দর্পণ | দৈনিক ধারাবাহিক কলম | গল্প ~ তসলিম পাটোয়ারী




পোস্ট বার দেখা হয়েছে


স্বাধীনতার সুখ 

তসলিম পাটোয়ারী 


সাজেদুল ইসলাম মেধাবী ছাত্র। চাঁদপুরে আইকম পড়ে ঢাকায় গেলো। ঢাকায় তার কেউ ছিলনা। টিউশনি করে, ম্যাচে থেকে, অতি কষ্টে বিকম পড়লো। পাশ করলো। প্রথম শ্রেণির নাগরিক হলো। ঢাকাতেই বড়ো প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি পেলো। 


বছর দুয়েক পর বস্ মাহতাব বললেন, একটা মেয়ে আছে ধানমন্ডিতে। বাবা নামকরা বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি করতেন। গত বছর কর্মরত অবস্থায় হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। ওনারই বড় মেয়ে। মেয়েটি সুন্দর, তবে লেখাপড়া কম। কম বলতে আনুষ্ঠানিক ডিগ্রিটা কম। চাকরির সুবাদে বাবা প্রথম প্রথম পরিবার নিয়েই ঘুরতেন বিদেশে, ফলে মেয়েটার প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি হয়নি। এটা বুঝতে পেরে তিনি ধানমন্ডিতে থিতু হন। দোতলা বাড়ি করেন। এখন মেয়েটার ছোট এক বোন দুই ভাই ঠিক মতোই এগুচ্ছে। মেয়েটি বাংলা বলতে পারে লিখতে পারেনা, ইংরেজিতে চোস্ত, আরো কয়েকটি ভাষা জানে কমবেশি। সাজেদ, একদিন তুমিও বড় হবে, পাশে ইংরেজি জানা একটা স্মার্ট বউ থাকলে তোমার স্ট্যাটাস বাড়বে। 


মাহতাব সাহেব সাজেদকে নিয়ে গেলেন ধানমন্ডিতে। আইভি লতা আর বাহারি মানিপ্ল্যান্টের বড়ো বড়ো পাতায় ঢাকা নিরিবিলি বাসা। কলিংবেল টিপে নীচে ড্রয়িং রুমে বসলেন তারা। নেমে এলেন গৃহকর্ত্রী। বললেন, মাহতাব ভাই যে, কেমন আছেন ভাই, অনেকদিন পর এলেন। মাহতাব বললেন, সময় হয় না ভাবী, আপনার কথা মনে আছে তাই এলাম। সাজেদকে দেখিয়ে বললেন ও সাজেদ, আমাদের অফিসার, বাড়ি চাঁদপুর, বড় ভালো ছেলে। সাজেদ দাঁড়িয়ে সালাম দেয়। কর্ত্রী বললেন, বসো বাবা। তিনি সাজেদের মা বাপ বাড়ি ঘর জানলেন। মাহতাব বললেন, ভাবী লরাকে পাঠিয়ে দিন, দেখি মা মণিটা কেমন আছে। 


লরা আটপৌরে পোশাক পরেই এলো। বললো, আঙ্কেল! কেমন আছেন? মাহতাব বললেন, আছিরে মা। বললেন, শোনো লরা, ও হলো সাজেদ, আমাদের কোম্পানির স্মার্ট অফিসার, বসো, ওর সাথে আলাপ করো, আমি উপরে ভাবীর কাছে আছি। 


ভাবী বললেন, গ্রামের ছেলে, কেমন হয় কে জানে, লরাকে বুঝবে তো, নাকি দালানকোঠা দেখে কিছু আশা করবে? মাহতাব বললেন, না, বাড়ি করার জন্য এখন অফিস থেকেই লোন দেয়, তাছাড়া ও নীতিবাগীশ ছেলে, এখনও স্খলন দেখিনি। 


