পোস্ট বার দেখা হয়েছে
পাবলো নেরুদা
চে
এক বীরের মৃত্যুতে দুঃখের অনুভূতি
আমরা যারা দেখেছি জীবনে আজকের এই ইতিহাস,
আমাদের শোকাহত আশার
এই মৃত্যু আর পুনরুত্থান,
আমরা যারা বেছে নিয়েছি সংগ্রাম
দেখেছি পতাকার বেড়ে ওঠা,
জেনেছি আমরা কথা বলেছে যারা সবচেয়ে কম
তারাই ছিল আমাদের একমাত্র নায়ক
আর বিজয়ের পর
এসেছে উচ্চকণ্ঠের চিৎকার
মুখ তাদের ভরে গেছে গর্বের উচ্চারণ
আর লোলঝরা কৃতিত্ব প্রচারে।
মানুষ কুটেছে মাথা:
আর বীর ফিরে যায় নীরবে।
তবে সেই নীরবতা পালন করে শোক
যতক্ষণ না বেদনায় তা আমাদের করে দেয় শ্বাসরুদ্ধ
পাহাড়ে মৃত্যুবরণ যখন ছিল
গুয়েভারার শোভিত আগুন।
কমানদান্তের সমাপ্তি আসে
গিরিখাতে খুন হওয়ার মধ্যে দিয়ে।
কেউ করেনি উচ্চারণ একটিও শব্দ।
ইন্ডিয়ান পল্লিতে করেনি কেউ অশ্রুপাত।
গির্জার ঘণ্টাঘরে উঠে আসেনি কেউ,
কারও হাতে ওঠেনি বন্দুক,
আর ওরা
নিহত কমানদান্তে এসেছিল যাদের বাঁচাতে,
তুলে নিয়েছে নগদ পুরস্কার।
সেসব ঘটনায় অনুতাপ করছে না কি প্রতিফলন,
যা ঘটেছে এখানে তার?
যা সত্য তা হয়নি বলা
তবে ধাতব এই দুর্ভাগ্য
ঢেকে রাখা হয় কাগজে।
পথ তো মাত্র শুরু হয়েছিল খুলে যেতে
আর পরাজয় যখন আসে
সেটা ছিল যেন
নীরবতার পাত্রে এসে পড়া কুঠার।
বলিভিয়া ফিরে গেছে তার সঞ্চিত বিদ্বেষে,
ফিরে গেছে মরচে ধরা গেরিলায়,
নিজের আপসহীন দুর্দশায়,
আর আতঙ্কিত জাদুকরের মতো
লজ্জার এই সৈনিক
অপরাধের অসহায় সব জেনারেল,
দক্ষতার সাথে লুকায়
যোদ্ধার মৃতদেহ,
যেন সেই দেহের আগুনে দগ্ধ হবে তারা।
তিক্ত জঙ্গল শুষে নেয়
আন্দোলন, পথ,
আর যা কিছু মাড়িয়ে গেছে
ধ্বংস হয়ে যাওয়া যোদ্ধাদের পা
পরগাছায় চুপিচুপি উচ্চারিত আজ
শেকড়ের সবুজ একটি কণ্ঠস্বর
আর বুনো হরিণ ফিরে আসে
বিস্ফোরণহীন শ্যামল অরণ্যে।
(পাবলো নেরুদা: জন্ম ১৯০৪ সালের ১২ জুলাই, চিলিতে। ১৯৭১ সালে সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন। এর দুবছর পর ১৯৭৩ সালে ২৩ সেপ্টেম্বর মারা যান এ কবি)
====
ডেরেক ওয়াল্কট
চে
ধূসর ধূলিময় খবরের কাগজের এই ছবিতে, দৃষ্টি যার
কারাভাজ্জিওর কঠোর নিয়মানুবর্তিতায় আঁকা ছবির মতো,
মরদেহ ছড়ায় শুভ্র মোমবাতির উজ্জ্বলতা এর শীতল বেদিতে—
বলিভিয়ার ইন্ডিয়ান কসাইয়ের প্রস্তর পাতের সেই দৃষ্টি
তাকায় যতক্ষণ না মোমের মাংস মার্বেলে শক্ত দানা বেঁধে
হয়ে ওঠে আেন্দজের শিরাযুক্ত শুভ্র লৌহদণ্ড;
তোমার নিজের ভয় থেকে, মূর্খ, বেড়ে ওঠে এর স্তম্ভ।
তোমার সন্দেহে হোঁচট খায় সে, আর তোমার ক্ষমার জন্য
পুড়ে হয়ে যায় ধূসর ছাই, সুবাসিত তুষার থেকে অনেক দূরে।
(ডেরেক ওয়াল্কট: জন্ম ১৯৩০ সালের ২৩ জানুয়ারি, সেন্ট লুসিয়ার ক্যাস্ট্রেস শহরে। কবিতা ছাড়াও নাটক লিখে সুখ্যাতি অর্জন করেছেন। সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন ১৯৯২ সালে)
====
রাফায়েল আলবের্তি
এর্নেস্তো চে গুয়েভারাকে
তোমাকে দেখেছি আমি যখন ছিলে তুমি বালক
আর্জেন্টিনার কর্দোভার সেই গ্রামীণ পরিবেশে
খেলছিলে তুমি পপলারগাছের ছায়ায় আর ভুট্টার খেতে,
পুরোনো কাছারিবাড়ির গরু, দিনমজুরদের ভিড়ে...
