গল্প || বিলাপ ~ তসলিম পাটোয়ারী




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

বিলাপ 

 তসলিম পাটোয়ারী 


- আছছালামু আলাইকুম। 

- ওয়ালাইকুম সালাম। 

- কাকা আমি আরাফাত, আপনের দোয়ায় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মেম্বার পদে দাড়াইছি। আপনাকে আসতে হবে কাকা।

- আচ্ছা..আচ্ছা। 


মিসেস সালাম বলেন, ধ্যাৎ, ভোট লাগে নাকি? 

সালাম বলেন, বাহ্, এ কেমন কথা? ভোট ছাড়া গদিতে বসা যায়? নাকি মর্যাদা থাকে গদির? গণতন্ত্র মানেই ভোট, ভোট মানেই গণতন্ত্র। 

- আচ্ছা বাবা, যেতে হয় যাও, বক্তৃতা দিওনা তো, মানুষ সবই জানে।

- ম্যাডাম, আমি তো গ্রামেরই ভোটার, তাছাড়া দু'বছর হলো বাড়ি যাইনি, খেতখামার আবার লাগানোর সময় হলো। 

- খাওয়া দাওয়া? 

- বাড়ির লোকদেরকে তো জানোই, ঘরে ঘরে ডেকে খাওয়াবে, আর এখন বাজারেও হোটেল রেষ্টুরেন্ট আছে। 


আরাফাত বলছিলো, ফিল্ড তার ফেভারেই আছে। দু'টো দিন জনসংযোগ করলেই হবে। কিন্তু কোম্পানি সালামকে একদিনের জন্যও ছাড়তে চায় না। শেষ পর্যন্ত এক সপ্তাহের ছুটি পেলেন তিনি। 


ঢাকা-চাঁদপুর রুটে এখন বড়ো বড়ো স্টিমার চলে। সালাম স্টিমারে করে চাঁদপুর এলেন। চাঁদপুর থেকে বেবিট্যাক্সিতে করে বাবুরহাটে। মতলব রোডের মাথায় বাবুরহাট গোলচত্বরে সিএনজিট্যাক্সিরা হাঁকছে মতলব হাজিগঞ্জ শাহাতলী বলে বলে। সালাম চত্বরের উত্তরে গেলেন, চাইলেন বাংলারিক্সা। পেলেন না। অদূরে ছিলো ক'টি ব্যাটারীরিক্সা। ওগুলোতে তিনি উঠেননা, একবার পড়ে গিয়ে থ্যাতলে গেছেন বলে। একটু এগুতেই চাইনিজ ইজিবাইকগুলো সরব হলো মিলিটারির দোকান, ময়দান খোলা, বডুরবাজার বলে। সালাম উঠলেন শেষের দিকেরটায়। 


ড্রাইভারের দু'পাশে দু'জন, পেছনে মুখোমুখি চারজন। সালাম বসলেন পেছনে। জানতে চাওয়ায় এক সহযাত্রী বললো পিচ ঢালা পথ চলে গেছে পাইকাস্তা রালদিয়া উত্তরপাইকাস্তার দিকে। সালাম বলেন, রাস্তাঘাট পাকা অইছে, তাইলে তো কাম কাজ অইছে ভালোই। আরেকজন বললো, মাদ্রাসাও চাইরতলা বিল্ডিং অইছে। সালাম বলেন, বাহ্, ঘরেত্তন নামলেই আলিম পাশ, কতো সুবিধা। তখনই বিদ্যুৎ চলে যায়। একজন বললো, আইজ আবার লোডশেডিং কা, ক্রিকেট আছে না ফুটবল? যত্তোসব, ফ্লাডলাইট জ্বালায়া খেলার দরকারডা কী? খেলা অইব দিনের বেলা। ড্রাইভার খেদোক্তি করে বলে, পুলিশ শুধু দাবড়ায় আমাগরে, সব বিদ্যুৎ নাকি আমাগো অটোয় খায়! 


