পোস্ট বার দেখা হয়েছে
সংশোধনাগার
দে বা শী ষ
ভুল টাইপ, তারপর সংশোধন করতে করতে কেটে গ্যাছে চল্লিশটা বছর ;
সময়ের টাচস্ক্রিনে ঘষে, যতো আরোপিত কবিতা -
সবটাই উলঙ্গ হয়েছে ভাবনার কাছে ,
ইচ্ছের কাছে দমবন্ধ প্রকাশ - স্বপ্নের কাছে বাস্তবের কালশিটে ;
শব্দেরা রীতিমতো বিদ্রুপ করতে পারতো,
ভালোলাগা ছন্দে বিবর্তনের ইতিকথা ,
প্রতিদিনই কিছু না কিছু বিস্ফোরণ হয় -
আসে সুনামী ; ব্যাটারি চালিত শিরোনামে সৃষ্টির ঢেউ আর মর্চে -
কবিতা হয়ে ওঠার পরেও - কারেকশন টুটি টিপে ধরে,
শব্দেরা দমবন্ধ পরিস্থিতিতে কোনমতে প্রাণ হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে বানান ভুল হয়।
সংশোধন করতে কেটে যায় একটা জীবন।
*****************************
আলেয়া
অরিজিৎ রায়
ভুলেও ফিরেছ কি এ আলপথে একবার ?
দোসর বেলার কথা, নীল মেঘে ঢাকা এ সম্ভার।
নুড়ি পাথরে ফিরে পেয়েছে কি রুক্ষতা?
চলে গিয়েছিলে যেদিন, বলেছিলে সে সব কথা!
শ্রাবণে মাখিনি কোনো গন্ধ, বৃষ্টিরও উল্লাস
মেঘেদের গুম গুম কষ্ট, মেনেছি এ কষ্ট-বিলাস।
সীমানা ছুঁয়েছে দেখো অভিমানে মেঘ সব
নদী ফিরে গেছে পাহাড়ের কাছে, শুখা রব।
সবুজে সবুজ মেখে স্বপ্নের বন্যতা একাকী,
ভিখারী করেছে দাবানল, পোড়া আজ থাক কিছু বাকী!
এমনও সকাল জানি , সূর্য হাসেনি কোনো চোখে
বয়ে গেছে সাত জনমের জল , গভীরতম এ শোকে।
ফিরে যদি আসো আজ, ঐ নক্ষত্রের নীলাভ জাহাজে
অবসরে আঁকা হবে জেনো, নিহত মনের ছবি,কোলাজে!
************************************
নৌকা নোঙর,,
জয়তী
একদিন কোথায় ছিলাম?
খুব মেঘ করে আসা বিকাল আমার ছিলোনা
সামনের ওই গাছটা, নদীটা, বিষণ্ন ঘাসের নগ্ন পা
আমার জন্য ছিলো না, সংযোজিত তদ্রূপ বুলি
চিহ্নিত নাম, মেখে নেওয়া ভাতে রোদ্দুর শাক
এইসব আমার ছিলো! ভাষা শব্দ ধ্বনির প্রকরণ..
রুচি-অরুচির ঢেঁকুরের প্রয়োজন,অসুখের পানশালা
আমি তো শোষক ছিলাম, রক্ত ও জল - অন্ধ কালা
কে যেন গ্রহান্তরে উপহার দিলো অনিন্দ্য বাস..
দেওয়ালের জালিকা ছিঁড়ে, ঘিরেছে সহস্র অক্টোপাস
অজস্র খেলার রকমারী, সাজের অফুরন্ত আয়োজন, যান্ত্রিক মুখোশ
পরিযায়ী সন্ধি যাপনে স্টেথোস্মিটারে ছুটছে শ্বাস
চলন্ত যত ঢেউ, মোক্ষম ঘায়েল -স্ট্রাইকারের চোখে
থমকে বাঁচা বেসামাল খাদে, জাপটে নৌকার হাল
আজব বাস্তুবলয়, দংশক পেচিয়ে রয়েছে মাটির গোড়ায় -
গভীরে জেগে ভেজা ফুজিয়ামা, বৃষ্টি বুকে সালফার
কিলবিল করে জোঁকের লালা, উঠোনে থিকথিকে কাদা
বন্ধ খাঁচায় চিড়িয়াখানা, জিরাফের গলায় ছাপাখানা
আমি কি জেনেছিলাম, লীলাভূমির অপার হৃদয়
দেহক্ষেতে ফুঁড়ে ওঠে বিস্ময় মানুষ..
