দর্পণ || গল্প || ছি ~ তসলিম পাটোয়ারী




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

ছি 

 তসলিম পাটোয়ারী


বক্স অফিস সুপারহিট সিনেমা লেগেছে জলসা সিনেমা হলে। সাহেব আলী টগবগিয়ে উঠে। কুলিগিরি ছেড়ে টিকেট ব্ল্যাকিং এ ছুটে। এখনই কয়টা টাকার কামানোর সময়। যদিও এ কাজ চ্যালেঞ্জময়। হলের ক্লার্ক, নিরাপত্তা রক্ষী প্রমুখকে বখরা দিতে হয়। লাভের গুড় পিঁপড়ায় খায়। তবুও পকেটে ভালোই থেকে যায়। 


সাহেব আলী প্রস্তুত। বাইম মাছের মতো কাত চিৎ হয়ে লম্বা লাইন ঘেঁষে ঘেঁষে সে টিকেট কাউন্টারে যায়। সতীর্থদের সাথে ধ্বস্তাধস্তি করে কাউন্টারে হাত ঢুকায়। ক'টা টিকেট নিয়ে হাসিমুখে ফিরে। তারপর অদূরে গিয়ে হাকে ডি.সি ডি.সি। মূহুর্তেই তার সব টিকিট বিক্রি হয়ে যায়। সে আবার ঢুকে, ঢুকে আর বের হয়। রাস্তার উল্টো দিকে নিউমার্কেটের সামনে ফুটপাতে বসে রানি দেখে তার সাহেবের মর্দামি। গায়ে গতরে ক্যাংটা হলেও মরদের মর্দামি আছে অশ্বের মতো, রাতে সে ভালোই টের পায়। 


চাঁদপুরের কোনো এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে বাবা মার সাথে চট্টগ্রাম এসেছিল ছোট্ট রানি। এসে ওরা হাত পেতেছিল শহরবাসীর দ্বারে। শহরবাসী দিয়েছিল। কিন্তু দিতে পারেনি রাতের আশ্রয়টুকু। ছিন্নমূল বহু মানুষের পাশে অবশেষে তারাও ঠাঁই করে নেয় দেওয়ানহাট ব্রিজের নিচে, বস্তিতে। 


সাহেব আলীও এই বস্তির বাসিন্দা। ব্রিজের নিচে দুই সারিতে শুধু বস্তি আর বস্তি। মাঝখান দিয়ে চলে গেছে চট্টগ্রাম-ঢাকা রেললাইন। দক্ষিণ পাড়ে সাহেব আলী উত্তর পাড়ে রানি। একই ঘাটের মরা ওরা। মাসে পঞ্চাশ টাকা করে ভাড়া গুনতে হয় ঘর প্রতি। ভাড়া কে নেয়, জমিদার কে, কিছুই জানে না ওরা। ওরা শুধু চিনে ভাড়া আদায়কারীকে। সেও তাদের মতো সামান্য মানুষ। তবে কথা বলে দাপটের সাথে। বুঝা যায় আসল জমিদার আরো দাপুটে। 