দুই যুগ ধরে সালাম ঢাকায়। তবু অটুট বন্ধন তার গ্রামের সাথে। বাবার কবর, বসতঘর, জমির বহর সবই গ্রামে। পৈতৃক জমি লাগিয়ে তিনিও টাকা নেন। চাষীরা কাচুমাচু করে টাকা-পয়সা কম দেয়, সালাম তা ই নেন। চাষীরা তাই তাকে ভালো জানে। সবসময় তিনি সপরিবারেই আসেন। ছেলেমেয়েরা ক'দিন ধূলো মাখে গায়, দেখতে পায় বুড়িগঙ্গার ময়লা পানির স্থলে গাছের তলে পুকুরের স্বচ্ছ পানি, 'একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশিরবিন্দু'। সেবার এসে বাবার আমলের চৌচালা টিনের ঘরটা মেরামত করে যান। ঘরটা দিয়ে যান অন্য ঘরের দুই ভাতিজাকে। ওরা পাঠ অনুশীলন করে ও ঘুমায় এই ঘরে, কাকারা এলে চলে যায় নিজেদের ঘরে। 


লকডাউনের দেড় বছর সহ মোট দু'বছর পর সালাম এলেন। ঘরে ঢুকতেই বিদ্যুৎ পেলেন। ঘুরে ঘুরে দেখলেন ঘর, ফ্রেশ হলেন, কথা বললেন বাসায়। এই ফাঁকে ভাতিজারা বিছানা ঝেড়ে মুছে দিয়ে ভাত নিয়ে এলো। সালাম বলেন, রাইত ভাত খাই না, ডাইবেটিস বিস্কুট আছে লগে, ক্ষিধা লাগলে খামু দুই পিস। অতঃপর বিছানায় লম্বা হয়ে ফেসবুক দেখতে দেখতে চোখ বন্ধ করলেন। কিন্তু আজান শুনেই আক্কেল গুড়ুম। এ কী, লাইট অন করা, মশারি টানানো হয়নি, দরজা লাগানো হয়নি, এতো ঘুম হলো! নিজের সেই পুরনো খাটে বলে! ম্যাডামের পরশন নেই, তবুও! 


চারিদিকে সুমধুর আজান। ছোট বেলায় শুনতেন গোটাকয় খালি গলার আজান। কিন্তু এখন বাড়ি বাড়ি মসজিদ। প্রতি মসজিদেই মাইক। 'আসসালাতু খাইরুম মিনান্নাউম' শুনে শয্যা ছাড়েন সালাম। মসজিদে ওনাকে দেখে উৎফুল্ল হয় সবাই। আরাফাত এসে জড়িয়ে ধরে। সময় মতোই এসেছেন কাকা। আরেকটু পরেই তাদের জনসংযোগ শুরু হবে। 


যাত্রার সময় সালাম বলেন, আরাফাত বলো দেখি তোমার মেনিফেস্টো। আরাফাত বললো কাকা, আমার জুরিসডিকশানে একটা প্রাইমারি স্কুল আছে, একটা আলিম মাদ্রাসা আছে, বাবুরহাটে হাই স্কুল ও কলেজ আছে, আমরা একটা জুনিয়র গার্লস হাই স্কুল করবো, বাল্যবিয়ে বন্ধ করবো, বৃদ্ধ ভাতা বিধবা ভাতা প্রতিবন্ধী ভাতা প্রকৃত প্রাপ্যকে দিব, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ দিব, উত্তর পাড়ায় গ্যাস আসছে এই পাড়ায়ও গ্যাস আনবো, শপথ করছি গরিবের ত্রাণ নিয়ে ছিনিমিনি খেলবো না, মাদক-নেশাখোর প্রতিরোধ করবো, কোন অন্যায় করবোও না, বরদাশতোও করবো না, উন্নয়ন কাজ করবো। সালাম বলেন, তোমার প্রতিপক্ষরা তোমার কী কী বদনাম রটায়? অন্যরা বললো, না কোন বদনাম নেই ওর। সালাম বলেন, তাইলে তো আমরা বলতেই পারি, 'আরাফাত ভাইয়ের চরিত্র, ফুলের মতো পবিত্র'। সবাই হেসে উঠলো, বললো, ভাই না তো, কাকা। সালাম হেসে বলেন, আঠারো বছর হয়ে গেলে ছেলেমেয়ে বাবার বন্ধু হয়ে যায়, আর এ তো নির্বাচনী বুলি। তিনি বড়ো করে আওয়াজ তুলেন, 'আমার ভাই তোমার ভাই' ভোরের নির্জনতা ভেঙে সমবেত কন্ঠে শ্লোগান উঠে, 'আরাফাত ভাই, আরাফাত ভাই', 'আরাফাত এগিয়ে চলো' / 'আমরা আছি তোমার সাথে' ইত্যাদি। 