*****************************
অথচ তবুও ....
দেবলীনা
এই মুহূর্তে তোমার থেকে কয়েক যোজন দূরে
আমি,তবুও -
তোমাকে না দেখেও বলতে পারি
এই নরম সন্ধ্যার আঁচে কেমন দীপ্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছো পদাবলীর মতো
তোমাকে না শুনেও বলতে পারি
এই মুহূর্তে তোমার মনবীণার সুর তার সপ্তকে মন্দ্রিত
কেননা মাথুর তোমাকে তো সেভাবে ছুঁতে পারে না
তোমাকে না স্পর্শ করেও বলতে পারি তোমার সদ্য বৃষ্টি ভেজা ছাতিম গন্ধ আমাকে নেশায় বুঁদ করে অবিরত
তোমায় আয়ত চোখে চোখ না রেখেও বেশ বুঝতে পারি ওই কৃষ্ণ কালো চোখে অপেক্ষার আর্তি, ঘনঘোর...
এমন অজস্র নির্বিকল্প বাক্যে তুমি জড়িয়ে আছো, তোমাকে পেরিয়ে যাওয়া আমার একপ্রকার অসম্ভব
তবুও এই দেখা - শোনা - কথা মেলামেশার অন্তর্বর্তী যে ফাঁক সেখানেও তোমার নিটোল আঙুলের ছায়া লেগে....
************************************
ডিঙা_ভাসাই
সায়ন্তিকা
প্রতিবারই রোদ্দুর মাখানো সুখ ডিঙিয়ে আমি আমার চৌকাঠে এসে দাঁড়াই !
অথচ আমি অন্ধকারের অনুভূতিগুলোকেই ভালোবাসি ,
ওগুলোর মধ্যে একটা পুরুষালি গন্ধ আছে !
ছেলেবেলায় মা বলেছিলো প্রতিটা পুরুষের গায়ে আলাদা আলাদা মেঠো গন্ধ থাকে ,
কারুর গায়ে রাঙামাটির গন্ধ ,
কারুর আবার সোঁদা মাটির ۔۔۔
অথচ আমি এ যাবৎ প্রতিটা পুরুষের গায়েই প্রায় একই রকম গন্ধ পাই ۔۔۔۔রোদ্দুরে ভেজা মেঘের মতন !
আসলে পরপুরুষের মধ্যে একটা অদম্য নেশা আছে ۔۔۔বেশ একটা মাথা ঝিমঝিম ব্যাপার ,
ভালোলাগে এমন নেশায় মাতাল হয়ে প্রলাপ বকতে !
কথা ছিলো জয় গোস্বামী আর পূর্ণেন্দু পত্রী একসাথে আমার জন্য কবিতা লিখবে ۔۔۔
কিন্তু হলো কই ?
তাই জীবন নামের একটা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমি রোদ্দুর ভেজা ঘাসের আদর মাখলাম ,
তাতে অবশ্য তোমার অস্তিত্ব পুড়লো না !
নোঙ্গর বাঁধা রেখেছি ঘাটে ۔۔۔
নিজেকেও !
তবুও বেলাশেষের প্রান্তরে এসে প্রতিটা পুরুষকেই মনে হয় ভীষণ পবিত্র !
পবিত্রতা কী সত্যিই বিভেদ সৃষ্টি করতে পারে ?
আজ একবার শুধু তোমার জন্য কবিতা লিখতে চাই ۔۔۔۔
তুমি আমাকে আদর করলে আমার কবিতাও আদিখ্যেতা করতে চাইবে ۔۔۔۔۔۔এটাই শর্ত !
গঙ্গায় ভাসছে ঢেউগুলো ,
আমি ডিঙা ভাসাবো না ?
এও কী সম্ভব ?
*****************************
জন্মান্তর
তন্ময় রাণা
এ'জীবনে মিললো না জীবনের সব ভাগফল!
ভাগশেষ
হয়ে থেকে গেলো যে শুধুই কর্মফল!
