দর্পণ | ধারাবাহিক কলম | উপন্যাস ~ কংসাবতী { পর্ব - ১০ } উপস্থাপনায় ~ মহুয়া




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

 

উপন্যাস ~ কংসাবতী (পর্ব --১০)

উপস্থাপনায় ~ মহুয়া 


পুলিশ অফিসারের গাড়িটা অদৃশ্য হয়ে যেতেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সুচেতা । অফিসারের হাতে চেনটা দেখে মাথাটা কেমন ঘুরে উঠেছিল । বুকের মধ্যে ঢেঁকির পাড় পড়ছিল । বৃষ্টিভেজা শরীরে ঘাম দিচ্ছিল । ইন্সপেক্টরের চায়ের আমন্ত্রণ নাকচ করাতে বেশ একটা স্বস্তি বোধ হোল । আ আ আ আ, কণ ও ও ও ক একটু আয় তো । 

----- বল দিদি , ইসস আর একটু হলেই তো পড়ে যাত্যে । বৃষ্টিতে উঠান টা কাদা হইয়ে আছে । তুমি আমাকে ডাইকবে তো । আস , ই খোঁড়া পায়ে কুথায় কুথায় যাছ । বইললে কুথা শুনো নাই ।

----- তুই চুপ মাইরবি ? সুযোগ পাইল্যেই হল্য আর কি! বাবা কুথায় ? 

----- বুড়হা ট আছে ঘরকে , চা খাইছে।

----- তুই যা ,আমার জন্যে চা লিয়ে আয় জলদি । আমি কাপড় পাল্টাই আসছি ।

----- বুড়হা বইলতেছিল তুমার নাম আইজ খবরের কাগজে আইসছে । কি একটা অ্যাক্সিডেনের সময় তুমি নাকি দেইখছ ? সত্য নাকি ?

----- হুম , তুই যা ।

----- এই লাও তুমার চা । এই জন্যে দিদি পুলিশ আসেছিল ?

----- না রে , অ্যাক্সিডেন্ট তো কাল হয়েছিল , আমি আজ ইস্কুল থেকে ফেরার সময় ভিজে যাচ্ছিলাম , তাই দেখে গাড়ি থামিয়ে আমাকে উঠতে বললো । 

----- বুড়হা তুমাকে ডাইকছে গো দিদি ।

----- বলো বাবা , কেমন আছে শরীর আজ তোমার ? পায়ের ব্যাথা কম আছে নাকি বেড়েছে ?

------ ঠিকই আছি । আইজ খবরের কাগজে তুর নামট দিছে । কিসের অ্যাক্সিন হছে ? মইরছে

কজন ? 

------ সব ঘটনা বিস্তারিত বাবাকে বলে সুচেতা নিজের ঘরে গেলো । এই সময়টাই ওর নিজের সাথে নিজের একা থাকার সময় । ডাইরি থেকে কিছু পুরনো ছবি বার করে দেখতে দেখতে হারিয়ে গেলো কংসাবতীর ধারের ছোট্ট মন্দিরটায় । এই তো সেই ছবি !!!সে সময় নতুন বিয়ে হলে বা বিয়ে করলে জোড়ে মায়ের মন্দিরে প্রণাম করাটা রেওয়াজ ছিল । ওরাও এসেছিল ঘুরতে ঘুরতে মন্দিরে । দেখছিল কিছু নতুন জীবনে পা দেওয়ার আনন্দে খুশির আলো চলকে ওঠা নতুন নতুন জোড়া নিজেদের মধ্যেই বিভোর । প্রণাম করতে এসেছে যেনো নিয়ম রক্ষার্থে । খুব ভালো লাগছিল অমন আনন্দিত মুখগুলো দেখতে । হঠাৎ প্রতুল কোথা থেকে দুটো জবার মালা , মিষ্টি আর সিঁদুর নিয়ে এসে পুরোহিতকে দিয়ে বললো ," আমরা বিয়ে করবো "।©️

আচমকা প্রতুলের এই সিদ্ধান্তে সুচেতা কিছু বলতে পারে না । যদিও ও কখনোই চায়নি সবার অলক্ষ্যে এইভাবে বিয়ে করতে ।তবুও বললো ,"বিয়েটা কি খেলার মত নাকি , যে তুমি ইচ্ছে হলো আর বিয়ে করলে ?" কিন্তু প্রতুলের জেদের কাছে হার মানে । বেশি কিছু বললে প্রতুল দুঃখ পাবে এই ভেবে পিছিয়ে যায় , রাজি হয় বিয়েতে । কিন্তু একটা শর্তে , ওদের এই বিয়ের খবর যেনো কেউ জানতে না পারে যতদিন সুচেতা নিজের পায়ে না দাঁড়াতে পারে । প্রতুল রাজি হয়ে যায় । দিনটা যেনো স্বপ্নের মত কেটে যায় । হোটেলের ঘরে সেই প্রথম দুজনে এক হয় । দুজন দুজনের অনেক কাছে আসে । এক অনির্বচনীয় আনন্দ কানায় কানায় শরীর ও মনকে পূর্ণ করে তোলে । প্রতুল ওকে নিজের গলা থেকে হারটা খুলে পরিয়ে দেয় । আনন্দের আতিশয্যে সুচেতা কেঁদে ফেলে । প্রতুল আলতো করে সুচেতার মুখটা তুলে ধরে বলে,"তোর কাছে হারটা ফিকে ,কেনো বলতো ? হারটা সোনার আর তুই আমার কালো হীরে । বলতো কে জিতলো ? " সুচেতা অবাক হয়ে তাকাতেই বললো ," বুদ্ধু আমি রে আমি , সোনার বদলে হীরে ।" সুচেতা জড়িয়ে ধরে প্রতুল কে ।তবে একটা ভয় ও কাজ করে ভেতরে ভেতরে । কিছু অঘটন ঘটলে আর উপায় থাকবে না । এখনও তো কত পথ পাড়ি দিতে হবে । এমন করে ইন্টারভিউর নাম দিয়ে দুদিন প্রতুলের কাছে থাকে । সেই দুদিন সুচেতার জীবনে সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতি । তিন দিনের দিন প্রতুল ফিরে যায় কলকাতায় । তারপর কদিন পরে সুচেতা ও কলকাতায় ফেরে চাকরির জন্যে পড়াশোনা করবে বলে । মাঝে মাঝে কলেজে যায় এটা ওটার দরকারে । প্রতুল ও আসে । দুজনেই আবার পড়াশুনো নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে । প্রতুল তার বাবার কথামতো বিদেশ যাবার পরীক্ষাগুলোতে বসে । সুচেতা কে প্রতুল বলে ," তুই একদম চিন্তা করবি না , আমি বিদেশে পড়াশুনো শেষ করেই এদেশে চলে আসবো । তুই ও একটা চাকরি পেয়ে যাবি তদ্দিনে। সামনে শুধু কটা বছর ,দেখবি দেখতে দেখতে কেটে যাবে "