এরপর আর হয়নি দেখা আমাদের সেই দিনের আগে
যখন আমি জানতে পারি তুমি হয়ে গেছ রক্তমাখা আলো,
উত্তর আকাশের সেই উজ্জ্বল তারা,
প্রতিটি মুহূর্তে যেদিকে আমাদের রাখতে হয় চোখ
সেই সত্যকে বুঝে নিতে কোথায় আমরা দাঁড়িয়ে।
(রাফায়েল আলবের্তি: জন্ম ১৯০২ সালের ১৬ ডিসেম্বর, স্পেেন। স্প্যানিশ সাহিত্যের তথাকথিত রুপািল সময়ের উল্লেখযোগ্য কবি। মারা গেছেন ১৯৯৯–এর ২৮ অক্টোবর)
====
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
চে গুয়েভারার প্রতি
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়
আমার ঠোঁট শুকনো হয়ে আসে, বুকের ভেতরটা ফাঁকা
আত্মায় অভিশ্রান্ত বৃষ্টিপতনের শব্দ
শৈশব থেকে বিষণ্ন দীর্ঘশ্বাস
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরধী করে দেয়-
বোলিভিয়ার জঙ্গলে নীল প্যান্টালুন পরা
তোমার ছিন্নভিন্ন শরীর
তোমার খোলা বুকের মধ্যখান দিয়ে
নেমে গেছে
শুকনো রক্তের রেখা
চোখ দুটি চেয়ে আছে
সেই দৃষ্টি এক গোলার্ধ থেকে চুটে আসে অন্য গোলার্ধে
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।
শৈশব থেকে মধ্য যৌবন পর্যন্ত দীর্ঘ দৃষ্টিপাত-
আমারও কথা ছিল হাতিয়ার নিয়ে তোমার পাশে দাঁড়াবার
আমারও কথা ছিল জঙ্গলে কাদায় পাথরের গুহায়
লুকিয়ে থেকে
সংগ্রামের চরম মুহূর্তটির জন্য প্রস্তুত হওয়ার
আমারও কথা ছিল রাইফেলের কুঁদো বুকে চেপে প্রবল হুঙ্কারে
ছুটে যাওয়ার
আমারও কথা ছিল ছিন্নভিন্ন লাশ ও গরম রক্তের ফোয়ারার মধ্যে
বিজয়-সঙ্গীত শোনাবার-
কিন্তু আমার অনবরত দেরি হয়ে যাচ্ছে!
এতকাল আমি এক, আমি অপমান সয়ে মুখ নিচু করেছি
কিন্তু আমি হেরে যাই নি, আমি মেনে নিই নি
আমি ট্রেনের জানলার পাশে, নদীর নির্জন রাস্তায়, ফাঁকা
মাঠের আলপথে, শ্মশানতলায়
আকাশের কাছে, বৃষ্টির কাছে বৃক্ষের কাছে, হঠাৎ-ওঠা
ঘূর্ণি ধুলোর ঝড়ের কাছে
আমার শপথ শুনিয়েছি, আমি প্রস্তুত হচ্ছি, আমি
সব কিছুর নিজস্ব প্রতিশোধ নেবো
আমি আমার ফিরে আসবো
আমার হাতিয়অরহীন হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়েছে, শক্ত হয়েছে চোয়াল,
মনে মনে বারবার বলেছি, ফিরে আসবো!
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়-
আমি এখনও প্রস্তুত হতে পারি নি, আমার অনবরত
দেরি হয়ে যাচ্ছে
আমি এখনও সুড়ঙ্গের মধ্যে আধো-আলো ছায়ার দিকে রয়ে গেছি,
আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়!
(সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বিশ শতকের শেষভাগে সক্রিয় একজন প্রথিতযশা বাঙালি সাহিত্যিক। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুর পূর্ববর্তী চার দশক তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসাবে সর্ববৈশ্বিক বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিলেন )
1 মন্তব্যসমূহ
এই সব লেখার মূল্যায়ন করার ক্ষমতা আমাদের নেই,শুধু সমৃদ্ধ হওয়া যায়।
উত্তরমুছুন