দর্পণ || সাপ্তাহিক সেরা || কবিতা ও মুক্ত গদ্য




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

মেঘ তোমায় || জয়া


বৃষ্টির কবিতা লেখার কথা ছিল না কোনদিও। 
সেই টেপ ফ্রক পরা বয়েস থেকেই, 
যখন পাঠ্যপুস্তকের তলায় মায়ের ভয়ে সে লুকিয়ে ফেলতো চাঁদের পাহাড়, পোস্ট মাষ্টার, নৌকডুবি কিংবা হাঁসুলি বাঁকের উপকথা। 
সেইথেকে বারংবার বৃষ্টি ভাবতো গদ্য লিখবে, লিখবে ফুল্লেলময় কাহিনী। 
কিন্তু লিখতে পারলো কোই? লিখতে গেলে নোনা জলে তার বুক ভাসে....মানুষের জীবনে ওঠা পড়া, চাওয়া পাওয়া, বিশ্বাস আবিশ্বাস, ঠিক ভুল, সব যেন গোল পাকিয়ে যায়। বৃষ্টি আকাশ হতে চায় নি কখনো, মাটি আঁকড়ে বাঁচতে চায়।  
অবাক চোখে সে দেখে..সত্যি বাঁচে মিথ্যা হয়ে, 
আর মিথ্যে বাঁচে সত্যি হয়ে। 
কোন টা যে কথার কথা আর কোন টা যে মনের কথা আজও ঠিক করে বুঝতে পারে না বৃষ্টি। 

হঠাৎ এক বাদল দিনে মেঘের ঘনঘটা। 
দূরের আকাশ পানে চেয়ে দেখে মেঘের গায়ে অন্তরাগের ছটা লেগে মনোহর রূপ ধারণ করেছে। বৃষ্টির সেদিকে পানে চেয়ে মনে হলো, যদি লিখে দিতে পারতাম তাহলে লিখে দিতাম ...মেঘে মেঘে শিমুল পলাশের বনে বনে কে যেন মুঠো মুঠো আবির ছড়িয়ে দিয়েছে। ওই ভাব নিয়ে শুরু হলো যাত্রা। মেঘের সাথে কথা বলা আর লেখা।   
শব্দ যন্ত্রণায় সোঁদামাটির গন্ধে,বীজ বপনের স্তরে স্তরে কথকতা। আদৌ কি সেটা কবিতা হলো? 
বৃষ্টি জানেনা। জানতেও চায় না। লেখার আনন্দে সে লিখে যায়। মেঘ জানলো কি? পড়লো কি তার লেখা? জানেনা। বাতাসের ঠিকানায় শিমুল পলাশের বনে,আবির রাঙানো আকাশের গায়ে বৃষ্টি নীরব চিঠি পাঠায় দূর বহুদূরে। 

ইতি, মেঘ তোমায়...!


**********************

শুদ্ধি ।। প্রহ্লাদ ভৌমিক 


অরণ্যের চারপাশে ছড়িয়ে থাকা নিষিদ্ধ জ্যোৎস্নায়
গাঢ় হয়ে উঠছে নিরিবিলি নির্জনতা
হঠাৎ নিভে যাওয়া বিজলি বাতির আলোর মতো
চোখ বুজে যাওয়া অন্ধ স্তব্ধতা
ক্রমশঃ ঝুঁকে আসে তার নিভৃত ছায়া
ও সুর সমাহিত তার অদ্ভুত স্বর 
আর গড়িয়ে যেতে থাকে গভীর উদ্বেগের ভেতর

মনে হয় উৎকন্ঠার ফল্গু স্রোতে ভেসে আসে
নির্বেদ দিন ও রদ্ধশ্বাস মুহূর্ত
 সে সব চিহ্নিত করে একে একে
গভীর উদ্বেগের ভেতর থেকে নামিয়ে আনো
পথের ধুলোয়...নামিয়ে আনো একে একে
যাপনের নির্মম সত্যের শব্দ ও অক্ষরে

জাগিয়ে তোল জীবনের যত আকুলতা

স্বজন কিনা জানিনা
সুজন ভেবেই এই অন্তহীন সংযোগ ও সংলগ্নতা
সুজন ভেবেই জীবনের সমস্ত মুগ্ধতা আমি
এঁকে যেতে চাই ভালোবাসার রঙে আজীবন