আগামী জন্মে আবার না'হয় এসো,
আবার-
ভালোবাসবো তোমায় তুমি ঠিক মিলিয়ে
দেখে নিও l
মানুষ জন্মে কষ্ট ভীষণ,তুমি বরং
অন্য রূপে এসোl
মেঘ হয়ে আসো যদি,আকাশ হয়ে আগলে রাখবো-
তোমায়,মনের সুখে সেখানে ভেসো l
যদি প্রজাপতি হয়ে আসো, দেখো
ফুল হয়ে,
আমি ঠিক তোমায় আমার কাছে
টেনে নেবো l
মুক্ত হয়ে আসো যদি আমি ঝিনুক
হয়ে,
তোমাকে তখন ঠিক লুকিয়ে নেবো l
যদি শ্রাবণ হয়ে ভাসো,
আমি জলকণা হয়ে ভাসাবো তোমার
সে শ্রাবণের ধারায় জেনো l
আর যদি হও আগুনে ফাগুন,
আমি
ফাগুনের লালিমা হবো তখন l
যদি হও কোনো শরতের সকাল,
আমি শিউলি হয়ে
ঝরে,ভরাবো তোমার উঠোন l
এ জন্মে নাহয় এমন ভাগশেষ
নিয়েই থাকিl
যে'কটা দিন আছে আর এ জীবন
বাকি l
আগামী জন্মে মিলবো ঠিকই হবো
আমরা সুখী,
জড়িয়ে না'হয় আবার বলবো তোমায়,
খুউব খুউব ভালোবাসি l
****************************
পদচিহ্ন
রতন চন্দ্র রায়
কাগজের মলাটে
তোমার হৃদয়ের ভাঁজে-ভাঁজে
থাকে, অনাহত জীবন.......
চোখের মাঝে রক্ত ঝরে
অঝোরে চারপাশে,
পৃথিবীর বুকে রক্তচোষা দেয়াল.....
মাটির ফুল ফুটেছে
পরিত্যক্ত অট্টালিকায়
তোমাদের চোখের আড়ালে,
এই শহরের বুকে রেখে যায়
কত পদচিহ্ন.........
নিজেরই অজান্তে।
*****************************
হিসেব পত্র ( গল্প )
শিবাজী সান্যাল
শশধর পড়াশোনায় ছোটবেলা থেকেই খুব ভাল ছিল। কলেজে যাওয়ার পর থেকে ওর আইন সংক্রান্ত বিষয়ে উৎসাহ শুরু হয়েছিল । আইন বিষয়ক প্রচুর বই পড়ত , আইনের খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ নানা পত্রিকায় ও খবরের কাগজে বেরুলে তা পড়ে বুঝবার চেষ্টা করত। বাড়ি থেকে সবাই আশা করেছিল ও ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবে , কারণ সেসময় সেটাই সমস্ত মেধাবী ছাত্রদের জন্য একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত ভাবা হত। কিন্তু পরবর্তীতে ওর ইচ্ছে অনুযায়ী আইন পড়ুক , অনিচ্ছা সত্ত্বেও সবাই মেনে নিয়েছিল। শিলিগুড়ি ছেড়ে ও কলকাতায় গিয়ে ভর্তি হল। সময়ে খুব ভাল ভাবে পাশ করে একজন হাইকোর্টের বড় উকিলের সহকারী হিসেবে কিছুদিন কাজ করে নিজের পেশা শুরু করল। সময় লেগেছিল , তবে আস্তে আস্তে পসার জমতে শুরু করল আর একসময় হাইকোর্টের নামী উকিলদের মধ্যে ওর নাম যুক্ত হল।
এরপর কয়েক বছর এক ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যে কেটে গেল। প্রচুর কাজ , কিছু কোম্পানির নিয়মিত উপদেষ্টার দায়িত্ব , অন্য প্রদেশ থেকেও ডাক , লিপিকে বিয়ে করে সংসার পাতা , চারজন জুনিয়ার ওকে সাহায্য করার জন্য , একে একে এল সন্তানেরা শুভ আর তৃপ্তি । বাড়ির কোনো কাজেই শশধর কোনরকম সাহায্য করবার সময় পেতো না , সে সব কিছু একা হাতে লিপি সামলাতো। ছেলে মেয়ে বড় হতে লাগলো , সেই সঙ্গে শশধরের ব্যস্ততা । লিপি মাঝে মাঝে বলত , “ এবার কাজের বোঝা কিছুটা কমাও। কি হবে এত উপার্জন করে যদি তা ভোগই করতে না