রাস্তার মোড়ে মোড়ে চায়ের দোকান। গৃহিণী যখন ঘরদোর ঝাড়ু দেন, থালাবাসন ধোন, পুরুষটি তখন রাস্তার মোড়ে চা মুড়ি খান, চুটিয়ে গল্প করেন, চায়ের কাপে ঝড় তোলেন, উড়ান বিড়ির ধোঁয়া। শ্লোগান শুনে তারা হাততালি দেন। দোকানের সামনে অনেক পুরুষ ভোটার পেয়ে যান সালাম। তারা মলিন বস্ত্রাচ্ছাদিত, হাড়জিরজিরে, সস্তা প্লাস্টিক সেন্ডেল পরা। সালাম হাত বাড়িয়ে দেন। সমবয়সীরা জড়িয়ে ধরে বলেন, ওভাই কতোদিন পরে আইলেন। সালাম বলেন, ভাতিজার জন্য আপনেগো ভোট চাই। ভোটাররা বলেন, আলহামদুলিল্লাহ, ইনশাআল্লাহ, আল্লাহ ভরসা। সালাম আরাফাতকে টেনে বলেন, তোমার ফিল্ড ভালোই। আরাফাতের এক দাদা বলেন, ভিলেজ পলিটিক্স বাবা, ভিলেজ পলিটিক্স, অন্তরের কথা বুঝবানা। 


রোদ তেজি হয়ে উঠে, ভোরের দোকান ছেড়ে ভোটাররা ছুটে। ওরা ভাত যোগাবে মাছ যোগাবে, তবেই তো সবে মাছে ভাতে বাঙালি রবে। যাক ওরা, ওদের ঘরে আছে নারী ভোটার। পা চালায় আরাফাতরা। এখনো আলপথ জেগে উঠেনি। বিলে ঝিলে স্থানে স্থানে আটকে আছে বর্ষার পানি। কোনাকুনি এ বাড়ি ও বাড়ি যেতে হবে কাদা পানি পাড়িয়ে, শিশিরে নাওয়া রাস্তা ঘাট মাড়িয়ে। সালাম পারেন, তিনি গ্রামেরই ছেলে। 


কার্তিকের শেষ। হালকা শিশিরে নাওয়া প্রকৃতি। কী শান্ত গ্রাম, কী অপরূপ রূপ গ্রামের। সৌন্দর্য সভ্যতা গ্রামেই সব। বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী ড.নাজমুল করিম যেমন বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতবর্ষ প্রধানত গ্রামীন সভ্যতারই দেশ; গ্রামীণ পরিবেশে মানুষ প্রকৃতির প্রিয় সন্তান হিসাবে বেড়ে উঠে; প্রকৃতির বিচিত্র শোভা, সৃষ্টি রহস্য, অনন্ত বিশ্ব, সবকিছু মানুষ গ্রামে বসেই উপভোগ করে। 


