দর্পণ | সাপ্তাহিক নির্বাচিত কলম | কবিতা ও বিবিধ বিভাগ




পোস্ট বার দেখা হয়েছে


 


কবিতা 


কবিতাও গল্প বলে । উত্তম কুমার দাস



কোল্ডস্টোরেজে থেকে থেকে কবিতাগুলো বাসি হয়ে গেছে;

ভাব মরে গেছে ভাষার মাঝে

সৃষ্টি হয়েছে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাকটেরিয়া

কবিতার শরীরকে সংক্রমিত করেছে বারবার!

বিপ্লবের কবিতাগুলো আজ মমি হয়ে গেছে,

কোন কোন ক্ষেত্রে কবি সংরক্ষণ করেছে কবিতার শরীর।

এই কবিতাগুলো কিন্তু একটা সময়ে নজরুলকে কারারুদ্ধ করেছিল;

আবার মলয় চৌধুরী বন্দী হয়েছিল কবিতার প্রাচীরে!

বিশ্ব কবি কবিতায় থেকেও ত্যাগ করেছে কবিতার পোশাকি আবরণ।


আজও ঋষি, সায়ন্তিকা, কুমকুম চৌধুরীর কবিতাগুলো তেড়ে আসে সমাজের মাঝে!

তীক্ষ্ন দাঁত নিয়ে কামড় বসায় সমাজের গর্দানে।


আজ আর কেউ কবিতা পড়তে চায় না

শুধু দেখে শব্দের উপর সাজানো শব্দ


আজ আর কেউ মানুষ চায় না

প্রয়োজন শুধু আর্থিক বন্ধন খোঁজে


আজ যেন কারোর কবিতা পড়ার সময় নেই

কাব্য এখন কবির নেশার খোরাক!


কবিতার যেদিন দাঁত আর নখ হবে

সেদিন কলমের নিব হবে শলাকা

বাস্তবে নির্মম পরিণতি গুলো সেদিন ভাষা পাবে।


অনেক শব্দ আছে

অনেক বাক্য আছে

কিন্তু প্রতিবাদ কই!

রাস্তায় যখন চার চাকার দু চাকার ঘরে গিয়ে পড়ে,

ভিখেরীর সঙ্গে যখন আভিজাত্যের ধাক্কা লাগে;

তখন মুখ থুবড়ে পড়ে গরীবের সম্মান;


বর্ষার জলে যখন পাড়া পল্লী ভেসে যায়;

বহুতল ভবনের ছায়া যখন দরিদ্রতার সূর্যকে কেড়ে নেয়;

নিচু তলার আবর্জনাগুলো যখন নিচুতলার নিষ্কাশন ব্যবস্থা কে বিপর্যস্ত করে---তখন কিন্তু কেউ ভোট চাইতে আসে না।


সমাজের সকল উন্নয়ন শুধু নিজেকে ঘিরে

বেঁচে থাক উঁচুতলার মানুষগুলো

আমরা শুধু তাবেদারী করে যাই!


উন্নয়নের নামে চলুক পোশাকী পালাবদল

রিতিশা পালের গীতিকবিতা গুলো সর্বজনীন হোক

সাদ্দামের প্রলাপ গুলো

 ভবিষ্যতের জন্য সুরক্ষিত থাক!


এতোটুকুই তো স্বপ্ন।


কিন্তু বর্তমানের কি হবে স্যার


আজ তো ভবিষ্যতটাই অতীত হয়ে যাচ্ছে

প্রিয় দার্শনিক আপনি একটু ভাবুন!


আমি তো শুধু শুধু ভয় পাই

এখনো হাতটাই তো খুলতে পারলাম না!


দেখুন না- জানোয়ারগুলো কেমন 

                   ‌ ‌       দাঁত বের করে হাসছে।





তন্দুরের আগুন । কুমকুম চৌধুরী


মাঝরাতে তোমার সাড়া পেয়ে দরজা খুলি

চমকে যাই তোমায় দেখে 

কি করব কি করব না ভাবতে ভাবতেই 

তুমি বলে উঠলে পাগলী আমি তো!!

তোর আমি..

আমায় নিয়ে এত ব্যস্ততা কিসের!!

আমায় যেমন রাখবি..রাখিস

যা খেতে দিবি..দিস

শুধু রাত কপাটে আগল দিয়ে আগলে রাখিস।

বিষণ্ণ মুখ তোর,যেন কত রাত ঘুমসনি

কতদিন নাওয়া খাওয়া নেই..

