পোস্ট বার দেখা হয়েছে
কবিতা
এখানে পিঞ্জর
সুব্রত হালদার
নিভৃত অন্তরাল থেকে ডাক দিয়ে ছিলে ইশারায় ...
সে ডাক ফেরাতে চাইনি অবহেলায় কিংবা উপেক্ষায় ..
খুব চেয়েছিলাম জানো ,ফিরে যেতে ..
তোমার বোধের কাছে...
তোমার আলোর কাছে..
তোমার নির্জন নিরালায়..
আমি কতবার দেখেছি জানো,
বৃষ্টি না ঝরিয়েই মেঘেরা গিয়েছে ভেসে....
চিলে ছাদ ছুঁয়ে দূরে নিরুদ্দেশে..
রুক্ষ প্রান্তরে প্রখর তপন পড়েছে ঝরে ...
মৃত ঘাসের শরীরে ,শুষ্ক শিকড়ে..
পিঁপড়েরা সার বেঁধে হেঁটে গেছে অবিশ্রাম খাবারের বোঝা নিয়ে ঠোঁটে..
সেইসব ঘাসের গভীরে..
আমি চাইনি জানো ..
তবু আকাশের নীল ঢেকেছে কুয়াশায় ...
ঊর্ণজাল জড়িয়েছে সবুজ পাতায়...
এইসব খিন্ন দিন শুধু কিছু দায়ভারে বেঁধে বেঁধে রাখে..
ক্লান্ত করে ..
বিষণ্ন করে ..
এইসব বিবশ রাত অবসন্ন জ্যোৎস্নার কালি মাখে..
অবিরত মৃত নক্ষত্রের ছাই মাখে..
তবুও তো কোথাও ফিরতে হয় বলো ..
চক্রাকারে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হই..
গোলকধাঁধার মত লাগে সব..
পথ তবু খোলে কই ?..
রঙিন মাছের পাখায় ক্লান্তি নামে ..
বন্দর ছেড়ে যায় শেষ জাহাজ..
অবিশ্রান্ত কোলাহল থামে..
বাঁশিওয়ালা,
তোমার সুর শুনতে পাই ভেসে আসে ..
উদাস দক্ষিণা বাতাসে..
গোলাপের পাপড়িগুলো একে একে ঝরে গেলে..
আমি খুঁজে ফিরি যে সময় গিয়েছ চলে..
আবার সকাল আসে, সন্ধ্যা নামে বিষাদ জর্জর..
অন্ধকারে ফিসফিসিয়ে কে যেন বলে যায় -
এখানে পিঞ্জর..
======================
কবিতা তুমি
মনোজ কুমার রথ
কবিতা,
তুমি মায়ের মলীন আঁচল...
আজও মুখ মুছি খাওয়ার পর
সেই সে'দিনের শিশুটির মতো,
ঘামগুলোও শুষে নাও সযত্নে অকৃপণ!
তুমি বড্ড উদার,
মাটির মানুষ,
বুকে এতো গন্ধ তবু অহংকারহীনা!!
কবিতা,
তুমি ওই পাখিটির মতো...
যে আমায় ঘুম পাড়ায়,
জাগিয়ে তোলে...
গানে গানে মুখরিত করে আমার আবহ;
বড্ড ক্ষিদে তোমার!
শুধু খাই খাই...
আমার ভাঁড়ারে খাদ্য সংকট,
তবু শিশুর মতোই অবুঝ তুমি,
খালি চাই,চাই...... শব্দ চাই!
কবিতা,
তুমি সদ্য ফোটা ফুল...
না ভুল নয়,
ভাঁজে ভাঁজে কত মধু!
লাজুক বধূ নও,
নবযৌবনার মতো স্বরূপ প্রদর্শন করো...
তখন তোমার খুউব অংহকার!!
সূর্যমুখীর মতো ঘুরে ঘুরে তাকাও আমার দিকে...
আমি সূর্য!
ধৈর্য ধর,
তোমার ভাঙা উঠোনে নতুন বৌঠানের মতো
উনুন পাতো...
কিরণ দেবো,
আগুন দেবো...
জ্বালানীর যা দাম!
অন্নপূর্ণার হাঁড়িতে ভাত ফুটবে,
লৌহ শরীর নিয়ে গন্ধ নেবো মূমুর্ষু মানুষ...
