সত্যজিৎ ১০০ || সুবর্ণজয়ন্তী স্মরণ || অলিপা পাল




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

 


                      সুবর্ণজয়ন্তী স্মরণ

                          অলিপা পাল 


সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা প্রতিদ্বন্দ্বী ও অরণ্যের দিনরাত্রি উপন্যাস নিয়ে পরপর দুটি ছবি বানিয়ে ফেলেন সত্যজিৎ রায় ৷

বছরটা ১৯৭০ ৷সেই অশান্ত সত্তরে লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তখনও বাংলা সাহিত্য খ্যাত হয়নি ৷কিন্তু সত্যজিৎ রায় নামটি তখন রীতিমত আন্তর্জাতিক ৷ কাহিনি দুটি অত্যন্ত সাময়িক,সেই ভাবনায় এমন দুটি ছবি বানালেন যা আজ পঞ্চাশ পেরিয়েও সাম্প্রতিক ৷


 প্রতিদ্বন্দ্বী তে বেকার যুবক সিদ্ধার্থের সঙ্গে একবিংশ শতকের মধ্যবিত্ত যে কোনো কর্মহীন,কর্ম সন্ধানী যুবক একাত্ম হয়ে যাবেন ৷

সত্যজিৎ রায়ের নাগরিক ছবির অন্যতম সেরা প্রতিদ্বন্দ্বী ৷

সিদ্ধার্থের অন্তরের অনুশোচনা ও পরাজয়ে সত্যজিৎ এক প্রশান্তির শৈল্পিক মাত্রা যোগ করলেন, যা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখায় ছিল না ৷সাহিত্যে আর সিনেমার এখানেই ফারাক ৷ সিনেমায় একটা ফ্রেম,শব্দ ভ্রূভঙ্গি কিংবা চোখের প্রতিফলন হাজার কথা বলতে পারে দর্শকের কাছে, যা সাহিত্য পারে না ৷ সে জন্য লেখককে একটু বেশি কালি খরচ করতে হয় ৷প্রতিদ্বন্দ্বীর সিদ্ধার্থ যুবক সত্যজিৎ রায়ের ফটোকপি ৷

সত্যজিৎ রায়ের সমস্ত সত্তার প্রতিফলন সিদ্ধার্থের মধ্যে ৷ সিদ্ধার্থের সাংসারিক পরিমণ্ডল ,দিদির উচ্চাশা, ছোটভাইয়ের চোখে সমাজ বদলানোর স্বপ্ন ৷তখনও বড়োদিদিরা উচ্চবিত্তের স্বপ্ন দেখত নিজেদের পণ্য করে ৷ছোটভাই পুলিশের বন্দুকের গুলিতে লুটিয়ে পড়লে নার্সের পোশাকে ছুটে আসে দিদি ৷প্রথম পর্যায়ে মনে হতে পারে কিছুক্ষণ আগে পরিচিত হওয়া নার্স কাম যৌনকর্মী হয়ত ৷কিন্তু দিদিকে দেখার পর তাঁর মুখে এক প্রশান্তি,যেন শোকের ভাগ বহন করতে এসেছে ৷পথের পাঁচালির গ্রাম্য অপু,সত্তরের দশকের বিদ্ধস্ত রক্তাক্ত কলকাতায় সিদ্ধার্থের চেহারায় উপস্থিত ৷


অরণ্যের দিনরাত্রি মুক্তি পেলে কলকাতার পত্র পত্রিকায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায় ৷কেউ বলেছেন বিপর্যস্ত সত্তর সালের কলকাতা শহরকে এড়িয়ে সত্যজিৎ চার যুবকের জঙ্গল বেড়ানোর কাহিনিতে মুখ লুকিয়েছেন ৷ কেউবা বলেছেন বাম রাজনৈতিক আন্দোলনের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ সময়ের বাস্তবতাকে এড়িয়ে একদল নারী পুরুষের এডভেঞ্চারাস ভ্রমণকে তিনি ধরলেন ৷ছয়জন নরনারীর গল্প বলতে গিয়ে পরিচালক এক মুহূর্তের জন্যও দর্শককে স্থির হতে দেয়নি ৷ বাঙালি দর্শক গল্প শুনতে ভালবাসে৷

আর সত্যজিৎ রায়ের গল্প বলার মুন্সিয়ানা তর্কাতীত ৷সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে গল্পের পরেও বাড়তি পাওনা সিনেমার কৌশলের কারুকার্য ৷সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মূল কাহিনি থেকে চারবন্ধু অসীম সঞ্জয় হরি শেখরদের ব্যাকগ্রাউন্ড'টা সরিয়ে রাখলেন পরিচালক ৷শুধু জানা গেল অসীম, চারজনের মধ্যে আর্থিক দিক থেকে ধনী ৷তার কেনা নতুন গাড়িতে লংড্রাইভ ৷কবিতা ভালবাসে, রাজনীতির দিকে বামঘেঁষা ৷সঞ্জয় একটি কারখানার দায়িত্বপূর্ণ পদে ম্যানেজার ৷মহিলা সঙ্গে লাজুক প্রকৃতির,শিক্ষিত, অবশ্যই বামপন্থী ৷