---- তুমি যদি বিদেশে গিয়ে ভুলে যাও আমাকে ? ওখানে কত সুন্দর সুন্দর মেয়ে ।

---- পাগল নাকি ? সুন্দর মেয়ে এদেশে নেই বুঝি ? তারা তো খালি সুন্দর । কিন্তু তুই যে সৌন্দর্য্যের খনি । জয় গোস্বামীর "মেঘবালিকা "। আর খালি আমার কথা বলছিস কেনো? আমি বিদেশ চলে গেলে তুই যদি অন্য কাউকে ভালোবাসিস , তখন কি হবে ? 

ওদের রোজকার এই মান অভিমানের পালার মাঝেই সুচেতার রেজাল্ট বেরোলো । ইউনিভার্সিটিতে প্রথম হয়েছে সুচেতা । কলেজে রেজাল্ট দেখতে গিয়ে সুচেতা পড়লো মহা বিপদে । প্রিন্সিপাল স্যার , এইচ ও ডি স্যার , আর ও টিচাররা , সুচেতার সহপাঠীরা কেউ ওকে ছাড়তেই চায় না । অত ভিড়ে প্রতুল ওর ধারে কাছে আসতে পারলো না ।সবাই একবার করে ওকে অভিনন্দন জানিয়ে যাচ্ছে ।ক্ষণিকের জন্যে সুচেতার কলেজে ভর্তি হবার প্রথম দিনগুলো মনে পড়ে গেলো । অনেক পরে ভিড় কমলে সুচেতা প্রতুল কে খুঁজতে খুঁজতে দেখে চুপচাপ একা ইউনিভার্সিটির পার্কে বসে আছে । ওকে দেখে বললো ," ভালো রেজাল্ট করলে মানুষ তার বরকে ভুলেই যায় "। বর কথাটা শুনে সুচেতা হেসে ফেললো । 

হাসলে ওকে ভারী মিষ্টি দেখায় গজ দাঁতের জন্যে । প্রতুল আচমকা ওকে চুমু খায় ।

বলে," এটা তোর প্রাপ্য আজকে ।"©️

দুজনে হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসছিল কলেজের গেট দিয়ে । হঠাৎ অফিসঘর থেকে চিৎকারের আওয়াজে ওরা দেখতে যায় ,কি হয়েছে ? দেখে কিছু ছেলেমেয়ে অফিসঘরে পুরো তাণ্ডব করছে । ওদের নাকি রেজাল্ট ঠিক হয়নি , ব্যাক পাবার কথা নয় । চেয়ার টেবিল ছোঁড়াছুঁড়ি করছে । প্রতুল ঠেকাতে গেলো ওদের , হাতাহাতিতে প্রতুল পড়ে যেতেই সুচেতা ছুটে ওকে তুলতে যেতেই ছেলেমেয়েগুলো বিশ্রী ভঙ্গিতে সুচেতা কে দেখিয়ে বলতে লাগলো ," কোথাকার এক জংলী আদিবাসী মেয়ে ইউনিভার্সিটি টপার হয়ে গেলো আর আমরা ফেল করলাম । তারপর প্রতুল কে বললো "কিরে তোর বাপ কত টাকা দেয় কলেজের প্রোগ্রামে ? গতবার তো জোজোকে আনবার টাকাটা তোর বাপ দিয়েছিল । টাকার জোরে প্রেমিকাকে টপার করে ফেললি ? " প্রতুল ছুটে গিয়ে ছেলেটাকে মারতেই সবাই হামলে পড়লো ওর ওপর। সুচেতা প্ৰতুলকে বাঁচাতে যেতেই একটা আধলা ইট পড়লো মাথায় । সুচেতার আর কিছুই মনে নেই । 

----- ও দিদি , চা টা যে জুড়ায় গেলো । কি ভাইবছ এত ? কাইল থিকে তুমাকে এমনি পারা লাইগছে । 

----- হুম ।

ঠোঁটের কোণে বিদ্রুপের হাসি ফুটে ওঠে সুচেতার , স্বগক্তি করে ,"আমার জীবনের উত্তাপটাই তো আর নেই । শীতলতায় মোড়া প্রতিটা বসন্ত উপহার দেয় রুপোলি চুল , কালো ফ্রেমের চশমা আর স্মৃতির মমি ।


(চলবে)


আগের পর্ব পড়ুন ...

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