দর্পণ | ফেসবুক সাপ্তাহিক নির্বাচিত কলম | গল্প




পোস্ট বার দেখা হয়েছে


 
মুখেভাত (অনুগল্প)
অপর্ণা


বিকলাঙ্গ হয়ে জন্মানোর অপরাধেই হয়তো ফেলে গেছে গর্ভধারিনী...বা ফেলে যেতে বাধ্য হয়েছে...

মাতাল হলেও অমানুষ হতে পারেনি সেদিন বীরজু...বাচ্চা টাকে দেখে পাশ কাটিয়ে না গিয়ে, কুড়িয়ে এনে হাসপাতালে জমা দিয়েছিল...

তাইতো নিঃসন্তান ডক্টর তিয়াসা পালের চিকিৎসাধীন ছেলে আনন্দর আজ মুখে ভাত...বীরজু মামার হাতে..




বিষাক্ত কলঙ্ক 
রত্না চক্রবর্তী 


ছিঃ ছিঃ এই বয়েসে এসে যে ঝুনু এমন একটা কান্ড ঘটাবে কেউ ভাবতে পেরেছিল?অত বড় বংশের মেয়ে।।তার কিনা এমন নীচ কাজ। ভাবা যায়! তা এতই যদি শখ ছিল বয়সকালে বিয়ে করলেই তো হত। বাপের টাকাপয়সার তো অভাব ছিল না। তিন চারটে সম্বন্ধও তো এসেছিল। একটা খুব গরিব খেতে না পাওয়া ঘরের সুস্থ সবল ছেলে। বলেছিল বিয়ে করতে রাজী শুধু তার আর তার পরিবারের পাঁচ জন সদস্যের দায়িত্ব এনাদের নিতে হবে।তা ঝুনুর বাবার যা টাকা পয়সা ছিল, সে দায়িত্ব তিনি নিতেই পারতেন। ওনাদের বাড়িতে তো কতই মানুষ আশ্রিত থাকে। কিন্তু ঝুনু তখন বেঁকে বসল। কিছুতেই রাজী হল না। বলল যে বিয়ে করতে চাইছে সে তো টাকা আর নিরাপদ জীবনের লোভে বিয়ে করতে চাইছে। ভালোবেসে তো আর বিয়ে করতে চাইছে না। পরে ঠিক ঝুনু তার কাছে ভার বোঝা হয়ে যাবে। পোলিও রোগীকে সারাজীবন বয়ে বেরানো তো সহজ নয়। হ্যাঁ ঝুনুর বাঁ পা টা পোলিওতে পঙ্গু।খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঘরের মধ্যেই হাঁটাচলাটুকু করতে পারে। একই ভাবে আরো দুটো সম্বন্ধও ফিরিয়েছিল সে।একজন দোজবর, অন্যজনের একটা চোখ পাথরের ছিল। দুই বৌদি, মা, খুড়ি জ্যেঠিরা অনেক বুঝিয়েছিল তখন। তারপর একসময় হাল ছেড়ে দিয়েছিল।।সবাই ধরেই নিয়েছিল ঝুনুর বিয়েথা সংসারে মন নেই। সংসারে একটা দামী আসবাবের মতই ছিল সে।যত্নের ত্রুটি ছিল না। কিন্তু তার নিজস্ব অস্তিত্ব সত্তা মতামত এসব নিয়ে কেউ কখনও মাথা ঘামায় নি। 
ঝুনুর বাবা অবশ্য নিজের ছেলেদের চিনতেন। বরং বলা ভালো তিনি নিজেকে আর নিজের বংশকে ভালো চিনতেন।সম্পত্তি নিয়ে ভ্রাতৃবিরোধ এই বংশে পরম্পরায় চলে এসেছে।।তাই ঝুনুর বাবা পাকাপাকি ভাবে ব্যবস্থা করেছিলেন যে ঝুনু যতদিন বাঁচবে এই বাড়িতে সে থাকতে পারবে ও সকল সম্পত্তি ভোগদখল করতে পারবে, যাতে কোন ভাই তাকে বঞ্চিত করে তাড়িয়ে দিতে না পারে। আবার মেয়েকে সম্পত্তির ভাগও দিলেন না। কারণ প্রথমত পুরুষতান্ত্রিক ছিলেন। মেয়েদের মনে করতেন বুদ্ধিহীন।ন বলতেন -"যাদের আটহাত কাপড়ে কাছা নেই তাদের হাতে রান্নাঘর থাকাই ভালো, দলিল দস্তাবেজ নয়।"  
