দর্পণ || আলোচনা || রবীন্দ্রনাথ, বর্তমান প্রজন্ম ও বাংলা ভাষা ~ আর্য চ্যাটার্জী




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

রবীন্দ্রনাথ, বর্তমান প্রজন্ম ও বাংলা ভাষা

আর্য চ্যাটার্জী

২৫শে বৈশাখ, ১৪২৮


শুরুতেই বলে রাখি, সময়ের সংগে (এই বানান সত্যজিত রায় প্রবর্তিত, সহজ রেফারেন্স 'সোনার কেল্লা' চলচ্চিত্রের মন্তাজ) আমি আমার সন্তান, আমার পরিবারের পরবর্তী প্রজন্ম, ও আমার সন্তানসম সমগ্র ছাত্রকূল সবাই একসাথে ভুক্তভোগী। তাই উপপাদ্য বিষয়ে আলোচনা একটি সমসাময়িক পরিস্থিতির অবতারণা মাত্র এবং কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সমাজ ব্যবস্থার বিরূদ্ধে অভিযোগ বা আঘাতের উদ্দেশ্যে নিক্ষিপ্ত নয়। কেউ যদি এটিকে উন্নততর ভবিষ্যতের জন্য উপযুক্ত সমালোচনা বলে মনে করে কিঞ্চিৎ সেই উন্নতির দিকে উদ্যোগ নেন, তাহলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মা আরো খানিকটা শান্তি পাবে, তাঁর মৃত্যুর আশি বছর, ও জন্মের একশো-ষাট বছর পরেও। 


