দর্পণ || নিবন্ধ || দৃষ্টি ~ ধর্মেন্দ্র রাওয়াত




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

প্রসঙ্গ-'when rape is inevitable, enjoy it. और क्या करें '- রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত

দৃষ্টি 

ধর্মেন্দ্র রাওয়াত

আমরা দুই বন্ধু আজ দুপুর 12 টায় স্টেশনে বসে ছিলাম বেশ কিছুক্ষণ ।বন্ধু ফিরে যাচ্ছে। কলকাতায় থাকে। কথায় কথায় অনেক কথাই হলো।  বাল্য   কৈশোর যৌবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছি একসাথে ।অনেক আনন্দঘন মুহূর্ত অনেক সংকটজনক অবস্থা সময় মুহূর্ত কাটিয়েছি অবলীলায় সুখে দুঃখে। আজ সেই সব দিন অনেকটা ,হয়তো সবটাই নিস্তরঙ্গ। তবু কথা আসে ,এসেই যায় ।আজ আমরা প্রায় পৌঢ়। খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে বসলেই চোখে মুখে ঠোটে যেন তরঙ্গায়িত হয় সংকট। কথাটা তোলে বন্ধুই ।

আচ্ছা বলতো আমরা  দুজনাই তো অনেক বেশী বয়সে বাবা হলাম। অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে ।

আমিও হাসি হাসি মুখে  বললাম- তোর যমজ দুই ছেলের বয়স এখন এক বছর ,আমার সাত বছর । আর আমাদের বয়স 52 । অনেকেই তো ভেবেই  বসে ,ছেলে না নাতি ! তাই কেউ জিজ্ঞেস  করার আগেই  আমিই আগ বাড়িয়ে  তাড়াতাড়ি  বলে ফেলি- 'এ আমার  ছেলে'।হেসে  উঠি দুজনেই ।

ও বলল- কিন্তু় সব সময়  একটা ভয় তাড়া করে , অরণ্য  ও দিগন্তকে মানুষ করে যেতে পারবো তো ! তাই মাঝে মাঝেই দুশ্চিন্তা হয়। মনে হয় একটা সংকটজনক অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছি।

আমি বললাম-  when rape is inevitable,  enjoy it.

আমরা দুজনেই হো হো করে হেসে উঠলাম ।আমরা একে অপরের কথা খুব বাল্য বয়স থেকেই হা করলেই বুঝতে পারি । আমার কাঁধে হাত রেখে বলল-

আমিতো রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের ক্ষমা চাওয়ার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখলাম। প্রচুর গালাগালি খেতে  হয়েছে ওনাকে। আচ্ছা বলতো রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত কিভাবে এরকম একটা সেনসিটিভ কথা বেফাঁস  বলে ফেললেন ।

বললাম- আমি এই বিষয়টা একটু অন্যরকম করে ভাবছি।

আচ্ছা বলতো, 'ভালো হয়েছে' এর অর্থ কি,?

"খুব সাধারন কথা যা তোকে আমাকে সবাইকে আনন্দ দেয়।"

আমি বললাম-

"অর্থাৎ enjoy it অর্থাৎ যা enjoyable  তাই ভালো। 

অর্থাৎ enjoy আর ভালো এ দুটি সমার্থক শব্দ।"

গৌতম বলল-

হ্যাঁ হ্যাঁ, আর এটাই তো হওয়া উচিত। সব তো আর enjoyable হতে পারে না, ভালোও হতে পারে না। আমি জিজ্ঞেস করলাম-

আর, 'ভালো হচ্ছে',,?

সেটাও তাই।

 আমি বললাম -তোরা তো সারোগেট মাদার hire করেছিলি। তাতেও সাকসেস হোসনি ।তিন মাসে মিসক্যারেজ হয় ।সেদিন তো তোদের স্বামী স্ত্রীর চোখে ছিল জল আর হতাশা। হয়তো ভেবেছিলি আর মা বাবা হতে পারবো না। আমাদের ভাগ্যটাই খারাপ ।নিরাশ হয়ে ছিলি ।আমি জানি অবশ্যই সেটা enjoyable  নয় ।ও আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বুঝতে পারছে আমি কি বলতে যাচ্ছি ।আবার তোরা যখন এই শেষ বার ভেবে ট্রাই করলি নিজের বাচ্চা হল । সুপর্ণা  নিজের গর্ভে ধারণ করলো সন্তান । তোরা মা বাবা হোলি। কত আনন্দ! এখন কি তোর মনে হচ্ছে না ভাগ্যিস সেদিন---- 

