দিনলিপির মালা ~ সাবিত্রী জানা সন্নিগ্রহী




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

দিনলিপির মালা

সাবিত্রী জানা সন্নিগ্রহী

গল্প -১

সবুজের সকাল-সন্ধ‍্যে


           ওদের দিনলিপি কি মধুর। ভোর হওয়ার সাথেই লেখা হয় সূয‍্যিমামা ও সবুজের দিনলিপি। পূব আকাশে সূয‍্যিমামা উঁকি দেওয়ার আগেই ওরা জেগে ওঠে। ওরা সবুজের জীবন। লতাগুলো তাদের নরম আগাগুলোকে ঊর্ধপানে তাকাতে নির্দেশ দেয়। কচি সেগুনবাগিচার সোজা কান্ড তার চওড়া পাতাগুলোকে মেলে দেয়। শিশু

সূয‍্যিমামাকে অভিবাদন জানায়--। সূর্যের আগমন বার্তা পেলেই স‍্যালুট জানায় বন অতসীর দল। আগায় আগায় সেজে থাকে হলুদ ফুলের সারিদল। আর লজ্জাবতী, আমলকি গাছ একটু অভিমানী---পূব আকাশ রাঙা না হলে ওদের পাতার জড়তা কাটে না। সূয‍্যিমামার ছোঁয়া পেলেই ছোট ছোট পাতাগুলো ঘুমের জগৎ থেকে বেরিয়ে মেলে দেয় ডানার মতো। আলতো সকালের নরম রোদের ছোঁয়া পেয়ে জেগে ওঠে মাচার উপর দিগন্তজোড়া করলার হলুদ ফুল-- পথের পাশে অবহেলায় বাড়তে থাকা পুরুল/ধুধুল/বনঝিঙ্গের হলুদ পাঁচটি পাঁপড়ি যেন বলে--আমরা জেগে উঠেছি। ---বাহারি কলমী তার ডালপালায় ফুটিয়ে দেয় বাদামী ফুল। ফুটে ওঠে তরুলতার রক্তরাঙা ছোট্ট ছোট্ট লালতারা। জবাগাছগুলো সাজতে আরম্ভ করে। কেউ লাল, কেউ হলুদ, কেউ বেগুনি। আর গোলাপি গোলাপ মুচকি মুচকি হেসে হেসে তার রূপের ডালি সাজায়। সূয‍্যিমামার সাথে শিউলিগাছের বেশ দ্বন্দ্ব আছে। সূর্য ওঠার আগেই রেগে নিজের গা থেকে সব ফুল ঝরিয়ে দেয়। -বেলা বাড়ে--দিনের সূয‍্যিমামার ঘন্টায় বয়স বাড়ে--সবুজেরা লুটেপুটে নেয় সূর্যরশ্মির কনা--গ্রহন করে সবুজ অনুকনা--জল জোগান দেয় শেকড় আর বাতাস জোগায় জীবের বিষবায়ু। পাতার ভেতর চলে রান্নার কাজ--খাদ‍্য তৈরির প্রক্রিয়া। ----সূয‍্যিমামার তাড়া আছে---অন‍্যদেশে যেতে।হবে---বিকেল হয়---সবুজ গাছেরা তারা ও ক্লান্ত হয়। যে যতটুকু পারলো খাদ‍্য বানিয়ে নিল---খরচ করলো---নিজেদের কাজের জন্য। বাকীটা জমিয়ে রাখলো---হয় নিজেদের জন্য বা অন‍্য জীবেদের জন্য।

