দর্পণ || ফেসবুক সাপ্তাহিক কলম || সেরা গল্প




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

                      বেলা ফুরাবার আগে

                         নাসরিন সুলতানা 


লাশ এনেই মর্জিনার দুলাভাই বললো মা কই।মর্জিনার বাবা নেই। সবাই বললো বাপের বাড়ি গেছে। মর্জিনার মা কাপড় ছিঁড়লেই বাপের বাড়ি যায়।ভায়েরা গৃহস্থ ধনী। আর মর্জিনার মা তাদের একমাত্র বোন।বোধ বুদ্ধি কম থাকায় তারা গরীব ঘরে বিয়ে দিয়েছিলো।তাই সারাজীবন বাপের বাড়ির শাড়ী পরে তার জীবন গেছে। আর আমাদের বাড়ি কাজ করে ভাত খেয়েছে । পাগলাটে টাইপের থাকলেও গায়ে শক্তি ছিলো প্রচুর।আমাদের দশ ভাই বোনের জন্মের সময় মায়ের সেবা শশ্রুষা ঘর পরিস্কার সব সেই করতো।ধান সিদ্ধ, তখন ঢেঁকিতে ধান ভানা, কলাই, মসুর, ছোলা, সরিষা,তিষি সব ফসল পরিস্কার করা গোলায় তোলা সব মর্জিনার মা করতো।আমাদের বাড়ির ভাত নিয়ে ওরা সবাই ভাগ করে খেতো।সারাজীবন আমাদের হাড়ির সকালের পান্তা পানি আর দূপুরে ফ্যান(ভাতের মাড়) নিতে ওরা মালসা রেখে যেতো।মা তাতে এক দু চামচ ভাত দিয়ে দিতো সেটা নিয়ে ওরা লবণ আর ঝাল দিয়ে শরবতের মতো চুমুক দিতো।তাতেই ওদের সারাদিন। কোন কোন দিন কিছু না খেয়ে শুয়ে থাকতো।পেট আর পীঠ মাটির বারান্দার সাথে লেপ্টে থাকতো।খালি মাটির বারান্দায় শুতে শুতে মাটি তেলে তেলে হয়ে গিয়েছিলো।বিছানা লাগতো না।আমরাও সেখানে খালি বারান্দায় বসে থাকতাম।ওদের সম্বল ছিলো একটা খেজুর পাতার পাটি। পাটিটাও তেল চকচকে ছিলো। ঘরে ছিলো একটা বালিশ দোলা। যেটা ঘরের চালের বাঁশের সাথে শাড়ির দুটো পাড় দিয়ে বাঁধা আর তার ভিতর তক্তা দেওয়া। এই তক্তার উপর বালিশ আর কাঁথা থাকতো। আর ধান রাখার জন্য ছোট একটা ডোল ছিলো। সেটা বাঁশের বোনা।ওদের জমির ধান রাখতো তাতে।তিন/চার মাসের ভিতর সে ধান শেষ হয়ে যেতো। আট সদস্যের সংসারে আর কতদিন। ওর বাবা দিন মজুর আর ওর বড়ভাই যতদিন বেঁচে ছিল ততদিন দিন মজুর দিতো।সেও জন্ডিসে অকাল মৃত্যু বরণ করেছিলো।তারপর খুব দারিদ্রতার ভিতর দিন কাটতো।অগত্যা বোনরাও লোকের বাড়ি কাজ করতো পেটে ভাতে।বড় বোনকে দত্তক দিয়েছিলো নিঃসন্তান চাচার কাছে। মেজ বোনকে বিয়ে দিয়েছিলো গরীব ঘরে। সেজো বোন ঢাকায় কাজ করতে করতে বিয়ে হয়েছিলো।ইতিমধ্যে বাবা ও মারা যায়।এখন ছোট ভাই, মা আর মর্জিনা।ছোট ভাইটা তখনো কাজ করতে শেখেনি।তাই তো ওর সেজ দুলাভাই এর কাছে ঢাকায় মর্জিনা চিকিৎসা হতে গিয়েছিলো জীবনের শেষ স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে।

