দর্পণ || বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নির্বাচিত উক্তি




পোস্ট বার দেখা হয়েছে
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উক্তি । জনপ্রিয় ও মনছোঁয়া বাণী সমাবেশ
প্রথম আধুনিক বাংলা ঔপন্যাসিক হিসেবে খ্যাত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ২৬ জুন ১৮৩৮ সালে জন্মগ্রহণ করে এবং ৮ এপ্রিল ১৮৮৯ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি একাধারে বাঙ্গালী সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও ব্রিটিশ সরকারের আওতাধীন সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন। তবে সরকারী চাকুরীজীবির চেয়ে তিনি লেখক এবং হিন্দু পুনর্জাগরণের দার্শনিক হিসেবেই বেশি প্রখ্যাত ছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত উল্লেখযোগ্য রচনাবলী – দুর্গেশনন্দিনী, কপালকুন্ডুলা, বিষবৃক্ষ, কৃষ্ণকান্তের উইল, রাজসিংহ, কমলাকান্তের দপ্তর ইত্যাদি। এসকল গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধে তিনি সময় উপযোগী অসংখ্য উক্তি ও বাণী করে গিয়েছেন। যা কালের সীমা ছাড়িয়ে আজো জ্বলজ্বল করছে এই সময়ে এবং অতিক্রম করে যাবে অনেক প্রজন্ম। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উক্তি সমূহের কিছু অংশ নিয়েই আজকের বিশেষ নিবেদন --

।। জীবন দর্শন ও জীবনবোধ নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উক্তি।।

★ “আত্মোপকারীকে বনবাসে বিসর্জন করা তাহাদিগের প্রকৃতি, তাহারা চিরকাল আত্মোপকারীকে বনবাস দিবে–কিন্তু যত বার বনবাসিত করুক না কেন, পরের কাষ্ঠাহরণ করা যাহার স্বভাব, সে পুনর্বার পরের কাষ্ঠাহরণে যাইবে। তুমি অধম–তাই বলিয়া আমি উত্তম না হইব কেন?”
( ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাস )

★“মরিলে যদি রণজয় হইত,তবে মরিতাম। বৃথা মৃত্যু বীরের ধর্ম নহে।” 
( ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস)

★“পাহাড় যত নিকট দেখায়, তত নিকট নয়।”
( ‘রাজসিংহ, ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ, অষ্টম খণ্ড)

★ “ওপারে যে যন্ত্রণার কথা শুনিতে পাও, সে আমরা এই পার হইতে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাই। আমাদের এ জন্মের সঞ্চিত পাপগুলি আমরা গাঁটরি বাঁধিয়া, বৈতরিণীর সেই ক্ষেয়ারীর ক্ষেয়ায় বোঝাই দিয়া, বিনা কড়িতে পার করিয়া লইয়া যাই। পরে যমালয়ে গিয়া গাঁটরি খুলিয়া ধীরে সুস্থে সেই ঐশ্বর্য্য একা একা ভোগ করি।”

( ‘সীতারাম, একাদশ পরিচ্ছেদ, প্রথম খণ্ড’ )

★“মীরজাফর গুলি খায় ও ঘুমায়। ইংরেজ টাকা আদায় করে ও ডেসপাচ লেখে। বাঙ্গালি কাঁদে আর উৎসন্ন যায়।”  
( ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস)

★ “মনুষ্যের সুখ মনুষ্যত্বে, এই মনুষ্যত্ব সকল বৃত্তিগুলির উপযুক্ত স্ফূর্তি, পরিণতি ও সামঞ্জস্যের সাপেক্ষ। মনুষ্যের সমুদয় শক্তিগুলিকে চারি শ্রেণীতে বিভক্ত করা গেল: ১. শারীরিকী, ২. জ্ঞানার্জনী, ৩. কার্যকারিনী, ৪. চিত্তরঞ্জিনী। এই চতুর্বিদ বৃত্তির উপযুক্ত স্ফূর্তি, পরিণতি ও সামঞ্জস্যই মনুষ্যত্ব।”

★ “যদি মনে এমন বুঝিতে পারেন যে, লিখিয়া দেশের বা মনুষ্যজাতির কিছু মঙ্গল সাধন করিতে পারেন, অথবা সৌন্দর্য সৃষ্টি করিতে পারেন, তবে অবশ্য লিখিবেন। যাঁহারা অন্য উদ্দেশ্যে লেখেন, তাঁহাদিগকে যাত্রাওয়ালা প্রভৃতি নীচ ব্যবসায়ীদিগের সঙ্গে গণ্য করা যাইতে পারে।”

জীবন দর্শন যত উন্নত, গভীর তিনি পেয়েছেন পাঠকের মনে শীর্ষস্থান। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সময়ে তাঁর চেয়ে জীবনবোধ সম্পন্ন সাহিত্যিক ছিল না বললেই চলে। যার উদাহরণ আমরা তাঁর করা চয়ন এবং বাণী থেকে পেয়েছি।

★ “জ্ঞানে মনুষ্য মাত্রেরই তুল্যাধিকার। যদি সে সর্বজনের প্রাপ্য ধনকে তুমি এমত দুরূহ ভাষায় নিবদ্ধ রাখ যে, কেবল যে কয়জন পরিশ্রম করিয়া সেই ভাষা শিখিয়াছে তাহারা ভিন্ন আর কেহ তাহা পাইতে পারিবে না, তবে তুমি অধিকাংশ মানুষকে তাহাদিগের স্বত্ব হইতে বঞ্চিত করিলে। তুমি সেখানে বঞ্চক মাত্র।”