বাঙালীর সুখে-অসুখে, আনন্দে-শোকে নোবেল জয়ী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলতে গেলে ঠাকুরের স্থান-ই নিয়ে ফেলেছেন। টেগোর বললে ওনার নামের সংগে যে দেবত্ব জড়িয়ে আছে তা ঠিক প্রতিভাত হয় না। সমস্যা হল গিয়ে যে বাংলা ভাষাই রীতিমত অবলুপ্তির পথে। ওনার এই বিশাল কর্মকাণ্ড বোঝার মত, সেই নিয়ে মাতামাতি করার মত, মানুষের অভাবের হার ক্রমবর্দ্ধমান। দেশে সীমানায় থেকে এই ভাষার গুরুত্ব ঠিক উপলব্ধ হচ্ছে না। বিদেশের মাটিতে গিয়ে বাঙালীরা বুঝতে পারছেন হাড়ে হাড়ে যে বাংলা ভাষার মহিমা কি। অনেকেই জানেন, তবু মনে করিয়ে দিই যে, পৃথিবীতে বাংলা ভাষা তার ব্যবহারের নিরিখে, তিন হাজার ব্যবহৃত ভাষার মধ্যে ষষ্ঠ স্থান অধিকার করে আছে। সেখানে যে ভাষার মোহে আমরা অন্ধ, সেই ইংরেজী আছে তৃতীয় স্থানে। এর পরেও, বাংলা ভাষার মানুষরা ডুবে আছি এক আশ্চর্য ইংরেজী মোহে। কোনো ভাষাকে ছোট করছি না, বা এটা অন্ধের মত বলার চেষ্টা করছি না যে বাংলা ভাষা থাকুক আর ইংরেজী বিদেয় হোক। ইংরেজী থাকুক, কিন্তু বাংলা-কে বাদ দিয়ে নয়। মাতৃভাষাকে বাদ দিয়ে কোনো শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না জানবেন। যদি জোর করে তা চাপিয়ে দেওয়া হয়, যেমন হচ্ছে, তাহলে তা অবৈজ্ঞানিক ও অবাস্তব কল্পনা। এর ফলে কোনো শিশু কোনো ভাষাই ঠিক করে শিখে উঠতে পারে না। বাংলা ভাষার সংগে ইংরেজির কোনো বিবাদ নেই। বাংলা শিখলে ইংরেজি কম শেখা হবে, এ ধারণা ভুল ও ভ্রান্ত।  আমরা যে ধ্বংস-কে প্রশ্রয় দিচ্ছি, তাকে আটকাতেই, ‘সহজপাঠ’ রচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি বুঝেছিলেন, এই ভাষাকে সময়ের সংগে আধুনিক না করে তুললে, ঘোর বিপদ আসন্ন। চলিত ভাষা, বাংলা বানান, এমনকি ছেদ-যতি চিহ্নের ব্যবহার-কে তিনি এতটাই সরল করে তোলার চেষ্টা করলেন এবং তা এমন সাদরে গৃহীত হল যে বিগত শতকের নব্বই এর দশক পর্যন্ত বাঙালী সেই ভাষাকে আঁকড়ে পার করল তার শৈশব, কৈশোর, যৌবন...আমরণ চলবে তা, এমনই বাঁধলেন তিনি। বাড়িতে যাঁদের রবীন্দ্র রচনা সমগ্র আছে, তাঁরা সেই বিশাল কীর্তির দিকে তাকিয়ে একবার ভাববেন, ঠাণ্ডা মাথায়, যে কোন স্তরে একজন মানুষের মস্তিষ্ক আশি বছর বয়স অব্দি কাজ করে গেলে এ হেন সৃষ্টি করা যায়! বা ভাববেন, পৃথিবীতে একজন দ্বিতীয় ব্যক্তির নাম, যিনি নিজের মাতৃভাষায় সাহিত্যক্ষেত্রের সমস্ত রূপে, এমনকি সঙ্গীত ও চিত্রকলায় সমান অবলীলায় বিচরণ করেছেন, তাও এই বিপুল পরিমানে। সাহিত্যক্ষেত্রে চিরকালীন গুরুদেবদের কথা উঠলেই চলে আসে, উইলিয়াম শেক্সপীয়রের নাম। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সংগে তুলনা করলে দেখা যাবে দুটি সহজ ফারাক। শেখ্যপীর বাবাজি কয়েকশতক আগের মানুষ। আর ওনার সৃষ্টি সীমাবদ্ধ ছিল নাটক ও সনেটে। উপন্যাস বা ছোটগল্প তিনি লেখেন নি, চল ছিল না বলে। গান-ও বাঁধেন নি। আসলে উনি গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য চেয়েছিলেন শো-বিZ- এ মন দিতে -- কিভাবে নাটক-কে রাজদরবারের বাইরে টেনে এনে হাটে-বাজারে কমার্শিয়ালাইজ করা যায়, তার প্রথম পথিকৃৎ ছিলেন তিনি। রচনাও যে সব মৌলিক, তা নয়। প্রচলিত গাথা-কে রূপ দিলেন নাটকে। আর বাকি যে কবি সত্ত্বার তাড়না ছিল, তা ঢেলে দিলেন সনেট রচনায়। রবীন্দ্রনাথের সবটাই কবিসত্ত্বার মৌলিক তাড়না কারণ অর্থ উপার্জনের পথ তাঁকে খুঁজতে হয় নি।তিনি সৃষ্টিসুখের উল্লাসে নিমজ্জিত। তাতে রয়েছে গভীর সমাজ ও শিক্ষা দর্শন। শেক্সপীয়রের ভাবনা চিন্তার মধ্যে সে সব আসে না। ইংরেজী সাহিত্যের ছাত্র হয়ে আমাকে কোনো দিন এই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় নি, যে শেক্সপীয়রের দর্শন নিয়ে আলোচনা কর। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে যে প্রশ্ন ঘুরে ফিরে বারে বারে আসে। এমনকি, বি-এড, এম-এড এও তা অবশ্য-পাঠ্য বিষয় -- শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর দর্শণ। শুধু আমাদের দেশে নয়, বিদেশেও, holistic education তিনি যেভাবে থীয়োরি থেকে বেরিয়ে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করেছেন তা অভূতপূর্ব। সে চর্চা আজও পৃথিবীজুড়ে চলছে। সেই ভিত্তির ওপর গড়ে উঠছে প্রাসাদ।