রানিদের পাশ দিয়ে কাজে যায় সাহেব আলী। গান গেয়ে গেয়ে যায়, হৈ হাই করে যায়। একদিন সাহেব দেখলো মানুষের চলাচল ভুলে এলোচুলে পাগলী মতো এক কিশোরী দাঁড়িয়ে আছে এক বস্তিঘরের ছাউনি ধরে। সহানুভূতি জাগলো তার। ভাবলো এ কী, নিজের বউয়ের মতো আরো পাগল বুঝি আছে এই বস্তিতে। কিন্তু তার অন্তদর্শন কয় মেয়েটি যেন পাগলী নয়, পাগলীর ভান ধরেছে। বস্তির অনেক মেয়েই ষন্ডাদের চোখ এড়াতে এমন করে। কিন্তু সাহেব আলী অনুসন্ধিৎসু, মেয়েটিকে ঘেটে দেখতে চায় সে। সে মেয়েটির পাশ দিয়ে যায়, তার আপাদমস্তক চেখে দেখে। মেয়েটি মাঝারি গড়নের, পানপাতা মুখ, জ্বলজ্বলে চোখ, কুচাগ্রে উন্নত বুক, কালো হলেও তেল চুকচুক। সাহেবকে দেখে মেয়েটি তার পরনের মলিন ফ্রক টেনে টেনে পাছা ঢাকে, ময়লা ওড়না টেনে বুক ঢাকে। সাহেব আলী বুঝে গেলো মেয়েটি পাগলী নয়, ছিনালও নয়, ভানই করে। দিন কয়েক পরে তার ঘোর একেবারেই কাটে, দেখে মেয়েটি পরিপাটি, তার পিছু পিছু হাঁটছে এক মহিলার সাথে। মহিলা মেয়েটিকে বলছে, ও রানি, আস্তে যা মা, তোর মতো আমি কী আটতাম হারি। সাহেব বুঝলো ওরা মা ও মেয়ে। মা-মেয়ে ঢুকে যায় পলোগ্রাউন্ড কলোনির দিকে, সাহেব আলী বটতলী রেলস্টেশনের দিকে। 


সাহেব আলী একদিন জিজ্ঞেস করলো, ও খালা তোমরা যাও কই ডেলি ডেলি। খালা কয়, কামে যাইরে বাবা, মেছে কাম করি, তুমি কেডা? সাহেব আলী জবাব দেয়, আমিও এক কপালপোড়া গো, আপনেগো সামনেই থাহি, যহন যা পাই করি। তারপর থেকে খালার সাথে সখ্য সাহেব আলীর। রানির দিকেও সে পুটুস পাটুস চায়। খালা না দেখে মতো সাহেব বুড়ো আঙুল আর মধ্যমার ঘর্ষণে টস টস তুড়ি বাজায়। রানির দৃষ্টি ফেরাতে চায়। রানি হুহ্ বলে মুখ বাঁকায়। এমনি করে করে বহুদিন পরে একদিন রানির মুখ সোজা হয়। ওর ওষ্ঠে জাগে হাসির রেখা। 


প্রেম গজালে প্রেমিক শার্টের কলারে টোকা দিয়ে প্রেমিকাকে ভাব দেখায়। ময়ূরীর চারপাশে পেখম খুলে ময়ুর যেমন নাচে তেমনি নাচতে চায়। কিন্তু সাহেব আলী অতো কিছু করে না, প্রেমের মুদ্রা বুঝেনা। সে একদিন সোজাসুজি রানিকে বলে ফেলে, রানি আমি তোরে বিয়া করুম। রানি মুখ বাঁকিয়ে বলে, বিয়া কয়ডা করছেন অন তালিক। সাহেব রানির চোখে চোখ রাখে, বলে, হাছা কইরা কই বিয়া একটাই করছিলাম। তয় বৌডার মাথায় ছিট আছিল, খালি আবোল তাবোল কইতো। গত বছর একদিন দোপর বেলা অয় ঝাপ দিলো ট্রেনের নিচে, অয়ও গেলো পেডের পোলাডাও গেলো, বস্তির বেবাকেই জানে হেই কতা। সাহেব আলীর চোখ ছলছল করে, কথা আটকে যায়। রানি বলে, অ, হেয় তাইলে আমনের বউ আছিলো। সাহেব আলী মাথা নাড়ে। 