প্রতিটি বাড়ি স্বাগত জানায় আরাফাতকে। কিন্তু সালাম আশ্চর্য হন ছোট্ট বেলার সেই বাড়িগুলো দেখে। ছিল ক'খানা করে ঘর, বেশির ভাগই ছিল কুঁড়েঘর, দু’একটি ছিল টিনের। কিন্তু এখন প্রতিটি বাড়িতেই অগণিত ঘর, আর এতো ঘন ঘন যে দু'ঘরের চিপা দিয়ে যাওয়া যায় না। প্রায় ঘরই পাকাপোক্ত, হয় টিনের নয়তো টিনশেড বিল্ডিং, দু'একটা একতলা দোতলাও আছে। বাড়ি সংলগ্ন জমি ভরাট হয়ে বাড়ছে বাড়ি, উঠছে ঘর, হচ্ছে মসজিদ-গোরস্থান, কমছে জমি। বড়ো রাস্তার পাশে হচ্ছে ঝলমলে মার্কেট। কালিবিলের বিস্তীর্ণ ফসলি জমিতে হয়েছে বিদ্যুৎ অফিস। এভাবে জমি কমে গেলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কোথায় দাঁড়াবে কে জানে। ম্যালথাসের জানা থাকবে হয়তো। 


আরাফাত বললো ঐ কোনার চাইর পাঁচটা ঘর শেষ কইরা এই বেলা ঘরে ফিরুম। প্রথম ঘরটি টিনশেড বিল্ডিং, বড়োসড়ো, সুন্দর। আরাফাত বললো কাকা, এইটা আপনেগো ক্লাশ মেইট তাসলিমা আন্টির ঘর, আঙ্কেল থাকেন কাতার। আমি আরো দুইবার আসছি, আন্টি দুইবারই আপনের কথা জিগাস করছে। 


পা থেমে যায় সালামের। তাসলিমা! এতো কাছে! সালাম জানতো, 'সে এখন ঘোমটা পরা কাজল বধূ দূরের কোন গায়'। জানতো, বিয়ে হয়েছে পিংরা বাজারের কাছে, অসচ্ছল ঘরে। কিন্তু এ তো দেখি বড়লোকের ঘর। আরাফাত বললো ওনারা এইখানে জমি কিন্যা ঘর করছে। আন্টি ছোটদের স্কুল খোলছে

ঘরে। অনেক বাচ্চা হয় স্কুলে। আন্টি গার্জিয়ানদের বইলা দিলে ভোটগুলি আমি পাই; আপনে আন্টিরে বইলেন কাকা। 


আরাফাত আন্টি বলে ডাকতেই বেরিয়ে আসেন আন্টি। আন্টি দরজা খুলতে খুলতে বলেন আরাফাত তুমি আমার ছেলের মতো, বারবার আসা লাগেনা বাবা, অন্যদিগে সময় দেও। আরাফাত বললো, প্রতিপক্ষ বারবার আসলে আমারও বারবার আসতে হয় আন্টি। তবে এইবার কাকারে লইয়া আইছি, আমাদের সালাম কাকা, আপনের ক্লাশ মেইট আন্টি। 


তাসলিমা চেয়ে থাকেন। সম্বিত ফিরে পেলে ঘোমটা টেনে বলেন, ঘরে নিয়া আসো, এতো বড়ো মানুষ নিয়া আসছো বাবা, বসতে দেই কই; বসো সবে, চা খাইয়া যাইবা। আরাফাত বললো তাইলে কাকা আপনেরা কথা কন, আমরা ঐদিগের ঘরগুলা ঘুইরা আসি। 


মুখোমুখি সালাম ও তাসলিমা। চার চোখে কতো কথা সাঁতরায়। সালামই মুখ খোলেন,

- কেমন আছো তাসলিমা!

- হাহ্, "পঁচা মাছের দুর্গন্ধ, ভালো না মন্দ?"

- আজো মনে আছে 'অবরোধবাসিনি'? 