★ যাহাতে সাধারণের উন্নতি নাই, তাহাতে কাহারই উন্নতি সিদ্ধ হইতে পারে না।…অনেকে বিবেচনা করেন যে, বালকের পাঠোপযোগী অতি সরল কথা ভিন্ন কিছুই সাধারণের বোধগম্য বা পাঠ্য হয় না। এই বিশ্বাসের উপর নির্ভর করিয়া যাঁহারা লিখিতে প্রবৃত্ত হয়েন, তাহাদিগের রচনা কেহই পড়ে না। যাহা সুশিক্ষিত ব্যক্তির পাঠোপযোগী নহে, তাহা কেহই পড়িবে না, যাহা উত্তম তাহা সকলেই পড়িতে চাহে, যে না-বুঝিতে পারে, সে বুঝিতে যত্ন করে।”

★ “কাব্যগ্রন্থ মনুষ্যজীবনের কঠিন সমস্যা সকলের ব্যাখ্যা মাত্র, যিনি একথা না বুঝিয়া, একথা বিস্মৃত হইয়া, কেবল গল্পের অনুরোধে উপন্যাস পাঠে নিযুক্ত হয়েন, তিনি উপন্যাস পাঠ না করিলেই বাধিত হই।”

★“কাব্যের উদ্দেশ্যে নীতিজ্ঞান নহে; কিন্তু নীতিজ্ঞানের যে উদ্দেশ্য, কাব্যেরও সেই উদ্দেশ্য। কাব্যের গৌণ উদ্দেশ্য মনুষ্যের চিত্তোত্কর্ষ সাধন—চিত্তশুদ্ধি জনন। কবিরা জগতের শিক্ষাদাতা, কিন্তু নীতিব্যাখ্যার দ্বারা তাঁহারা শিক্ষা দেন না। কথাচ্ছলেও নীতিশিক্ষা দেন না। তাঁহারা সৌন্দর্যের চরমোত্কর্ষ সৃজনের দ্বারা চিত্তশুদ্ধি বিধান করেন। এই সৌন্দর্যের চরমোত্কর্ষের সৃষ্টি কাব্যের মুখ্য উদ্দেশ্য।”

★“যে কণ্ঠ হইতে কাতরের জন্য কাতরোক্তি নিঃসৃত না হইল, সে কণ্ঠ রুদ্ধ হউক। যে লেখনি আর্তের উপকারার্থে না-লিখিল, সে লেখনি নিষ্ফলা হউক।”

★“সাহিত্যের আলোচনায় সুখ আছে বটে, কিন্তু যে সুখ তোমার উদ্দেশ্য এবং প্রাপ্য হওয়া উচিত, সাহিত্যের সুখ তাহার ক্ষুদ্রাংশ মাত্র।”

★ “সাহিত্যও ধর্ম ছাড়া নহে। কেননা, সাহিত্য সত্যমূলক। যাহা সত্য, তাহা ধর্ম। যদি এমন কুসাহিত্য থাকে যে তাহা অসত্যমূলক ও অধর্মময়, তবে তাহার পাঠে দুরাত্মা বা বিকৃতরুচি পাঠক ভিন্ন কেহ সুখী হয় না।”

★ “গ্রন্থ পাঠ করিয়া পাঠক যে সুখ লাভ বা জ্ঞান লাভ করিবেন, তাহা অধিকতর স্পষ্টীকৃত বা তাহার বৃদ্ধি করা, গ্রন্থকার যেখানে ভ্রান্ত হইয়াছেন সেখানে ভ্রম সংশোধন করা, যে গ্রন্থে সাধারণের অনিষ্ট হইতে পারে সেই গ্রন্থের অনিষ্টকারিতা সাধারণের নিকট প্রতীয়মান করা—এইগুলি সমালোচনার উদ্দেশ্য।”

★“এক একখানি প্রস্তর পৃথক করিয়া দেখিলে তাজমহলের গৌরব বুঝিতে পারা যায় না। এক একটি বৃক্ষ পৃথক পৃথক করিয়া দেখিলে উদ্যানের শোভা অনুভব করা যায় না। এক একটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বর্ণনা করিয়া মনুষ্যমূর্তির অনির্বচনীয় শোভা বর্ণনা করা যায় না। কোটি কলস জলের আলোচনায় সাগর-মাহাত্ম্য অনুভব করা যায় না। সেইরূপ কাব্যগ্রন্থের।”

জীবনবোধ এবং জীবন দর্শনের উপর ভিত্তি করেই স্থাপিত হয় কবি, সাহিত্যিকদের রচনা এবং মনীষীদের জীবন। যা জীবন দর্শন যত উন্নত, গভীর তিনি পেয়েছেন পাঠকের মনে শীর্ষস্থান। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সময়ে তাঁর চেয়ে জীবনবোধ সম্পন্ন সাহিত্যিক ছিল না বললেই চলে। যার উদাহরণ আমরা তাঁর করা চয়ন এবং বাণী থেকে পেয়েছি। 
----------------
(উপরোক্ত উক্তিসমূহ বঙ্কিম রচনাবলী ও বিভিন্ন বাংলা ব্লগ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ




  1. কাব্যের উদ্দেশ্য নীতি জ্ঞান নহে ......
    যে কণ্ঠ হইতে কাতরের জন্য ....

    সমস্ত উক্তিতে তো সমৃদ্ধ হওয়ারই ৷ তার মধ্যে এই দু'টি উক্তি আমাকে ভাবিয়ে দিলো

    উত্তরমুছুন