ছোট্ট ধুতি ছোট্ট করে পরা,
মাথায় গামছা বাঁধা কোমরে কুঠার;
বাঁ হাতের বুড়ো আঙুল থেকে
চুঁইয়ে চুৃঁইয়ে রক্ত পড়ছে এখনও!
একটু সজনে শাক রান্না করো,
তেলের আজকাল বড্ড বেশি ঝাঁঝ l
======================
অতিক্রম
জাকারিয়া
যত সময় পেরিয়ে যাচ্ছে ততটাই ধোঁয়াশা লাগছে সবকিছু,
তিতাসের জল তুই একটু ছুঁয়ে দে আমায়-
যদি তোর স্পর্শে আবার নবীন হয়ে উঠতে পারি,
আবার পথ চলায় শক্তিমান হয়ে উঠতে পারি।
আমি পথ চলায় হাহাকার চাইনা,
আমি চাই ভোরের শিশিরের মতোন নরম কোমল হৃদয়,
যাকে সাথে নিয়ে এই দুর্গম, বন্ধুর পথ পাড়ি দেয়া যায় অবলীলায়।
তিতাসের জল তুই একটু শুদ্ধ করে দে আমায়,
যে হৃদয় ঢাকা পরেছে কালো ধোঁয়ায়, সে অশুচি আত্মা আমি চাইনা।
জীবনের পরিবর্তন আমাকে যা দিয়েছে, তা মানুষের ঘৃণা,
সেই অবজ্ঞা, তিক্ত ঘৃণার স্বাদ পেয়েছি আমি,
মুখ লুকিয়ে পথ চলেছি একা এই শহরের বুকে।
তিতাসের জল তুই একটু শুদ্ধ করে দে আমায়,
======================
অব্যক্ত দস্তাবেজ
মনিকান্ত
বাম হাতে লুকিয়ে রেখেছি মৃত্যুর দস্তাবেজ
আর, ডান হাতে বন্দী - ফিরে আসার স্বপ্ন -
ভোরের শরীর ছুঁয়ে যায় অপ্রাপ্তির কুয়াশা
সাঁঝের গায়ে আঁকা হয় বেনামী সংশাপত্র,
যে আকাশ একদিন ভাসতে শিখিয়েছিল -
সে আকাশে আজ অকারণ কালো মেঘের পাহাড়,
যে দালান একদিন চিনিয়েছিল ইঁটের গন্ধ
আজ তা নগ্ন। খসে পড়ছে চুন সুরকীর প্রলেপ,
প্রাচীরের গায়ে নাম গোত্রহীন আগাছা, প্রতি মুহূর্তে
রেখে যাচ্ছে আদিমতার বেহিসাবী নিদর্শন,
এখন যেটুকু পথ একলা হাঁটি অজানায় -
তার থেকে বেশী টানে
ফিরতি পথের জমিয়ে রাখা নীরব অভিমান...
======================
ব্যবচ্ছেদের উল্লাস
শিবানী বাগচী
পোড়া গন্ধে সন্ধ্যে নামে --
মুক্ত বিহঙ্গের ডানায় ভাজ খোলা ইচ্ছেরা
হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকে রোজ।
প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত অজস্র হাত,
ঠোঁটে অপাঠ্য শব্দ লতানো বিষাদে স্তব্ধ!
দুঃখে ভারী হয়ে যাওয়া সুখ,
ঢলে পরে নিকষ রাতের দেউলে -
পরে থাকে শুধু এক মুঠো ছাই!
অন্তঃসার শূন্য দীগন্তে কান পাতা আবেশে শুনি
হেমন্তের পাতা খসা শব্দে, ব্যবচ্ছেদের উল্লাস!
======================
গল্প
দ্বিমুখী লড়াই
জয়ন্ত চক্রবর্তী
দুটো পায়রার খোপের মতো ঘর, তারই মধ্যে খেয়োখেয়ি । খ্যাচখ্যাচ খুচখুচ দ্বিমুখী লড়াই, বৃদ্ধা শাশুড়ির সঙ্গে আধুনিকা বৌমার ।
– বউমানুষ, বেলা সাতটা না বাজলে বিছানা ছাড়তে পারো না ?
