মীর তকী মীর || ভাবানুবাদ ~ দেবলীনা




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

কবি পরিচিতি : মীর তকী মীর 

মীর তকী মীরকে উর্দু কবিদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ট আসনে বসিয়েছিলেন গালিব। তাঁর একটি মুকতহ-তে তিনি লিখেছিলেন,

'রেখতে কে তুম হি উস্তাদ নহী হো গালিব
কহতে হ্যায় অগলে জমানে মে কোই মীর ভি থা'।
মুহম্মদ তকীর ছদ্মনাম ছিল শুধু মীর। অন্যতম সুপরিচিত কবি মীর দর্দ (দিল্লি ত্যাগ করেননি) থেকে পৃথক করার জন্য মুহম্মদ তকীকে উল্লেখ করা হত মীর তকী মীর নামে। মীরের জন্মস্থান এবং বাল্য ও কৈশোরের স্থান ছিল আগরা, জন্মগ্রহণ করেছিলেন সম্ভবত ১৭২২ অথবা ১৭২৩-এ।
 মীরকে গজলের ঈশ্বর বলা হয়। ভারতে গজলের ইতিহাস বহু শতাব্দী প্রাচীন। গজল আরবের মরুভূমির মধ্য দিয়ে ইরানের উদ্যানগুলিতে পৌঁছে ভারতে পৌঁছেছিল, আর এই গজলের সৌন্দর্য ও মহিমা তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। মীরের বাবা নিজেও একজন ভাল গজল কবি। মীরের বাবার নাম আলি মুত্তাকী, তিনি ছিলেন এক দরবেশ ধর্মাবলম্বী, নির্জন জীবনে বিশ্বাসী, সর্বদা ইয়া আল্লাহ ইয়া আলি বলেছিলেন কথিত আছে যে মীরের বাবা আলি মুত্তাকী যখন তাঁর মৃত্যুর বিছানায় ছিলেন, তখন তিনি দশ বছর বয়সী তাঁর ছেলে মীরকে ডেকে বললেন, "পুত্র, দেখো, তোমাকে দেওয়ার মতো আমার কিছুই নেই। যা দিতে পারি সেই আস্থার নাম ভালবাসা।" এর পরে তিনি চলে গেলেন।

মীর তকি মীর তাঁর গজলের মধ্য দিয়ে সারা জীবন তাঁর বাবার ভালবাসা রক্ষা করেছিলেন। নব্বই বছর গজলের প্রতি মীরের ভালবাসা তাকে উর্দু গজলের কিংবদন্তি কবি করে তুলেছিল। মীর যে মহিমা অর্জন করেছিলেন তা প্রতিটি যুগের কবিরা এখন স্বীকার করছেন।  
উর্দু সাহিত্যের পণ্ডিত এবং মহান কবিদের মতে মীরের আগে কবিতায় উর্দু ভাষা পরিষ্কার ছিল না, তার পরে উর্দু ভাষার উন্নতি হয়েছিল।

তিনি আড়াই হাজারেরও বেশি গজল লিখেছেন এবং কবিতায় এই গজল আবৃত্তি করেছেন। আজ, দুই শতাধিক বছর কেটে গেছে, মীরের লেখা প্রতিটি গজল প্রচলিত ভাষায় অনূদিত।

মূলত, মীরের কবিতা প্রেম, তিনি কবিতা বলেছেন যেন তিনি কথা বলছেন, কবিতায় মনোমুগ্ধকর এবং সরলতা রয়েছে, এমন সুন্দর প্রকাশ যা গালিবও স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।

 শেষ বয়েসে তিনি আশ্রয় নিয়েছিলেন লখনউতে। ১৭৮২ সালে তিনি লখনউ এসে পৌঁছেছিলেন।
১৭৩৯ সালে নাদির শাহের দিল্লি লুন্ঠন এবং ১৭৫৭ সালে আহমদ শাহ আবদালীর মুঘল পরিবারের অপদার্থ উত্তরাধিকারীদের ঘিরে ওমরাহদের ষড়যন্ত্র, আত্মকলহ, বিশ্বাসঘাতকতা কবি মনেও প্রভাব ফেলেছিল। মুঘলদের রাজধানীর উজ্জ্বল জীবন ও বিদগ্ধ সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলেছিল তত্‍কালীন দিল্লি শহর। অপসৃত মুঘল বৈভবের সঙ্গে মানুষের জীবনের রঙ-রস-মাধুর্য্য সব লুপ্ত হয়েছিল। হৃতগৌরব দিল্লিতে তখন গুণীজনকে পোষণ করার মতো মানুষ আর অবশিষ্ট ছিল না।লখনউয়ের নবাবেরা গুণীজনদের আশ্রয়দাতা বলে বিখ্যাত হলে, দিল্লি থেকে সব গুণীজন লখনউয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন।