আমার মন কুড়ানো শীতল জলে নাইতে দিলাম

চিরজন্মের দুঃখী আঁচল দিলাম মাথা মুছতে।

ঘর পোড়ানো রুটি সেঁকে দিলাম তোর হাতে

সাথে ছিল জীবন নিংড়ানো,ভাষা হারানো মাখন।

তারপর বাড়ির দাওয়ায় আমার শক্তপোক্ত হাড়গুলো দিয়ে আগুন জ্বেলে তন্দুর বানাতে বসলাম তোর জন্য..

বুকময় পোড়া দাগ বলে বললাম পাশের জায়গাতেই শুতে

তুই বললি বুকের পোড়া দাগগুলোতেই মাথা রাখবি..

কেমন সব নিশ্চুপ,মায়াময় হয়ে রইল চারিধার

সকালে দেখলাম আমার শুন্য ঘর,শুন্য বুক!

তবে কালকের রাত কি ছিল!

স্বপ্ন ছিল?

হ্যাঁ স্বপ্নই ছিল নিশ্চয়।

কিন্তু দাওয়াতে তখনও তন্দুরের আগুন ঢিমে লয়ে জ্বলছিল..


তন্দুরের আগুনে কিছু স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল!

তন্দুরের আগুনে কিছু মুহূর্ত জ্বলে কালো হয়ে গিয়েছিল!

তন্দুরের আগুনে মন পুড়ে মাংস হয়ে গিয়েছিল!

বুঝতে পারিনি..


আমার অদৃষ্ট!




ঈশ্বর ও আমি । অজয় কুমার দত্ত

                    


যখন আমি প্রার্থনা করি~হে ঈশ্বর দাও শক্তি

তিনি আমাকে প্রদান করেন কঠিন পরিস্থিতি।


তার কাছে চাই যদি আমি বুদ্ধি এবং জ্ঞান

ঈশ্বর এক ধাঁধা দিয়ে কন~করো দেখি সমাধান।


যখন বলি~দাও আমারে শান্তি এবং সুখ

তিনি আমায় দেখিয়ে দেন অসুখী কিছু মুখ।


যখন আমি প্রার্থনা করি পরিমেয় ধনসম্পত্তি

ঈশ্বর বলেন কঠোর শ্রমই দিতে পারে স্বস্তি।


যদি বলি~দেখাও আমারে সফল হবার পথ

তিনি বলেন~চালাও কঠোর পরিশ্রমের রথ।


সব ভুলে আমি প্রার্থনা করি শুধু শান্তির জন্য

তিনি বলেন~সহায়তা করো যারা দীন নগণ্য।


আশাহত হয়ে বললাম~হে প্রভু জগদীশ্বর

আমার সকল মনোবাসনা করেছি তোমার গোচর


কিন্তু কোন প্রার্থনাই তুমি তুললে নাকো কানে।

ঈশ্বর বলেন~দিয়েছি সকলই যা লাগবে প্রয়োজনে


সেইমতো চলে জীবন তোমার করো তুমি ধন্য

তাহলে দেখবে বাসনা কোনই থাকবে না অপূর্ণ।




পুরোনো শহর | নীল অঞ্জন


আমার ঠিকানা পাল্টেছে বহুদিন

তুমিও তো নেই পুরোনো ঠিকানায়!

পুরোনো সে শহরে তুমি নেই জেনে 

আমিও থাকিনি সেখানে

তবুও কাজে কাজে কখনো এলে

বাতাসে তোমার ঘ্রাণ নাকে এসে লাগে

সমুদ্র জল, পাহাড় ডিঙিয়ে 

খোলা চিঠি নিয়ে উড়ে আসে মেঘ

তবুও সে চিঠি খুলেও দেখিনা আর 

পড়ে থাকে বন্ধ খামে ডাক বাক্সের ভিতর

জানি, দুজনের বুকেই কথার নদী

দলছুট মেঘ আর অরণ্যের হাতছানি

শুধু মাঝখানে বাঁধ হয়ে দুজনার

ফেলে আসা পুরোনো শহর!

চাইলেই ফেরা যায় এখানে আবার 

কিন্তু ফিরেও যাবনা আর

ফিরেও কী লাভ? তুমিও তো নেই!

এ শহর দিয়েছে যতটা আমাকে

নিয়েছে তার থেকে আরও বেশি

তার চেয়ে এখন যেখানে আছি

সেখানেই থেকে যাব আজীবন

লতাগুল্ম আর বনস্পতির সাথে মিশে

এখানে আমিও অরণ্য হবো 

সময়ে অরণ্যের গভীরে হারিয়ে যায় যদি

তবে যাক, কোন এক পুরোনো শহর!