সাজেদ লরাকে দেখলো, কথা বললো। রূপ আছে লরার, সাজেদের চেয়ে অনেক ফর্সা, চাঁপাফুলের প্রায়, লম্বা গড়ন, চুল ছোট ঘাড় অবধি। সাজেদ বললো, স্যার, ওভার স্মার্ট, আমরা গ্রামের ছেলে, আমাদের সাথে অনেক গ্যাপ হবে। মাহতাব বললেন, তা একটু হবে বইকি, তোমাকে তো বলেছি ওরা বাইরে বাইরে থেকেছে, সেভাবেই বড়ো হয়েছে, তবে বাবা নেইতো, এখন বুঝে বাস্তবতা, বিয়ের পর দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। 


সাজেদ বাবা মা কে জানালো। কিন্তু মা তার এক ভাইঝির কথা বলতেন। তিনি হতাশ হলেন, শেষে ছেলেকেই মেনে নিলেন। একদিন সংক্ষেপে বিয়ে হয়ে গেলো। সাজেদের বাবা মা গেলেন না। তাদের পক্ষে সব করলেন সাজেদের চাচা হামিদ সাহেব। তিনি ঢাকায় ছোটখাটো চাকরি করেন। 


মাহতাব সাহেব ধানমন্ডিতেই সাজেদকে বাসা ঠিক করে দিলেন। সিঙ্গেল ফ্যামিলির জন্য বাসাটি বড়োই। লরা বাসায় উঠে দক্ষিণে মুখ করে দু-হাত মেলে। ফুরফুরে বাতাস তার দেহ মন নাচায়। কালে কালে তার কোলে আসে সন্তান। সে মেয়ের নাম রাখে 'এলিজাবেথ'। সাজেদ বলে, শক্ত নাম, বরং 'রানি' রাখো। সে ছেলের নাম রাখে 'ভিক্টর'। সাজেদ বলে, শক্ত নাম বরং 'জয়' রাখো। তবুও লরার কাছে ও তার বাপের বাড়িতে ওদের নাম ছোট হয়ে হয় এলিজা ও ভিকো।  


কিন্তু সাজেদের মন থাকে ভারাক্রান্ত। চার বছরেও বাঙালি হলোনা বউটা। সে গালে হাত দেয়, জেনেশুনে কেন বিয়ে করতে গেলো লরাকে, দেশে কি মেয়ের অভাব ছিল? মামাতো বোনটাও তো বেশ ছিল। দেশের মেয়েদের কথা মনে পড়ে তার। কতো নরম সুশীতল তারা। সাজেদ চায় বউটা তাদের মতো করে শাড়ি পরুক, চুড়ি পরুক, কাজল পরুক, কপালে পরুক টিপ, হোক নরম। 


বউয়ের দোষ ধরে না সাজেদ। সে জানে ওরা দেশে ছিল না, মুক্তিযুদ্ধের সময়ও না। কিন্তু যারা দেশমাতার জন্য এতো ত্যাগ তিতিক্ষা সইলো, স্বজন হারালো, তারা কেন নিরব হয়ে গেলো? স্বাধীন দেশে কেন অপসংস্কৃতি? কেন অফিসে আদালতে আজও বাংলা নেই? কেন থরে থরে দুর্নীতি? কেন সবে আবার লাঠি ধরেনা!


সাজেদের বোধ নড়ে উঠে। নিরীহ বাবা মা কে ফেলে সে আছে আয়েসে? অথচ বাবা মা লড়ে যাচ্ছেন গ্রামে, একটি ভাই দুটি বোন নিয়ে। একখানা মাঝারি চৌচালা টিনের ঘর। তারই তলে তারা থাকেন বছর বছর। এখন তা ঘুনে ধরা ঝুরঝুরে। একটুখানি হাওয়ায় যেন যায় উড়ে। মরিচা পড়া চাল ফুটো হয়ে আছে স্থানে স্থানে। ফুটো দিয়ে বৃষ্টি যেন ঘরে, মা বাবার কাঁদন হয়ে ঝরে। ভাইবোনরা সে জল ধরে ঘটি বাটি বসিয়ে। বাবা-মার আশা ছিল সাজেদই সব, ও বড়ো হলে কোন দুঃখই হবেনা অনুভব, ওর পরশে ফুটবে দোনা, সব হবে সোনা, দশ জনে দেখবে তাদের সুখ, গর্বে ভরবে তাদের বুক। সে সব মনে পড়ে সাজেদের। সাজেদ পণ করে ভাইবোনদের নিয়ে আসবে কাছে, লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে তাদের। প্রথম শ্রেণির নাগরিকইতো টেনে তুলবে পিছিয়ে পড়া নাগরিকদের।


