শব্দমালা || ধারাবাহিক কলম || পঞ্চম পর্ব || জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

পিপলান্ট্রি

মেয়ের অকাল মৃত্যুতে শোকে পাথর প্রাণোচ্ছল মানুষটি। বড়োই দুর্বিষহ আজ জীবন।


চারপাশে মার্বেল পাথরের খনি-খাদান।

রুক্ষ্ম পাথুরে জমি। সবুজহীন গ্রামের পানীয় জলের ঘোরতর আকাল। অশিক্ষা আর কুসংস্কারের যাঁতাকলে বিবর্ণ মানুষ৷ পরিবারে কন্যা জন্মানো এখনে অভিশাপের নামান্তর৷ 


একদিন অশ্রু থেকেই জ্বলে উঠলো আগুন৷ আগুন দিলো ঘুরে দাঁড়ানোর মন্ত্র। নতুন শপথে উঠে দাঁড়ালেন কন্যা-হারানো-পিতা শ্যামসুন্দর। শ্যামসুন্দর পালিয়াল। 


এখনও স্বপ্নের মধ্যে আসে তাঁর কন্যা৷ কন্যা হারানোর কষ্ট বোঝেন শ্যামসুন্দর। বোঝেন মেয়েকে নিয়ে মা-বাবার দুর্ভাবনা। 

সমস্যার গভীরে পৌঁছোতে চান তিনি। অশিক্ষা আর দারিদ্র্যই যে সব সমস্যার মূল তা বোঝালেন গ্রামের মানুষকে৷ গ্রাম পঞ্চায়েতের অগ্রণী মুখ, সরপঞ্চ হিসেবে ছোট ছোট জলাধার গড়ে তিনি উৎসাহ দিলেন কৃষিকাজে। শিশু কন্যার সুরক্ষার জন্য পরিকল্পনা করলেন এক অভিনব তহবিল৷ 


মানুষকে বোঝালেন— কন্যাশিশু পৃথিবীতে এলে দুশ্চিন্তা নয়, পড়াশোনা শিখিয়ে স্বাবলম্বী করতে হবে মেয়েকে। সেই মেয়েই একদিন শরিক হবে প্রগতির। উজ্জ্বল করবে পরিবার ও গ্রামের মুখ৷ তাকে নিয়েই গর্ব করবে দেশ৷


সূচনায় এসেছিল নানান বাধা৷ গড্ডলীকা প্রবাহে বয়ে চলা শক্তি গড়তে চেয়েছিল প্রতিরোধ৷ কিন্তু শুভ প্রচেষ্টার গভীরে সতত জেগে থাকে আবহমানের আলো৷ সব প্রতিকূলতা চূর্ণ করে নতুন স্বপ্নে যুগে যুগে মানুষকে পথ দেখায় সে৷


ঘন কুয়াশায় জেগে আছে বাতিঘর

নতুন শপথ সবুজের বরাভয়

হাজারো দূষণ, সংঘাতময় দিনে

লিখেছে মানুষ বিজয়ীর প্রত্যয়। 


মুছে গেছে আজ শতাব্দী হাহাকার

সমাজে স্বাগত শিশুকন্যার প্রাণ

বেঁধেছে মানুষ বৃক্ষশরীরে রাখি

দিগন্তে ভাসে চেতনার আলোগান।


শ্যামসুন্দরের পরিকল্পনায় এখন কন্যাশিশু জন্মানোর পর সারা গ্রাম মাতে খুশির উৎসবে৷ ১১১টি বৃক্ষরোপণে উদ্ভাসিত হয় নবজাতকের আগমনী বার্তা৷ গাছের শরীরে বাঁধা হয় মাঙ্গলিক রাখি৷

মা-বাবা সদ্যোজাত কন্যার নামে জমা করেন দশ হাজার টাকা। গ্রামবাসীরা চাঁদা তুলে দেন একুশ হাজার। পুরো টাকাটাই কন্যার ভবিষ্যৎ সুরক্ষায় রাখা হয় ব্যাংকে। মেয়ের বিয়ে বা উচ্চশিক্ষার জন্য ১৮ বছর পর সুদ-আসলে পুরো টাকাটাই তুলতে পারেন কন্যার বাবা-মা। 