উর্দু কবি সওদাকেও লখনউয়ের নবাবেরা মাসোহারা দিতেন, সসম্মানে মাথায় করে রেখেছিলেন তাঁরা। ১৭৮১ সালে সওদার মৃত্যু হয়।

মীর লখনউ এসে পৌঁছোলে, খবর গেল নবাব আসাফুদ্দৌল্লার কানে। তিনি নিজে এসে তাঁকে স্বাগত জানালেন এবং তাঁর বসবাসেরও সব রকম প্রয়োজন মেটানোর সুবন্দোবস্ত করে দিলেন। মাসিক তিনশো টাকা মাসোহারারও ব্যবস্থা করে দিলেন নবাব।

লখনউ দরবারে উর্দু কবি সওদার যতখানি প্রতিপত্তি ছিল ততখানি মীর পাননি হয়তো, কিন্তু যত দিন নবাব আসাফুদ্দৌল্লা বেঁচেছিলেন তত দিন তাঁর আর্থিক সাচ্ছল্য যথেষ্টই ছিল।

দীর্ঘ ২৮ বছর তিনি লখনউয়ে বাস করেছিলেন। দিল্লি যতই হতশ্রী হচ্ছিল, লখনউর ততই শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছিল। মীর কিন্তু সব সময়ই বিশ্বাস করতেন দিল্লির জামা মসজিদের সিঁড়িতে যে উর্দু শোনা যায় তা লখনউর দরবারে পাওয়া যায় না।

তিনি লখনউয়ে থাকাকালীন প্রথম দিন থেকেই নিজেকে স্বতন্ত্র রেখেছিলেন। তাঁর কাছে লখনউয়ের সংস্কৃতি ভুঁইফোঁড় সংস্কৃতির সমান ছিল। তিনি ছিলেন পুরোনো কেতার মুঘলাই ঘরানার মানুষ।

আজ মীরের লেখা সেই অসামান্য দুটি গজলের বাংলা তর্জমা করার সামান্য প্রয়াস আমার ...

বুদবুদের মতো সত্তা
মীর তকী মীর
অনুবাদ : দেবলীনা 

এই সত্তা বুদবুদের মতো 
আর এর প্রদর্শনী মরীচিকার মতো

কি মোলায়েম তার ঠোঁট কি বলবো 
যেন গোলাপের পাপড়ির মতো

অশেষ কৃপা ছিল এই অধমের ওপর 
নাহলে কি ধৃষ্টতা এমন স্বপ্ন দেখার

বারবার সেই চৌকাঠে উপস্থিত হয়েছি 
যে পরিস্থিতি হয়ে উঠেছে অসহনীয় 

তোমার তিল বিন্দু থেকে তোমার আব্রু 
এখন সবই অনন্ত অপেক্ষার মতো

আমার বলা - কওয়া সেসব কথা
আজ যেন সেই হতভাগ্যের মতো

বিরহের আঁচে হৃদয় জ্বলে অঙ্গার
যেন ভুনা কাবাবের মতো

এখন আমার দুচোখ জলে টলমল
 ঘন কালো মেঘের মতো 

মীরের এই অর্দ্ধনিমিলীত চোখের 
জাদু যেন ঘোলাটে নেশার মতো

--------------------------------------------
ভালোবাসার সুদীর্ঘ পথে...
মীর তকী মীর
অনুবাদ : দেবলীনা 


ভালোবাসার সুদীর্ঘ পথে বিষাদ আছে 
চলতে চলতে দেখা যাক কি হয় শেষে 

প্রতিদিনের মিছিলে ভোরের কিছু করাঘাত থাকে 
তবে কি আমরা অচেতন হয়ে থাকি ঘুমিয়ে

সবুজ হলেও এই মন চিরহরিৎ তো নয় 
ইচ্ছার মুকুলে তবে কি সে অঙ্কুরিত বোঁটা

এই ভালোবাসার চিহ্ন কখনো মেটে না 
বুকের শিরার দাগ সে যে ধুলেও যায় না

ভগবানের দেওয়া এই অমূল্য সময় 
মীর কি সে অনাদরে ফেলে হারায়!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