– না, পারি না । রাতে শুতে শুতে ক'টা বাজে জানেন ? তারপর যা গরম । ঘুমই আসতে চায় না ।
– গরম কি তোমার একার লাগে ? আমাদের লাগে না ?
– গরম লাগলে তো ছেলেকে বলতে পারেন একটা এসি কেনার জন্য । আমার কথা তো আপনার ছেলে শোনে না । দেখুন বলে, শোনে কি না ।
কথায় কথা বাড়ে ।
– বৌমা, এক কাপ চা । – শ্বশুর মশাই মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে ঝগড়ার ফোকাস চেঞ্জ করে দিলেন ।
– এই তো চা খেলে, আবার ! যতসব আদিখ্যেতা । – শাশুড়ি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন বুড়ো মানুষটার ওপর । ব্যাস, বৌমার মুক্তি, আপাতত কিছুক্ষন চলবে স্বামী স্ত্রীর বাকযুদ্ধ ।
এ সংসারে সমস্যা খুব একটা নেই অথচ মানুষগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে তুই-মুই করে । মানসিকতার তফাৎ আছে তাই দাঁতে দাঁত চিপে অ্যাডজাস্টমেন্ট । মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ ।
ছেলে, বউমা দুজনেই চাকরি করে । ছেলে বেসরকারি, বৌমা সরকারি । সকালে নাকে মুখে গুঁজে ছেলে বেরিয়ে যায় সাড়ে আটটা নাগাদ, বৌমা আরও কিছুক্ষণ পরে । কখনো সোয়া ন'টা কখনো সাড়ে ন'টা । তারপর বাড়িটা খাঁ খাঁ করে । বুড়ো আর বুড়ি । কত আর গল্প থাকে । দুজনেই মুখিয়ে থাকেন সন্ধ্যেবেলা কখন ছেলে আর ছেলের বউ বাড়ি ফিরবে । বাড়ি ফিরলেই কী শান্তি আছে, আবার শুরু হয়ে যায় কাজিয়া ।
বছর তিনেক হলো ছেলের বিয়ে দিয়েছেন অথচ সন্তান নেওয়ার কথা এরা কানেই তোলে না । ফ্রি থাকতে চায় ফ্রি । এই একটা ব্যাপারে বুড়ো, বুড়ির সাথ দেয় । বুড়ি এ প্রসঙ্গ তুললেই বুড়ো বলেন, ' বুঝলে গিন্নি, এই ব্যাপারে আমি তোমার সঙ্গে একশো ভাগ সহমত ।'
সেদিন সকালে অফিস যাওয়ার আগে পুত্র আর মায়ের কিছু সাংকেতিক কথা ।
– তুমি ঠিক পারবে তো ।
– হ্যাঁ, হ্যাঁ, পারবো । কী ভাবিস তুই তোর মা'কে । তুই অফিস যা তো । কোন চিন্তা করতে হবেনা ।
মা, ছেলের এই সাংকেতিক বাক্য বিনিময় বৌমার কানে যায়নি আর শ্বশুর মশাইয়ের কানে গেলেও বোধগম্য হয়নি । হাঁ করে তাই দু'জনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন । একটু পরে বৌমা অফিস বেরোতেই বুড়োর প্রশ্নবান শুরু । কী ব্যাপার গো । কী লুকোচ্ছ ?