সেখানে পশ্চিমবংগের মানুষ রবীন্দ্রনাথ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন গত তিন দশক ধরে প্রায়। ছেলে-মেয়ে রা জন্মানোর পর নার্সারী রাইম পড়ে, সহজপাঠ (প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ)-এর মত বই তারা পায় না। পড়েও না। ‘হাট’-এর বদলে শেখে ‘হাম্পটি-ডাম্পটি’। সরকারী প্রাথমিক শ্রেনি-গুলিতে বহু বছর পড়ানো বন্ধ ছিল সহজপাঠ কারণ পাঠ্যপুস্তক হিসেবে তা রাখা হয় নি। সম্প্রতি কোনো উদ্যোগে আবার তা ফিরৎ এসেছে । যাঁরা এনেছেন তাঁদের অসংখ্য ধন্যবাদ। সংগে আবার গোদের ওপর বিষফোঁড়া, আমরা বাবা-মা-এরা গর্ব বোধ করি বলতে যে তাঁদের সন্তান বাংলা টা ঠিক পড়তে বা লিখতে পারে না ( যদিও সারাদিন বলতে পারে)। আর ইংরেজিটা খুব সহজ আর বাংলাটা খুব শক্ত। কিন্তু মজার বিষয় হল, সন্তানরা যেদিন মাতৃভাষা সরিয়ে রেখে সারাদিন ইংরেজি-তে কথা বলবে, তখন বাবা-মা এর সংগে সফল হবে তো আসল নাড়ির টান? যে কোনো ভাষার প্রাথমিক উদ্দেশ্য হল কমিউনিকেশন বা যোগাযোগ। ইংরেজিতে Functional Communicative English শেখানোর নাম করে কত নামী দামী সংস্থা বাজারে করে খাচ্ছে। কিন্তু হায় বাঙালী, বাংলায় চিঠি লেখাই শেখে নি কোনোদিন।  বেশির ভাগ বাবা-মা কে দেখি নিজের সন্তানদের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চতুর্থ শ্রেনি থেকেই ভাল ইংরেজি টিউটর খোঁজেন। কারণ, এর পর লেখাপড়া বিষয়টি মাতৃভাষায় থাকে না বলে তাঁদের আয়ত্বের বাইরে চলে যায়। কেউ বুঝে উঠছে না, এর সাথে আয়ত্বের বাইরে চলে যাচ্ছে সম্পর্ক-ও। সহজপাঠ-না-পড়া এই প্রজন্ম ফেসবুক, ইন্সটা, ট্যুইটারে দড় নেটিজেন হয়ে কোভিড পরিস্থিতিতে প্রাণ বাঁচাচ্ছে বটে, অপ্রত্যাশিত ভাবে স্বার্থপরতার ঊর্ধ্বে উঠে, কিন্তু মাতৃভাষার প্রতি এই অবহেলা একটি সম্পূর্ণ সংস্কৃতিকে গ্রাস করতে চলেছে, এ সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই। 