মা তার মেছে যায়। রানিরটা রানি ক'দিন আগে ছেড়ে আসে। মেছের চার জনের মধ্যে সবচেয়ে ভালো লোকটা বদলি হয়ে গেছে। বাকী তিনজনের একজন শয়তান। সামনে পড়লেই কথা বলতে চায়, টসটস করে তাকায়। একদিন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি দিয়েই দু'জন অফিস মুখো হয়। শয়তানটাও প্যান্ট শার্ট পরে রেডি হয়। এমন সময় অঝোর ধারায় বৃষ্টি শুরু হয়। রানি অগত্যা অপেক্ষা করতে থাকে। সেদিনই লোকটা সুযোগ নেয়। একশো টাকার একটা নোট ধরে বলে, ধর এইটা রাখ। রানি বাকীটা বুঝে যায়। মা'র কথা মনে পড়ে তার। মা বলেছেন, গরিবের সবচে দামী জিনিস অইলো ইজ্জত। জান দিবি কিন্তুক ইজ্জত দিবিনা। শয়তানটা রানির হাত ধরে টান দিয়েছিল। রানি এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নেয়। একদলা থুতু তার গায়ে ছুঁড়ে দিয়ে বলে, খবিস বুইড়া, বাড়িত গিয়া নিজের মাইয়্যারে ধরতে পারস না। তারপর ঝটপট দরজা খুলে বৃষ্টির মধ্যেই বের হয়ে যায়। আর যায় না মেছে। 


সাহেব আলীর জন্য এখন রানিদের ঘর খোলা। সে একদিন ঢুকে যায় তাদের ঘরে। রানি লাফ দিয়ে দূরে সরে। সাহেব বলে ডরাইছ না, আমি গরিব তয় নোংরা মানুষ না। আইজ কয়দিন ধইরা তোরে একটা কতা কওনের জন্য মনডা ছটফট করে, হেইডাই কইতে আইছি। হোন, তোরে আমি ঘরে তোলবার চাই। তুই কি কছ? 


রানি ভাবতে শুরু করে। কতো শয়তান হাত বাড়াতে চায়। বস্তির পোলাগুলাতো আরো বদমাশ। সন্ধ্যা হলেই রেল লাইনের উপর আসর জমায়। বিড়ি মদ গাঁজা সবই খায়, মেয়ে দেখলে তখনই কুকুরের মতো লাফিয়ে উঠতে চায় গায়। রানি মাথা তুলে বললো, মায় আছে না, আমি কী কমু। 


সাহেব আলী বলে, খালারে নাইলে কইলাম, তোর কতা তুই ক। রানি সাহেব আলীর চোখের দিকে চেয়ে থাকে। খুঁজতে থাকে একখানি ছোট্ট পাখির নীড়। সাহেব আলী বলে, তয় এইডাই কতা, অহন যাই, মেঘনা এক্সপ্রেস লাইনে লাগবো অহনই, তুই আমার ঘরে যাইছ, এই ল একটা চাবি, মনে করিছ এইডা তোর ঘর। 


রানি জেনেছে সাহেব আলী কর্মঠ। বসে থাকে না। দু’পয়সা ইনকামের চেষ্টা করে। কৈশোর থেকেই বহু কাজের অভিজ্ঞতা তার। ছিলো চায়ের দোকানে গ্লাশবয়, মুরগীর দোকানে মুরগী ছিলানো কারিগর, বটতলী রেলওয়ে স্টেশনের কুলি। কোন কাজই তার কাছে কঠিন নয়। প্রতিভা দিয়ে টিকে থাকে সবখানে। 


রানি যেন চাতকী। সাহেব আলী কখন ফিরে তার পানে চেয়ে থাকে। কান পেতে রাখে সাহেবের হেই হাই শব্দের জন্য, গানের জন্য। দরজায় ঝুলানো ময়লা পর্দাটা বার বার সরিয়ে আকুলিবিকুলি করে। একদিন চুপি চুপি গিয়ে সাহেব আলীর ঘরটাও দেখে আসে। দিন যায়, সাহেব আলীর ঘরের সাথে রানির বন্ধনও বেড়ে যায়। একদিন সে সাহেবের ঘরে ঢুকে পড়ে। ঘরে আছে ছোট্ট একখানা চৌকি, কেরোসিনের স্টোভ, অল্প কিছু হাঁড়ি সরা ভান্ড ইতস্ততবিক্ষিপ্ত, কোনায় কোনায় মাকড়সার জাল আর ময়লা ঝুল, লুঙ্গি গামছা, জামা, প্যান্ট, ছড়ানো ছিটানো। সে হাত লাগায় আর গালি দেয়, সব বেডাগুলাই খাডাশ। 


