দর্পণ || নৌকো বাঁধা আছে~ হেমন্ত সরখেল




পোস্ট বার দেখা হয়েছে
নৌকো বাঁধা আছে
হেমন্ত সরখেল

বেলগাছিয়া খালটার পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা সোজা পূবমুখো হয়ে নেমে গেছে ট্রামডিপোর পেছনটায়, সেটা ধরে এগিয়ে গেল অরুণ। এগোল বললে পুরোটা বলা হয় না। মাপতে মাপতে এগোচ্ছে। যদি প্রত্যেকটা পদক্ষেপ দেড় ফুট হয় তাহলে দু'বার এগোলে এক মিটার। এভাবে নিজের বাসা পর্যন্ত ঠিক কতো মিটার সেটা আজ জানার ইচ্ছে হয়েছে। আজ হয়নি, হয়েছে গতকাল রাতে। যখন বৃষ্টির বড়ো বড়ো ফোঁটা একটা দুটো করে পড়তে শুরু করলো ওর করোগেটেড টিনের চালে, ঠিক তখনই ওর মনে হল। মনে হল কী কী করা হয়নি। যেমন মাপা হয়নি এই রাস্তাটা। অনেকদিন আগে মারা গেছিলেন শ্যামবাজারের নিধুবাবু। টিকিট চেকার ছিলেন। ট্রাম স্লো হতেই নেমে পড়েছিলেন বাঁ পাশে কি জানি কেন। আর, পেছন থেকে এক অলপ্পেয়ে ড্যাকরা মোটর সাইকেলের ধাক্কায় তাকে ছিটকে দিয়েছিল উল্টোদিক থেকে আসা মিনিটার সামনে। কারোরই দোষ না। না নিধুবাবুর, না সেই অলপ্পেয়ের, না মিনির ড্রাইভারের। দোষ শুধু নিধুবাবুর বৌয়ের কপালের। প্রথম আর শেষবারের মতো তার বাড়িতে যাওয়া হয়েছিল মৎসমুখের দিন। পাতে একটা কাতলার মুড়ো পড়েছিল। অত ভীড়ে সেদিনের সতীর্থ ড্রাইভারকে কে আর মনে রাখে! ওরা মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে ফিরেছিল সিটিসি নিশ্চয়ই নিধুদার ছেলেকে কাজে রাখবে। দুঃখের দিন কেটে যাবে। তারপর তো টালিগঞ্জ থেকে ওর ট্রান্সফারই হয়ে গেল, যাবে টা কখন! এটা ভাবার পর, রাতে একটু স্বস্তি পেয়েছিল অরুন। ট্রান্সফার হলে যাওয়া যায় না। তখনই আর কী বাকি আছে খুঁজতে খুঁজতে এটা পেয়েছিল। এই রাস্তাটা মেপে নিতে হবে। এগারো বছরেও এই কাজটা করেনি ও! আশ্চর্য! আজকের পর তো আর সময়ও পাবে না। শিয়ালদা থেকে ট্রেনটা কাল সকাল ছ'টা পয়ত্রিশ'এ। এখনও বহু কিছু গোছানোর বাকি।
               জীবনে কোনো কিছুই তালে বসেনি অরুণের। খুব কষে পড়েও টিটিএমপি। মানে টেনে টুনে ম্যাট্রিক পাস। পি.ইউ'র আগে বাবার টি.বি.র একটানা কাসি আর সাঁই সাঁই শব্দের হাঁপর রাতের পিদিমে তেল ফুরিয়ে আনতো। কতোদিন বিরক্ত হয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে বকুলতলায় ঠায় বসে চোখে সকাল ফুটিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। এখানেও টেনে টুনেই হল। লাভের লাভ পেল, রেজাল্ট নিয়ে আর বাড়ি ফিরতে হয়নি। সুবল জ্যাঠা কলেজ থেকেই সাইকেলে চাপিয়ে ওকে কালাকুণ্ডু'র শ্মশানে নিয়ে এল। একেবারে পিতৃদাহ সমাধা করে শ্বেতবস্ত্রে বিধবা মায়ের সামনে ধপ করে বসে পড়লো বাড়ি ফিরে। এর আগেই মায়ের চুড়ি, বালা,বিয়ের পেতলের হাড়ি বন্ধক রাখা হয়ে গিয়েছিল। এবার সেগুলো বেচে ফেলা গেল। নমো নমো করে পুরুতের কাজ আর পোনা মাছের আঁশে নিয়মরক্ষা হলে, মায়ের পিসতুতো ভাইয়ের পোঁ ধরে গ্রাম ছাড়লো অরুণ। মা বলেছিল, তুই ভাবিস না, অনেক দুধমানকচু হয়েছে পায়খানার পাশ দিয়ে।না খেতে পেয়ে মরবো না।দ্যাখ,যদি কিছু করতে পারিস।তাহলে, এসে আমায় নিয়ে যাস।
                যেদিন অরুণ দুবেলা খেতে পেল, তার পরের দিনই মাকে আনতে ট্রেন ধরলো।গিয়ে শুনলো,ওর সেই মামা ওর মাকে তখনই কোন একদিন নিয়ে চলে গেছে,যখন ও কোলকাতায় গেল। বাড়িটার দরজা, জানলা কারা যেন খুলে নিয়ে গেছে। আগাছা পরিষ্কারের ইচ্ছে ভুলে, ও সুবল জ্যাঠাকে দেখাশোনা করতে বলে ফিরে এল ভাতের দু বেলার খোপে। বাচ্চার ন্যাকা কান্নার মতো নাকের পোঁটায় চোখের জলে দিন গড়ালো।ড্রাইভার হলো,সিটিসি'তে চাকরি পেল। বিয়ে করলো। 