গ্রামের মানুষের উপস্থিতিতে রীতিমত আদালতের অঙ্গীকার পত্রে স্বাক্ষর করেন শিশু কন্যার অভিভাবক৷ তাতে লেখা থাকে পরিবারের কেউ কখনও পারবে না কোন কন্যাভ্রুণ হত্যা করতে, নিতে হবে মেয়ের যত্ন, পড়াশুনো অবশ্যই করাতে হবে আর পরিচর্যা করতে হবে ১১১টি বৃক্ষের৷

সদিচ্ছা আর কঠিন পরিশ্রমের সুফল ফলেছে। একসময়ের রুক্ষ্ম বন্ধুর জনপদ আজ এক চিরসবুজ নন্দনকানন। গ্রামে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে সাড়ে তিন লক্ষ মূল্যবান ঔষধি বৃক্ষ। পোকামাকড় থেকে গাছগুলোকে সুরক্ষিত রাখতে গড়ে তোলা হয়েছে অ্যালোভেরার বলয়। 


আজ গ্রামে গড়ে উঠেছে মেডিসিন পার্ক। অ্যালোভেরা প্লান্টে তৈরি হচ্ছে শ্যাম্পু, ক্রিম থেকে স্বাস্থ্য-পানীয়। চারপাশে গড়ে উঠেছে জলাধার। কৃষিকাজে স্বাবলম্বী, মদ্যপান বর্জিত উপমাবিরল পরিবেশবান্ধব এই জনপদ পিপলান্ট্রি আজ দেশের গর্ব৷ গ্রাম থেকে বিদায় নিয়েছে দারিদ্র। নিজেদের বসানো গাছের ফল, ফুল বিক্রি করেও উপার্জন করছেন গ্রামের মানুষ।


অনেক রাজ্য যখন কন্যাভ্রূণ হত্যার অভিশপ্ত নজির রুখতে ব্যর্থ, যখন লিঙ্গ বৈষম্য নিয়ে ভারসাম্য হারাচ্ছে 4G প্রযুক্তির সমাজ, তখন কন্যা সন্তানের জন্মকে আশীর্বাদ বলে মনে করেন পিপলান্ট্রি গ্রামের মানুষ। এখন বছরে গড়ে ৬০-৬৫ টি কন্যাসন্তান পৃথিবীর আলো দেখে এই গ্রামে৷

একক মানুষের স্বপ্ন আজ শত সহস্র পুষ্পে বিকশিত। প্রতিটি পরিবারে পৌঁছেছে শিক্ষার আলো। স্বাবলম্বী হওয়ার পথে দৃপ্ততায় এগোচ্ছে আগামী প্রজন্ম। 

রাজস্থানের মরুভূমি রুক্ষতায় পিপলান্ট্রি এক স্বপ্নজয়ের সোনালী উপাখ্যান, মহান কীর্তির আলোকবর্তিকা। 

আজও শ্যামসুন্দর স্বপ্ন দেখেন। প্রকৃতিলগ্ন জীবনের বার্তা পৌঁছে দেন মানুষের কাছে। অকালে হারিয়ে যাওয়া "কিরণকে", খুঁজে পান হাজারো প্রাণোচ্ছল কন্যার মধ্যে।


প্রিয় কন্যাকে বাঁচাতে পারোনি তুমি

কীর্তিতে আজ হাজার কন্যা-ত্রাতা

নবাগতা কুঁড়ি পেয়েছে আশার আলো

অগ্রণী প্রাণ প্রেরণার উদগাতা।

 

প্রতি গ্রামে থাক শ্যামসুন্দর এক

প্রগতির সাথে মিশে যাক ভালোবাসা 

সুখে-শান্তিতে বেঁচে থাক হাসিমুখ

জীবনে মিশুক জ্যোৎস্নার প্রত্যাশা।


                   একটি গান 



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