বাতি জ্বালিয়ে সাহেব আলী তাজ্জব হয়। নিজের ঘরটা অপরিচিত মনে হয়। বুঝতে পারে এ কাজ রানিরই। রানির প্রতি তার টান আরো বেড়ে যায়। সে হাঁটতে হাঁটতে রানিদের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। রানি গলা বুঝে বাঁশের তরজার দরজা খুলে দেয়। সাহেব জিজ্ঞেস করে কী রে খালায় নাই। রানি বলে, আইজ দেরি অইতাছে দেহি। সাহেব জিজ্ঞেস করে, আইজ কী আমার ঘরে গেছিলি। রানি মুচকি হেসে বলে, বেগানা বেডাইতের ঘরে যামু ক্যান? সাহেব রানিকে কিল দেখিয়ে বলে, ঐ আমি বেগানা পুরুষ, আয় একদম ছেইচ্চা দিমু। রানি বলে, এইডা আর নতুন কী, ভালা বুরা বেক বেডায় ই বেডিগরে ছেঁচে, তুমিও ছেচবা, কিলাইবা, লাথি মারবা, পুরানডা ছাইড়া নতুন একটা বিয়া করবা। 


সাহেব আরো কাছে আসে। রানির যৌবনের ঘ্রাণ লাগে তার নাকে। সে রানিকে একটানে বুকে ঢুকিয়ে বলে, আমি ঐ রহম নারে রানি, তোরে ধইরা কই, আমারে বিশ্বাস কর। রানি সাহেবকে বিশ্বাস করে, চুপসে থাকে সাহেবের বুকে। 


সাহেব আলী একদিনও মারেনি রানিকে। আদরে আদরে ভরে দেয় তার দেহ মন। তাদের ছোট্ট ঘরখানা হয়ে উঠে আদম হাওয়ার স্বর্গ। একটি আপেল যোগাতে পারলে ওরা খায়, নয়তো পানি খেয়ে ঘুমিয়ে যায়। 


সাহেব আলীরা এতদিন নিরাপদেই ছিল। কিন্তু যেদিন বস্তি ছাড়ার মাইকিং শুনতে পেলো সেদিনই বুঝলো তাদের পায়ের তলায় মাটি নাই। তবুও ভাড়া উত্তোলনকারী চামচা এসে জমিদারের খবর বলে যায়। জমিদার বলেছেন কিচ্ছু হবে না, বিকল্প ব্যবস্থা না করে বসতঘর থেকে কাউকে উচ্ছেদ করা যায় না, এটা মানবতা বিরোধী, মানুষকে হোমলেস করা যায় না, দরকার হলে মানবাধিকার সংস্থাকে জানানো হবে, সরকার ঠাঁই না দিলে এই সব পাহাড় ভাঙা নদী ভাঙা মানুষগুলো যাবে কোথায়? 


কিন্তু একদিন সত্যি সত্যি তারা উচ্ছেদ হয়ে যায়। তিলে তিলে গড়ে ওঠা রানি সাহেবের ঘর এক ফুঁৎকারে উড়ে যায়। বুলডোজারের চাপে গুড় গুড় করে ভেঙে যায় ঘর হাঁড়ি পাতিল বাসন কোসন। চিৎকার করে অসংখ্য রানি। সে চিৎকারে কান দেয় না যন্ত্রদানবের চালক। সেও যে সাহেব আলীর মতো, দু'মুঠো অন্নের জন্য সামান্য চাকুরিজীবী।