আবার আমাদের কথাই ধর। আমরা তিন ভাই ।বড় দুই দাদার বায়োলজিক্যাল চাইল্ড নেই ।আমাদের তিন ভাইয়ের  স্পার্ম রিপোর্ট খারাপ ।আমার মাত্র 40 % স্পার্ম  জীবিত । তুই তো জানিস ডাক্তার চান্স ফিফটি-ফিফটি বলছিলেন । এদিকে আমার বয়সও বাড় ছিলো। ওষুধও চলছিল ।যেহেতু adopted ব্যাপারটা আমাদের ঘরে নর্মাল, তাই decision  নিলাম দাদাদের মতো আমিও মাদার টেরেসার সেন্টার থেকে adopt করার। আমরা স্বামী স্ত্রী প্রায় প্রস্তুত adopt করার জন্য। কিন্তু সেই  মাসেই প্রেগনেন্সি রিপোর্ট পজিটিভ আসে ।আমাদের আর adopt করা হলো না ।এটা কে কি বলবি কিভাবে বিশ্লেষণ করবি ।আমরা দুজনেই চুপ। সামনেই একটি ভিখারি বাচ্চা ঘোরাঘুরি করছিল। আমাদের তার দিকে চোখ গেল। আমাদের দুজনেরই, আমার যে কোন  একটি  বাচ্চাকে adopt করার কথা ছিল তাদেরই মধ্যে এই বাচ্চাটিও তো হতে পারতো  একজন। একটু উদাস হয়ে বলল আমরা কি স্বার্থপর নই! আমরা খানিকক্ষণ চুপ থাকলাম।

আবার আমিই কথা শুরু করলাম।

আচ্ছা

আর একটা কথা যদি বলি , 'সবই ভাল হবে',এই  কথা  কি তুই বিশ্বাস  করিস?

গৌতম সঙ্গে  সঙ্গে  বললো- এই যে এত এত মানুষ নিরাশ্রয় অভুক্ত  যুদ্ধ দাঙ্গা প্রতিদিন কত শত নারী তিন চার বছর বয়সের মেয়েও  ধর্ষকদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না,  যদি কান পাতি তবে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধে  রাত শুধুই কান্না ভেসে আসে কানে । এটার কী ভাল হচ্ছে বা হবে!!!

 আমি আমার বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে বললাম -হ্যাঁ বন্ধু অনেক বিষয়ে উক্তি বা মন্তব্য সামগ্রিকভাবে না নিয়ে লিটারেরি নিলে তুই আর আমি বা আমরা সবাই তুই যেটা ভাবছিস সেটাই ভাববো। কিন্তু একবার ভেবে দেখবি হিন্দু ধর্মে পূর্ণ অবতার শ্রীকৃষ্ণ যখন যুদ্ধক্ষেত্রে সংকটজনক অবস্থায় বলেন -'যা হয়েছে  ভালো হয়েছে যা হচ্ছে ভালো হচ্ছে যা হবে ভালো হবে'। তখন কি এর মানে নাট্যকার রুদ্রপ্রসাদের ভাষায় accepts  and  enjoy it নয় ? শ্রীকৃষ্ণ যুদ্ধক্ষেত্রে সংকটকালীন অবস্থায় দাঁড়িয়ে অর্জুনকে কি কেবলমাত্র যুদ্ধ ও যুদ্ধের পরিনীতি  মেনে নেওয়ার কথা শোনাচ্ছেন, নাকি  জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ জীবন-মৃত্যুর সামগ্রিক  রহস্য কে তারই পরিপূর্ণতায়  ছুঁয়ে যাচ্ছেন! বইয়ের পাতার ভাঁজে  কাঠ হয়ে যাওয়া একটি তরতাজা ফুলের গল্পও কি বলছেন না শ্রীকৃষ্ণ।  শ্রীকৃষ্ণের অর্জুনের সাথে এই সংবাদ কি রুদ্রপ্রসাদ সেন গুপ্তের এই ভাষাগত উক্তির খুব কাছাকাছি নয়? কিন্তু নাট্যকারের এর ভাষার ব্যবহারে ছিল আপাতদৃষ্টিতে সামাজিক নগ্ন হিংস্রতা।

একটু আগেই  যে যুক্তি  তুই দিচ্ছিলি । শুধু তোর মুখেই  নয় এই প্রসঙ্গে  অনেকের মূখেই এই যুক্তি  শুনেছি  ।অথচ  শ্রীকৃষ্ণের এই উক্তিকে আমরা অনেকেই  বা আমাদের দেশ কি খুবই ভক্তি সম্মানের চোখে দেখি না? দেখে না ?