কাঁহাতক আর পাশ কাটানো যায় । আর তাছাড়া … । একসময় বুড়ি সব ভেঙে বলে বুড়ো কে ।
এমনিতে সন্ধ্যেবেলা বৌমা বাড়ি ফেরে আগে, ছেলে পরে । আজ কিন্তু উল্টোটা ঘটলো । সন্ধ্যে হওয়ার মুখে ছেলে বাড়ি ফিরেই মা'কে প্রশ্ন করলো, 'কী সব ঠিকঠাক মিটেছে ? '
– নিজে গিয়েই দ্যাখ, ঠিক হয়েছে কি না ।
ছেলে নিজের ঘরে ঢুকেই বললো, – বাঃ দারুন । খুব ভালো জায়গাটা চয়েস করেছো । একদম পারফেক্ট । শোন না মা, একবারটি এসো । বাবাকেও ডাকো । একসঙ্গে সবাই বসি ।
– তুই বোস । আমার কাজ আছে । বৌমা ফেরার সময় হচ্ছে । জলখাবারটা রেডি করি । ও আসুক, তারপর তোর বাবা আর আমি না'হয় ওঘরে যাবো । তুই ততক্ষণ ফ্রেস হয়ে নে ।
শাশুড়ি মা হেঁসেলে ঢুকলেন । কর্তা ড্রয়িংরুমে বসে টিভির চ্যানেল ঘোরাচ্ছিলেন । গিন্নির দিকে চেয়ে একটু মুচকি হাসলেন ।
কিছুক্ষন পরে বৌমা ঘরে ঢুকেই ডাইনিং স্পেসে দাঁড়িয়ে বললো, 'মা, এক গ্লাস ঠান্ডা জল দিন তো, বড্ড জল তেষ্টা পেয়েছে । দেখুন কেমন ঘেমে চান করে গেছি । অফিস টাইমে বাসে যা ভিড় হয় । '
– দিচ্ছি । তুমি বরং নিজের ঘরে গিয়ে বসো ।
– হ্যাঁ, যাই ।
ঘরে ঢুকেই চক্ষু চড়কগাছ বৌমার । ঠান্ডা ঘরে বিছানার ওপর চিৎপটাং হয়ে শুয়ে আছে শাশুড়ির আদরের খোকা । নাক ডাকছে । ডানদিকের দেওয়াল থেকে ছুটে আসছে ঠান্ডা হাওয়া ।
বৌমা ছিটকে বেরিয়ে আসতেই শ্বশুর মশাই হাঁক পারলেন, 'কই গো আমার চা টা কোথায় ? '
– দিচ্ছি বাবা – বলে বৌমা রান্নাঘরের দিকে এগোতেই শ্বশুর মশাই বললেন, 'আজ থাক মা । আজ তোমার শাশুড়িমা'র হাতেই চা টা খাবো । সারাদিন একাই যা লড়াই করলো, তোমরা কী যেন বলো, হ্যাটস অফ্ ।'
শাশুড়িমা একটা প্লেটে দুটো মিষ্টি আর ঠান্ডা জল নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন । বৌমাকে দেখেই এগিয়ে এসে বললেন, 'এই নাও । শুধু জল খাবে কেন, দুটো মিষ্টি খেয়ে জল খাও ।'
বৌমা বাকরুদ্ধ । কোনক্রমে যেই না বলেছে, 'মা আপনি … '
– আমি, কী শুনি ? খুব খারাপ ! তুমিই তো সেদিন বললে গরমে রাতে ঘুম হয়না । আমি আর তোমার শ্বশুর মশাই ভেবে দেখলাম, একদম ঠিক বলেছো । এইজন্যই ঘরটা আজও ভরলো না । দাদু বা দিদা হতে পারলাম না । সারাদিন শুধু লড়াই । খোকাকে বললাম তোমার কথা । ও তো প্রথমে রাজি হচ্ছিল না । তবে জোর করতে রাজি হয়ে গেল । একটা ভয় ছিল । আমি দাঁড়িয়ে থেকে সব গুছিয়ে করতে পারবো কি না । তা সব ঠিকঠাক হয়েছে তো মা । কী দেখলে ?
– টেন অন টেন । কিন্তু মা, আমাদের ঘরে লাগালেন, আপনাদের ঘরে ?