ভালোবাসা যতটা গভীর মায়ার
ভালোবাসা ততটা মায়াবী কিন্তু নয়

ভালোবাসাতেই প্রকৃত চিত্ত শুদ্ধি ...।

**********************

চিলেকোঠা || জয়া চক্রবর্তী সোমা 


অবর্জনা, বাতিল জিনিষ তাদের ভিড়েই ঠাসা
ঘুলঘুলিতে চড়াইপাখির পরিবারের বাসা
সেখান থেকে খুঁজলে পাবে মাঞ্জা লাটাই ঘুড়ি
এককোনাতে কোথায় যেন পুতুল খেলার ঝুড়ি
হাতড়ে খুঁজে কুলুঙ্গিতে আদুরে শৈশব
রাজকন্যা রাজপুত্র দৈত্যপুরী সব
জমা হত। সিঁড়ির মাথায় ছোট্ট চিলেকোঠা,
দুপুরবেলায় চোখ এড়িয়ে পা টিপে সেই ওঠা
আচার বোয়াম রোদ্দুর খায়, তারপর সেই তাকে
চিলেকোঠায় এনেই সেসব জমা করে রাখে।
সেসব চুরি.. ধ্যাৎ চুরি নয়.. একটু নিয়ে খাওয়া
আমসী তেঁতুল আর কত কি,যায় কি সেসব পাওয়া
জং ধরা এক ট্রাঙ্ক ছিল, আর ট্রাংকে টুকি টাকি
ঝাপ্সা ছবি, বিয়ের কার্ড আর ভাঙা লক্ষ্মীর ঝাঁপি।
সেতার ছিল ছেঁড়া তারে, আরও অনেক কিছু
খুঁজতে গেলে হাতড়ে ফেরা স্মৃতির পিছু পিছু।
খুঁজেও পেলাম সে সব বাতিল...না থাক দাম তার
দাম ছিল যে ছোট্টবেলার চিলেকোঠাটার।

**********************

বিসর্জনের সুর || শিবানী বাগচী



গুমোট বাধা হিমশ্বাসে কানপাতা আবেশে শুনি,
পচা গলা লাশের গোমড়ানো আস্ফালন।

ওরা ক্ষতের গভীরে দগদগে যন্ত্রণায়, ঘাঁড় গুঁজে পড়ে থাকে প্রতি মুহূর্তের ক্লান্তি মেখে।

ম ম ওঠা ঘণ নিঃশ্বাসে ফাটা ঠোঁট উপেক্ষা করে মুক্তির উল্লাসে ওরা চিৎকার করে তৃস্নার্ত কাকের মতো।

দম বন্ধ হওয়া শ্রান্ত শরীর জুড়ে ধীর পায়ে 
নেমে আসে স্তব্ধতা নৈঃশব্দকে ছুঁয়ে।

বিরহের চুঁইয়ে পড়া নোনা জলে ডব ডব করে শীতল শরীর, আর স্বজনের বুকের জমাট বাধা শোক, বিকট আর্তনাদে শ্রান্ত শরীর ভিজিয়ে দেয় বৃষ্টি ফোঁটার মতো বিসর্জনের সুর তুলে!

মরণ তুই বুঝি এমনই নিঠুর নির্দয়?


**********************

আমি কন্যা ভ্রূণ বলছি || প্রশান্ত মুখার্জ্জী



মায়ের জঠরে বিন্দু বিন্দু রক্তকণা হয়ে, সবেমাত্র জমাট বাঁধছি তখন!!

ঈশ্বর চাই ঈশ্বর, চিৎকার করে উঠেছিল ঠাম্মি! বাবাকে বলেছিল, বুঝলি সুবোধ ঈশ্বর চাই আমার ঈশ্বর! বংশের প্রদীপ চাই আমার, প্রদীপ!!

একদিন, ঠাম্মির আদেশেই পতিতা পল্লী থেকে, কিছুটা মাটি নিয়ে এসে মায়ের জঠরে প্রলেপ লাগিয়ে দিয়ে বাবা বলেছিল, নাও মা তোমার কাজটা করেই দিলাম!!

পাশের বাড়ির জেঠিমা মাকে বলেছিল, অনুসূয়া দেখো, এবার কিন্তু তোমার ঘরে একটা ফুটফুটে রাজকন‍্যার জন্ম হবে।।

বাবা, দাদু, ঠাম্মি সবাই জেঠিমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলেছিল, একা রানীতেই রক্ষা নেই!
আবার রাজকন‍্যা!!

নাতি চাই আমার, নাতি। বুঝলে বউমা এবার তোমার কোলে আমি কার্তিক দেখতে চাই। বংশে বাতি দেওয়ার লোক তো লাগবে নাকি! আমার বংশের প্রদীপ চাই..... বুঝলে..... প্রদীপ!!