পারো ? ” কথাটি সত্যি , সারাদিন পরিশ্রম শেষে বাড়িতে ফিরে শশধর ক্লান্ত শরীরে ইজিচেয়ারটায় বসে সেই কথাই ভাবতো। জীবনে বৈষয়িক প্রাপ্তির আর কিছুই বাকি নেই। কলকাতা বোনেদি পাড়াতে বাংলো , শিলিগুড়ির বাড়ি বেশ কিছু খরচ করে একদম নতুন করে তোলা হয়েছে , আছে শহরতলিতে একটু গ্রামীণ পরিবেশে ফার্মহাউস , অনেকগুলো বড় কোম্পানির শেয়ার । এখন কাজ অর্থ উপার্জনের জন্য নয় , এ এক নেশা। চাইলেও বেরিয়ে আসা খুব মুশকিল।
ছেলেদের পড়াশোনা শেষ হলে ওরাও চাকরিতে ঢুকে গেল। প্রথমে তৃপ্তি , তারপর শুভর বিয়ে দিয়ে দিল। শুভ চাকরি বদল করে মুম্বাই চলে গেল , আর তৃপ্তি এখন থাকে ব্যাঙ্গালরে , ওর স্বামীও সেখানেই কাজ করে। এতবড় বাড়িটা যেন একদম খালি লাগে লিপির । শশধর একদিন বলল , “ তুমি ঠিকই বলেছিলে , এবার কাজ কমিয়ে দেব। নতুন জজের পোস্টের জন্য আবেদন করলাম , যদি হয়ে যায় তাহলে দৈনন্দিন এই কজের ভার অনেক কমে যাবে। ” ঈশ্বরের কৃপায় সত্যিই শশধর জজ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে গেল। এক নতুন দায়িত্বের কাজ শুরু হল। নিজের বাড়ি থাকায় ও সরকারি বাড়ি নিল না , কিন্তু বাকি সব সুবিধে বাতিওয়ালা গাড়ি , ড্রাইভার , সিকিউরিটি , বাড়িতে কাজের লোক , রান্নার লোক সব এসে গেল। কিন্তু সবকিছুর মধ্যেও কেন যেন মনে হত ছেলে মেয়ে দিনদিন দূরে সরে যাচ্ছে । কোনোই যোগাযোগ রাখে না , খবর নেয় না , একটি ফোন পর্যন্ত করে না। লিপি তবু ওদের ওপর দোষারোপ না করে বলত , “ নানাকাজে সব ব্যস্ত থাকে , তাই হয়ত - - - । ” শশধর তা মেনে নেয় নি , ওদের এই ভুলে থাকায় কষ্ট পেয়েছে।
কিছুদিন আগে তৃপ্তির ছেলে হয়েছে । তবে ম্যাটারনিটি লিভের ছয় মাস শেষ হতে চলেছে । হঠাৎ লিপির কাছে ফোন এল , “ মা , তুমি কিছুদিন আমার এখানে এসে থাকবে ? আমাকে এবার অফিস জয়েন করতে হব , বাপ্পাকে ক্র্যাসে দিতে সাহস পাই না। ওখানে ভাল করে দেখাশোনা করে না - - - । ” শশধর বলল , “ বেশ যাও , শেষ পর্যন্ত মাকে মনে পড়েছে । আমার লোকজন আছে , কোনো অসুবিধে হবে না । ” লিপি গিয়ে পাক্কা ছয় মাস থেকে ফিরল , তারপর আবার যেতে হল। শশধর ফোন করেছিল , “ কেমন কাটছে তোমার সময় ? একসময় ছেলেমেয়েদের জন্য করেছ , এখন নাতির জন্য কর। এই তোমার ভাগ্যে ছিল। ”
লিপি বলল , “ এমন করে কেন বলছ ? নিজের নাতির জন্য করছি , তাতে কি ? ”
“ সব স্বার্থ । এতদিনে একবারও তোমার কথা ওদের মনে পড়েছিল ? একবারও তোমাকে এসে থাকতে বলেছিল ? ”
শুভ লিপিকে ফোন করেছিল , “ মা , এখানে প্রতিমাসে একরাশ করে বাড়ির ভাড়া দিতে হচ্ছে । তাই ভাবছি একটি ফ্ল্যাট কিনব। যদি চলে যাই , বেঁচে দেব। ”
“ বেশ তো , কেন না । ”
“ আসলে সমস্যা হয়েছে টাকা। ভীষণ দাম , আমার আর মলির সেভিংস বেশি কিছু নেই। বড় অংকের লোন নিলে , এত বেশি ইএমআই হয়ে যাবে যে সামলানো যাবে না। তাই বলছিলাম তুমি একবার বাবাকে বলে লাখ পঞ্চাশ পাঠাতে পারবে ? তাহলে বাকিটা আমি ব্যবস্থা করব। ”