তবে এটাই যে একমাত্র কারণ সেটাও পুরোপুরি সত্য নয়।আসলে তার ভয় হয়েছিল যে সম্পত্তির ভাগ দিলে তার এই পঙ্গু মেয়েকে তার গুণধর দুই পুত্র হয়ত বিষ দিয়ে মেরেও ফেলতে পারে। কথায় আছে বিষয় বিষ। তাও যদি মেজ ছেলেটা থাকত তবু তিনি ভরসা পেতেন। সে বড় আর ছোট ছেলের মত এত অর্থলোভী ছিল না। কিন্তু যে নেই তার কথা ভেবে আর কি করবেন তিনি। তিনি বিচক্ষণ মানুষ ছিলেন। তার ভাবনা যে অমূলক নয় তা প্রমাণ হল তিনি চোখ বুজতেই। বড় আর ছোট ছেলে দুজনেই সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ শুরু করল।নেহাত বোনের ভাগ নেই, তাই বোনের দিকে কারো কোপ দৃষ্টি গেল না।প্রথমে মামলা দায়ের করা হল। তারপর ভিটের মাঝখান দিয়ে দেওয়াল উঠল।এখন তো অবস্থা এমন যে যেকোনদিন দুজন দুজনকে খুনও করতে পারে। দুই পরিবারে পরিবারে মুখ দেখাদেখিও বন্ধ। কিন্তু ঝুনুর দুই পরিবারেই অবাধ যাতায়াত। দুজনেই তার কাছে প্রাণ খুলে নিন্দে মন্দ করে, শাপশাপান্ত করে।।ঝুনু সবই চুপচাপ শোনে।তার নিজের মতামত দেবার অভ্যাস কোনদিনই নেই।।গড়েই ওঠে নি ছোট থেকে। বাবার রেখে যাওয়া ব্যাংকের কাগজ থেকে সুদ আসে তাই দিয়ে একতলার কোনের ড্যাম্পধরা ঘরটায় থেকে আর দুটো সেদ্ধ ফুটিয়ে খেয়ে তার দিব্যি চলে যায়। 
কিন্তু আজকাল সে যেটা শুরু করেছে সেটা আর কারো চোখ এড়াচ্ছে না। কিছুদিন হল গ্রামে একটা পাগলগোছের ফকির গোছের লোক এসেছে।অনেকেই তার কাছে আধুলি সিকি পূজো দিয়েছে।।সে অবশ্য কারোর থেকে সেসব নেই নি। চাল আলুর সিধেও না। নেবার মধ্যে কাঁচা ফল দিলে খায়।অষুধ টষুধও দেয় না। শুধু সারাদিন কিসব বিড়বিড় করে।অষুধ বিষুধ দেয় না বলেই গ্রামে আসার দু একদিনের মধ্যেই লোকের তাকে দেখার পূজো দেবার বা সিধে দেবার গরজ চলে গিয়েছিল। ঝুনু একদিন টেঁপির মাএর সাথে ঘাটে যাবার সময় ওই পাগল ফকিরের সাথে দেখা হয়ে গিয়েছিল। ঝুনু আঁচলে বাঁধা একটাকা দিয়ে তাকে প্রণাম করে। লোকটা ঝুনুকে অবাক চোখে দেখতেই থাকে। তারপর কি যে হল! ঝুনুকে এখন প্রায় দিন দুপুর বেলা ওই ভাঙা দালানের পিছনে ভাতের থালা হাতে যেতে দেখা যায়। পাগলাটে ফকিরকে নিজে হাতে খাওয়াতেও দেখেছে কেউকেউ। একখানা নতুন শাল সে দিয়েছে ওই ফকিরকে। আর ওই ভন্ড ফকিরের সাহসও বলিহারি। ন্যাপা নিজে চোখে দেখেছে সে আর ঝুনু পাশাপাশি বসেছে গাছতলায়।আর ফকির ঝুনুর হাতখানা টেনে গভীর ভাবে কিছু বলছে। ছিঃ ছিঃ কি ঘেন্না কি ঘেন্না। বৌদিরা শুনে কানে আঁচল চাপা দিয়েছে।পঞ্চাশ বছর প্রায় বয়েস হল।।এই বয়েসে এসে এই নোংরামি সহ্য করা যায়? নিজে তো কলঙ্ক নিলিই। বংশের মুখেও চুনকালি দিলি। দুই বৌদিই কড়া ভাষায় নিজেদের সংসারে ঝুনুর ঢোকা বন্ধ করেছে। ঝুনুর অবশ্য তাতে খুব কিছু আসে যায় নি। এ কলঙ্ক সে মাথা পেতে নিয়েছে। সে জানে গ্রামের পাঁচটা লোক পাঁচটা কথা বলছে।