তারপর থেকে সাহেব আলী, রানি ও তার মা ভাসমান। তারা রাত কাটায় রেলের পরিত্যক্ত বগির জমকালো আঁধারে কিংবা আলো ঝলমল স্টেশনের করিডোরে। জনপদ গমগম করে উঠার আগে সরে পড়ে। নতুবা পরিচ্ছন্নতার অজুহাতে দাবড়ানি আছে। আগে দোকান থেকে চা রুটি ভাত আনতো সাহেব। এখন ওরা দোকানে গিয়ে খেয়ে নেয়। শাশুড়ি আগের মতোই মেছে চলে যায়। রানি যাত্রী ছাউনিতে বসে কিংবা প্লাটফর্মে ঘুরে বেড়ায়। সাহেব যায় কুলিকাজে। কিন্তু সাহেব ভেবে দেখলো কুলিগিরির চেয়ে রেলের টিকিট কিংবা রেলের চেয়ে সিনেমার টিকিট ব্ল্যাকিং এ আয় ভালো। এই করে সে ক’দিনের মধ্যেই তিন মাসের অগ্রিম পনেরো'শ টাকা জমাতে পারবে, পোস্তার পাড়ে কিংবা আইস ফ্যাক্টরী রোডে তিন চারশো টাকার মধ্যেই ঘর ভাড়া নিতে পারবে। তাদের চোখে ভাসে একটি ছোট্ট ঘর, ছিমছাম, নিরুদ্বিগ্ন। 


নিউ মার্কেটের সামনে বসে রানি দেখে যাচ্ছে সাহেবের অক্লান্ত পরিশ্রম। আবেগাপ্লুত হয়ে উঠে সে। ইচ্ছে করে ওকে সেও সহায়তা করে। কিন্তু এখন নড়াচড়াই তার দায়। পেট বড়ো হয়েছে। কাপড়ের ভিতর দিয়ে পেটে হাত বুলায় সে। অনাগত শিশুটির জন্য হলেও একটু ঠাঁই দরকার। সে উপরের দিকে চেয়ে বলে, আল্লাহ তুমি দয়া করো। 


মা বাবার সাথে আসা ফুটফুটে এক ছেলের দিকে চেয়ে রানি চোখ তুলে উপরের দিকে। আল্লাহ, আসুক একটি ছেলে। গরিবের ঘরে মেয়ে হয়ে লাভ কী। ছেলে হলে বড়ো লোকের জুতার বোঝা বয়েও বাঁচতে পারবে। রানির চোখ বন্ধ হয়ে আসে। সে স্বপ্নে বিভোর হয়। রঙ লাগে তার চোখে। সে যেন ঘরে বসে আদরে সোহাগে ভরে দিচ্ছে তার সোনাকে, বাবুটির মতো করে সাজিয়ে রাখছে, সাজিয়ে গুজিয়ে পাঠাচ্ছে স্কুলে। 


কিন্তু হলের সামনে বড়ো বড়ো আওয়াজে রানির ধ্যান ভাঙে। হৈ চৈ কোলাহল ছুটাছুটি, ধর শালারে মার শালারে, পেটা হারামখোরকে, শালারা শেষ করে দিল দেশটাকে। রানি চোখ তুলে তাকায় জটলার দিকে। তার হৃদপিণ্ড মোচড় খায়, কোন ব্ল্যাকার মার খাচ্ছে না তো? যখন তখনই ব্ল্যাকাররা চড় থাপ্পড় খায়। এ কাজে তরুণরাই অগ্রগামি। ব্ল্যাকার মেরে তারা দূর্নীতি দমন করবে। 


রানি পলকে চোখ ঘুরায় সাহেব আলী যে দিকে ছিল সেই দিকে। সব ক'জন ব্ল্যাকারই তার চেনা। সে একে একে সবাইকে দেখতে পায়। কিন্তু সাহেব আলী কোথায়? তাহলে কী..। জটলার দিকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় রানি। ধবধবে সাদা গাড়ীটার টিনটেড গ্লাশ নামিয়ে মুখ বের করে সুন্দরী নারী বললো, মারেন বদমাশটাকে, ছোটলোকদের লাই দিতে নাই। তার সাথী বললো, মর শালারা, মানুষ সখ করে একটু সিনেমা দেখবে আর তোরা কালোবাজারি করে ডাবল ট্রিপল দাম রাখবি? 