এই সময় কোম্পানি সাজেদকে পদোন্নতি দিয়ে চকবাজার শাখায় ম্যানেজার করে পাঠায়। লরার আবদারে সাজেদ শালা শালি শাশুড়ি ও মাহতাব সাহেবকে দামী রেস্তোরাঁয় খাওয়ায়। খুশিতে লরা সবাইকে তাদের প্লটে নিয়ে যায়। মাহতাব সাহেব সাজেদকে বলেন, কোম্পানি থেকে আরো কিছু টাকা নিয়ে একটা সেমি পাকা ঘর তোল আপাততঃ, ভাড়াটা বাঁচবে।


সাজেদ আরো লোন নেয় এবং কাজে হাত দেয়। একদিন সে বাড়ির গাড়ি ধরে। বাড়ি গিয়ে মা বাবার চরণ ধরে। ভাইবোনদেরকে ধরে বলে, দাঁড়া আমি দেখছি, তোদের কাজ হলো মন দিয়ে লেখাপড়া করা। বাবা-মা মুখ চাওয়াচাওয়ি করেন। তারা নতুন ভোর দেখেন। শোকর করেন খোদার কাছে, মাজেদ জেবা রেবা'র পড়া হবে, সুখ আসবে ঘরে। 


কাজ কিছু বাকি থাকতেই সাজেদ বউকে নিয়ে বাসায় উঠে যায়। বউ তড়পায়, প্রমোশন মানে উন্নতি, অথচ এমন বাসা! তবুও বলে কি আর করা যখন যেভাবে রাখো সঙ্কটে, সম্পদে! কিছু বলে না সাজেদ। ধূমপান বাড়ায় শুধু। গোল করে ধোঁয়া উড়ায়, বুদ্ধি বাগায়। লরাকে একদিন প্রস্তাব করে, চলো এবারকার ঈদ গ্রামের বাড়িতে করি। লরা সায় দেয়। গ্রাম দেখার সাধ তার বহুদিনের। 


এই প্রথম গ্রামে আসা লরার। শোয়া বসা নাওয়া খাওয়ায় নতুন সংষ্কৃতির সাথে তার পরিচয় হয়। পুকুরে ডুব দিয়ে গোসল, মাটির চুলায় রান্না; চোঙা ফুঁকে আগুন ধরানো, হাতপাখার বাতাস, হারিকেনের মৃদু আলো, উপভোগ করে সে। এমনকি ঢেঁকিতেও পাড় দিয়ে দেখে। ননদীদের সাথে চলে যায় বিলে, ধানের কাছে। কতো ভাত খেলো শহরে বসে বসে। অথচ এই প্রথম দেখা হলো ধানের খেত, গরুর পাল, চাষী, রাখালের বাঁশী। লরা নিজেকে হারিয়ে ফেলে। গ্রামের প্রেমে পড়ে যায়। জেবা ও রেবাকে বলেও বসে, ওরে আমি আর ঢাকা যাবো নারে। 


কিন্তু ক'দিন পরেই লরার মনে হয় শাশুড়ির বচন যেন শাসন। সব বাঁকা ঠেকে তার কাছে। ঘরটা মনে হয় খুপরি, ফ্যান নেই, এসি নেই, এটাচড বাথরুম নেই, গ্যাসের চুলা নেই, কোমল বিছানা নেই, মাটির সোদা গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে, খোলা পায়খানায় বিশ্রী গন্ধ; নাক চেপে যেতে হয় সেখানেই। বাচ্চাগুলো সারাদিন থাকে মাটিমাখা। লরা স্বামীর আসার আশায় পথ চেয়ে কাটায় পক্ষকাল। 


