দর্পণ॥ কবিতার ডালি॥ অরিজিৎ রায়




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

 

    আশ্বিনের বিকেল

    

তোমাকে তোমার মত করে 

কতদিন দেখি'না, 

আকাশে বৃষ্টি দেখবে বলে 

এক ছুট্টে-ভুবনডাঙার পুকুর ! 

কাশের জঙ্গলে হারিয়ে যাবে

বলে- সাদা মেঘমন নীলের বুকে, 

ছুঁয়ে দিয়েছিলে তোমার ওড়না | 

যেদিন -রাতে, জোছোনা মাখবে 

বলে- টুপ করে ঝরে পড়েছিল , 

দু-ফোঁটা জলে- দুহাত ভরে 

মেখে নিয়েছিলাম অভিমান | 

ঝরা শিউলির মালায় একটা 

একটা করে গেঁথেছিলে 

তোমার আমার ভাললাগা , 

নতুন জামার গন্ধ ঢালবে

বলে- তোমার বুকে চেপে

ধরেছিলে -আমার মুখ | 

চোখ বুজে দাঁড়িয়েছিলাম বহুক্ষণ। 

প্রথম শ্রাবণের ইলশে-গুঁড়ি, 

সাজিয়েছিল আমাদের মুহূর্তগুলো - 

জলেভাসা শালুকের মতো | 

একশো আটটা নীল পদ্মে 

নীল হয়ে গিয়েছিল আমাদের 

শেষ আশ্বিনের বিকেল , 

শুধু বিজয়ার সিঁদুরে ঢাকে 

ভালবাসার বিসর্জন হয়েছিল, 

তোমাদের ঠাকুরদালানের

চৌকাঠ থেকে !


আজ-ও আরো একবার তোমাকে 

তোমার মতো করে পেতে চাই , 

ভুবন-ডাঙার দুর্গামন্ডপ সেজেছে- 

শুধু তোমারই জন্য ,

ধুনুচির ধোঁয়া পাক খেয়ে 

লিখে চলেছে ইতিহাস- 

ভালবাসার জন্মান্তরবাদ 

***

চার দেওয়াল

                

ভুল করে ফেলে এসেছিলাম ঘূর্ণিফল আর

তেঁতুল বীজের জমজমাট বাঘবন্দী খেলা!

লাল নীল হলুদ সবুজে চুবিয়ে ঘুরিয়ে দিতাম, 

ভাঁড়ার ঘর থেকে খিড়কির  চৌকাঠ অবধি। 

মাঠের শেষপ্রান্তে গোলপোস্টের মাঝে নিরাপদ

আমি, পোস্টদুটো ঠিক মা ও বাবার স্নেহের মতই! 


মুশকিল আসান করে তুমি এলে আগন্তুক হয়ে! 

পাহাড়ি ঝোরার মত ঠোক্কর খেতে খেতে

ধুয়ে গেলাম, বিছানার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত!

কোল আলো করে সূর্য উঠলে, জানালা খুলে

রোদের সাথে মিলিয়ে নিতাম রক্তের রঙ।


সম্পর্কেরা শীতের লেপ হলে দায়ভার ঠিক

উত্তাপের মত নিষ্ঠুর, পুড়লে দাগ রেখে যায়! 

কর্তব্য আর বাটখারার মধ্যে ফারাক বাড়লেই

জীবনের দাঁড়িপাল্লা নুয়ে যায় দর্মার ছাদের মত!


এখন স্তব্ধতার থেকে ভাষা শিখে নিই,

পাখির ডানার থেকে উড়তে পারার বিশ্বাস, 

পাকদণ্ডী বেয়ে পাহাড়ের কিনারায় দাঁড়িয়ে-

প্রত্যক্ষ করি - মেঘ রৌদ্রের লুটোপুটি প্রেম।

প্রয়োজনে সম্পর্কেরা আজ বোবা হোক,

প্রকৃতির পাঠশালায় আমি খুঁজে ফিরি সেই

লাল নীল হলুদ সবুজ ঘূর্ণিফলের সংসার ।

****

এই যে আমার ইচ্ছে গাড়ি

                   

তোমার ভালোলাগাগুলো কেমন গুছিয়ে রেখেছি দেখ। একদম টান টান। ঠিক যেন আলমারিতে ইস্ত্রি করে রাখা জামা কাপড়ের মতো। যাদের ছুঁয়ে দেখতে নেই, মেখে দেখতে নেই। সাজিয়ে রাখাতেই যেন তোমার সব সুখ।

সুখের মানে বুঝিনি কোনোদিনই। সুখ মানে কি অর্থযশ নাকি শান্তির পাঠশালা নাকি ব্ল্যাকআউটে জেগে থাকা , নাকি লড়ে যাওয়া রোজের মতো! সুখ খুঁজতে তো দুই কুড়ি কেটে গেল! হ্যাঁ ভালোবাসা যদি সুখ পাওয়া হয়, তবে তাই মানি । কিন্তু ভালোবাসার সংজ্ঞা জানা নেই! এক মাটিতেই সবটুকু, নাকি জমি বিভিন্ন হলে সুখের মাত্রারাও বেহিসেবী হয়!