তাসলিমা হুতাশ নিশাস ছাড়েন। 


তাসলিমা সালাম এক সাথে পড়তো প্রাইমারি স্কুলে ও হাইস্কুলে। তারা তাদের দু'বাড়ির মাঝখানের নিরিবিলি সরু পথের উপর বকুল তলায় একত্রিত হতো। তারপর হাটা শুরু করতো স্কুলের দিকে। এসএসসি তে ফার্স্ট ডিভিশন পায় তাসলিমা। নাম হয় তার। কিন্তু তাসলিমা সব কৃতিত্ব দেয় সালামকে। সালাম বললো ঠিক আছে, কলেজে ভর্তি হ, বড়ো হ, আছি তোর পাশে। সালাম সেদিন তাসলিমার হাতে তুলে দেয় "রচনা সংকলন, রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন''। বইতে লিখে দিয়েছিল 'প্রিয় অবরোধবাসিনী কে'।

হঠাৎ কী হলো তাসলিমার! লেখাটি পড়েই সে বইখানি দিয়ে সালামের চোখ অবরোধ করে একটি মিষ্টি চুমু দিয়ে বসে সালামকে; মুচকি হেসে চোখ বন্ধ করে রাখে। সালাম অবাক হয়ে দেখে তাসলিমার অপরূপ রূপ। অমন করে আর কোনোদিন দেখা হয়নি তাকে। তার অন্তর শিহরে, সেও চুক করে তাসলিমার অধরে পুরে বৃন্দাবনের একমুঠো প্রেম, একবার দুবার, রুমিও জুলিয়েটের মতো বারবার। 


কিন্তু মেয়ে হয়ে জন্মানোর জ্বালা তাসলিমা কাকে বলবে। আপনজনও দানব হয়, সম্পর্ক ভুলে রয়, হাত বাড়ায়। যে হতে পারতো তার প্রিয় প্রতিরক্ষা তাকে তার বাবা ঢাকা নিয়ে যায়। হোস্টেলে রেখে কলেজে পড়তে দেয়। একটা বিপ্লব হতে পারতো আশরাফ আতরাফে, কিন্তু সব তছনছ হয়ে যায়। 


টলটলে চোখ নিয়ে তাসলিমা ভিতরে চলে যান। পুরুষেরও চোখ ফাটে। সালাম তা মুছে নেন শার্টে। তাসলিমা ফিরে এসে শুধান-

- কেমন আছো তুমি, ভাবী, বাচ্চারা? 

- ভালো, কিন্তু সারাদিন বকা খাই।  

- কেন?

- এই যেমন আড্ডা দেই, বিঁড়ি খাই, ঘরদোর ভাবিনা, বউয়ের জন্য একটা আইব্রুও কিনিনা, উদাসীন। 

- ভাবী একদম ঠিক আছে, আমি হইলে ঘরেই জাগা দিতাম না। 

- হাহ্, তুমি আর হইলা কই। 


মুহূর্তে নিরব হয় ড্রয়িং রুম। সালাম সত্যি সত্যি  উদাসীন হন, আওড়ান জীবনানন্দ দাশ-

"আজকের জীবনের এই টুকরো টুকরো মৃত্যু আর থাকত না;

থাকত না আজকের জীবনের টুকরো টুকরো সাধের ব্যর্থতা ও অন্ধকার;

আমি যদি বনহংস হতাম,

বনহংসী হতে যদি তুমি;

কোন এক দিগন্তের জলসিড়ি নদীর ধারে

ধানক্ষেতের কাছে।"

অঝোর ধারা বয় তাসলিমার চোখে। সামান্য আঁচল তা মুছে নিতে পারেনা। 


চা খাওয়া হলে সালাম বলেন, তাসলিমা তোমার বাচ্চাদের মা-বাবার ভোটগুলি যেন আরাফাত পায়, তুমি বইলা দিও। 


পথে একজন নারী মেম্বার প্রার্থীর সামনে পড়েন তারা। ভালো লাগে সালামের, ভেঙে যাচ্ছে মান্ধাতার কাল। ইউনিয়নের নয়টি ওয়ার্ডের তিনটি ওয়ার্ডের জন্য সংরক্ষিত মহিলা মেম্বার পদে প্রত্যক্ষ ভোটে একজন মহিলা নির্বাচিত হবেন, মেম্বারের তিনগুন এলাকা, কম কথা নয়, তারা কোন রাজা বাদশা'র দুহিতা বা দয়িতা নয়, গ্রাম বাংলার অবহেলিত জনপদের সাহসী কন্যা, দাঁড়াতেই হয় তার জন্য। সালাম আরাফাতকে খোঁচা দিয়ে বলেন, তোমাগো তিনগুন মাইয়্যারা, অগো লগে পারতানা। সবাই হেসে উঠে। 