এদিকে লরার মা একদিন আসেন সাজেদের বাসায়। তিনি নাখোশ হন, গ্রামে কেন পাঠিয়েছো ওদের, লরা কি থেকেছে গ্রামে? বাসা ঘুরে বলেন, কেমন বাসা বানালে! শ্রমিকের ডেরা! ছি ছি, ওয়াক থু। তিনি রুমাল দিয়ে নাক চাপেন। সাজেদের রক্ত মাথায় উঠে, গায়ের লোম গায়ে কাঁটা হয়ে ফুটে। শাশুড়ি চলে গেলে সে খাটে, টেবিলে, জামাকাপড়ে সর্বত্রই যেন এক দলা 'ওয়াক থু' অনুভব করে। বেচারা চিৎপটাং হয়ে ধোঁয়া ছেড়ে ছেড়ে ঘর অন্ধকার করে ফেলে।


ছুটি নিয়ে বাড়ির ট্রেন ধরে সাজেদ। কুলি হাঁকাহাঁকি যাত্রীর ব্যস্ততা পেছনে ফেলে গুটিশুটি হয়ে বসে ট্রেনে। ঘৃণার শরে বার বার যেন বিদ্ধ সে। শাশুড়ির মতো ট্রেনও যেন বলছে, ছি ছি ওয়াক থু, ছি ছি ওয়াক থু। কিন্তু গাছপালা তরুলতা সবুজ প্রান্তর দেখতে দেখতে হঠাৎ সাজেদ রজনীকান্ত সেনের মতো স্বাধীনতার সুখ অনুভব করে। কবির মতোই আওড়ায়, 'কষ্ট পাই তবু থাকি নিজের বাসায়'। সে জানলা দিয়ে পাল্টা ওয়াক থু ছুঁড়ে মারে, বাম হাঁটুর বাটিতে বাঁয়া বাজায়, ডান হাঁটুর বাটিতে ডাঁয়া বাজায়, গেয়ে উঠে রবিঠাকুরের কথা, 

'সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান, 

সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ। আ আ হা!

মুক্ত করো ভয়, 

আপনা মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়। আ আ হা!

দুর্বলেরে রক্ষা করো, দুর্জনেরে হানো,

নিজেরে দীন নিঃসহায় যেন কভু না জানো। আ আ হা!'


সাজেদ যখন বাড়ি পৌঁছে তখন কালপুরুষ মধ্য গগনে। গায়ে তার স্যুট টাই, মখমলের হ্যাটে আকর্ণ ঢাকা। বাড়ির কুকুর খেপে উঠে তাকে দেখে, ঘেউ ঘেউ করে। কান খাঁড়া করেন মা। দরজায় এসে সাজেদ ডাকে 'মা'। উড়ে এসে দরজা খোলেন মা। লরাও উঠে বসে। 


'খাওন লাগবোনা' বললেও মা ও লরা বসেন ভাত নিয়ে। সাজেদ ফ্রেশ হয়ে এসে ছোট বোনদের সাথে ঘুমন্তু বাচ্চাদের এক নজর দেখে। তারপর একমুঠ খেয়ে বিছানায় যায়। লরাকে বলে, আছো কেমন? লরা বলে, বড়ো সুন্দর বাড়ি ঘর গ্রাম, শুধু গা রি রি করে যখন চারদিকটা হয়ে উঠে নোংরা থকথকে, আর ঐ খোলা বাথরুম, 'ছি'। সাজেদ লরার পিঠে হাত বুলায়। লরা নিবিড় হয়। দু'টি ঠোঁটের ভাঁজে ভাঁজে জেগে উঠে সুধা, মিলন জোয়ারে ভাসে চির সুন্দর আনন্দ ক্ষুধা। 


চকচকে ভোরে রানি ও জয় জেগে উঠলে সাজেদ দু'জনকে দুই কাখে নেয়। রানিকে বলে, থাকবি এখানে। রানি বলে, হ্যা ড্যাড, খুব মজা, সারাদিন খেলি আমরা, সবাই আদর করে, কতো গল্প বলে দাদু, ফুফিরা। চাচ্চু কাঁধে করে নিয়ে যায় দূরে বহুদূরে। সাজেদ তবু ওদের নিয়ে ফিরে। কেঁদে কেটে তাদের বিদায় দেন দাদা দাদু চাচ্চু ফুপিরা। 