চিনচিন করে উঠে রানির বুক। জটলার ভেতর কে? ও কী তার সাহেব আলী? শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে দু'হাতে সে সরায় মানুষ। আতকে উঠে সে, এ যে তার সাহেবই। হুমড়ি খেয়ে পড়ে সে সাহেবের গায়। নিজের ছোট্ট দেহ দিয়ে ঢেকে রাখতে চায় সাহেবকে। চিৎকার করে উঠে রানি, আপনেগো পায়ে ধরি মাইরেন না, হেয় আমার স্বামী, হেয় ছাড়া দুনিয়াতে আমার কেউ নাই। 


নীতিবাগীশদের জেদ থামে নি। এক তরুণ খাবলি মেরে ধরে রানির চুলের মুঠি। গালি দিয়ে বলে, চুতমারানি, মাগীর আবার স্বামী? একটা মরলে দশটা পাবি বলেই সে রানির পাছায় বসিয়ে দেয় লাথি। কয়েক হাতে দূরে গিয়ে উপুড় হয়ে পড়ে রানি। সাথে সাথে তার পেটটা ফ্লোরে থেঁতলে যায়। মাগো বলেই জ্ঞান হারায় সে। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে তার কপালে। 


দৌড়ে আসে অনেক রানি। তারা রানির মাথাটা উঁচু করে ধরে। কেউ কেউ বিলাপ করে, হায় হায় গো মাইরা ফালাইছে মাইয়াডারে, জানোয়ারেরা মাইরা ফালাইছে মাইডারে। ওরা ধরাধরি করে রানিকে দূরে সরায়, পানি ছিটায় চোখেমুখে। রাস্তায় তখনো পড়ে আছে সাহেব আলী। অন্য ব্ল্যাকাররা ভয়ে জনতার সাথে মিশে গেছে। চারিদিকে চলছেই নীতিবাগীশদের রুদ্র ভড়ক, গেলো কই শালারা। কেউ শার্টের হাতা গুটায়, কেউ মাটিতে পদাঘাত করে, গালি ছোড়ে অবিরাম। কেবল কাজ ফেলে এগিয়ে আসে ক'জন হকার। তারা টেনে বসায় সাহেবকে, দাঁতে দাঁত খিঁচে বলে, ব্লেক গরিবা ত ডঅর জিনিস করো, তোয়ার গাড়ী অইবু, বাড়ি অইবু, তুঁই নেতা অইবা, দেশ তোয়ারে ছালাম গরিবু, গোডা দুনিয়াও ছালাম গরিবু, দুনিয়া অইয়েদে বড়ো বড়ো ব্ল্যাকার অরার লাই, আঁরার লাই ন। 


রানির জ্ঞান ফিরে। গোঙায় সে। দু-হাত দিয়ে তলপেট চেপে ধরে, চিৎকার করে বলে উঠে, আল্লারে.., মাগো..। ওর উঁচু পেট চেপে রাখা দেখে রানিরা বুঝতে পারে ওর পেটের শিশুটি নড়ে উঠেছে। ওরা রানিকে জনসমাগম থেকে সরিয়ে গলির ভিতরে নিয়ে যায়, আড়াল করে ফেলে পৃথিবীর চোখ থেকে। অন্ধকার গলিতে একটু পরেই মায়ের চিৎকার ছাপিয়ে সুতীব্র চিৎকার করে বেহেশত হতে নেমে আসে এক বিপ্লবী মানুষ। উদ্যত মুষ্টিবদ্ধ তার হাত, সে দুপায়ে উড়ন্ত লাথি মারছে অমানুষকে। 


নাড়িছেঁড়া ধন কোলে তুলে নেয় রানি। ঠোঁট কামড়ে চেয়ে থাকে সাহেব আলীর দিকে। ওর চোখে মুখে আগুনের ফুলকি। সে আগুনে পুড়ে যায় নিষ্ঠুর সভ্যতা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