– ওসব লাগবে না । আমাদের যেটা লাগবে সেটা তো তোমার শ্বশুর মশাই আগেই বলেছেন ।
এতক্ষন শ্বশুর মশাই চুপ করে শুনছিলেন শাশুড়ি বৌমার রসালাপ । হঠাৎ গা ঝাড়া দিয়ে ছড়া কাটালেন, – দাদু হোক বা দিদিভাই, এবার কিন্তু চাই-ই-চাই ।
======================
বিজন সংলাপ
মৌসুমী চক্রবর্তী ষড়ঙ্গী
কিছুতেই আজ ঘুমোতে পারছে না প্রত্যুষ। জানালাটা খুলে আকাশের দিকে তাকালে ধরা পড়ে তারাময় রাতের নানা ইশারা। আকাশের অথৈ বুকে তারাদের ঝিলমিল শরীরের নানা রূপটান। কাল ৫ই সেপ্টেম্বর, শিক্ষক দিবস। দেখতে দেখতে দশটা বছর কোথা থেকে কেটে গেছে ভাবতেই অবাক লাগে প্রত্যুষের। সারা রাত জাগবে বলে ইচ্ছে করেই আজ ঘুমের ওষুধ আর খায়নি প্রত্যুষ।
মনে হচ্ছে এই তো সেদিন ঘুমের ঘোরে অস্পষ্ট আওয়াজটা শুনতে পেয়ে তাড়াতাড়ি উঠেছিল প্রত্যুষ। দেখেছিল বাথরুমের সামনে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে প্রিয়া। একটুও সময় নষ্ট করেনি সে। ডঃ বিশ্বাস বলেছিলেন হার্ট অ্যাটাক। অবাক হয়েছিল প্রত্যুষ , মাত্র বিয়াল্লিশ বছর বয়সে ! তাছাড়া প্রিয়াকে বেশ ফিট বলা যায়। হাই ব্লাড প্রেশার , হাই কোলেস্টরল কিছুই তো নেই। কোন আর্টারি ব্লকেজ আছে কি ? সেটা অবশ্য জানা নেই। তবে তার লক্ষণ তো থাকবে , তাও তো কখনও নজরে আসেনি।
প্রত্যুষ ও প্রিয়া পরস্পর পরস্পরের ছোট বেলার বন্ধু। স্কুল কলেজ থেকে ইউনিভার্সিটি সবই ওরা একসঙ্গে করেছে। ছোট থেকেই প্রিয়া খুব হাসিখুশি ও একটিভ। অপূর্ব নাচতে পারত প্রিয়া। নিজের যোগ্যতায় একটি নামকরা নাচের স্কুলের ইনচার্জ পর্যন্ত হয়েছিল সে । বিদেশেও বেশ কয়েক বার নাচের প্রোগাম হয়েছে তার।
বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে “ সূর্যকিরণ নাসিং হোম ”। টানা চারদিন প্রায় অনিদ্রায় কেটেছে প্রত্যুষের। ডঃ বিশ্বাসকে সবাই ভগবান ডাক্তার বলে মানেন। সেই হাতের স্পর্শেই হয়ত পরের দিন থেকে প্রিয়াকে একদম সুস্হ মনে হচ্ছিল। ৫ই সেপ্টেম্বর প্রিয়ার ডিসচার্জ -- ঠিক এমনটা বলে দিনকয়েকের জন্য ছুটিতে গিয়েছিলেন ডঃ বিশ্বাস। সাবধানতা হিসাবে পরবর্তীতে প্রিয়াকে শহরে নিয়ে গিয়ে কয়েকটি টেস্ট করাতে হতে পারে এমনটা বলে গিয়েছিলেন।
ডিসচার্জের খবরটা শুনে খুব ঝকঝকে দেখাচ্ছিল প্রিয়াকে। মোবাইল খুলে হোয়াটস এ্যাপ ও ম্যাসেঞ্জারে ঝটপট কিছু ম্যাসেজ সেন্ড করার পর প্রত্যুষকে বাড়ি পাঠানোর জন্য একেবারে অস্হির হয়ে পড়ে সে। প্রত্যুষের হাতটা ধরে রীতিমতো জেদ করতে থাকে প্রিয়া ,
_ তুমি এক্ষুনি বাড়ি যাও প্রত্যুষ। এ ক’দিন তুমি একটুও ঘুমোওনি , তোমার চোখ মুখের কি অবস্হা হয়েছে দেখেছ ? বাড়ি গিয়ে ফ্রেস হয়ে টানা ঘুমোও। প্লিজ দেরি কোরো না একদম , কাল সকাল- সকাল চলে এসো। তোমার মনে আছে ? কাল সন্ধ্যায় নাচের স্কুলে শিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠান আছে। আমি না যাওয়াতে এ ক’দিনের রিহার্সাল সব রেখাদি একাই সামলেছেন। তুমি আর দেরি কোরো না।