সবথেকে বড় কথা হল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে দারুন ইংরেজি জানতেন বলে সাহিত্যক্ষেত্রে নোবেল পেয়েছিলেন তা আদপেই নয়। ইংরেজী গীতাঞ্জলি-তে তাঁর অনুদিত কবিতার সংকলনের অনুবাদ অত্যন্ত দুর্বল, কারণ যতই সেন্স ট্রান্সলেশনের চেষ্টা উনি করে থাকুন না কেন, ভাবের ঘরে চুরি হয়ে গিয়েছে, অনেক বড়। সে ভাব একমাত্র, বাঙালী তাঁর বাংলা লেখা পড়ে ধরতে পারবে। ইংরেজরা কোনোদিন ইংরেজি গীতাঞ্জলী পড়ে সে ভাব ধরতে পারবে না। শুনলে অবাক হবেন, রবীন্দ্রনাথের মত মানুষের সৃষ্টির শুধু ভাব ধরতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ বংগদেশে ভিড় জমাচ্ছেন, বাংলা শিখবেন বলে। আর আমরাই আমাদের পরের প্রজন্মকে সেই মাতৃভাষা শিক্ষা থেকে ভীষনভাবে বঞ্চিত করছি।  প্রশ্ন করে অনেকেই -- তবে কেন নোবেল দেওয়া হল তাঁকে ইংরেজি ‘গীতাঞ্জলি’-র জন্য? উত্তরে ভাবা দরকার, শুধুমাত্র ওইটুকু বই-এর ওই ক'টা কবিতার অনুবাদে সারা বিশ্ব কাঁপিয়ে দিলেন তিনি তাঁর বৃহত্তর ও চিরকালীন দর্শনের কথা সেখানে ধরে, যা অদৃষ্টপূর্ব। এভাবে কেউ কোনোদিন ভাবে নি। তাহলে যদি রবীন্দ্রনাথ তখন পুরোটা ইংরেজি-তে করতেন, তাহলে কি ঘটতে পারত। তাও আবার গীতাঞ্জলি-র অনুবাদে সব ভাব ধরা পড়ে নি। ভাষা ও সংস্কৃতি বড্ড ওতোপ্রতো ভাবে জড়িত। ইলিশ মাছ আর ভাত যে বাঙালীর কাছে কি জিনিষ সে ভাব কি ‘slices of hilsa and fine rice’- এই ট্রান্সলেশনে ধরা পড়বে? গীতাঞ্জলির ইংরেজি ওই একই ব্যাপার। ওনাকে নোবেল দেওয়ার আগে সংগে আরো জানা গেল যে, একটি বিশেষ ভাষা 'বাংলা'-য় তাঁর সাহিত্যকীর্তির যা ব্যাপ্তি, তা পৃথিবীর আর কোনো ভাষায় কেউ কোনোদিন করে যেতে পারেন নি। কষ্ট হয় সেই প্রজন্মকে সামনে দেখতে, যারা রবীন্দ্রনাথের 'সহজ-পাঠ' টুকু ছেলেবেলায় না পড়ার জন্য জীবনে কোনোদিন রবীন্দ্রনাথ-কে পড়তে পারবে না। পারলেও পড়তে হবে পেঙ্গুইন ক্লাসিকস-এর ইংরেজী ট্রান্সলেশনে, যেমন করে ফেলুদা পড়ে বেশিরভাগ কিশোর-কিশোরী।ইলিশমাছ-ভাতের বদলে সার্ডিন স্যান্ডঊইচ। এর থেকে বড় 'আয়রণী অফ ফেট' আর কি হতে পারে একটি জাতির পক্ষে। বলতে দ্বিধা নেই, বাংলা ভাষা-কে, সংস্কৃতিকে আর তার চর্চা-কে আজও একা হাতে রক্ষা করে চলেছেন ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ, না থেকেও। 


২৫ শে বৈশাখে বাঙালীর এই পরম ব্রহ্ম ঠাকুরের ফটোয় গলায় মালা আর ফুলের নৈবেদ্য ও চন্দনের ফোঁটা দিয়ে ধূপ ও প্রদীপ জ্বালিয়ে ওনার শ্রাদ্ধ না করে, টেগোর-কে একটু বাস্তবে নামিয়ে এনে ভাইরাল করা যায় না কি? তবে ঠিক করে ডাউনলোড না করে সোজাসুজি শেয়ার করা যাবে না ওনাকে। সব ডেটা এনক্রিপটেড। বুঝতে জানতে গেলে সেই চোখ লাগে যা দিয়ে ডিসাইফার করে সবটা ডিকোড করা যাবে। সেখানে আবার একটা রিস্ক থেকে যায়, যা আপলোড করে গিয়েছেন বিগ-ডেটা হিসেবে, তাতে সেগুলো ডাউনলোড করতে গিয়ে আবার পুরো সিস্টেম না ক্র্যাশ করে!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

2 মন্তব্যসমূহ

  1. বর্তমান প্রজন্মের কাছে অধরা বাংলা ভাষার কিছু আভাস পেলাম বটে কিন্তু এই প্রেক্ষিতে রবি ঠাকুরকে কি করে বর্তমান প্রজন্মের (ইংরাজী এবং বাংলা মাধ্যমের ছাত্র ছাত্রীদের কাছে) আরো গ্রহণযোগ্য করে তোলা যায় সে ব্যাপারে কিছু আলোকপাত থাকলে আরো ভালো লাগতো। তবু লেখাটা পড়ে ভালো লাগলো ।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. সে নিয়ে বিস্তারে আলোচনা সম্ভব। কিন্তু বাংলা ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাঙালীরাই এখন এমন নিচু চোখে দেখে যে সব উদ্যোগ বিফলে যায়...সবার আগে নিজের ভাষার প্রতি সম্মান ফেরানোটা জরুরি...

      মুছুন