আমার চোখে ' মন্দার ' || দেবাশীষ ভট্টাচার্য্য




পোস্ট বার দেখা হয়েছে


কলমে : দেবাশীষ ভট্টাচার্য্য 

ম্যাকবেথ উইলিয়াম সেক্সপিয়ার রচিত বিশেষ জনপ্রিয় নাটকের মধ্যে একটি। ১৬০৬ সালে ম্যাকবেথ প্রথম মঞ্চস্থ হয়। তারপর কেটে গ্যাছে সুদীর্ঘ ৪০০ বছরের বেশী । তবে আজও বদলায়নি তার রূপ। আমরা যারা ইংরেজী সাহিত্য কমবেশি পড়েছি সকলেই প্রায় নাটকটির বিষয়বস্তুর সাথে পরিচিত।

ম্যাকবেথের এক একটি চরিত্রে সমগ্র অন্তরাত্মার অবস্থান ম্যাকবেথকে অমর করেছে। মূল চরিত্র নায়ক - খলনায়ক থেকে নায়ক রূপান্তর মুগ্ধ করেছে বিশ্বকে এখানেই কলমের স্বার্থকতা। পাশাপাশি তিন ডাইনির প্রত্যাবর্তন মানুষের গঠনগত  চেতন ও অবচেতন মনের বিকাশকে ধরে রাখে । এখানে উল্লেখিত খুন - জখম কিংবা উল্লাস তুলে ধরেছে সেই দিক গুলো যেখা‌নে অন্ধকারে আলোর পথ সুগম হয়। এছাড়াও রয়েছে যৌনতার এক অদ্ভুত দৃষ্টিকোণ, তথা লেডি ম্যাকবেথের কামাষক্তি কিংবা শয়তানকে নিজের গর্ভে স্থান দেওয়ার প্রবণতা এক অদ্ভুত দৃশ্যকাব্য সৃ‌ষ্টি করে। যেখা‌নে আমরা চতুর্থ ডাইনির সন্ধান পাই। এতোটা প্রজন্ম, শতাব্দী পেরিয়ে এসেও আমরা সেই চিত্র কল্পেই রয়ে গেছি আজও। 


তার বাস্তবতা আজও আমাদের মুগ্ধ করে। প্রতিটি সংলাপ গঠন এবং তার সাধারণ জীবনে অবতারণায় ম্যাকবেথ তার শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে।

এবার আসা যাক , অভিনেতা অনির্বান ভট্টাচার্যের প্রথম পরিচালনায় "মন্দার" ওয়েব সিরিজ বিষয়ে  । যা " based on Macbeth" শোনার পরেই বেশ কিছুটা নড়েচড়ে বসেছিলাম । এবং ফেসবুকে চারপাশে শোরগোল, আলোচনার ঝড় দেখে অবশ্যই দেখার প্রবনতাটা আলাদা ছিলো, এবং সেই মতোই একটি রিভিউ লিখে ফেল্লাম। আসলে বহু সিনেমা কিংবা ওয়েব সিরিজ দেখেছি বহু ক্ষেত্রে মুগ্ধ কিংবা হতাশও হয়েছি তবে কোনদিনই "মুভি রিভিউ " লেখার মানসিকতা তৈরি হয়নি। তবে আজ সংক্ষিপ্ত আকারে লেখার চেষ্টা করলাম ।

সিরিজে মন্দারের (ম্যাকবেথ) ভূমিকায় অভিনয় করছেন থিয়েটার অভিনেতা দেবাশিস মণ্ডল এবং লাইলি (লেডি ম্যাকবেথ) চরিত্রে রয়েছেন সোহিনী সরকার। দেবেশ রায় চৌধুরী অভিনয় করছেন ডাবলু ভাই (কিং ডানকান), মুকাদ্দার মুখার্জির চরিত্রে অনির্বাণ ভট্টাচার্য, শঙ্কর দেবনাথ, বঙ্কা (ব্যাঙ্কো) চরিত্রে, লোকনাথ দে, মদন (ম্যাকডাফ) চরিত্রে, দিগন্ত,  মনচা (ম্যালকম) চরিত্রে এবং কোরক সামন্ত, ফন্টাস (ফ্লাইন্স) চরিত্রে অভিনয় করছেন। এছাড়াও 'ম্যাকবেথ' -র তিন ডাইনি রয়েছেন এখানে।সজল মণ্ডল অভিনয় করেছেন মজনু বুড়ির চরিত্রে এবং সুদীপ ধারাকে দেখা গেছে পেদোর ভূমিকায়। অন্যদিকে তৃতীয় জন কালা নামের একটি বিড়ালকে রূপায়িত করা হয়েছে। 

আমি যা পেয়েছি --- 

গেইলপুর খ্যাত ডবলুভাইয়ের পোষা মস্তান মন্দার ও বঙ্কা ও তাদের কাজ এক অদ্ভুত নেশা তৈরী করে ।

         "কালের কোলে কপাল ফেরে 

  কেউ রাজা আর কেউ রাজার বাপ"

 

অথবা,  


        "পিত্তি দিয়ে গাঁথব মালা 

                    পচা রজনীগন্ধা 

       মিলব যেদিন চারজনেতে 

        আমি,পেদো,কালা আর 

                           মন্দার....."

