দর্পণ || দৈনিক গল্প গাথা || সাবিত্রী জানা ষন্নিগ্রহী ||




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

 

চশমাটা কোথায় গেল?

সাবিত্রী জানা ষন্নিগ্রহী


ক'দিন থেকেই চশমাটা মাঝে মধ্যে বিগড়োচ্ছে। আগামীকাল নাতির পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোবে। না হোল স্কুল, না হোল পরীক্ষা---রেজাল্ট বেরোবে--মাধ‍্যমিক পরীক্ষার রেজাল্ট। সেই গতবছর থেকে মনমরা হয়ে আছে। স্কুল নেই তো- -কখনো রাজমিস্ত্রির সাথে যোগাড় দিতে যায় তো কখনো সকালে কৃষকদের নিকট থেকে সবজি- আনাজ কিনে বাজারে বিক্রি করে। একটু কমদামে কিনে কয়েকটা টাকা বেশী পায়। গতকাল কোন সবজি পায়নি। শরীরটা ভালো ছিল না--আগেই কিনে নিয়েছে কেউ। স্কুল বন্ধ থাকায় পাড়ার সব ছেলেরা বিভিন্ন রোজগারের আশায় নেমে পড়েছে। কেউ বাসন ফেরি করে, কেউ বালির ট্রাকটারে বালি তোলার কাজ করে, কেউ ডাক্তার খানায় প্রেসক্রিপশন লেখার কাজ করে, কেউ বা সরকারি একশ' দিনের কাজে যায়। কয়েকজন নাতির সাথে সবজি কিনে দূর হাটে বিক্রি করতে যায়।

সরকার থেকে খাদ‍্যসামগ্রী পেলে কি হবে!!! মশলা পাতি, জ্বালানি, দুধ, ঔষধপাতি, মোবাইলে টাকা ভর্তি, আলোর বিল ---খরচের তো শেষ নেই। বাচ্চা বাচ্চা দুটো নাতি -নাতনি স্কুলে মিড-ডে-মিল খেতো। তাও তো প্রায় এক'বছর বন্ধ। বৌমা দুটো বাড়িতে কাজ করে। ছেলের মাঝে মাঝে মাঝেই ট্রলি বন্ধ --লকডাউনের বলি। এ অবস্থায় আমার চশমা সারাতে বলি কি করে? নাতি টাকা এনে আমায় গুনতে বলে। বলতে পারি না যে চশমাটা ঝাপসা হয়ে গেছে। গুনতে দেরী হয় --নাতি ঠাট্টা করে। কি দাদু --এত শীঘ্র বুড়ো হয়ে গেলে?? ক'টা টাকা গুনতে এত দেরী করছো!! --দেরি তো হবে রে দাদু--আমার কি তোর মতো শক্ত শরীর!!! ---আগামীকাল মাধ‍্যমিক পরীক্ষার ফল বেরোবে। নবম শ্রেণীর নম্বর যোগ হবে। পড়তেই তো পায় না। কখনো বাবাকে ট্রলি ঠেলতে সাহায‍্য কর তো কখনো নিজে কাজে বেরোয়। টিউশনি তো নিতে পারেনি। বড় ইস্কুলে ভর্তি হওয়ার পর প্রথম প্রথম নিত। মা কাজের বাড়ি থেকে মাসের বেতন এনে টিউশনি মাষ্টারের টাকা দিত। মা কখনো কখনো অসুস্থ হলে কাজগুলো চলে যেতো। সত্যি তো যারা কাজে রাখবে তাদের তো কাজের লোক না হ'লে চলবে না। অন‍্যলোক ঢুকিয়ে দিতো। টিউশনির মাষ্টারের টাকা না দিতে পারলে বাকি টাকার জন্য তাগাদা দিত। লজ্জায় টিউশনি পড়া ছেড়ে দিয়েছে। বছর দুই পড়েছিল। তারপর থেকে নিজেই পড়ে। ক্লাসে উঠে ও যায়। এবার তো অনেক সময় পেয়েছিল--পড়ে ও ছিল--প্রত‍্যেকদিন সন্ধ্যায়।

বলেছিল জানো দাদু আমি এবার খুব ভালো পরীক্ষা দেবো। পড়ার অনেক সময় পেয়েছি। কিন্তু পরীক্ষাটাই হোল না। পরীক্ষা ছাড়া রেজাল্ট বেরোবে শুনে একটু মুষড়ে পড়েছিল। নবম ক্লাসের নম্বর তো ভালো নয়। ---