তবুও খাতার পাতা ভরা মন কেমন লেখার মতো সহজ ভাবে গুছিয়ে রাখি - তোমার ভালোলাগাগুলো, তোমার মনের মতো সুখগুলো।

তবু মাঝে মাঝে ন্যাপথালিনের গন্ধে গা গুলিয়ে ওঠে, ছোঁয়া গেলেও মনে নেওয়া যায় না যে! আমার সুখ যে একটু অন্যরকম! আমার ভালোলাগা, আমার সুখগুলোকে সময় পেলেই রোদে শুকোতে দিই- সিল্কের পাঞ্জাবীর মতো। পোকায় কাটে না যে। ন্যাপথালিনের গন্ধ আমার ভালো লাগে না।

তাই অবেলায় বৃষ্টি হলেই ছুটে যাই জানালার পাশে, সোঁদামাটি গন্ধ আমার ভীষণ ভালো লাগে।

           তাই চলো না, কাদামাটি মেখে আরো একবার আমরা সুখ খুঁজি, কাদামাখা মাটিতে হারিয়ে যাওয়া কড়ির মতো ভালোবাসা খুঁজি! 

 ভালবাসার অন্য রঙ

                  

এক চরাচর জুড়ে বিস্তৃত তোমার আঁচল,

শূন্যতা ঢেকে দিয়ে জেগে আছ গালিচার মতো,

পুড়বে জেনেও একা মরুভূমির প্রহরী হয়ে

লিখে চলেছ লাভাময় আমাদের ভালোবাসার

গলিত এ কোন ইতিহাস!


সবুজের রহস্যময়তার সে দিন গেছে চলে 

নিভিয়ে দিয়েছ যা কিছু বন্য অবুঝ সে দিন, 

পায়ে পায়ে আমিও পেরিয়ে গিয়েছি পথ

যে পথে অচেনা কাদামাটির অনুশাসন ছিল

একদিন।


রাতের অন্ধকার নেমে এলে এখন জড়িয়ে নাও

হিমবাহ  ফিসফাসের চুপিসাড় অলস যাপন, 

গুটিয়ে নিয়েছ পাতাবাহার হাত পা'য়ের দেহাংশ, 

আরো দূর বহুদূর থেকে একলা করেছ আমায়!


জানালাময় বিষ বায়ু আপন হয়েছে তেমনই

দাবানলে জ্বলে গেছে আমার বন্য যা কিছু, 

ফিরিয়েছি শতবরষের অমৃত ভরা সে বাতাস

মরফিন নদীর জলে ভেসে গেছি মানুষের মতো!


এখন সন্ধ্যে গড়িয়ে মাঝরাত হলে

লণ্ঠন জ্বালিয়ে সোনা রোদ খুঁজি,

আকাশে বৃষ্টি এলে উচ্ছ্বাসে নয় ভয়ে

ঢেকে দিই তোমার বিস্তৃত আঁচল

অ্যাসিডের নোনা জলে পুড়ে যাচ্ছে

শিশুমুখ থেকে  আমাদের বৃদ্ধাবাস

এখনই সময়, ফিরে এসো অপরাজিতা

দু-হাত ভরে মাটি মেখে নিই প্রথমের মতো

সোচ্চার ভালোবাসার ঔরসে জন্ম দিই

শত সহস্র বছরের অনাহূত সবুজ চারার ।

****

অমর যাপন 

                 

বয়স হচ্ছে বলেই বোধহয়, বার বার হারাই,

কিন্তু কি যে হারাই! আনমনে! 

কখনও চশমা, ঘড়ি বা মুঠোফোন, সিগারেট। 

আংটিটা টিকে থাকে, রঙটা যদিও ফ্যাকাশে! 

ফুটপাতে হাঁটতে হাঁটতে সিনেমা পোস্টারে

চোখ আটকে - অথবা থিয়েটার ক্যাফের এডে

আবারও হারাই! অভিনয় সত্তাও হারাচ্ছি কি!