কিন্তু বন্ধু , এখানে  অমি একটু নিশ্বাস নিলাম।বললাম-,ভাবসম্প্রসারণ -এ একই ভাবগত হলেও  ,রুদ্রপ্রসাদের জ্ঞান  ভাব বোধ ও উক্তি  খণ্ডিত, অপরিপূর্ণ  ।শ্রীকৃষ্ণের অখণ্ড  দর্শনের উচ্চতায় যেতে না পারায় ভাষাগত ভুল করে বসলেন বুদ্ধিমান রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত ।বন্ধু  বলল-  তাহলে কি রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত  ভাবগত ভাবে ঠিক বলেছেন?

না,না ঠিক বুঝলি না ,

আমি বলতে চাইছি আমার ভাষাগত  অর্থ যতই ঠিক হোক না কেন আমি যদি তার গভীরতায়  তার সম্পূর্ণতায়  না পৌঁছায় তবে তা  অর্থহীন হয়ে পড়ে।

আমার  মনে হয় না  উনার কাছেও উনারই উক্তির অর্থ পুরোপুরি পরিষ্কার । সেই আলোচনাতেই  মাননীয় রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত  'ডিসিশন' নেওয়ার ক্ষেত্রে  ছাত্রদের উপদেশ দিচ্ছেন  যে  কমিটির সঙ্গে সূক্ষ্মভাবে বার্গেনিং করতে  এবং কমিটি  যাতে মনে করে  যে তারাই 'ডিসিশন' নিল  কিন্তু  শেষমেষ  ডিসিশনটা হবে আপনাদেরই ।

এখানেই  আর বিষয়টা  "accept  and enjoy it",রইল না । আমিই চূড়ান্ত"হয়ে  রয়ে গেলো ।তাই বলছি - "accept and enjoy it",-এর ভাবগত অর্থে  তিনি পরিপূর্ণ নন ।আমার মনে হয় তিনি যদি শ্রীকৃষ্ণের গীতার এই সংবাদের প্রতি মন দিতেন তাহলে তিনি আরও সমৃদ্ধ হতেন। শ্রীকৃষ্ণের খুব কাছাকাছি গিয়েও তিনি "আমিত্ব " ছাড়তে পারলেন না । । খুব কম জনই পারেন ।চাইনিজ দার্শনিক এর উদাহরণ না দিয়ে শ্রীকৃষ্ণের মতো  তিনিও বলতেই পারতেন ,- 'যা হয়েছে ভালো হয়েছে যা হবে ভালো হবে যা হচ্ছে ভালো হচ্ছে'। ভাষাগত  না হলেও ভাবগত উদ্দেশ্য প্রায় একই। গৌতম বলল- আমাদের কাব্য কথা তো একটা ছোট্ট গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সেখান থেকেই আমরা আকাশ টা দেখি ।তাই বোধহয় রুদ্র বাবুর বাদ সাধল শ্রীকৃষ্ণ নামটা। একটু গণ্ডির বাইরে যেতে পারলেই যারা গালাগালি দিয়েছেন তাদের অনেকে হয়তো হাততালি দিয়ে উঠতেন ।  আমিও হাসতে হাসতে বললাম কিন্তু নাস্তিকেরাও নিশ্চয়ই  বলতেন রুদ্রপ্রসাদ বাবুর মাথাটা একেবারেই গেছে।আমরা  আবার  হো হো করে হেসে  উঠলাম । 

ও হাসতে হাসতেই ব্যাগ কাঁধে নিয়ে উঠে দাড়িয়ে বললো-

যাইহোক কিন্তু শেষমেশ এই কথাটাও বলতে হবে  যে

রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তের ক্ষমা চাওয়া প্রসঙ্গে  উনি বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে প্রমাণ করলেন যে উনার বক্তব্যে উনি অনেকটাই গভীরতাই আছেন অর্থাৎ সংকটকালীন অবস্থায়-

'Eccept and enjoy it " 


ততক্ষণে ট্রেন প্লাটফর্মে এসে দাঁড়ায় বন্ধুকে বিদায় দিয়ে বাড়ি ফিরে আসি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. অসাধারণ একটি তাত্ত্বিক লেখা পড়লাম। গভীরতায় গিয়ে চূড়ান্ত ভাববাদ প্রকাশ আর বাস্তবিক অর্থ প্রকাশের যে দ্বন্দ্ব তা এ লেখায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বোঝা যায় এ লেখা বাস্তবতা ছাড়িয়ে ভাববাদের দর্শন কে আপন করে নিয়েছে।

    উত্তরমুছুন