দর্পণ || আজ মোহনবাগান দিবস ~ কৌশিক চক্রবর্ত্তী




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

আজ মোহনবাগান দিবস

কৌশিক চক্রবর্ত্তী

বিবেকানন্দ বলতেন - “পদাঘাতের বিপরীতে পদাঘাত কেবলমাত্র ফুটবলেই সম্ভব।” 

১৯১১ সালের ২৯শে জুলাই খুব পিছিয়ে যায়নি বাঙালির ফুলবল মানচিত্রে। গোরাদের পর্যুদস্ত করে কলকাতার ছেলে শিবদাসের (তৎকালীন মোহনবাগান অধিনায়ক শিবদাস ভাদুড়ী) মাথায় শিল্ডজয়ের মুকুট - ব্যাস, বাংলার ফুলবল স্বর্ণযুগের শুরু। ১৮৬৩ সালের ব্রিটেন যদি পৃথিবীকে গোলকটা চিনতে শেখায়, তবে পিছিয়ে নেই তৎকালীন নব্য বাংলাও। ১৮৮০ সালে বাংলার রেনেসাঁ লগ্নে হেয়ার সাহেবের প্রতিষ্ঠিত স্কুলে নগেন্দ্র প্রসাদ সর্বাধিকারীর (১৮৬৯-১৯৪০) হাত ধরে ফুটবলে লাথি মারতে শেখা বাঙালির। আর এই সামান্য সময়ের তফাৎটা হয়তো সেদিনই মুছে গেছিলো যেদিন কলকাতার মাঠে ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টের থেকে খালিপায়ে শিল্ডটা কেড়ে নেয় মোহনবাগান ক্লাবের অভিলাষ, সুধীর, শিবদাসরা। ইতিহাস অন্তত সেরকম কথাই বলে। সেবার শিল্ডে মোহনবাগানের উত্থান চমকপ্রদ। প্রথমে ফেবারিটের তালিকায় একেবারেই না থেকেও পরপর ব্রিটিশবধ। অবশেষে সেমিফাইনালে মিডলসেক্স একাদশকে হারাতেই সারা ভারতের চোখে চকচক করে ওঠে জাতীয়তাবাদের আগুন। এরপর ফাইনালে ইস্ট ইয়র্কশায়ার একাদশ। দ্বিতীয়ার্ধের শেষে অভিলাষ ঘোষের তেকাঠির দিকে খালিপায়ের একটা জোড়ালো লাথি ফুটবলের চামড়া ভেদ করে যেন আছড়ে পড়েছিল ক্ষুদিরাম, কানাইলালের হত্যাকারী ব্রিটিশ সরকারের বুকে। একটা জয় নাড়িয়ে দিয়েছিল আসমুদ্রহিমাচলকে। ভারতবর্ষে আবার নতুন করে বেজে উঠেছিল স্বাধীনতার ঘন্টা।

অংকের হিসাবে ১৯১১ সাল হয়তো মান্ধাতার আমল, চার প্রজন্ম পিছনে। কিন্তু একটা স্বপ্নের নেপথ্যে যতটা ইচ্ছে জড়িয়ে থাকে, তা হয়তো কোনোদিনই কালের হিসেব মানেনি, মানবেও না। আজও সময়সারণি বেয়ে ১৯১১ তে পিছিয়ে গেলে দেখা যায় ফুটবলের মোড়কে ২৯শে জুলাই ছিল বাঙালি ও বাংলার এক জাতীয়তাবাদের দিন, দেশপ্রেমের দিন। সেদিন খেলার মাঠে উঠেছিল 'বন্দেমাতরম' মহামন্ত্র। বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে এসেছিল জাতীয়তাবাদের আগুনে ঝলসে যাওয়া প্রায় ৮০ হাজার মানুষ। যুবক, বৃদ্ধ কেউ বাদ নেই সেখানে। বারাসাত, ব্যারাকপুরের মতো শহরগুলো থেকেও গরুর গাড়িতে হাজার হাজার মানুষ এসে হাজির হয় কলকাতা গড়ের মাঠে। এমনকি আসাম, বিহার, খুলনা, চট্টগ্রাম থেকেও দলে দলে মানুষ এলেন এ শহরে। সে এক আশ্চর্য কলকাতা। ফুটবলের মন্ত্রে মন্ত্রপুত বাঙালি নিজে চোখে সেদিন দেখতে এসেছিল ইউনিয়ন জ্যাকের প্রথম সমাপতন। হোক না সে ফুটবলে। কিন্তু ওই একটা দিনের পরে কেঁপেছিল স্বয়ং ইংরেজ বাহাদুরও। এরপর বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের তীব্রতা এতটাই বেগ পায় যে ওই বছরের ১২ই ডিসেম্বর বাংলাকে ভাগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য হয় ইংরেজ সরকার। 

মাঠ থেকে তখন তো আর ছিল না খেলার সরাসরি সম্প্রচারের মতো ব্যবস্থা। তাই কলকাতাবাসীকে জানান দিতে ময়দান থেকে দুই দলের গোলসংখ্যা লেখা ঘুড়ি ওড়ানো হয়েছিল আকাশে। কবি করুণানিধন বন্দ্যোপাধ্যায় এ উপলক্ষে মানসী পত্রিকায় লিখলেন-


"গোল দিয়েছে গোরার গোলে বাঙালির আজ জিত,

আকাশ ছেয়ে উঠছে উধাও উন্মাদনার গীত।"

এই দিনটায় গোরাদের হারিয়ে শুধু শিল্ডজয় নয়, স্বাধীনতার মন্ত্রে জাতীয়তাবাদী আবেগ ও আত্মবিশ্বাসের পতাকা তুলে ধরেছিলেন মোহনবাগানের ১১ জন সৈনিক। এটাই হয়তো ফুটবলধর্ম, বাঙালি অন্তত সেভাবেই খেলাটাকে চেনে: আজও।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