---বিকেল হয়--ক্লান্ত হয় পাতা--ক্লান্ত হয় সকালে ফোটা ফুল--ঘুমভাঙা পাতাগুলো। 

             না সবাই যে ঘুমিয়ে পড়ে তা নয়। মাঠে ধীরে ধীরে জেগে ওঠে ঝিঙেগাছের হলুদফুলের রূপ। মাচার উপর হলুদফুলের অপরূপ রূপ----বোধহয় সূয‍্যিমামাকে বিদায় জানায়। ---আঁধার নামে---ঘুমিয়ে পড়ে আমলকি পাতা---লজ্জাবতী পাতা। দিনের আলোয় লজ্জা পেয়ে অবগুন্ঠিত থাকে নিশিপদ্ম ফুল। বিকেল থেকে প্রস্তুত নেয় কখন সূয‍্যিমামা অন‍্যদেশে পাড়ি দেবে। লজ্জা কাটবে নিশিপদ্ম ফুলের। আঁধার নামলো---উপরের পাঁপড়ি একটু মুখ খুললো---বোধহয় অন‍্যদের সংকেত দিল---এবার জাগবো মোরা--মেলবো পাঁপড়ি---ক্রমশঃ। রাত দশটা-সাড়ে দশটা খুশীতে ডগমগ শ্বেতশুভ্র পাঁপড়িগুলো। আর গন্ধ বিলিয়ে বায়ুকে খুশী করে। সাথী হয় দোলনচাঁপা, কামিনী। নিশিপদ্ম বেশ লাজুক। ভোর হওয়ার আগেই অবগুন্ঠন দিয়ে দেয় শ্বেতপাঁপড়িগুলোকে। না ওরা আর জাগে না। জেগে ওঠে নতুন কুঁড়ি।

-----ওরা সব যৌথসংসারের বাসিন্দা---ওরা সবুজের পতাকা ওড়ায়, পতাকায় বাহারি রঙের কেরামতি চলে--ওদের দিনলিপি ওরা লেখে--নিজের রূপে--নিজের গন্ধে--বিলিয়ে দেয় বাতাসে--আমাদের আশেপাশে।--রোজ রোজ দিয়ে যায় দিনলিপির রঙবাহারি আলপনা।


গল্প ২

পথের দিনলিপি


  পথের তো প্রাণ নেই তার আবার দিনলিপি কি? আছে আছে। সারারাত চুপচাপ একা পড়ে থাকে। সন্ধ্যায় খুব কম জীবনের আনাগোনা চলে---কুকুরগুলো বিকেল হলেই আস্তানায় ফিরে যায়। পথিকেরা খুব অসুবিধা ছাড়া পথে পা দেয় না। আর পাখিগুলো তো মহা ভীতু। বিকেল হওয়ার আগেই গাছের ডালে বসে গপ্পো জুড়ে দেবে নিজেদের মতো।---ভোর হওয়ার আগে থেকে পথের দুর্দশার শেষ থাকে না। কুকুরগুলো দলবেঁধে ছুটে চলে মাঠের পানে---টয়লেটে যায়--ফিরে আসে একসাথে। পাখিগুলো গাছের ডাল ছেড়ে নেমে পড়ে কীট খুঁজতে। ওরা তো পথের বন্ধুবান্ধব। আর গাড়ি গুলো !!! যেমনি হাড় কাঁপানো শব্দ তেমনি আঘাতে আঘাতে জেরবার করে দেয় ছুটে চলা যানবাহনগুলো। মানুষের হাতে থাকে চালনযন্ত্র---কোনটা আটারো চাকা তো কোনটা আটচাকা কোনটা চারচাকা কোনটা দুই চাকা। ছুটে চলে সারি সারি ট্রাক। কারোর পিঠে বড় বড় পাথর তো কারোর পিঠে বালি, সিমেন্ট।--ধোঁয়া ছেড়ে --শব্দ বিলিয়ে মনের সুখে ছুটে চলে দূরদূরান্ত। আবার ছোট গাড়ি--কেউ যায় অসুস্থ মানুষ নিয়ে। ছুটে চলেছে কোন ডাক্তারখানায় বা হাসপাতালে। ভোরবেলায় দ্বিযানে ছুটে চলে আরোহী--পেছনে বাঁধা আনাজের বস্তা--ছুটছে-ছুটছে-ছুটছে--দলে দলে--বাজারে--বিক্রি হবে সবজি--কিনতে হবে বাড়ির ব‍্যবহার্য জিনিসপত্র। হ‍্যাঁ ---পথের কষ্টের সাথী কেউ নেই। একা একা সহ‍্য করে সব যন্ত্রণা। সহ‍্য করতে করতে একদিন গায়ের আবরণ ছিন্নভিন্ন হয়। খাবলা খাবলা অংশ কোথায় উড়ে যায় কেউ জানে না। ---কোন সাইকেল আরোহী আছাড় খায়---নেতিয়ে পড়ে রাস্তার উপর। রাস্তা অসহায় ভাবে মানুষটির সাথে যন্ত্রণা সহ‍্য করে।----রাস্তার দিনলিপি কেউ লেখে না--কেউ ভাবে না। না না ভাবে তো-----ছেঁড়া কাপড়ে তালি দেওয়ার মতো। তালি পড়ে---চাপড়া চাপড়া কালো পিচসহ পাথর। সেই তালে ও ফুটিফাটা হয়। রাস্তার দিনলিপি চলে এভাবেই।---রাস্তার দিনযাপন এভাবেই চলে। দিনলিপি নিজেই লেখে---পড়ে না কেউ-কাজে লাগে না পড়ে---শুধুই সময় ধ্বংস হয়।