প্রথমত সংলাপে সুগঠিত এবং অপূর্ব প্রতিভা প্রকাশিত হয়েছে। প্রত্যন্ত সাগরতীরের ভাষা উচ্চারণ ও তার প্রতিফলন কাহিনীকে এক অন্যরকম মাত্রা দিয়েছে ।

শহুরে পরিবেশ ভুলে প্রত্যন্ত পরিবেশে সমগ্র ম্যাকবেথকে তুলে ধরার প্রচেষ্টা খুবই ভালো লেগেছে । সাগর এবং আকাশ যেখা‌নে অনন্তের কথা বলে সেখানে আলোকিত হয় মানুষের চেতন ও অবচেতন মন তাই পরিবেশ নির্বাচনের  সার্থকতা রয়েছে।

তবে সবচেয়ে মন কেড়েছে পটভূমি। বিশেষ করে ' ইনকেলাব জিন্দাবাদ ' লেখা সাইকেলের চাবির  লকেটটি । এখানে সূচারু ভাবে রাজনৈতিক শাসক শ্রেণীর এবং শোষিত বঞ্চিত শ্রেণীর মধ্যে কতোটা বিস্তর ফারাক তা তুলে ধরার প্রবনতা আমায় মুগ্ধ করেছে। রাজা ও প্রজার মধ্যে যে ব্যবধান , কর্পোরেটের রমরমা,  রাজার প্রজাদের প্রতি বাৎসল্য দেখিয়ে সবটুকু কেড়ে নেওয়ার প্রবনতার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত ' মন্দার ' । খেটে খাওয়া মানুষ কিংবা সুপারী কিলার বানিয়ে আখের গোছানো নেতা মন্ত্রীদের উদ্দেশ্যে চরম বার্তা প্রতিফলিত হয়েছে। বর্তমান রাজনৈতিক কিংবা শ্রমিক মালিক শ্রেণীর খুব ভালো নিখুঁত উপস্থাপন ততসহ স্বৈরাচারী পুলিশ কিংবা আমলা তন্ত্রের গুণধরা অন্ধকার দিকটিও সুন্দরভাবে প্রতিফলিত।

আসি ক্যামেরার কথায়। প্রথম পরিচালক হিসেবে ক্যামেরার কাজ প্রশংসনীয়। অপূর্ব ড্রোনের ব্যবহার , বিশেষ করে ক্লোজসটের আধিক্য অন্যমাত্রা দিয়েছে ।

প্রত্যেকটি চরিত্রগত আচরণ গুলোকে অপূর্ব এ্যঙ্গেলে ধরা হয়েছে। যেমন - গাছের যোনী রূপ,  কিংবা লাইলির মৃত্যু , পেদোর প্রত্যাবর্তন ইত্যাদি । কেবলমাত্র তাই নয়,  একটি সমুদ্রের পাড়ে রাখা নৌকাকে কতোরকমভাবে ব্যবহার করা যায় তার দৃষ্টান্ত ' মন্দার ' । ম্যাকবেথ' যাঁদের পড়া নেই, সিরিজ দেখার আগে বিশেষ চিন্তায় পড়ার কোনও কারণ নেই। কারণ শেক্সপিয়ারের ট্র্যাজেডির পটভূমি অনুযায়ী এই গল্প এবং চরিত্রগুলির অনেকটা মিল থাকলেও, স্বতন্ত্র গল্প হিসাবেও এটাকে ভাবা যায়।

প্রত্যেক অভিনেতাই থিয়েটারের সাথে যুক্ত। সেক্ষেত্রে প্রত্যেকের অভিনয় বেশ সাবলীল এবং উপযুক্ত মনে হয়েছে। থিয়েটারের জাত অভিনেতাদের অভিনয় দক্ষতা যেমন 'মন্দার'-কে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছে। 

কেবলমাত্র চিত্রগ্রহণ নয়। আবহসঙ্গীতে যথেষ্ট পারদর্শীতা দেখা গিয়েছে 'মন্দারে'।  আরও একটি দিক এই সিরিজ এগিয়ে নিয়ে যেতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে, তা হল সোমনাথ কুন্ডুর মেকআপ। 

বিশেষ করে মজনু বুড়ির চরিত্র এবং  পেদোর মেকআপ । অভিনয় তো তুখোড় বলাইবাহুল্য কিংবা আমার মনে হয়েছে সঠিকভাবে মেকআপ যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে চরিত্র গুলোকে।

সেনসরশিপ না থাকার সুবাদে, সিরিজ জুড়ে রয়েছে গালাগালি, যৌনতা, নেশা, রক্ত, নেগিটিভিটি..। ফলে সিরিজ শেষ হওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পরেও তার রেশ মাথায় থেকে যেতে পারে। 

কেবলমাত্র চরিত্র গুলো নয়,  তৃতীয় ডাইনি হিসেবে কালো বিড়ালের সুন্দর ব্যবহার নজর কেড়েছে ।

সব মিলিয়ে ' মন্দার ' শোষিত শ্রেণীর গুরুত্বপূর্ণ উপকথা আমার বিচারে। এখানে প্রত্যেকটি চরিত্রই মানুষের অন্তরাত্মার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখানোর জন্য সার্থকতা  অনির্বান ভট্টাচার্যের। বাকিটা যারা দেখেননি দেখতে পারেন। আমার কাছে সিরিজটি ৭/১০ । 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