ওর দুলাভাই লাশ ফেলেই মাকে আনতে গেলো।জামাইকে দেখে ওর মা আনন্দে দৌঁড়ে এসে বললো আমার মর্জিনা ভালো হয়ে গেছে?ও হাঁটতে পারে?জামাই বললো হ্যাঁ,আপনি বাড়ি চলেন।মায়ের চোখ আনন্দে চিকচিক করছে। নতুন শাড়িটা বোগলে নিয়ে গাড়িতে উঠলো। পথে এসে বললো আমার মর্জিনার জন্য একটু খাবার কেনো বাপ।জামাইকে দিয়ে পাউরুটি আর কলা কিনে আবার গাড়িতে উঠলো। গাড়ি গন্তব্যে এসে থামলো।সমস্ত ব্র্যাক ঘর ঘিরে মানুষের ভীড়।মাঝখানে মর্জিনার লাশ।ওর মা হাসি মুখে 

নেমেই দু'হাত দিয়ে মানুষের ভীড় ঠেলে বললো তোমরা সবাই সরো আমার মর্জিনা কই?ভীড় ঠেলে দেখে মর্জিনার লাশ।সে দৃশ্য দেখা কারো পক্ষে সহনীয় নয়।তার মায়ের গগন বিদারী চিৎকারে আকাশ বাতাস কাঁপতে লাগলো।যে মা বুকের ভিতর মর্জিনার সুস্থতা ও হাসি মুখ দেখবে বলে পাউরুটি আর কলা কিনে এনেছে।তার পাগল মন বলেছিলো মেয়ের জন্য খাবার কিনতে হয়।জীবনে যে কখনো মেয়ের জন্য খাবার কিনতে পারেনি। পরের বাড়ির চাওয়া ভাত তরকারি দিয়েই তাদের পেট ভরেছে। আজ সে মেয়ের জন্য অফুরন্ত ভালবাসায় পাউরুটি আর কলা  নিয়ে এসেছে নিজ হাতে খাওয়াবে।মেয়ে কত খুশি হবে।অথচ এসেই দেখতে পেলো তার লাশ।আমরা সবাই এ মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে কাঁদতে লাগলাম। একটা কান্নার ঢেউ যেন কোথা থেকে কোথায় মিলিয়ে যেতে লাগলো।সেই সুন্দর চাঁদপণা হাসিমুখ আজ নিরব নিথর। তার টানা টানা চোখ দুটি সুরমা কাজলে বুজে আছে। পরণে সাদা কাফন তার ভিতর থেকে  ঘণ কালো চুলগুলো একটু একটু দেখা যাচ্ছে। শুধু মনে হলো ভালবাসার এক গভীর শিহরণে যে মানুষটি এ পৃথিবীতে বাঁচতে চেয়েছিলো সে আজ সব আয়োজন ফেলে বাবার কাছে ঘুমাতে যাচ্ছে।


*************************************


                      The Graveyard

                         মৃণাল_সরকার


ভিক্টোরিয়ান যুগ, লন্ডন,

নিম্নবিত্তদের এক বিশাল বস্তি.. রাস্তার ধারে শয়ে শয়ে শুয়ে অপুষ্টিগ্রস্ত, দারিদ্র, নিপীড়িতদের দল। চোখেমুখে হাহাকার আর না-পাওয়ার বেদনা। উচ্চবিত্তেরা এই এলাকাগুলো ঘোড়ার চোখ লাগিয়ে পেরিয়ে যায়। পেছনে ফেলে যায় ঘৃণার কটূক্তি।


পেটের খিদে ব্রথেল অবধি নিয়ে গেছে বেশিরভাগ মেয়েকে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আইন পাশও হয়েছে এই বিতর্কিত পেশা নিয়ে। মিলিটারি শহরগুলোয় ব্রথেলস আইনি কবজে বাঁধা পড়লো। সময় এইভাবেই এগিয়েছে উচ্চবিত্তদের সিদ্ধান্তের ওপর ভর করে। তারাই সব যুগে সব শ্রেণীর জন্য নিয়ম বানিয়েছে..


কয়েকদল উচ্চদক্ষতাসম্পন্ন সেনা ইতিমধ্যেই তীর ছুঁয়েছে। কোনো এক ব্রিটিশ-কলোনির বর্বরদের সাথে যুদ্ধে জিতে ফিরে এসেছে ওরা। আপাতত বিশ্রামরত এক শহরতলিতে। এরকম যদিও হামেশাই হয়। তবু, এবার কিছু একটা আলাদা হবে। শীত এবার বেশিই শীতল। গাছের পাতারা অনেক আগেই আধমরা হয়ে গেছে। পাখিরা আর আগের মতো ডাকছে না। চারিদিকে ধোঁয়া দুঃখ-কষ্ট-বেদনার। কেউ বুঝতে পারছে না, সবাই কুয়াশা ভেবে ভুল করছে।


সরকারি ডাক্তাররা বেশ ব্যতিব্যস্ত, উপর মহলের চাপে। 

"অবস্থা কি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে?"

