দর্পণ || মুক্ত গদ্য || পরিনির্বাণ ~হেমন্ত সরখেল




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

পরিনির্বাণ  

হেমন্ত সরখেল


দিন ল্যাংটো হয়ে এল ক্রমে ক্রমে | ঐ ভদ্দরলোকের ভাষায় যাকে বেলা বাড়া বলে | অমিতায়তন নিয়ে বাদল চাদ্ধারে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলছে খ এর সীমানায় | গতকাল রাতে যখন গেরিলা প্রক্রিয়ায় উপর্যুপরি গুঁতিয়েছে অন্নপূর্ণা রেঞ্জের এই সানুদেশে তখনই বোঝা গেছে, এ সকাল সিক্তঘাসবার্তা আনবে | রান্নার গ্যাস শেষ | ইচ্ছে হয়, ধেই ধেই করে নাচি | একটি পেটের কজ্জ্বল কতো ধামসা-মাদল এঁকে দিতে পারে পাষণ্ড বুদ্ধির দেওয়ালে, সেটা এখন অনুভূত হয় | 


                 নেপালের ইনরুবা জেলার উজ্জ্বল গ্রাম কোশীকাপুরের যে বাজার,সেই রামধুনি মার্কেটে টুকরো কাঠের বোঝা কিনতে পাওয়া যায় | নেরু শ' টাকা | নেরু হলো গিয়ে তোমার নেপালী রপেইয়া | আর শ' টাকা মানে আমাগো বাষট্টি-পঞ্চাশ | ঐ যেখানে হাতি স্নান করে, নীলগাই, বাইসন মাখে রোদ, সে জংলী জীবনের পিঠে জন্মেছে যত হরিৎ, টুপ টাপ খসে পড়ে প্রশাখা জুয়ারী প্রকৃতির পতনেচ্ছায়,যে খণ্ডাংশের 'দাম নেই কো কোনো' তোমাদের জগতে, মস্তকোপরি সারি সারি রমনীর সারি, বয়ে আনে জ্বলাবন, পেটের কজ্জ্বলের রেখা ধূসর করে নেবে বলে |


                 সুরারোপ কাকে বলে সেটা জানতে গেছিলাম থাংগা ডার্লং এর কাছে, মুরুআইবাড়ি, ত্রিপুরায় | কুমারঘাট স্টেশন থেকে গাড়ি ভাড়া করে | ধরিত্রীর বুকে প্রতিটি বীজের মাথা তোলার সংগ্রাম ভিন্ন ধারা নেয় | কেউ মোচা'র চপ খায়, কেউ দূর থেকে দেখে, কলা'র ফুলে কামিনী লেপ্টে আছে | টালমাটাল পাদবিক্ষেপে যে কিশোরী রামধুনি বাজারে বয়ে আনে শীর্ণকায় সখুয়া'র ডাল, সে আঁটি নিবৃত্ত করবে কজ্জ্বল,তার সেই উৎসাহী বসে থাকা চোখ, উন্মুখ শরীরী বলন, বিশ্বাস জাগায় | বুনো কপোত উড়ে যায় শস্যদানার অন্বেষণে | ঝোঁক ভেঙে একলপ্তে জেগে উঠি তাদের পক্ষঝাপটের রবে | আমার কজ্জ্বল দূরীকরণের প্রকল্প এবার ফিতে কাটবে সগৌরবে |


                 আমাদের কালাকেষ্ট মথুরার অপেক্ষায় কোনকালেই থাকেনি | না রেখেছে বৃন্দাবনী ছুতো | অরুণ কোশীর গায়ে গা ঠেকিয়ে যেখানে এখনও বাড়ছে অন্নপূর্ণার উত্থিত তলদেশ, সে ভঙ্গিল পর্বতগাত্রে নিজেকে ছুঁইয়ে রেখে জলধি নিজেকে ব্যাপ্ত করে আমার আখিড়কী দেহ | নগ্নতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ যদি কিছু থাকে, আমার মনে হয়, তা'হল বৃষ্টি | এত মসৃণ প্রারম্ভিক ঝিরঝির, এত পেলব তার উত্তাপখর্বকারী শক্তি, এত মনমোহিনী তার স্খলন, জুয়ারি থেকে পূজারী একদিঠে দিশেহারা হয় প্রেমে | যেন ব্রহ্মার তুলি থেকে একটু একটু করে উন্মোচনের পথে উৎসারিত অবয়ব,নন্দনসাম্রাজ্ঞী কোন | যেন অধিশ্বরীর আগমনের শঙ্খধ্বনি | আশ্লেষে পান করতে করতে রূপমাধুরী বিচারে ডুবে যায় মন- এই চর্ম,শিরা,মাংস,হাড়,মজ্জা পরিশেষে কতোই না মৃত্যুশীতল, কিছু ধোঁয়া, কিছু ছাই, কিছু মাটি | সমস্ত স্তরীভূত উত্তাপ নিমেষে জমাট বর্ফীলা এহসাসে | তারও পর, নিজেকে ছেড়ে বেরিয়ে আসা যেন এক পরকিয়াপ্রবেশ | আদি নেই,অন্ত নেই, শব্দ নেই, বাতাস নেই, সব নেই-এর মাঝে একা জাগরিত 'অস্তি', নিজের থেকে নিজের এই স্খলন আর কে বোঝাবে আমায়, বরিষ ছাড়া!আমিও তাই অধরা আনন্দে আত্মহারা অপরূপ সাঁঝে সাজতে বসি তার আগমনে | তুলসীমঞ্চের ধুপ কাঠি যে কোন একটি ফোঁটায় নির্বাপিত হলে খুশি হয় মন, কেমন হলো? যাঁর আরতিতে এ ধূমাবতী আয়োজন তোমার, সে কী চায়, কেন বোঝো না তুমি? বোঝো না, তাই তো বিন্দুতে নিভে নিভে যাও | দাতা! কী আছে মনে তোমার ?


                 অঝোরে তুমি এলে, ধুয়ে ফেলি এই অ্যাত্তো অ্যাত্তো চিন্তনডোর | চকচকে আঁধার প্রমাদ জাগায় মনে, এই বুঝি জাগলো কোনো দ্যুতি, তমসার বুক চিরে আলেকমালায় সুশোভিত করে মুহূর্তে জানিয়ে যাবে কেউ- এই জীবন, শুধুই এক উন্মুক্ত অবিরল জলধারা, এক রূপান্তরকামী প্রবৃত্তি, যা তোমায় বলে- দ্যাখো, তুমি কী ছিলে, কী হ'লে, কী হয়ে যাবে, গলে মিশে গেলে |

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