হরি'র সম্পর্কে জানা যায় প্রেমে সদ্য ল্যাং খাওয়া তরুণ,খেলোয়াড়, ইন্টেলেকচুয়াল ভণ্ডামি নেই ৷একটু হীনমন্যতায় ভোগে ৷শেখর, সদাস্ফুর্তিতে টগবগে ৷মুখে মারিতাং জগত,কিন্তু তেমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে কুপোকাৎ ৷তবে মজাদার সঙ্গী ৷আর দুই নারীর একজন অপর্ণা,গরবিনী ও সুপিরিয়োরিটি কমপ্লেক্সে আক্রান্ত ৷ তবে খোলস ছাড়ালে একজন সংবেদনশীল নারী ৷জয়া, অপর্ণার বিধবা বউদি ৷প্রাণোচ্ছল, সঞ্জয়ের প্রতি সাময়িক অনুরক্ত ৷এই ছয় জনের চারদিনের ভ্রমণ পালামৌ এর জঙ্গল ৷চার বন্ধু বাংলোয় থাকাকালীন এবং কাছের অন্য একটি বাংলোয় ওরা অপর্ণাদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর চরিত্র গুলোর বৈশিষ্ট্য দর্শক ধীরে ধীরে আবিষ্কার করতে থাকে ঘটনা পরম্পরায় ৷ এই ছবির সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশ মেমারি গেম ৷মূল কাহিনি ঘটনা চরিত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও বিখ্যাত ব্যক্তির নাম বলার মধ্যেই এক একটি চরিত্রের মানসিক গঠনের ছবি প্রকাশিত হয় ৷সঞ্জয় বিপ্লবী রাজনীতিকের নাম করে কাল মার্কস আর মাও সে তুং ৷

অর্থাৎ সত্তরের কলকাতার হৃৎস্পন্দন হয়ত সঞ্জয়ের মধ্যে আছে ৷অসীমের মুখ থেকে শোনা শেকসপিয়ার,রাণী রাসমণি,টেকচাঁদ ঠাকুরের নাম বুঝিয়ে দেয় তার বিভিন্ন সংস্কৃত শাখার প্রতি আগ্রহ ৷ এভাবেই জয়ার মুখে ক্লিওপেট্রা আর অপর্ণার কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ থেকে নেপোলিয়ান হয়ে ডন ব্রাডম্যান এ আসায় স্পষ্ট বুঝিয়ে দেয় আদুরে ও খামখেয়ালি চরিত্রের মেয়ে ৷শেষে অসীমের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠলে দশটাকার নোটের ওপর নিজের ফোন নম্বর লিখে দেয়  অপর্ণা ৷


সে সময় অনেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা'র সাথে এ ছবির তুলনা করেছিলেন ৷

কাঞ্চনজঙ্ঘা'র অশোক ও মনীষা'র স্বাধীনসত্তাকে দুই বাবা'র মুঠো থেকে বার করে এনেছিলেন সত্যজিৎ ৷ এক সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ রায় বলছিলেন—কাঞ্চনজঙ্ঘা ও অরণ্যের দিনরাত্রি ছবি দুটোতে তাকে আকর্ষণ করে,মানুষকে তার ঘরোয়া পরিবেশ

থেকে বের করে নিয়ে আসা ও আবিষ্কার করা মুখোশের আড়ালের মনকে, সেখানে কি ঘটছে ৷ 

কিন্তু গভীর চিন্তার খোরাক এই ছবিতে নেই ৷ আছে তাঁর নিজস্ব কিছু সিনেমার কারুকার্য ,রয়েছে শিল্পীসত্তার অর্ন্তবিরোধ ৷কিন্তু বিষয় বস্তুর দীনতার জন্য অরণ্যের দিনরাত্রি তাঁর চলচিত্র জীবনের মাইলস্টোন হয়ে উঠতে পারেনি ৷

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

4 মন্তব্যসমূহ

  1. খুব ভালো লাগলো। অরণ্যের দিনরাত্রি আমার দেখা ভালো মুভি গুলোর মধ্যে একটি। সত্যজিৎ রায়ের ছবি গল্প বলার মুন্সিয়ানা তেই অনবদ্য হয়ে ওঠে।

    উত্তরমুছুন
  2. খুব ভালো লাগলো। অরণ্যের দিনরাত্রি আমার দেখা ভালো মুভি গুলোর মধ্যে একটি। সত্যজিৎ রায়ের ছবি গল্প বলার মুন্সিয়ানা তেই অনবদ্য হয়ে ওঠে।

    উত্তরমুছুন
  3. খুব ভালো লাগলো। অরণ্যের দিনরাত্রি আমার দেখা ভালো মুভি গুলোর মধ্যে একটি। সত্যজিৎ রায়ের ছবি গল্প বলার মুন্সিয়ানা তেই অনবদ্য হয়ে ওঠে।

    উত্তরমুছুন