লিখতে লিখতে শব্দগুলো বিদ্রোহ করলেই

কলমও হারায়, নিজের সাথে নিজের লুকোচুরি, 

অবদমিত ভাবনাগুলো হারিয়েছি কবেই!

এক কাপ চা'য়ে মধ্যরাতে যখন ফ্রয়েডকে

প্রত্যক্ষ করি - আবারও অন্য আমি এসে দাঁড়ায়। 

জপের মালা, ক্যাপভরা বন্দুক, মৃত বাবার মুখ -

পাশের বাড়ির বৌদি, পাড়ার ভুলুর ঢুলু চোখ

আর, আর একটা বন্ধ সেকেলে দেওয়াল ঘড়ি,

খুব কষে দম দিচ্ছি, দম দিচ্ছি আর দম দিচ্ছি।

ঘড়িটার সাথে আমিও হারিয়ে যাচ্ছি , ফুরিয়ে যাচ্ছি শেষ বিকেলের মতো!


ঘড়িতে ঢং ঢং করে পাঁচটা বাজলো, দিনের আলো

শব্দ জট ভেঙে আস্তে আস্তে ফর্সা হচ্ছে।

আসলে শিল্পীর মৃত্যু হয়, শিল্পের বা সৃষ্টির নয়,

আসলে শব্দ-চাষাদের মৃত্যু হয়, কিন্তু শব্দের নয়!

****

 জাগিয়ে রাখে যারা 

                      

এক অস্থির রেখায় আছড়ে পড়ে পুরুষ সমুদ্রের

অভিমানী ঢেউ,দাম্ভিক রৌদ্রের গাল ভরা শোষণ

ছাপিয়ে-  ব্যক্ত করে শ্লেষ, সাধারণের মাঝে-

পৃথিবীর জারজ সন্তানের মতো!


তিল তিল আলো হাওয়া মাটি বুকে বেঁধে

পা রেখেছি, - নিশ্চুপ তার চলন এ রিক্ততায়!

সময়ের পাল ছেঁড়া অস্থিরতায় জোড়াতালি

তবু পিছন ফিরে বারে বারে মন কেমন!


এক মুঠো অগোছালো রং ছড়িয়ে দিও ক্যানভাসে! 

কোনও মূর্ত প্রতীক নয়, নয় কোনও পাহাড়ি ঝোরা,

আধ্যাত্মিক জীবাশ্মের গুঁড়ো ছাই মাড়িয়ে এ চলা, 

জীবন বোধের রং কুড়িয়ে - মেখে নেওয়া-টুকু!

শিল্পীর চোখে তখন জল, মাথায় অযুত বোধের

বিষ্ফোরণ! সে শব্দটুকু আমাকে দিও ভালবেসে, 

হে কবিতার ঈশ্বর!


সম্পর্কের দোহাই বড়ো একতরফা, তীব্র বাদ-বাদী তরজা, - অনুভবের আকাশে বড়ো অসীম শূন্যতা, 

অনুভূত বোধের পাঁচফোড়নে বন্ধুতার আকাশ যেন মুক্তি, জেনেছে আন্তর্দেশীয় রাজনৈতিক সে, তারা

আশা রাখি গোলাপের তোড়া হাতে দিন-বদল,

মানবতার নির্মম  পাপড়ি খসা এ অবেলায়!


সংসার ছাড়িয়ে ভালবাসা পাড়ি দেয়-

ভিন্ন হৃদয়, তবু অপত্যের স্নেহ মাখা এ যাপন -

নিশ্চিত ঘরমুখো করে বারবার,

যে ঘরে উৎসব রচনা হয়  আগামী নবান্নের , 

যে ঘরে সনাতন সুরে বাজে, ভোরের আজান!



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. সুন্দর সব কবিতা। ভাল লাগল , তাই দুবার করে পড়লাম।

    উত্তরমুছুন

  2. সম্পর্কের দোহাই বড়ো এক তরফা ৷ শীতের
    লেপের মত যদি হয় তবে দায় ভার পুড়লে দাগ থেকে যায় ৷ ভালোলাগা যেনো শৌখিন জিনিস ,ছুঁয়ে দেখতে নেই , মেখে দেখতে নেই ৷ সোচ্চার ভালবাসায় জন্ম হোক অনাহূত সবুজ চারার ৷

    প্রতিটি লেখা একটা আঙ্গিকে বাঁধা ৷ মুগ্ধতা একরাশ

    উত্তরমুছুন