলছে--করোণার আত্মা। আমার কেমন যেন ওদের সাথে গল্প করতে ইচ্ছে করছে। জিজ্ঞেস করলাম কোথা থেকে এসেছো তোমরা? আর কেনই বা এসেছো? উত্তরে যা বললো শুনে আমার খুব  কান্না পেলো। ---ওরা এক একজন বলতে লাগলো --ধারাবাহিক ভাবে ---আমরা তো আলাদা আলাদা বন্দী ছিলাম। বহু বহু বছর ধরে। আমাদের আত্মার মুক্তি হয়নি। কত দেবতার কাছে মানত করেছি-আমাদের একটু খোলা হাওয়া দাও--একটু ভালো ভালো খাদ‍্য দাও --আমাদের পূর্বপুরুষদের সবাইকে একসাথে থাকতে দাও। সবাই মিলে আড্ডা দেবো--ঘুরে বেড়াবো --একটু আনন্দ করবো। দেবতাদের বড়ই কড়া নিয়ম। আমাদের পূর্বপুরুষেরা নাকি বহু পাপ করেছে--সমুদ্রের নিচে পাথর সরিয়ে ফেলেছে, পাহাড়গুলোকে সমুদ্রের জলে ডুবিয়ে মেরেছে -দেবতাদের সমস্ত রাজত্ব ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে, স্বর্গরাজ‍্যের অপ্সরাদের মর্তে পাঠিয়ে দিয়েছে, কত কত দোষারোপ করলে। আমরা সবাই মিলে বারবার ক্ষমা চাইলাম। কোনক্রমেই আমাদের ক্ষমা করলে না। অবশ্য একটা উপায় বাৎলে দিলে--এককোটি বছর বরফে তলায় জীবন কাটালে তবেই আমরা মুক্তি পাবো। অগত্যা মুক্তির উপায় জেনে আমরা সবাই মিলে রাজী হলাম দল বেঁধে  তাই করবো। কিন্তু বরফ কোথায়?? হঠাৎ একদিন কি হোল কে জানে --পৃথিবীর বুকে কোন আলো নেই, কোন তাপ নেই। কেবল চাপ চাপ কালো রঙ্--আমরা কিছু দেখতে পাচ্ছি না--কেবল ঠাণ্ডা লাগছে। আমরা কোথায় কে হারিয়ে গেলাম কেউ জানিনা। এভাবে কতদিন ছিলাম তাও জানিনা। 
 ----কেমন যেন লাগছে --সাদা ক্ষীণ আলো, গা-টা একটু গরম গরম লাগছে।আমাদের দু'চারজন একসাথে হলাম। কোথায় ছিলাম কেউ বলতে পারলাম না। ক্রমশঃ দলে দলে বহুজন আমরা একসাথে হলাম। হলাম তো-খাবো কি!! সবাই মিলে স্বর্গে গেলাম। দেবতাদের পায়ে পড়ে  প্রার্থনা জানালাম--আমরা কোথায় ছিলাম জানিনা। কোথায় যাবো তাও জানিনা। কিন্তু বড় খিদে--কি খাবো তাও জানিনা। তোমরা বলে দাও--আমরা কি করবো। দেবতারা পা থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিলে। আরো বললে --অস্পৃশ্য, অসূচি, নরকের কীট--দূর হ--যা মর্ত‍্যে চলে যা। মর্ত‍্য আবার কি রে বাবা!! কিভাবে যাবো!!!জিজ্ঞেস করায় বললো --নিচের দিকে চেয়ে দ‍্যাখ --কিছু দেখতে পেলেই পিছু নিবি--জড়িয়ে ধরবি--মর্ত‍্যে চলে যাবি। খাবো কি? উত্তরে বললে এত খাদ‍্য পাবি এককোটি বছর তোদের কোন কষ্ট করতে হবে না। মহা আনন্দে নিচের দিকে সবাই তাকালাম। হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে চলেছে কি যেন কয়েকটা। পিছু ধাওয়া করলাম--দলবেঁধে ছুটলাম লেপ্টে গেলাম ভাসমান জিনিসটার সাথে। কিন্তু খিদে মিটছে না তো। ভাসমান জিনিসটা থামলো এক জায়গায়। জিনিসটার ভেতর থেকে কত কত পুতুলের মতো বেরোচ্ছে। আমরা কেউ কেউ পুতুলের গা জড়িয়ে ধরলাম। কেমন যেন অনুভূতি লাগছে। পুটপুট করে কোথায় যে ঢুকে গেলাম কে জানে!! সবাই বলাবলি করছে --মানুষগুলোর কি হোল??পটাপট মরে যাচ্ছে--আরে মরবে কেন!!! মানুষগুলো বোঝে না--আমরা ওদের মুক্তি দিচ্ছি। --বেশ আছি আমরা---এ আবার কি রে বাবা!! কিন্তু খিদে তো লাগছে না আর। কি হোল ব‍্যাপারটা!! দেখি আমাদের আশেপাশে ও আমাদের মতো কতকগুলো নতুন শরীর। বা বেশ মজার। সবাই একসাথে মিলেমিশে থাকা যাবে। খাওয়ার ও অভাব নেই। --দেবতাদের কথা সত্যি হোল। আমাদের মুক্তি হয়েছে। 
আমরা মর্ত‍্যে মুক্তি পেয়েছি এটাই আমাদের স্বর্গরাজ্য। দেশে দেশে কেবল আমরা --সুখের জীবন। ---সে সুখ ও সইলো না। সমস্ত মানুষগলোকে কি যেন খাওয়াচ্ছে--লম্বা সরু নলের আগায় কি যেন নিয়ে মানুষের শরীরে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। আমরা তো আবার ছটপট করছি--কি খাবো!!! দেবতা মুক্তি দিলে--মানুষগুলো আবার ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে--আমরা ছটপট করছি উদ্বাস্তু হয়ে--অনাহারে--অনিদ্রায় দিশেহারা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি।  
--অবশেষে আমাদের আত্মাগুলো দলবেঁধে সবাই আবার ঘুরে বেড়াচ্ছি। ---হঠাৎ টিউবলাইটটা আবার জ্বলে উঠলো। খেয়াল করিণি মোমবাতিটা কখন আপনাআপনি নিভে গেছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