শুনে শশধর বলল , “ দেখলে তো , শুধু নিজেদের প্রয়োজনে কথা বলবে , হাত পেতে চাইবে , আর নইলে আমাদের ভালমন্দ নিয়ে ওদের কোনো চিন্তা নেই । ” তবে যতই রাগ হোক , ছেলের জন্য টাকা পাঠাবার ব্যবস্থা শশধর ঠিকই করেছিল।
জীবনের সফলতা বা সুখ কি দিয়ে সত্যিকার ভাবে বিচার করা সম্ভব ? শশধর এ নিয়ে অনেক ভেবেছে কিন্তু কোনো সঠিক উত্তর খুঁজে পায় নি। স্বাভাবিক ভাবে যা পেলে সমাজে সফল বলা হয় , যেমন বাড়ি , গাড়ি , ব্যাঙ্কে মোটা ফিক্সড ডিপোজিট , ছেলেমেয়েদের ভাল দামী স্কুল কলেজে পড়িয়ে শিক্ষিত করা , এ সবই পূর্ণ হয়েছে। তবুও দিনান্তে যখন নিজেকে নিয়ে একটু ভাববার অবকাশ পাওয়া যায় , মনে হয় একটি দিক যেন দুর্বল থেকে গেছে। ছেলেরা কাজের প্রয়োজনে বাইরে যাবে তা , দূরে থাকবে তা মেনে নিতে কষ্ট হয় না। কিন্তু তাই বলে এই উপেক্ষা ? ওদের ব্যবহারে এতটুকু শ্রদ্ধা বা ভালবাসার অনুভব থাকবে না ? যা কালে ভদ্রে ফোন আসে তা শুধু ওদের নিজেদের প্রয়োজনে , কখনও বাবা মায়ের কুশলতা জানতে নয়।
শশধর রিটায়ার করার পর এই বোধ যেন আরও প্রকট হয়ে উঠল। একাকিত্ব চারদিক থেকে ঘিরে ধরল। শুভ একবারও বলল না ‘ বাবা তোমরা এবার কিছুদিনের জন্য আমার এখনে চলে এস। ’ সন্ধ্যা বেলায় পার্কে হাঁটার পর কিছু বন্ধু ওরা এক জায়গায় বসে গল্প করে । সেখানে একমাত্র রতিকান্তকে সবচাইতে সুখি মনে হয়। দুই ছেলে বিদেশে থাকে সর্বদা ওদের খবর নেয় , প্রতি বছর নিয়ম করে বছরের ছয় মাস পালা করে দুই ছেলের বাড়িতে থাকে বাকি ছয় মাস এখানে। তবে বাকি অধিকাংশের জীবন কাহিনী একই প্রকার। একটি চাপা যন্ত্রণা বুকে নিয়ে এরা দিন কাটাচ্ছে। সেবার শুভই ফোন করে বলল , “ বাবা , অনেকদিন তোমাদের সঙ্গে দেখা হয় নি তাই এবার তোমার জন্মদিনে আমরা কলকাতা আসছি। আমি তৃপ্তির সঙ্গেও কথা বলেছি , ওরাও আসছে । সবাই মিলে আমরা খুব ধুমধাম করে সেলিব্রেট করব । ” শুনে শশধরের মন খুশিতে ভরে গেল । এতদিন প্রতি মুহূর্তে যে কষ্ট অনুভব করত , ওদের নিয়ে নানা কিছু ভাবত , তা নিমেষে দূর হয়ে গেল। লিপি খুশি হয়ে বলল , “ আমি তোমাকে বলেছিলাম না , ওরা আমাদের ভীষণ ভালবাসে। তুমিই শুধু শুধু ভেবে অস্থির হতে। ” এরপর শুধুই অপেক্ষার পালা। প্রতিদিন ক্যালেন্ডার দেখে দিন গোনা । কি কি রান্না হবে দুজনে বসে ঠিক করা। ওদের থাকাকালিন আশেপাশে কোথায় বেড়াতে যাবে তার ভাবনা , মাঝে মাঝে বাইরে কোথায় খেতে যাবে তারও লিস্ট তৈরি করা , সব হয়ে গেল। ওদের ঘরগুলো আবার করে পরিষ্কার করা হল , জানালার পর্দা বদলানো হল , পরিবর্তন করে সাজানো হল। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস , তৃপ্তি আসার তিন দিন আগে জানালো ওর এক জরুরি কাজ পড়ে গেছে তাই আসতে পারব না। আর ঠিক একদিন আগে শুভর বউ জানালো শুভ হঠাৎ জার্মানি যাচ্ছে তাই আসতে পারছে না। শশধর চুপচাপ অনেকক্ষণ বসে রইল , যেন এই আকস্মিক আহত প্রত্যাশায় পাথর হয়ে গেছে। লিপি কাছে এসে ওর ঘাড়ে শান্তনার হাত রাখল , তাপর আঁচল দিয়ে চোখ মুছলো।