"স্যার, আমরা সমস্ত চেষ্টা করছি কারণ খোঁজার।"


বর্বর-নেটিভদের আন্দোলন দমন করে ফেরত আসা সেনাদের মধ্যে প্রতিদিন কেউ না কেউ অসুস্থ হচ্ছে। কয়েকদিনের মধ্যেই মৃত্যু গিলে খাচ্ছে বেশিরভাগ জনকে। ডাক্তারি বিশ্লেষণে প্রাথমিক ভাবে কোনো এসটিডি বলে ধরা হচ্ছে। 


শুরু হলো চিরুনি তল্লাশি। জোরপূর্বক ব্রথেলসের সব মেয়েদের ডাক্তারি-পরীক্ষা শুরু হলো। রিপোর্ট অনুযায়ী ধরে আনা হলো একজনকে। শুরু হলো অত্যাচার। মেয়েটা কিছুই বুঝছে না। প্রাথমিক শিক্ষা সে পায়নি। সে এখন শুধুমাত্র বিখ্যাত চাইল্ড-বুমের অংশ। কলোনি-ফেরত-সৈন্যদের "বৈধ" আনন্দ-ফুর্তিতে তৈরি "অবৈধ" সন্তানদের জন্মের এই কালো-যুগ ইতিহাস কি ভুলে যাবে? 


জনৈক এক অফিসার তদন্তের দরুণ সব ফাইল ঘেঁটে দেখলেন সরকারি চাপে সত্য বরাবরের মতো লুকোনো হচ্ছে। সময় যতই কালো হোক, সে সবসময় একটা আলো অন্তত বাঁচিয়ে রাখে! হয়তো আর্তদের মনের জোর বাড়ানোর জন্যই!


স্থানীয় এক কবরস্থান,

খানিক বৃষ্টিতে জোলো হয়েছে চারপাশ, গোড়ালি ডোবার মতো। লোকটা খুব জলদি-জলদি একের পর এক কবর খুলে দেখতে লাগলো। তার সন্দেহ সঠিক! ছেলেদের থেকে বেশি মৃত্যু হয়েছে মেয়েদের। মেয়েদের কবরের কফিনেও তাচ্ছিল্য স্পষ্ট! ফুঁপিয়ে কাঁদার একটা আওয়াজ কানে আসছিল সেটা আরও স্পষ্ট হলো। একটা নিস্তেজ আগুনের ভরসায় থাকা একটা মেয়ে কবরের সামনে বানানো একটা ভাঙাচোরা-অবহেলিত চার্চের সামনে বসে। ছিন্নভিন্ন নোংরা বস্ত্র গায়ে চাপানো। ওতে লজ্জাও ঠিকমত মেটে না, তো শীত দূর অস্ত! হাত-পা যতটা সম্ভব শরীরের সঙ্গে জড়িয়ে কাঁদছে সে। চোখগুলো চিনে নিতে অসুবিধে হয়নি। 


সেই সংক্রমিত এসটিডির উৎস ছিল অন্য কোনো দেশ আর বাহক ছিল সেই সৈন্যদের মধ্যে কেউ বা কিছুজন। আর তারপর এত মৃত্যু যার হিসেব কেউ রাখেনি। সরকারি চাপে সেদ্ধ হয়ে সত্যি রূপ নিয়েছিল খবরের কাগজে এইভাবে, 

"লন্ডনের এক মানসিক ভাবে দুর্বল মেয়ে শহরের অন্য প্রান্ত থেকে এসটিডি বহন করে এনেছিল, যার মূর্খতার দরুণ আমরা কয়েকজন সাহসী সৈন্যকে হারিয়ে ফেলেছি এবং সেই ক্ষতি অপূরণীয়। তাই সরকার তাদের পরিবারকে চাকরি ও কিছু টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বদ্ধপরিকর। নিপুণ দক্ষতায় সবটা সামলে নেওয়ার জন্য ডাক্তারদের আলাদা করে ধন্যবাদ দিয়েছেন প্রশাসনিক প্রধানরা আর অন্যদিকে দেশের অর্থনীতির উপর চাপ সৃষ্টির জন্য চাইল্ড-বুমকে দায় করা হয়েছে। এতে অযথা চাপ সৃষ্টি হচ্ছে কাজের ক্ষেত্রে, চাহিদা ও যোগান মেটাতে ও ইত্যাদি জায়গায়। 