গল্প ৩

সংগ্রামের দিনলিপি


     ----চলে বছরভর। দিনআনা--দিনখাওয়া মানুষদের। মাঠে ফসল ফলানো উদ‍্যোগীদের। বৃষ্টিঋতু আসার সাথে সাথেই ভোরবেলায় ঘুম থেকে ওঠার তাড়া থাকে---তাড়া থাকে বীজ বোনার--ঘাস তোলার---মাচা তৈরির--সার দেওয়ার---সবজি তোলার ---সবজি বিক্রির। বাড়ির বাবা, মা, ছেলে, বৌ সবাই মিলে ছুটতে থাকে ভোরবেলায় মাঠের পানে। কোথাও সাইকেলে বাবা মা, মোটরসাইকেলে ছেলে-বৌ। কোথাও দ্রুত হেঁটে চলেছে ভোরের ঘরকন্নার কাজ সেরে আসা বৌ---হাতে জলের শিশি, পলিথিনের ব‍্যাগে মুড়ি। কারোর আছে "কাল্লা" মাচা/করলা মাচা, কারোর আছে লাউ মাচা, কারোর আছে ঝিঙ্গে মাচা, কারোর আছে কুমড়া ক্ষেত। কারোর আছে পটল তো কারোর আছে কচুচাষ। সূর্য ওঠার আগেই মাচা থেকে তোলা হয়ে যায় সবজি। ডাঁই করে রাখে পথের পাশে। --থলে ভর্তি করে। নিয়ে যায় পথের পাশে আড়ৎদারের কাছে। সাইকেলে ঠেলে নিয়ে যায়, মোটর সাইকেলের পেছনে বেঁধে নিয়ে যায় বা মাথায় বড় ডালায় নিয়ে যায়। আড়ৎদার আর এক সংগ্রামে ব‍্যস্ত। কতটা কম দামে কৃষকের নিকট থেকে কিনতে পারবে তার হিসেব চলে মাথার মধ্যে।----চলে কথোপকথন ----কাল্লা কত করে-----আটটাকা কিলো----না দশটাকা দিতে হবে। আটটাকার বেশি হবেক নাই। -----তাই দাও-----পয়সা আজ দিলে ভালো হয়----আজ হবেক নাই-----আছি তো-----পয়সা ঠিক পাবি----লে ঢাল তো------ঢেলে দেয় মাটিতে বিছানো কালো পলিথিনের উপর। ----বেলা বাড়তে থাকে----পলিথিন ভরে ওঠে সবজিতে। একদিকে করলা, মাঝে ঝিঙ্গে, আর একদিকে শশা, লাউ, পটল। ঘরে ফিরে যায়---সবজি চাষের মালিকেরা। সবজি জেগে বসে থাকে আড়ৎদার। লরি আসবে--সব সবজি লরিতে উঠবে----গাড়ি চেপে কতদূর যাবে কে জানে!!!! না কি শহরে যাবে। লরির ভর্তি সবজির মালিক পরে দেবে সবজির টাকা---দেবে আড়ৎদারকে ঐ কথোপকথন শোনা যায় না। ওটা বড়দের ব‍্যাপার। আড়ৎদার দেবে সবজি চাষের মালিককে। এক দীর্ঘ দিনলিপি। সংগ্রামের দিনলিপি----মাঠে সংগ্রাম--সবুজ ফলানোর সংগ্রাম--সবজি বিক্রির সংগ্রাম---যা খাতার পাতায় লেখা হয় না। লেখা থাকে সবজি মাঠে--মাটিতে, লেখা থাকে মনের অন্দরে--সংসারের কোনায়, লেখা থাকে লরির উপরে---লেখা থাকে-----খুচরো সবজি বিক্রেতার ওজনদাঁড়িতে।

----------এই সংগ্রামের দিনলিপিতে কষ্ট লেখা থাকে না---থাকে আশা---থাকে আগ্রহ----থাকে বেঁচে থাকার চাবিকাঠি----বাঁচিয়ে মাটি, জল, বায়ু, রোদ। আশার দিনলিপি যোগায় প্রকৃতির আশির্বাদ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