শশধর ইউরোপ বেড়াতে যাবার টিকিট করে এনে বলল , “ তৈরি হও , আমরা পনের দিনের জন্য ইউরোপ যাচ্ছি। ”
শুনে লিপি আশ্চর্য হয়ে বলল , “ সে কি ? হঠাৎ এতদূর বেড়াতে যাবার ব্যবস্থা করলে কেন ? ”
“ এই তো শুরু । এবার থেকে আমরা সারা পৃথিবী ঘুরে ঘুরে দেখব। প্রাণভরে খরচ করব । আমাদের কষ্টে অর্জিত টাকায় আমরা যা মন চায় তাই করব। কারও জন্য এ টাকা জমিয়ে রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। ” যেমন কথা তেমন কাজ। এই প্রথম লিপি দেশের বাইরে বেরুল। ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ ঘুরে মন ভরে গেল। কত সুন্দর করে সাজানো সব শহর , পর্যটকদের জন্য কত রকমের আকর্ষণীয় ব্যবস্থা । ফিরে এসে আবার ছয় মাস পরে শশধর আমেরিকা যাবার ব্যবস্থা করে ফেলল। সেও এক মনোমুগ্ধকর অভিজ্ঞতা । ওরা ফিরে এলে শুভ মাকে ফোনে জিজ্ঞেস করল , “ তোমরা নানা জায়গায় বেড়াতে যাচ্ছ ভাল কথা , কিন্তু এত তাড়াতাড়ি , পরপর ? ”
লিপি বলল , “ আমি কিচ্ছু জানি না বাবা । তবে তোমরা যদি আমাদের কথা না ভাব , শুধু নিজেদের নিয়েই মেতে থাকো , তবে কিন্তু পরে পস্তাবে মনে রেখো। উনি ভীষণ রেগে আছেন। ”
শুধু বিদেশেই নয় , দেশের মধ্যেও ওরা বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে লাগল । কিছু দেখা জায়গাও আবার করে পৌঁছে গেল। আর সেখানকার দামী হোটেলে থাকার ব্যবস্থা । লিপি বলল , “ কি করছ তুমি ? এত দামী হোটেলের কি দরকার ? এখানে এক কাপ চা ১০০ টাকা , লন্ড্রিতে একটি পাজামা ২০০ টাকা চার্জ করছে। ”
শশধর হাসতে হাসতে বলল , “ টাকার জন্য ভেবো না , মন ভরে উপভোগ কর। তুমি যদি চাও চল আজই কোনো মলে গিয়ে তোমার জন্য ডিজাইনার ড্রেস কিনে আনি। বেশ মানাবে তোমাকে । তারপর তোমার ছবি তুলে ফেসবুকে লাগিয়ে দেব। দেখুক আমাদের পুত্র আর কন্যা। ”
“ রক্ষে কর ! ”
সেদিন সন্ধ্যা বেলা রোজকার মত শশধর হেঁটে বাড়িতে ফিরে ব্যালকনিতে বসে চা খাচ্ছিল, হঠাৎ শরীরটা খারাপ হয়েছে মনে হল। বেশ ঘাম হচ্ছিল আর বুকে একটা অস্বস্তি । পাড়ার ডাক্তার দেখে হাসপাতালে পাঠাতে বললেন। হাসপাতালে দুদিন থাকতে হল , নানা রকমর সব টেস্ট হল , তবে লিপি স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল যখন ডাক্তার বললেন যে না তেমন ভাববার কিছু নেই তবে এখন থেকে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে আর শরীরের ওজন কমাতে হবে। হাসপাতালে থাকাকালিন শশধর খুব আশা করেছিল শুভ এসে পাশে দাঁড়াবে , তৃপ্তিও আসবে , কিন্তু ওরা কেউ আসে নি। শুধু কয়েকবার ফোন করে লিপির কাছ থেকে খবর নিয়েছে।
সবাইকে অবাক্ করে দিয়ে শশধর কলকাতার বাড়ি বেচে দিল। লিপি বলল , “ এ তুমি কি করলে ? তিল তিল করে সাজানো এই সুন্দর বাড়ি বেচে দিলে ? আর শুভ যদি কখনও এখানে ফিরে আসে , ও কোথায় থাকবে ? ”