বাসায় ফিরে আবার ব্যাগ গুছায় লরা। ক'টা দিন অট্টালিকায় আরামে থাকবে মা'র কাছে। এখনই বেড়াতে সুবিধা, এলিজা ও ভিকো স্কুল শুরু করেনি। 


এদিকে ঘরের কাজ শেষ হলে সাজেদ চিঠি দেয় বাড়িতে। মাজেদ মা ও জেবা রেবাকে নিয়ে আসে। বাবা এলেন না। বাবা এরকমই। নিজে নিজে ভাত রেঁধে খেতে পারেন, ঘর বাড়ি, দুখন্ড জমি, গ্রামের মানুষের ভালবাসা ছেড়ে কোথাও যেতে পারেননা। সাজেদের মা জোর করেছিলেন, ঢাকায় এনে হাঁপানির চিকিৎসা করাবেন বলে। কিন্তু ওনার এক কথা, হাঁপানি ভালো হয় না, গ্রামের কবিরাজি ওষুধই বরং দমিয়ে রাখে। 


সুন্দর বাসা। মাজেদ জেবা রেবার লাফিয়ে উঠে মন। মা তাদের বুঝান, 'এল্লাগ্গাই তো কই মন দিয়া পড়, লেহাপড়া করলে বাড়ি অয়, গাড়ি অয়, ভালা ঘর অয়, বর অয়।' মা দোয়া করেন সাজেদকে। বারান্দায় এসে তিনি তাকিয়ে থাকেন গাড়ির দিকে। গাড়ি, বাড়ি, এসবের নামই শুনেছেন, এবার সব দেখছেন চোখ মেলে। কিন্তু যখন দেখেন ভিখারিও আছে, তারা হাত পাতে, দরজায় কড়া নাড়ে, তাঁর কষ্ট হয়, হায়! মক্কায়ও পাপী আছে, লঙ্কায়ও ভিখারি আছে! 


লরা অনেক দিন কাটালো মা'র কাছে। এবার ফেরার পালা। লরা জানে সাজেদ তাকে ইচ্ছামতো বেড়াতে দিয়েছে। সে তাকে নিতে আসবে না। পুরুষগুলো এমনই, পাঁজি, আদর শেষ, সব শেষ। হোটেলের পঁচা ডাল ভাত খেয়ে নাক ডেকে ঘুমাবে, তবু বউ নেবেনা। এখন তাকেই ফিরতে হবে। লরা দিন ঠিক করে। কিন্তু এলিজা ও ভিকোকে লুকিয়ে রাখে আন্টি ও মামারা, বলে ওরে ওখানে তোরা থাকবি কেমন করে! লরা জানে তার এলিজা ও ভিকো দেখতে রাজকন্যা রাজকুমার। সে নরম গলায় ডাকে তাদের, এলিজাসোনা, ভিকোসোনা, চলো এবার। তৈরি হয়ে লরা মা'র কাছে গিয়ে বলে, মম্ আমার বাক্সটা দাও, ওগুলো ছেড়ে দিয়ে ফাউন্ডেশনটা ধরবো, সেমিপাকা ঘর অসহ্য। 


লরার বাবা বলেছিলেন লরার যেহেতু পড়াশোনা হয়ে উঠেনি, ওর জন্য একটু বেশিই গয়নাগাটি থাক। বিয়ের পরে ও যেন স্বামীর কাছে খাটো না হয়। কিংবা প্রয়োজনে ওগুলো কাজে লাগাতে পারে। 


লরা মা'র সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, মা ততই সরে দাঁড়ান। লরা জিজ্ঞেস করে, কি হয়েছে মম্!

- খালি বাক্স নিয়ে কি করবি মা।

- কি বলছো মম্!

- এতোদিন তোদের বাঁচিয়েছি তবে কি দিয়ে?

-আমারগুলো সেল করে! ড্যাডির তো ব্যাংকেও এমাউন্ট ছিল?

- তর্ক করিস না লরা? সেখানে কি লক্ষ লক্ষ টাকা ছিল?

লরার কপালে বিন্দু বিন্দু জল, তবুও সে মনে বল নিয়ে বলে, তাহলে ড্যাডির ব্যাংক ব্যালান্স থেকে কিছু দাও।

- ফ্লোরা ডাক্তারি পড়ছে, সিজার ইন্জিনিয়ারিং পড়ছে, প্রিন্স কলেজে পড়ছে, তুই কি চাস ওদের পড়া বন্ধ হয়ে যাক? 