তদন্তে নতুন মোড় এসেছে দোষী মেয়েটি যখন স্বীকার করেছে সে পিডোফোবিয়ায় আক্রান্ত। ডাক্তাররা এটি যাচাই করে সমর্থন করেছেন। অনিয়ন্ত্রিত উপায়ে সন্তান জন্মদান ও ফোবিয়ার জন্য তাদের হত্যা করার অপরাধে আজীবন কারাবাসের আইন প্রয়োগের চেষ্টা চলছে। কিন্তু, সে কয়দিন ধরে নিখোঁজ ও পাশাপাশি আমাদের এক তদন্তকারী অফিসারও নিখোঁজ। পুলিশ খতিয়ে দেখছে এই ঘটনাগুলোর যোগসূত্র। এসবের পেছনে সরকার তাদের কোনো এক কলোনির বর্বর নেটিভদের চক্রান্ত হিসেবে দেখছে। হয়তো তারা হেরে যাওয়ায় কোনোভাবে আমাদের বীর সৈন্য বাহিনীকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। কিন্তু, সরকারি তরফে জানানো হয়েছে যে, বর্তমানে সব নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।"


তথাকথিত বিত্তশালী ও বাকি সমস্ত সৈন্যকুল আশ্বস্ত, সব ঠিক আছে।


কবরস্থানটিকে বন্ধ করা হয়েছে সরকারি ভাবে। মাটি সেখানে "সত্যি" লুকিয়ে রেখেছে। ঘৃণ্য কালো ইতিহাস চাপা আছে। ভোর হতে চললো। কয়েকটা কাক কবরের চারপাশে ঘুরছে। সমাজে উঠতি শ্রম আন্দোলন, ফেমিসিস্ট আন্দোলন, শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে আগুন ধিকিধিকি জ্বলছে! সরকার কি সেই আগুনে ঘি দিতে পারে নাকি? সবটা মাটিচাপা দেওয়ার কৈশল তাদেরই রপ্ত। কলোনিগুলোই শুধু শাসিত হচ্ছে না, হচ্ছে এখানকার মানুষরাও। তবে, বিদ্রোহ আসন্ন। 


এক পসরা আগুনের পাশে ভেজা চোখগুলো মুছে নিয়ে সে বলল,

"মেরে ফেলতে পাঠিয়েছে? বিশ্বাস করুন, আমি কোনো বাচ্চাকে মারিনি। আমার কোনো রোগ নেই। ওরা সবাই ওই ঘরটায় বন্দি করে জোর করে লিখিয়েছে আমায় দিয়ে.. আমি করিনি.. আমি.."


কষ্ট আর শোনা গেল না লোকটার। বুকের কাছটায় কেউ যেন হাতুড়ির ঘা মারছে। চোখে জল ভরছে। হাত দিয়ে মেয়েটার মুখের কথা থামিয়ে সে বলল, "আমি জানি আর হয়তো বুঝতেও পারছি আপনার কষ্ট। এই সমাজ আমাকেও বিশেষ কিছু দেয়নি জানেন? ভালো কাজ যখনই করেছি, নাম হয়েছে অন্য কারোর। বাবা যুদ্ধে মরেছে জানি, কিন্তু জানি না কোথায় কোন যুদ্ধে। প্রশ্ন করলে জুটেছে লক-আপ, অত্যাচার আর দেশদ্রোহী ঘোষণা করে দেওয়ার আশ্বাস। হাতিয়ে বেরিয়েছি সুন্দর ভবিষ্যৎ। পাইনি! পেয়েছি কেবল একটা চাকরি যেটাতে খালি অমানবিক কাজ করে যেতে হয় ক্রমাগত। প্রচুর মানুষ মেরেছি জানেন! মারতে চাইনি, কিন্তু উপরের আদেশ। মারতেই হবে। সমাজে সব কথা প্রকাশ করা যাবে না! সব হালহকিকত বেরিয়ে গেল যে অর্থনীতি চাঙ্গা থাকবে না। পুঁজিপতিরা টাকা ঢালবে না.. কলোনিগুলো চলবে না.. বড়োলোকরা আরও বড়লোক হবে না.. কত বস্তিতে গিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছি, কত ব্রথেলসে গিয়ে গলাগুলো চেপে ধরেছি আর হিসেব রাখি না.. এই জীবন শুধু কষ্ট দেয় এখন। মরার মতো খালি বেঁচে আছি। মা দুঃখে চলে গেছে অনেকদিন হলো। কিন্তু, এই সমাজ কোনো সহানুভূতি দেখায়নি কোনোদিন। ন্যায় এ সমাজেও আছে কিন্তু সেটা শুধুমাত্র ক্ষমতার কেন্দ্রে। আমরা ক্ষমতার বাইরের লোক, যাদের অস্তিত্ব কেবল কাজেকর্মে আছে ব্যাস!"