“ মুম্বাইতে যেভাবে আছে , ভাড়া করে। ক্ষমতা থাকলে নিজে করে নেবে। ” এ খবর পেয়ে শুভ যেন আকাশ থেকে পড়ল। বাবাকে জিজ্ঞাসা করার সাহস নেই , তাই মাকে বলল , “ এ কিন্তু বাবা ঠিক করল না। আমাদের ভবিষ্যতের কথা একবারও ভাবল না। ” তৃপ্তি বলল , “ আমারও একটা ভাগ আছে । যদি বিক্রির টাকা বাবা দাদাকে দেয় , তবে যেন আমার অংশ আমাকে দিতে বলবে ।
” লিপি বলল , “ তুইও ভাগ দাবি করছিস ? ”
“ কেন করব না , এ আমার অধিকার । এই তো আমার ননদ ওর ভাগের থেকে সব হিসেব করে নিয়ে গেল । আমি চাইলেই দোষ ? ”
শশধর বাড়ির সব প্যাকিং এ ব্যস্ত ছিল । বুঝতে পেরেছিল শুভ আর তৃপ্তি এ নিয়ে মায়ের সঙ্গে কথা বলেছে। তাই লিপিকে বলল , “ ওদের পরিষ্কার বলে দেবে যে আমার কাছ থেকে যেন কিছু আশা না করে । আমার নিজের তৈরি বাড়ি , আমি বেচেছি , এর থেকে ওদের জন্য কোনো কিছুই রেখে যাব না। ”
শিলিগুড়িতে এসে আবার করে সব সাজানো হল। দীর্ঘদিন পর আবার ফিরে সব যেন নতুন লাগছিল। সামনের জায়গায় শশধর নানা রকমের ফুলের গাছ লাগাল। পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করল, সঙ্গে বেশ কিছু সেবামূলক প্রতিষ্ঠান , মন্দির ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করতে লাগল। লিপি লক্ষ্য করছিল প্রায়ই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে লোক এসে দানের চেক নিয়ে যাচ্ছে। তবে তা না বলে শুভকে বলল , “ দেখ তুই এসে বাবার সঙ্গে কথা বলে ওকে একটু শান্ত কর। ও তোদের ব্যবহারে খুব দুঃখ পেয়েছে , নইলে পরে কিন্তু সবকিছু হাতের বাইরে চলে যাবে । ”
শুভ বুঝতে পারল বাবা রেগে গিয়ে বেপোরোয়া হয়ে সব শেষ করে দেবার মনস্থির করেছে। দেরি হলে আর বোঝাবার অবকাশও থাকবে না। তাই শুভ স্ত্রী পুত্র নিয়ে শিলিগুড়িতে এল।কিন্তু কেন যেন একটা আরষ্ঠতা ওকে বাবার সামনে বসে খোলাখুলি কথা বলতে বাধা হয়ে রইল। কয়েকবার চেষ্টা করেও কিছুই বলতে পারল না। তৃতীয় দিন শুভ পরিবার নিয়ে দার্জিলিং বেড়াতে গেল । ওখান থেকে কার্সিয়াং , গ্যাংটক বেড়িয়ে পাঁচ দিন পর ফিরল। দুদিন থেকে আবার জলদাপাড়া বেড়াতে চলে গেল। তারপর ফিরে পরদিন বাগডোগড়া থেকে প্লেন ধরে কলকাতা হয়ে মুম্বাই চলে গেল। শশধর পুরোনো এ্যালবাম থেকে শুভর ছবি দেখছিল আর সেইসব স্মৃতি মনে পড়ছিল। কি ভীষণ ভালবাসত ও বাবাকে। লিপি বলত ও তোমার নেওটা হয়েছে। অসুখ হলে ওকে সারাক্ষণ বুকে চেপে থাকত। ওর ওষুধ খাওয়ানো , ঘুম পাড়ানো সব বাবাই করত। লিপি পেছনে এসে দাঁড়াল , কষ্টে ওর বুক ফেটে যাচ্ছিল শশধরের যন্ত্রণা দেখে। শশধর মুখ তুলে লিপিকে দেখে বলল , “ সব কিছু এত তাড়াতাড়ি এমন বদলে গেল কেন বলত ? আমরা কি আমাদের দায়িত্বে কোনো কমতি করেছিলাম ? কিছুই তো চাই নি , শুধু একটু ভালবাসা , তাও ওরা - - - । ” শশধরের গলা ভারি হয়ে এল।