- মম্!

- কেন? তোর জামাই টাকা চেয়েছে? জানতাম গ্রামের ছেলে, ছোট মনের, একদিন হাত পাতবেই! 

- মম্! যা খুশি বলো না, ওকে তুমি চেনো না, হি ইজ মাই লাইফ পার্টনার, এ গুড ম্যান।


লরা কেঁদে ফেলে। ড্যাডির ছবির সামনে যায়, ছলছল চোখে ড্যাডির দিকে চায়, তারপর ঘুরে দাঁড়ায়। চিৎকার করে মেয়েকে ডাকে 'রানি', ছেলেকে ডাকে 'জয়'। বাচ্চারা অবাক হয়, মা'র মুখে তাদের এই নাম কেন! লরা মুহূর্তও দেরি করে না, এক চুমুক পানিও খায় না আর, সোজা বেরিয়ে যায়। ছুটির দিনে নিশ্চয়ই ঘরে আছে সাজেদ। 


বেবিট্যাক্সির আওয়াজ শুনে সাজেদ বুঝতে পারে রানিরা এসে গেছে। দরজা খুলে ওরা দাঁড়ায়। রানি চিৎকার করে বলে উঠে, দাদু। সে এক দৌড়ে দাদুর কোলে যায়। জয়কে কাড়াকাড়ি করে জেবা রেবা। লরা শাশুড়ির পা ছুঁয়ে সালাম করে, শাশুড়ি তাকে জড়িয়ে ধরেন। ননদীরা লরার পা ছুঁয়ে সালাম করে, লরা তাদের জড়িয়ে ধরে। 


সাজেদ বললো, এলে। চোখ বড়ো করে লরা বললো, আসবোনা? আমার স্বর্গে আমি আসবো না? সাজেদ ঠোঁট চেপে বললো, মা আইছে তোমারে নিতে। লরা বললো, মা আদর করলে কিচ্ছু ভয় পাই না, এই হাতে দেশে বিদেশে উঁচু নীচু রাস্তায় ড্রাইভ করেছি, বড়ো বড়ো পার্টি দেখেছি, শরাব দেখেছি, শরবত দেখেছি, আমি মূর্খ হতে পারি, কিন্তু দুনিয়াকে চিনি। শাশুড়ি লরাকে বুকে টেনে বলেন, মা তুমি যে কতো সোন্দর তুমি জানোনা, তোমারে আমি পেডের মাইয়্যা বইল্লাই জানি।


দু'দিন পরে শাশুড়ি বলেন, 'বুড়ামিয়ায় একলা বাড়িত, এইবার যাই মা'। লরা বললো, জ্বী মা যাবেন আসবেন, আমরাও যাবো আসবো, জানবেন একসাথেই আছি। তবে মাজেদ জেবা রেবা যাবেনা। ওরা এখানে থাকবে পড়বে, অনেক বড়ো হবে। সাজেদ বিষ্ময়ে তাকায় লরার দিকে, লরার মুখে তার মনের কথা! এইটুকু ভালোবাসার এতো বিনিময়!


রানি বললো মম্, দাদুকে যেতে দেবোনা। লরা বললো, এক শর্তে, এখন থেকে বলতে হবে, আম্মু আব্বু, নো মম্ নো ড্যাড, এন্ড ফ্রম দিস মোমেন্ট ইউ আর নাইদার এলিজাবেথ নর এলিজা, নাইদার ভিক্টর নর ভিকো, অনলি 'রানি' এন্ড 'জয়' টু আচ। রানি মা'র মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলে উঠলো, 'আম্মু'। লরা কোল পেতে রাখলো, ঝাপিয়ে পড়লো রানি। লরা টের পেলো গনগনে গরম সব বাইরে, অথচ ঘরে পরম শান্তি, আদিম যূথবদ্ধ জীবনের শান্তি। চোখ বন্ধ করলো লরা। দু'ফোঁটা সুখের জল গড়িয়ে পড়লো তার গন্ড বেয়ে। 

-----

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