বলুক গে যাক। কিন্তু তার চিন্তা অন্য জায়গায়।।তার দাদা ওই ফকিরকে মারার কথা ভাবছে।এব্যাপারে দুই ভাইই এককাট্টা।বংশের মর্যাদা বাঁচাতে দুজনেই নাকি ঠিক করেছে লাঠির বাড়ি মেরে ওই পাগলের মাথা দুফাঁক করে ফেলে দেবে রাতের আঁধারে। পুলিশ কিচ্ছু করতে পারবে না।।আর গাঁয়ের লোকও জানবে যে চৌধুরীরা বংশের মান রাখতে খুন ইস্তক করতে পারে। তাই ঝুনু দ্রুত হাতে জিনিষ গোছাচ্ছে।যেভাবেই ওকে ওদের দুজনকে এখনই পালাতে হবে।ঝুনু জানে এই পা নিয়ে পালানো মুখের কথা নয়। গাঁয়ের লোক কাল ছিছিক্কার করবে। তবু এটা তাকে করতেই হবে। এতদিন পর মেজভাইকে সে ফিরে পেয়েছে। এই মেজভাই আর সে যমজ।বরাবরই মেজ কেমন আলভোলা প্রকৃতির। বোধও কম ছিল। সবাই বলত যমজের একটা নাকি দুর্বল হয়। গ্রামে বাউল এলে তার সাথে চলে যেত। দিনের পর দিন কুমোরের বাড়িতে নাওয়া খাওয়া ভুলে পরে থেকে মূর্তিগড়া দেখত। একবার এক বেদের দল এলো। তারপরের দিন থেকে মেজকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। সব তন্নতন্ন করে খোঁজা হল। হাসপাতাল, রেলস্টেশন, এমনকি পুকুরে জালও ফেলানো হল। কিন্তু ছেলে নিঁখোজ। মাস খানেক পর বাবার এক বন্ধু মেজ'র মত দেখতে একজনকে এলাহাবাদে দেখেছিলেন।খবর পেয়ে বাবা গুম হয়ে গিয়েছিলেন।মেজকে আর খোঁজেন নি। তবে তারপর থেকে সবাইকে বলতেন তার দুই ছেলে এক মেয়ে। 
সেদিন ঘাট থেকে ফেরার পথে প্রণাম করার সময় ফকিরের ঝুলির দিকে নজর চলে গিয়েছিল ঝুনুর।সেখান থেকে উঁকি দেওয়া একটা ভীষণ ঝাপসা গ্রুপ ফটোগ্রাফ দেখে বুকটা ছ্যাঁত করে উঠেছিল। এ ছবি যে তার চেনা। আর ঠিক তখনই পাগল বিড়বিড় করে উচ্চারণ করেছিল ঝুনু নামটা। ঝুনুর যেন বিশ্বাস হতে চাইছিল না। কিন্তু নোংরা খড়ি ওঠা ঘাড়ে যেটা ময়লা বলে ভুল হচ্ছিল সেই জরুলটা দেখার পর আর কিছু বলার বা বোঝার বাকী ছিল না। ঝুনু বাড়িতে বলতেই পারত মেজ'র কথা। কিন্তু ইচ্ছে করেই বলে নি। দুই ভাইই সম্পত্তি নিয়ে খুনোখুনিতে প্রস্তুত। আর সেখানে যদি এখন ভাগীদার হিসেবে মেজ যোগ হয়, ওরা ওকে বাঁচতে দেবে না। তাই ঝুনু সব কলঙ্কের ভার মাথায় নিয়ে আজই ভোর রাতে চলে যাবে এখান থেকে। লোকে না হয় একটা নোংরা মিথ্যেই আঁকড়াক। তবু বিষাক্ত কলঙ্ক নিয়েই ঝুনু চলে যাবে।মেজকে সে অনেক কষ্টে ফিরে পেয়েছে।আর হারাতে পারবে না। ব্যাঙ্কের কাগজ পত্র, পাসবই নিয়ে নিয়েছে। শেষ বয়সটা দুই ভাই বোনে কাটিয়ে দেবে এ বিশাল দেশের কোন এক কোণে।।

---------------


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