যাইহোক আগামীকাল রেজাল্ট বেরোবে। বন্ধুরা সব ঠিক করেছে আগামীকাল কেউ কাজে বেরোবে না। বাড়িতে থাকবে ---পাড়ার টিভিতে খবর শুনবে। নেট সেন্টারে মার্কস জানতে যাবে। আমাদের গ্রামে সন্ধ্যা নামে বিকেলেই--রাত নামে সন্ধ‍্যায়। ঠাকুর প্রদীপ দেখিয়ে--শাঁখ বাজিয়ে বৌমা খাওয়ার যোগাড় ক‍রে। রোজ এক নিয়ম। সারাদিন সবাই খাটাখাটনি করে। রাতের খাওয়া সন্ধ্যায় মিটে যায়। ভোর উঠে যে যার কাজে যাবে। খেতে বসে নাতি জিজ্ঞেস করলে দাদু বল তো আমি কত নম্বর পাবো? মার্কসিট এনে আগে তোমায় দেখাবো। তুমি পড়ে পড়ে সব্বাইকে শোনাবে। বললাম--দাদু নম্বর যাই পাও--আবার পড়াশুনা করতে হবে। পড়া ছেড়ে দিলে চলবে না। নাতির উত্তর--দেখি একটা কোনরকম ছোটখাটো কাজ যদি পাই। দাদুর তীব্র আপত্তি---না না--আমরা সবাই মুখ্খু--পয়সা ছিল না--পোষাক ছিল না--পেটে অর্ধেক দিন খাওয়ার ছিল না। তোমাদের সরকার সাহায্য করছে তো। পড়াশুনা ছেড়ো না। কষ্টসৃষ্টে চালিয়ে নিতে হবে। খাওয়া দাওয়া সেরে যে যার শুতে গেল। ----

দাদু চশমাটা বালিশের পাশেই রাখে। রাতে পেচ্ছাব পেলে চশমা না চোখে দিতে হাঁটতে পারে না। তাছাড়া ইঁদুর মাঝে মাঝে সারা ঘর দাপিয়ে বেড়ায়। ইঁদুর তাড়াতে উঠতে হয়। বেড়াল একটা আছে সেটা ও রাতে ইঁদুরের পিছনে তাড়া করে। দুড়দাড় শব্দ হয়। আবার ক'টা ছাগলবাচ্চা আছে --পাশের জঙ্গল থেকে শেয়াল আসে ছাগলবাচ্চা গুলোর লোভে। রাতে দেখতে হয়। এই একটু আগে ছুঁচো একটা ছুটে গেল। দেখে এসে সবে শুয়েছে---ভোর হয়ে এসেছে। নাতির ডাক্ দাদু ঘুম ভেঙেছে? উঠে পড়ো--আজ আমার রেজাল্ট বেরোবে। জানতে যাচ্ছি আর নম্বর ও লিখে আনবো। তুমি পড়ে পড়ে সব্বাইকে শোনাবে।

--নাতি পরীক্ষার ফল এনেছে। দাদু নাও এবার জোরে জোরে পড়। চশমাটা দে তো দাদু। বা দাদু অনেক নম্বর হয়েছে তো। দাদু তুমি যে কি বল না --ওটা নম্বর হয়েছে?? সব্বাই কত কত নম্বর পেয়েছে জান??? সেই যে আমার বন্ধু---নদীর ধারে ওদের বাড়ি---ও গত পরীক্ষায় অনেক নম্বর পেয়েছিল। ও তো ফাস্ট হয়েছে। আমাদের অনেকেরই খুব ভালো নম্বর হয়েছে। আর আমি তো নবম শ্রেণীতে ভালো নম্বর পাইনি। ভেবেছিলাম পরীক্ষা ভালো দেবো। পরীক্ষাটাই তো হোল না।

জানো দাদু---কত মানুষ উপহাস করছে---পরীক্ষা না হয়ে নাকি আমাদের ভালো নম্বর হয়েছে। ----আর অত মন খারাপ করতে হবে না---পাস নম্বর এসেছে ওতেই হবে। না গো দাদু---আমি কোথায় পড়বো?? ঐ নম্বরে তে পড়তে পাবো না। ---পড়তে পাবি না মানে কি??--- তুমি নম্বরগুলো পড়ো না বুঝতে পারবে।----আমার চশমাটা কোথায়?? চশমাটা দে তো ভাই---ও দাদু চশমাটা দে-- নম্বর পড়ি---তোম‍রা সবাই শুনবে এসো--দাদু কতকত নম্বর পেয়েছে। আমাদের বাড়িতে প্রথম মাধ্যমিক পাশ করেছে। কই দাদু চশমাটা দাও।----চশমাটা দাও----দাদু অনেক নম্বর পেয়েছে। ও এবার বড় ক্লাসে পড়বে। বলছে ও নাকি ঔ নম্বরে পড়তে পাবে না। আমি ইস্কুলের হেডমাস্টারের পায়ে ধরে ভর্তি করাবো।--চশমাটা দাও তো ভাই।---

দাদু তোমার কি হোল? এত ডাকছো কেন? চশমাটা দে--কখন থেকে বলছি চশমাটা দে। চশমাটা একটু আবছা লাগে তাও আমি পড়তে পারবো তোর নম্বর। --দাদু উঠ--সকাল হয়েছে। চশমাটা দে-পেয়েছি দাঁড়া পড়ছি তোর নম্বর। অঙ্ক, বাংলা, ইংরেজি, ----৭৮, ৫৬, ৬৯----এই তো অনেক নম্বর--- ও হেডমাস্টার ---নাতিকে বড় ক্লাসে ভর্তি করে লাও।--- দাদু বড় ক্লাসে উঠে গেছে।

--সব্বাই জড় হয়েছে দাদুর বিছানার পাশে---দাদুর কাছে ---দাদুর হাতের মুঠোয় চশমা--দুটো হাতল আলাদা। মুখে বিড়বিড় করছে---নাতিকে বড় ক্লাসে ভর্তি করছে।

--দাদু চশমাটা তো ভেঙে ফেলেছো। আজ তোমার চশমা কেনা টাকার জন‍্যই কাজে যাবে। নম্বর বন্ধুরা আনবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