জনসংযোগে তারা পেলেন অসংখ্য বিধবা, তালাক প্রাপ্তা, বালিকা বধূ, দৃষ্টি শক্তিহীন, দুস্থ বৃদ্ধ বৃদ্ধা, গরিব অসহায় মানুষ। দু'মাসের একটি ছেলেকে বুকে নিয়ে এক বাড়িতে দাঁড়িয়েছিলেন এক তরুণ বাবা। শিশুটিকে পৃথিবীতে নামিয়ে দিয়েই মা চলে গেলেন। বড়ো কষ্ট হয় সালামের। একটা হাসপাতাল আজো গড়ে উঠলো না দু'চার গ্রাম মিলে। আরাফাত বললো আমাদের ইচ্ছা আছে পাশের গ্রামের কম্যুউনিটি হাসপাতালটা বড়ো করার। সালাম আরাফাতের মুখের দিকে চেয়ে থাকেন। একজন ওয়ার্ড মেম্বার কী ই বা করতে পারেন। ইউনিয়ন পরিষদেরও স্বায়ত্তশাসন নেই যে, তারা উন্নয়নকর বসিয়ে জনহিতকর কাজ করতে পারে। তাদেরকে চেয়ে থাকতে হয় সরকারের দিকে। সরকার তাই চেয়ে থাকেন দলীয়করণের দিকে। নির্দলীয় নির্বাচন তাই এখন দলীয়। এক সময় বাংলায় ও ভারতে প্রশাসন ছিল পঞ্চায়েতের হাতে। গ্রামবাসীর শিক্ষা, ধর্মীয় আচার, সেচব্যবস্থা দেখভাল করতো পঞ্চায়েত। ব্রিটিশরা সে ব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে ইউনিয়ন বোর্ড গঠন করে। বোর্ড গ্রাম্য চৌকিদারী, রাস্তাঘাট, সেতু, জলপথ, স্কুল, চিকিৎসালয় স্থাপন করতো ও তা দেখভাল করতো। স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধু ইউনিয়ন পঞ্চায়েত বা ইউনিয়ন পরিষদ করেন। রাজনেতিক পরিচয় ছিল না তখনো। কিন্তু আজ রাজনৈতিক পরিচয়ের কারনে এই নির্বাচনে কতো প্রাণ যাচ্ছে, কে নেবে তার দায়? মানুষ স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় পরিচয় পছন্দ করেনা। 


ঘরে শুয়ে চোখ বুজেন সালাম। দেখেন তাসলিমার দায়িত্ববোধ। মাথা হেট হয়ে যায় তার। তার বাসার পাশেই বস্তি। কই, বস্তির ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার কোন ব্যবস্থাই তো তিনি করলেন না; তাসলিমার ন্যায় বাড়ির একটি ফ্লোর ছেড়ে দিলেন না। শুধু নিজের লাইব্রেরিখানাই বড়ো করে গেলেন। মহান ব্রত নিয়ে বাচ্চাদের পাশে দাঁড়িয়েছে তাসলিমা, সমাজের পাশে দাঁড়াতে চায় আরাফাত, দাঁড়াতে চায় নারী মেম্বার প্রার্থী। তাদের তুলনায় সালাম নিজেকে অপাংক্তেয় ভাবেন। ভাবেন সমাজের দুঃখ কষ্টে একাত্ম না হলে মানুষের বড়ো হবার দরকার কী? নিজেকে ধিক্কার দেন সালাম। তার চোখে ভাসে হিন্দি লাল কেল্লা সিনেমায় শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের বিলাপ-

"না কিসি কী আঁখ কা নূর হু, 

না কিসি কে দিল কা কারার হু; 

জো কিসি কে কাম না আ সাকে, 

মে ও এক মুস্ত ই গুবার হু।"

-----

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