মেয়েটা বিশেষ কিছু বুঝলো বলে মনে হচ্ছে না চোখেমুখ দেখে। তবু, সে যেন ভরসা পেলো যে, এই লোকটা তার ক্ষতি করতে আসেনি। কবরের ওপাশটা দিয়ে একটা নদী বয়ে গেছে। ভোর হয়ে আসছে। একটা হালকা বাতাস বইছে। ঠান্ডা খুব ঠান্ডা.. শীত এবার বেশিই শীতল। গাছের পাতারা অনেক আগেই আধমরা হয়ে গেছে। পাখিরা আর আগের মতো ডাকছে না। চারিদিকে ধোঁয়া দুঃখ-কষ্ট-বেদনার। কেউ বুঝতে পারছে না, সবাই কুয়াশা ভেবে ভুল করছে।


(অনেকটা সময় বাদে) 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছু সময় পর,

জয়ের উচ্ছাস সবদিকে। হাজার মৃত্যু শিকার ও স্বীকার করেই এই জয়। সাদা চামড়ার সৈন্যরা এবার এই আনন্দে হয়ে উঠবে "বর্বর"। তবু, তারা নেটিভ নয়। তারা অশিক্ষিত নয়। যথেচ্ছ ভাবে চলবে সুরাপান, ব্রথেলগুলো থিকথিক ভিড়ে ভরে উঠবে। কিছু সংখ্যক কান্না ব্যাথা হয়ে দেওয়ালের গায়ে জমবে, কিছু প্রাণ মাটিতে চাপা পড়বে, কষ্ট আরও বাড়বে, দোষারোপ চলবে, ফুর্তি চলবে এক শ্রেণীর, আরেক শ্রেণী সর্বশান্ত হয়ে কষ্ট পাবে.. পেয়েই যাবে.. 


কষ্ট যখন শিয়রে, প্রতিরোধ জমবে।

ন্যায় সবাই পাবে, অসতেরা জ্বলবে।।


হঠাৎই কিছু যুদ্ধ ফেরত "বীর" মিলিটারি পার্সোনালের মৃত্যু সংবাদ এসেছে প্রশাসনের কাছে। কোনো কিছু যাচাইয়ের আগেই "নিয়ম" মতো প্লেগে মৃত্যু বলে প্রচার করা হয়ে গেছে খবরের কাগজে। অভ্যন্তরীন যাচাইয়ের জন্য আধিকারিকরা খোঁজ খবর শুরু করতেই একটা অদ্ভুত জিনিস খুঁজে পেল।


প্রত্যেক মৃত অফিসারদের বাড়ি থেকে একই জিনিস পাওয়া গেছে, সেটা হলো পুতুল। কোনো এক অজ্ঞাত ঠিকানা থেকে পোস্ট হয়ে আসা এগুলো সবাই উপহার হিসেবে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু, কে জানতো যে এই উপহার ছিল মৃত্যুর।


পুলিশ ঘটনার ভাবভঙ্গিমা দেখে চার্চের দ্বারস্থ হলো গোপনে। পুতুলগুলোর শনাক্তকরণ হলো। সবগুলোই হলো ভুডু-পুতুল। বিশেষ ভাবে তৈরি, বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনে। আর কী সে বিশেষ উদ্দেশ্য সেই বিষয়ে আর সন্দেহ নেই কারোর। কিন্তু উৎস কিভাবে পাওয়া যাবে? শুরু হলো সন্ধান, অনুসন্ধান..


যার ঠিকানা থাকে, সেইই নিখোঁজ হতে পারে আর তার খোঁজ করা হয়। কিন্তু যার বা যাদের কোনো ঠিকানাই নেই তাদের? তাদের কী করে খোঁজ করা যাবে?


