সফদার হাশমি || অনুবাদ ও জীবনী || দেবাশীষ ভট্টাচার্য্য




পোস্ট বার দেখা হয়েছে
প্রখ্যাত নাট্যশিল্পী সফদার হাশমি (১২ এপ্রিল ১৯৫৪- ২ জানুয়ারি ১৯৮৯) ছিলেন একজন কমিউনিস্ট নাট্যকার এবং পরিচালক। তিনি একজন অভিনেতা, গীতিকার  এবং তাঁকে এখনও ভারতীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাগৃহে একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
ছাত্র জীবনে নাটকে অভিনয়ের পাশাপাশি শুরু হয়  কবিতা লেখা, নাটক লেখা, বাচ্চাদের জন্য গল্প লেখা।
৭০ সালের একটা পথ নাটক কাঁপিয়ে দিয়েছিল দিল্লি আর আশেপাশের অঞ্চল। একজন রাজা, তিনি যেখানেই যান, সাথে তাঁর সিংহাসনটা নিয়ে ঘোরেন। যদি কখনো সেটা বেহাত হয়ে যায় সেই ভয়ে। ইন্দিরা গান্ধীর কুর্সির প্রতি আশক্তিকে ব্যঙ্গ করে 'কুর্সি, কুর্সি, কুর্সি' নাটকটা নিউ দিল্লির বোট ক্লাবের লনে প্রতি সপ্তাহে অভিনীত হত। সেখান থেকেই উঠে আসে 'জন নাট্য মঞ্চ' বা সংক্ষেপে 'জনম' গ্রুপ তৈরি করার চিন্তা ভাবনা। ৭৫ সাল অব্দি জনম একের পর এক পথ নাটক করে গেছে যেসব নাটকের মূল সুর ছিল শ্রমজীবী মানুষ৷
সাধারণতই যা পছন্দ হয়নি শাসকদের। ৭৫'এ এমার্জেন্সি ঘোষণা করার পর দেশে সমস্ত রকম রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিটি বন্ধ করে দিতে হয়। সাথে সাথে রাজনীতির গন্ধ যেখানে রয়েছে সেসবও বন্ধ করতে হয়।
তাঁর যুগান্তকারী পথ নাটক ছিলো আওরত', 'মেশিন' ইত্যাদি। 
১৯৮৯ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিন দিল্লির কাছে গাজিয়াবাদে তৈরী হলো শ্রমিক আর কৃষকদের দুর্দশা নিয়ে তৈরি পথনাটক 'হাল্লা বোল'। খেটে খাওয়া মানুষ তাঁদের প্রতিদিনের লড়াইকে উঠে আসতে দেখছে নাটকের দৃশ্যে। কিন্তু মানুষকে এভাবে প্রভাবিত করলে যে কায়েমী স্বার্থে আঘাত লাগবেই! সেই কায়েমী স্বার্থের আঘাত তারা ফিরিয়ে দিল সফদারকে পিটিয়ে মেরে। কংগ্রেসি গুণ্ডাবাহিনী নাটকের ওপর হামলা চালাল।
গাজিয়াবাদ মিউনিসিপালিটি নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী রামানন্দ ঝা এর সমর্থনে চলছিল সেই নাটকের শো৷ কংগ্রেসি প্রার্থী মুকেশ কুমারের গুণ্ডার দল নৃশংসভাবে পেটাল নাটকের দলকে। ঘটনাস্থলে সাথে সাথেই মারা গেল নেপালী অভিনেতা রাম বাহাদুর। সফদারকে ভর্তি করা হল রাম মনোহর লোহিয়া হাসপাতালে। 
মৃত্যুর সাথে লড়াই করে পরদিন ২ জানুয়ারি ১৯৮৯
মারা যায় সফদার। থেমে গেছিল কালের কন্ঠ। কিন্তু থামানো যায় নি হাল্লা বোলকে। দুদিন পর সেই একই জায়গায় সফদারের বন্ধু কমরেড ও স্ত্রী মলয়শ্রী হাশমি কমরেডের মৃত্যু শোক নিয়েই মঞ্চস্থ করে হাল্লা বোল। 
   সফদার বা সফদারদের আসলে মৃত্যু হয় না , শ্রমজীবি মানুষের আন্দোলনে , অধিকার আদায়ের দাবীতে চির অমর থাকে।  আনন্দ পটবর্ধন কবিতা লিখেছিলেন সফদারের স্মৃতিতে-

'বাবরি মসজিদ ভাঙতে তুমি দেখো নি
তুমি দেখো নি তার পরের হিংসা আর ঘৃণাকে
তুমি রামাবাঈ আর অন্যান্য দলিতের মৃত্যু দেখো নি
পরমাণু বোমার জন্য দেশের আকুলতা তুমি দেখো নি
২০০২ এ গুজরাটের সাম্প্রদায়ীক হিংসা তুমি দেখো নি
প্রতিবেশি পাকিস্তানে তালিবানের উৎপত্তি তুমি দেখো নি
আর এখানে তুমি হত্যাকারীর রাজ্যাভিষেক দেখো নি
আমরা যারা এখনো বেঁচে রয়েছি তারা এগুলো সব দেখেছি
কিন্তু তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না।'