মুখে হাসি নিয়ে প্রত্যুষ বলেছিল ,
_ আচ্ছা ঠিক আছে। আমার জন্য এতকিছু ভাবতে হবেনা তোমায়। সবই আমার মাথায় আছে ।
দেরি করেনি প্রত্যুষ। নার্সিং হোম থেকে ফেরার পথে রাতের রুটি - তরকা আর পরের দিনের জন্য পূজোর ফুল , দুধ এমন কিছু টুকিটাকি কিনে ঘরে ঢোকে সে। সব কিছুই ছিমছাম। বুঝলো কাজের বউ পাশের ঘর থেকে চাবি নিয়ে ঘরদোর সব পরিষ্কার করে রেখে গেছে। অনেকদিন পর নিজের ঘর , ব্যালকনিময় সবুজ গাছ, তার প্রিয় বিছানা - বালিশ পেয়ে বেশ ফ্রেস ফিল করছিল প্রত্যুষ। অসম্ভব ক্লান্তির পর গভীর ঘুুম আসাটা স্বাভাবিক । চিন্তা তেমন ছিল না বললেই চলে। তাই সঙ্গে সঙ্গে ঘুমও এসে হাজির হল।
হঠাৎ ফোনের রিংটা বাজতেই ধড়ফড় করে উঠে বসে প্রত্যুষ । ভেবেছিল হয়ত অনেক বেলা হয়ে গেছে। ঘড়িতে তখন ঠিক চারটে। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখে নাসিং হোম থেকে ফোন ,অপর প্রান্ত থেকে সিস্টার পলির চেনা কন্ঠস্বর ,
_ অনেক চেষ্টা করেও আমরা কিছু করতে পারিনি। ফারদার অ্যাটাকে পেসেন্ট এক্সপ্যায়ার করে গেছে , আপনি একদম দেরি করবেন না। এক্ষুনি চলে আসুন - - - । বাকি কথাগুলোর আর কিছুই শুনতে পায়নি প্রত্যুষ। সবটা যেন ঘটে যাওয়া এক দুঃস্বপ্নের মত মনে হচ্ছিল।
কঠিন সত্যের প্রহার যে কি পরবর্তীতে তা প্রতিটি মুহূর্তে জীবন প্র্যতুষকে ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছে। আত্মীয়স্বজনের সাথে তেমন একটা যোগাযোগ নেই আসলে এখন যোগাযোগ রাখতেই কেউ চায় না। ঐ মাঝেসাঝে কেবল টেলিফোনের যোগাযোগ ঐটুকুই।
মাল্টি স্টোরি বিল্ডিং -এর ফোর্থ ফ্লোরের সুসজ্জিত ঘরটা ও তার সবটুকু শূন্যতা প্রত্যুষকে যেন গ্রাস করতে থাকে। এখন কেবল নৈঃশব্দের সাথে সখ্যতা আর শুধু বিজন সংলাপ। সমস্ত খুনসুটি যেন লুকোচুরি খেলায় হঠাৎ করে লুকিয়ে পড়েছে । এমনটা হবে প্রত্যুষ ভাবেনি কখনও। তবে এটা বুঝেছে সম্পর্কের যোগ- বিয়োগ বা গুন- ভাগের ফলাফল সব সময় ঠিকঠাক মেলানো যায় না। মনে বিরামহীন স্মৃতির হিল্লোল নিয়ে প্রত্যুষ বেঁচে আছে । চারিদিকে প্রিয়ার শান্ত নিরালা প্রেম। নির্জন প্রাঙ্গনে এমন ক্লান্তি প্রহর কাটাতে কাটাতে প্রত্যুষের মতই হয়ত বেঁচে আছে হাজার হাজার মানুষ। তারা এখন প্রত্যুষের প্রেরণা।
ওয়ারড্রব থেকে পাজামা পাঞ্জাবীটা বের করে রাখে প্রত্যুষ। সঙ্গে প্রিয়ার নিজের হাতে ডিজাইন করা ম্যাচিং উত্তরীয়। শিক্ষক দিবসের এই দিনটা প্রিয়ার নাচের স্কুলেই কাটায় প্রত্যুষ। এখন স্কুলটা অনেক বড় হয়েছে আর নামডাকও হয়েছে প্রচুর। প্রিয়ার দেখা স্বপ্নগুলো তাকে যে সত্য করে তুলতেই হবে। এক গুচ্ছ চাঁপাফুল রেকাবিতে সুন্দর করে সাজিয়ে প্রত্যুষ প্রিয়ার ছবির নীচে রেখে মুখ তুলে বলে ,
-- কি , পছন্দ হয়েছে ? তোমার মত সাজাতে পেরেছি তো ?
0 মন্তব্যসমূহ