দর্পণ | ধারাবাহিক দৈনিক কলম | গল্প ~ হেলাল সালাহউদ্দীন




পোস্ট বার দেখা হয়েছে


                           পৃথিবীতে 

           হেলাল সালাহউদ্দীন


কোনো তাড়া নেই তার, আলোআঁধারির মায়াভ্রমে হেঁটে যাচ্ছে সে, ইষৎ বাঁকা পাদুটো নিয়ে হেলেদুলে আপনমনে চলছে পথে, খোঁচাখোঁচা শুভ্র শ্মশ্রুমণ্ডিত ছোটোখাটো শরীরে যেনো কোনো ক্লান্তি নেই, অবিকার ভঙ্গিমা, বাঁশের বাঁকে ঝুলানো দুটি ভাঙাচোরা ঝুড়ি ভাঙা হাড়িপাতিল- পুরোনো লোহাটিন, ছেঁড়া জুতা- এসবে ভর্তি। শ্রাবণের মেঘ থইথই আকাশে আষাঢ়ী পূর্ণিমা ডুবতে ডুবতে ভেসে উঠছে ভুসকরে।

পৃথিবীতে ঘটে গেছে কতো বিবর্তন, মানুষ বিচ্ছিন্ন নিঃসঙ্গ একাকী হতে হতে এখন রোবটিক হৃৎপিণ্ডে জটিলতর অন্ধকারে হাবুডুবু খাচ্ছে; ভোগোন্মত্ত পৃথিবীতে মানুষ ঠিকানাহীন ক্রুর বিষাদে আক্রান্ত! কোনো খোঁজ রাখে না সে, না ঈশ্বর না রাজনীতির। আলতো গতিতে পা ফেলে ফেলে যখন মোকামে পৌঁছাবে তখন বেচাকেনা শেষে সকলে আড্ডা খোশগল্পে মাতোয়ারা সময় কাটাচ্ছে- অনেকে ফিরে গেছে ঘরে।

আরও খানিক পথ এগিয়ে যায় কুরমান, বর্ষামৌসুমে লতাগুল্মের নিবিড় বাঁকে ঘাড় থেকে বাঁকটি নামায় সে, ঝিঁঝিঁপোকা ব্যাঙের ডাকে মাতালকরা রাত, মিটিমিটি জ্বলছে জোনাকি, পকেট হাতড়ে দেশলাই বের করে কিছুক্ষণ কী যেনো ভেবে- কানে গুঁজে রাখা অর্ধেক বিড়িটা আলতো ঠোঁটে ধরে ঠুকে দেয় কাঠি; দপাদপ গোটাকতক টান মেরে আবার হাঁটতে শুরু করে কুরমান।

ঘরে পাগলি বউ, মাঝেমধ্যে সুস্থ থাকে সে, তখন রান্নাবান্না করে বাকিসময় শুধু বকে বকবক করে আর চুল ছেঁড়ে নিজের; ঘরের দেয়ালে ফাটল ধরেছে কয়েক জায়গায়, একপাশে কাত হয়ে পড়েছে চাল, জল মানায় না বৃষ্টিতে। তিনচারটা মেয়ে সবগুলোর বিয়ে হয়ে গেছে কেমনকেমন করে। 

ভাঙড়ির দোকানের সামনে যখন ঘাড়ের বোঝা নামায় কুরমান তখন রাত দশটা ছুঁইছুঁই, দোকানি অপেক্ষা করে থাকে এই শেষ লোকটির জন্য : অভ্যাস হয়ে গেছে; দোকানি মধ্যবয়সী, গম্ভীর, চৌকি থেকে উঠতে উঠতে বলে-

'আজ যে মিলা দেরি কুরলি চাচা, ন্যাও ন্যাও আমারও বাড়ি যেতি বে, শইলডা ভালো না...'

কোনো কথা না বলে মালগুলো আলাদা করতে থাকে কুরমান, দাঁড়িপাল্লায় ওজনকরে দুইশত পনেরো টাকা গুণে নিয়ে আবার পথে নামে সে। ফিরতি পথে আরও এক দোকানদার অপেক্ষা করে আছে তার জন্য, সেখান থেকে চালডাল তেলনুন কিনে আস্ত একটা আকিজ বিড়ি জ্বালিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ায় সে।

বারান্দায় এসে একপাশে থলেটি রেখে- সন্তর্পণে ঘরের ভেতর উঁকি দিয়ে ডাকে-

' হাসিনার মা ওই হাসিনার মা... কোনো সাড়াশব্দ নেই, অচেনা চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে হাসিনার মা; কুরমান বুঝে ফেলে- রান্নাবান্না হইনি কিছুই, এতক্ষণে মোচড় দিয়ে উঠেছে ঘুমন্ত ক্ষুধা। কোনো কথা না বলে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় সে, হাড়িতে ভাত আর আলু ফুটতে থাকে- বুড়ো একহাতে কাঠ ঠেলে দেয় আরও একটা, চুলোর আগুনের আলো এসে পড়ে মুখে- সে মুখে কিছুই বোঝা যায় না। পৃথিবীতে তখন অপরূপ বৃষ্টি ঝরছে অবিশ্রাম। 

.




 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