পূর্ণেন্দু পত্রী লিখেছেন -

নতুন শব্দ : সফদার হাশমি
এই মৃত্যুশোক
কাঁধ থেকে নামানো যাবে না কোনোদিন।
আর বর্বরতা কি নির্বোধ।
যেন মৃত্যু হলেই মুছে যায়
প্রতিজ্ঞার প্রাণ।
আক্রমণ কোনো নতুন শব্দ নয়।
হিংসা কোনো নতুন শব্দ নয়।
নতুন শব্দ-সফদার হাসমি।

সফদার হাসমি মানে জাগা,
জেগে থাকা,
জাগানো
(কাব্যগ্রন্থ / প্রকাশিত: রক্তিম বিষয়ে আলোচনা)

।। অ নু বা দ ।।

লেখাপড়া শেখো

লেখাপড়া শেখো, যাঁরা পরিশ্রম করছো,
লেখাপড়া শেখো, যাঁরা ক্ষুধায় জর্জরিত,

ক খ গ ঘ চেনো, শব্দ পড়তে শেখো , 
অ আ ই ঈ কে হাতিয়ার বানিয়ে লড়তে শেখো। 

ও সড়ক নির্মাণকারী , ও দালান নির্মাণকারী ,
নিজেই নিজের ভাগ্যের ফলাফল যদি নির্বাচন করতে চাও -

ও মালবাহক , ও রেল চালক,
দেশের লাগাম যদি ধরতে হয় 

ক খ গ ঘ চেনো, শব্দ পড়তে শেখো , 
অ আ ই ঈ কে হাতিয়ার বানিয়ে লড়তে শেখো। 

জিজ্ঞাসা করো, সামান্য মজুরীর জন্য মানুষ কেনো ভবঘুরে ,
পড়ো, তোমার শুকনো রুটি শকুনে কেনো ছোবল মারে ,

জিজ্ঞাসা করো, মা বোনেদের উপর বদমাইশদের হামলা কেনো হয়, 
পড়ো, তোমার পরিশ্রমের ফসল কোন মালিক ঠকিয়ে কেড়ে নেয় কেনো।

পড়ো, দেওয়ালে লেখা আছে মেহনতি মানুষের স্লোগান, 
পড়ো, পোস্টার কি বলে , সেও তোমার বন্ধু , 

পড়ো, যদি অন্ধবিশ্বাস থেকে মুক্তি পেতে হয়,  
পড়ো, বইগুলো বলে সারা পৃথিবী তোমার, 
পড়ো, প্রত্যেক মেহনতি মানুষকে তার হক দিতে হবে, 
পড়ো, নিজের মতো করে তোমার দেশ চালাতে। 


লেখাপড়া শেখো, যাঁরা পরিশ্রম করছো,
লেখাপড়া শেখো, যাঁরা ক্ষুধায় জর্জরিত।

বইগুলি 

বইয়েরা কথা বলে 
বিগত দিনের
পৃথিবীর, মানুষের , 
আজকের, কালকের
প্রত্যেক সময়ের। 
খুশীর, দুঃখের
ফুলের, ভোমরার 
জিতের, হারের 
ভালোবাসার , আশার,
শুনবে না
বইয়ের কথা? 
বইদের কিছু বলতে দিতে হয়,
তোমার কাছে রাখতে হয় ।
বইয়ের ভেতর পাখিদের কিচিরমিচির দেখি,
ক্ষেতের কাজকর্ম পাওয়া যায়। 
বইয়ের ভেতর জলপ্রপাতের স্বর আছে,
সুন্দর পরীদের গল্প শোনায়। 
বইতে বিজ্ঞানের ভাষা আছে,  
বইতে রকেটের রাজত্ব আছে। 
প্রত্যেক বৈশিষ্ট্যে পরিপূর্ণ,
বইয়ের নিজস্ব পৃথিবী আছে। 
তুমি সেখানে যেতে চাইবে না?
যা বইতে আছে পেতে চাইবে না? 
বইয়েরও সাধ হয় কিছু করার,
তোমার কাছে থেকে যাওয়ার। 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

3 মন্তব্যসমূহ

  1. এত অপূর্ব প্রস্তাবনা সাথে ওনাকে সম্বোধন করে লেখা অসামান্য দুটি কবিতা এবং দুর্দান্ত দুটি অনুবাদ কবিতা পড়লাম .... সফদার হাশমিকে জানলাম , ভীষণ ভালো লাগলো 🙏

    উত্তরমুছুন


  2. অসামান্য কিছু কবিতার সম্ভার ৷ মুগ্ধতা একরাশ

    উত্তরমুছুন