মায়ের বুকটা ভীষণ জোরে কেঁপে উঠেছিল সেদিন! আমি তা, বেশ অনুভব করেছিলাম মায়ের গর্ভে।।

প্রতিদিন মায়ের কান্না আর মায়ের মনের ভয়কে অনুভব করতে করতে, একটু একটু করে বড়ো হয়ে উঠছিলাম আমি মায়ের জঠরে।।

এইভাবে ছ'মাস কাটে। হঠাৎই একদিন, ঠাম্মির আদেশে বাবার পরিচিত এক ডাক্তার বাবু, আমার লিঙ্গ নির্ধারণ করে বাবা ও ঠাম্মিকে জানান, অনুসূয়ার গর্ভে পুত্র নয় কন্যা সন্তান বেড়ে উঠছে।।

তার ঠিক দুদিন পর..... রাগে, ঘৃণায় জর্জরিত বাবা ও ঠাম্মি মাকে নিয়ে আসে পরিচিত ডাক্তার বাবুর হাসপাতালে।।

এ এ একি... একি... হঠাৎ এতো যন্ত্রণা অনুভব করছি কেন আমি? আস্তে আস্তে আমার সারা শরীর টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে কেন? এতো রক্ত কেন? এতো রক্ত!!

ও ও ও মা... ও ও ও বাবা আমি যে নিঃশ্বাস নিতে পারছিনা! আমার যে প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে! প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে আমার!!

একটু বাঁচতে দাও আমাকে! একটু বাঁচতে দাও!
তোমাদের মতোই বাঁচতে চাই আমিও! আমাকে বাঁচতে দাও একটু!!

নিমেষের মধ্যে রক্ত মাংসের টুকরো বের করে এনে ডাক্তার বাবু বলেছিলেন, নাও সুবোধ এখন আর তোমার কোনো চিন্তা নেই! কি.... মাসিমা এবার খুশিতো??

মায়ের চোখে জল! সন্তান হারানোর ব‍্যাথা! এই কি তবে ভবিতব‍্য ছিল? একেই কি বলে জঠর যন্ত্রণা??

আচ্ছা মা.... তুমিও তো পারতে সেদিন, মুখ বুঁজে সব কিছু সহ‍্য না করে, প্রতিবাদ জানাতে! তুমিও তো পারতে আমাকে একটু বাঁচতে দিতে!!

আচ্ছা বাবা.... আমিও তো পারতাম ভাইয়ের মতো উচ্চশিক্ষিত হতে! আমিও তো পারতাম বড়ো কোনো কম্পানির অফিসার হতে! আমিও তো পারতাম তোমার হাতে অর্থ রোজগার করে দিতে!! 

আমিও তো পারতাম! আমিও তো পারতাম!! 

আমিও তো পারতাম বৃদ্ধ বয়সে তোমাদের হাতের লাঠি হয়ে দাঁড়াতে!!

আচ্ছা দাদু, ঠাম্মি তোমরা কি সর্গ থেকে তোমাদের বংশ প্রদীপের উজ্জ্বল শিখা দেখতে পাও এখনো? নাকি, তাও সময়ের ভিড়ে আবছা হয়ে গেছে? ঠিক যেমনটা তোমাদের মৃত্যু শয্যায়, শেষবারের মতো বিদেশে থাকা বংশ প্রদীপকে দেখার সাধটা অপূর্ণ থেকে গেছিল!!

কি করে দেখবে তোমরা? তোমাদের সাথে সাথে, চিতার আগুনে তোমাদের চশমা দুটোও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে সেই কবে!!

আচ্ছা বাবা, ভাই নাকি মস্ত বড়ো অফিসার হয়েছে এখন! শুনেছি..... সে নাকি বিদেশে থাকে!!

কেমন আছো তোমরা এখন? কেমন আছো মা? তোমরা বুঝি এখন বৃদ্ধাশ্রমেই থাকো? ওখানে কষ্ট হয়না-তো তোমাদের??

বাবা..... শুনেছি ওখানেও নাকি, নারী পুরুষ আলাদা আলাদা থাকে! আসলে.... সবই অদৃষ্টের লিখন! কালের নিয়ম, সময় দেখিয়ে দিয়ে যায় সবকিছুই চোখে আঙুল দিয়ে!!

ও ও বাবা..... এতো দুঃখ কেন তোমার? তুমি কি কোনো ভাবে কষ্ট পাচ্ছো এখন? তোমার কি অনুতাপ হচ্ছে ভীষণ? কিন্তু কেন এই অনুতাপ তোমার? এই নারী পুরুষের বিভেদ যে, তোমারই সৃষ্টি! এই মেরুদণ্ডহীন সমাজটা যে তোমাদের হাতেই গড়া!!

তবে.... তবে আমি বেশ ভালো আছি জানো! অমর আত্মা হয়ে, আমি বেশ ভালো আছি! আর আমাকে কেউ মেরে ফেলতে পারবেনা! এই দেহহীন অস্তিত্ব নিয়ে, আমি বেশ ভালো আছি! আমি বেশ ভালো আছি! আমি বেশ ভালো আছি......!!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