এরপর শিলিগুড়ির বাড়িও বিক্রি হয়ে গেল। শশধর বলল , “ কি হবে এতবড় বাড়ি রেখে ? ছেলে মেয়েরা তো কখনও আসেও না । আমি কার্সিয়াং এ একটি ছোট বাড়ির ব্যবস্থা করেছি , চল জীবনের শেষ কটা দিন সবার থেকে দূরে আলাদা প্রাকৃতিক পরিবেশে গিয়ে থাকি। ” এরপর ছেলে মেয়ে দুজনেই ভীষণ রেগে গেল। বাবা ওদের প্রতি সম্পূর্ণ অবিচার করে চলেছে বলে মনে হল। ফলে যেটুকু যোগাযোগ ছিল তাও প্রায় শূন্যে এসে দাঁড়াল।
ছোট্ট এই পাহাড়ী পরিবেশে আবার এক জীবন শুরু হল। ওরা দুজনে সকালে হাঁটতে যেত , ফেরার পথে কিছু শাক সব্জি কিনে আনত। এক নেপালী কাজের লোক ধুমাং বাড়ির সব কাজ করত। ঘরদোর পরিষ্কার , বাগান দেখা , রান্না করা সব। শশধরকে সময়মত খাওয়া বা ওষুধ দেওয়া তাও করত। এ শুধু ওদের দুজনের জীবন। কারো সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই , আশেপাশে কেউ বন্ধু বান্ধব নেই। এর মধ্যে শুভ আর তৃপ্তির জন্মদিন এল। ওরা দুজনে খোঁজ নিয়ে অনেক দূরে একটি মন্দিরে গিয়ে পূজো দিয়ে এল। শশধর মুখ ফুটে বলত না কিন্তু লিপি বেশ বুঝতে পারত ওর অনেকটা সময় শুধু শুভ আর তৃপ্তির কথা ভেবেই কেটে যেত। বাইরের বারান্দায় চেয়ারে বসে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকত , যেন অনেক প্রশ্ন ওর দুচোখে , যার কোনো উত্তর ওর কাছে নেই। এমনই এক সন্ধ্যায় সেই চেয়ারে বসেই ওর শরীর নিস্তেজ হয়ে গেল , মাথাটা একদিকে ঝুকে রইল।
শ্রাদ্ধের আগে শুভ আর তৃপ্তি এসে পৌঁছল। কাজের দিন শিলিগুড়ি থেকে শশধরের বিশেষ বন্ধু গৌতম সেন এল। শ্রাদ্ধের কাজ শেষে , পুরোহিত বিদায় নিলে গৌতম সবাইকে ডেকে শশধরের উইল শুভর হাতে তুলে দিল , বলল , “ শশধর এটা আমাকে দিয়েছিল যাতে সময়মত আমি এটা তোমাদের হাতে দিতে পারি। সমস্ত সম্পত্তি , কলকাতার এবং শিলিগুড়ির বাড়ি , কোম্পানির শেয়ার , ব্যাঙ্কের ফিক্স ডিপোজিট , সব কিছু ও তোমাদের দুই ভাই বোনকে আধা আধা করে দিয়ে গেছে । ”
শুভ আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করল , “ কিন্তু কলকাতা আর শিলিগুড়ির বাড়ি তো বিক্রি হয়ে গেছে ! ”
“ না কিছুই বিক্রি হয় নি । এ শুধু তোমাদের কাছে ফিরে পাবার জন্য ওর এক প্রয়াস ছিল। তবে তা কাজে লাগে নি। লিপি বৌদি পেনশনের টাকার সঙ্গে মাসিক ব্যাঙ্ক থেকে আমৃত্যু টাকা পাবেন তার ব্যবস্থাও করে গেছে। বৌদির অবর্তমানে , সে টাকাও তোমরা দুজনে পাবে। বড় দুঃখে কাটাল জীবন শশধর , তোমরা ওকে বুঝতে পার নি। তোমাদের থেকে একটু ভালবাসা পেতে ও কাঙ্গালের মত অপেক্ষা করেছে। ”
ফিরে যাবার আগের দিন শুভ বলল , “ মা , তুমি গুছিয়ে নাও , আমি তোমাকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাব । ”
তৃপ্তি বলল , “ না দাদা , মা এখন কিছুদিন আমার কাছে থাকবে। পরে না হয় তোর কাছে যাবে । ”
লিপি অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর নীরবতা ভেঙে বলল , “ আমি কোথাও যাব না । আমি এখানেই থাকব । ”
0 মন্তব্যসমূহ