লন্ডনের মূল শহর ও তার শহরতলি পরিধিতে অনেক বেড়েছে গত বিশ-ত্রিশ বছর। তবে, তার কেন্দ্র পুরোনো জায়গা থেকে সরে অনেকটা কলকারখানার দিকে হয়েছে। এর ফলে আগের একভাগের প্রান্তিক এলাকাগুলো আজকাল প্রায় জনমানবহীন, প্রাণহীন। বা বলা ভালো হিংসাহীন, উঁচুনিচু ভেদাভেদহীন, কষ্টহীন।


সেই পুরোনো কবরস্থানটা মনে আছে? ভেজা স্যাঁতসেঁতে ঘাসে মোরা কালো-কালো ফলকের কবর। আর অনেকগুলো ফলকহীন, পঁচে যাওয়া কাঠের কফিনে ছত্রাক ঘেরা সমাধি যেগুলো তাচ্ছিল্যের প্রমাণ হিসেবে গেঁথে আছে কিছুটা মাটির উপরে আর বেশিরভাগটা নীচে। যেন সেই সমাধিগুলোকে না উপরের কেউ, না নিচের কেউ নিজের মনে করে। জীবাণু-পোকামাকড়রাও হয়তো ওগুলোকে এড়িয়ে যায় বলেই এখনও টিকে আছে ওই নরম কাঠগুলো। নইলে কবেই নষ্ট হয়ে মিশে যেত মাটিতে।


একসময় যে এখানে চার্চ ছিল তার কোনো চিহ্নই নেই এখন। কোনোমতে পাথরের কয়েকটা দেওয়াল ছাদের আশ্রয় জুগিয়ে রয়েছে। মৃত কবরস্থানের ঠিক সামনেই এই ঘরের মাঝে একটা বেদী। প্রার্থনা করার একটা উপযুক্ত স্থান। ঈশ্বর যাদের সাহায্য করেন না তারাই তো শয়তানকে কাছে টেনে নেয়! শয়তান ওদের শক্তি দেয়। দেয় আত্মবিশ্বাস। দেয় সাহস। আর দেয় বদলা নেওয়ার ক্ষমতা। যা অমৃতের মতোই স্বাদ আর্তদের কাছে। ঈশ্বর কি বোঝেন না এগুলো? এই চিরজীবন কষ্ট পাওয়া, অন্যায়ের স্বীকার হওয়া মানুষগুলো একটু বদলা চায়.. চায় মধুর রক্তাক্ত প্রতিশোধ।


খবরের কাগজে বেরোনো নামগুলো একটা একটা করে কাটা হচ্ছে। লোকটা বিকৃত স্বরে হাসছে। মেয়েটা এখনও স্থির। সে জানে এখনও অনেক বাকি। রাত বাড়ছে। কবরস্থানের জোলো মাটিতে কম্পন হচ্ছে। অল্প-অল্প করে উঠে থাকা কফিনগুলোর গায়ের মাটিগুলো নড়ছে। কান্না ভেসে আসছে..


এই কবরস্থান অনেক অনেক বছর আগেই আর ইশ্বরের শুভ শক্তির ছায়া ছেড়ে দিয়েছে। এখানে বহুযুগ ধরে শয়তানের কালো ছায়া বিরাজ করে। এখানে অশুভ শক্তি নিজের উপাসক নিজেই খুঁজে নিয়েছিল আজ থেকে প্রায় বিশ-ত্রিশ বছর আগে। শয়তান আর্তদের মধুর প্রতিশোধ নিতে সাহায্য করছে আর ধীরে ধীরে এই পৃথিবীতে নিজের ছায়া বিস্তার করছে.. ধীরে ধীরে.. একটু একটু করে.. দিনের পর দিন মাসের পর মাস বছরের পর বছর যুগের পর যুগ ছায়া বাড়ছে শয়তানের.. শীত বাড়ছে.. রাত ঘন হচ্ছে.. শীত এবার বেশিই শীতল। গাছের পাতারা অনেক আগেই আধমরা হয়ে গেছে। পাখিরা আর আগের মতো ডাকছে না। চারিদিকে ধোঁয়া দুঃখ-কষ্ট-বেদনার। কেউ বুঝতে পারছে না, সবাই কুয়াশা ভেবে ভুল করছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