                 বেলেঘাটা জোড়ামন্দিরের পেছনে ছিল বৌ'টার বাড়ি। অরুণের না ছিল বরযাত্রী না হল আচার। মন্দিরে বিয়ে সেরে পশ্চিম পুঁটিয়ারির ভাড়াবাড়িতে সংসার। একদিন শেষ ট্রিপের ট্রাম ডিপোতে দাঁড়াতেই খবর পেল ওর বৌয়ের গায়ে আগুন লেগেছে,মেডিকেলে আছে। হসপিটালের গেটে ওর কলিগরা দাঁড়িয়ে। শুধু সই করে লাশ নিয়ে নিমতলা। এটুকুই ওর করণীয় ছিল। রাত তিনটেয় গঙ্গার জল যে এত কালো হয় সেই প্রথম ও সেটা দেখল।
               তেত্রিশ বছরের চাকরি জীবন কাটিয়ে আজ অরুণ ফিরছে নিজের গ্রামে। স্টেশনটা আমূল বদলে গেছে। তিনটে প্ল্যাটফর্ম। প্লাটফর্মে শুধু দোকান আর দোকান। এখানে কেউ ওকে চেনে না। ও ও কাউকে চেনে না। দুটো ঢাউস ব্যাগ ভ্যান্ডার থেকে নামিয়ে বোকার মতো প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে রইল। চলে যাক ট্রেনটা। ট্রেনটা চলে যেতেই দুটো চ্যাংড়া উদয় হলো।
-- কোথায় যাবেন কাকু?
-- গুপ্তি পাড়া।
-- কাদের বাড়ি? 
-- অরুণদের বাড়ি। 
-- অরুণ জেঠু তো কোলকাতায় থাকে। ওটা তো এখন পোড়ো বাড়ি!
-- আমিই অরুণ।
         ভ্যাবাচ্যাকা খেল। পরক্ষণেই একটা বললো,
-- চলুন, আমার টোটো আছে। আমি নিয়ে যাচ্ছি। এই, তোল তো তুই একটা!
         দুটোয় দুটো ব্যাগ ঘাড়ে তুলে নিল। টোটো অব্দি পৌঁছোতে যথেষ্ট বেগ পেতে হলো দুটোকেই। অন্যটাকে কুড়ি টাকার একটা নোট দিল অরুণ।
-- রাখ, চা খেয়ে নিস।
         বেলা চারটে নাগাদ আশু চা নিয়ে এল। সুবল জ্যাঠার নাতি। জ্যাঠা মারা গেছে। আশুর বাবার মুদিখানা স্টেশনে। অনেককিছু কেনাকটা করতে হবে।
-- তুই যাবি আমার সঙ্গে স্টেশনে?
-- না, বাবায় কুইট্টা ফ্যালাইবো।
           কেনাকাটা সেরে বাড়ি ফিরে হ্যারিকেন জ্বালিয়ে ঘড়ির দিকে তাকালো অরুণ। আটটা পয়তাল্লিশ। রাতের খাবার আসবে আশুদের বাড়ি থেকে। এই মৃত্যুপুরীতে থাকতে ওকে মানা করেছে দেবু। দুটো দিনেই সব ঠিক করা হয়ে যাবে।তখন না হয় থাকবে। লেবারটা বলে গেছে কাল আরও দুজনকে নিয়ে আসবে। রাজমিস্ত্রীও পাঠাবে। আজ বাইরেটা সাফ হয়েছে। বেশ কয়েকটা বিষধর আস্তানা ছাড়া হলো। লাগবে যে হপ্তাখানেক সেটা অরুণও বুঝতে পারছে। তবুও,সৌজন্য বোধেই ও নিজের বাড়িতেই থাকতে চায়।
              খাবার নিয়ে আশুর সাথে ওর মা ও এল। খাওয়া শেষ হলে গামছা দিল। তারপর জোর করে নিয়ে এল বাড়িতে। রাতে এ পাড়ায় চৌকিদার আছে। তাকে একশো টাকা বরাদ্দ হলো ততদিন,যদ্দিন অরুণ এ বাড়িতে থাকবে।
              দোতলার দক্ষিণ দিকের ঘরটায় অরুণ। বেডের লাগোয়া জানলাটা খুলে দিল। আবছা অন্ধকারে ভূতুড়ে লাগছে মৈত্র বাড়ি। উঠোনটা একটু পরিষ্কার। ঘরের হ্যারিকেনের ক্ষীণ আলো সরু সুতোর মতো দাগ কেটেছে পেয়ারা গাছটা অব্দি। কেউ নেই। বাড়িটা একা, ভীষণ একা। অরুণও নেই ওর কাছে। এত কাছে থেকেও নেই। মশারির মধ্যে নিয়ে এসেছিল সন্তোষের রেডিওটা। আজ ঠিক করিয়ে নতুন নিপ্পো ব্যাটারি ভরেছে। এটাই এখন ওর সবাই। খুট করে আওয়াজ করে রেডিও বললো, ও রেডি। কানে মোচড় দিতেই বেজে উঠলো,
'ইস খেল মে হম হো ন হো…'
চোখ বুজে এল অরুণের। আঃ!শান্তি

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