বাংলা ভাষা বাংলা। অসীম দাস 


বাংলা আমার প্রাণের আরাম আদুরে দখিনা হাওয়া ,

বাংলা আলাপে ছিপ তিন দাঁড়ে ময়ূরপঙ্খী বাওয়া ।


বাংলা ভাষায় দোল খেয়ে যায় বসন্ত দুই বেলা ,

বাংলায় কথা বললে বিষাদ হেঁটে চলে যায় মেলা ।


বাংলা হরফে লেখা হলে জ্বর আপৎকালীন ঘামে ,

বাংলা চিঠিতে শিশিরে মুক্তো মায়া মেঘেদের খামে 


বাংলা ধ্বনিতে কোজাগরী চাঁদ কৃষ্ণপক্ষে ফোটে ,

বাংলার ঢেউ- এ রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহের বোটে ।


বাংলা ভাষায় ব্যারিকেড ভাঙ্গা জনতার নজরুল 

বাংলায় কথা বললে পরাগে যেচে ফুটে যায় ফুল ।


ভাষা - সহবাসে সীমান্ত-হরা দুই দেশে এক কবি 

বাংলা-বর্ণে জীবনানন্দ আঁকেন কবিতা-ছবি ! 


বুলেটে বিদ্ধ ইতিহাস জেগে ঢাকা আর শিলচরে,

মাতৃদুগ্ধে স্বরচিত স্বাদ ফিরে এসো প্রতি  ঘরে।





নিবন্ধ


মাতৃভাষা দিবস । অয়ন দাস



আজ থেকে ৮০০০বছর আগে নতুন প্রস্তর যুগের মানুষ প্রথম কথা বলতে পেরেছিল।তার আগে মানুষ শুধু শব্দ করে আর ইশারা তে মনের ভাব প্রকাশ করত।কথা বলতে পারার পরও তারা ইশারার ব্যবহার ত্যাগ করেনি।এখনও পৃথিবীর সব দেশের সব ভাষার মানুষের ইশারার ভঙ্গি ও অর্থ এক।এই ভাষা আবিস্কারের ফলেই কিন্তু মানুষ পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল।


এই মুহূর্তে পৃথিবীতে ২৭৯৬ টি ভাষা প্রচলিত।তার মধ্যে প্রধান ভাষা ১৬০টি।আর ভারতে ১৬৫২টি ভাষার মধ্যে প্রধান ভাষা হল ২২টি।যথা-হিন্দি,বাংলা,তেলেগু,তামিল,মারাঠি,গুজরাটি,মালয়ালম,কন্নড়,ওড়িয়া,পাঞ্জাবি,অসমিয়া,সিন্ধি,নেপালি,কোঙ্কনি,মণিপুরি,কাশ্মীরি,সংস্কৃত,বোরো,ডোগরি,মৈথিলি ও সাঁওতালি।

মজা হল-অঞ্চলভেদে আমাদের বাংলা ভাষার কথ্য রূপও পাল্টে যায়।মজা দেখুন-


কলকাতা-ছোটো ছেলেটি তার বাবাকে বলল


ঢাকা-ছোটো ছাওয়াল তার বাপেরে কইলো


কোচবিহার-ছোটো বেটা উয়ার বাপোক কইলো


পুরুলিয়া-ছুট্ বেটা তার বাপকে বল্লেক


চট্টগ্রাম-ছোড়ুয়া পোয়া তার ব-রে কইলো।

-----------------------------------

এই যে আমরা গল্প লেখার জন্য একেবারে মুখের ভাষা ব্যবহার করি-এর সূচনা হয় ১৮৫০সালের পর থেকে।কারণ লেখকরা কিছুতেই অশিক্ষিত বা কম শিক্ষিত মানুষের কাছে পৌঁছতে পারছিলেননা।এইবার মুশকিল   হল একএক জায়গার তো একএক কথ্যরূপ।তাহলে কোনটা নেওয়া হবে?এইসময় বেশ একটা পলিটিক্স হয়েছিল।কলকাতা,নদীয়া,২৪পরগনাতে যেহেতু পন্ডিত দের সংখ্যা বেশি-অতএব এখানকার কথ্য ভাষাই সাহিত্যের ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেল।এইবার ভাষা হয়ে উঠল জীবন্ত।লেখকরা সাধারণ মানুষের মনে জায়গা পেলেন।

একটা কথা জানলে অবাক হই যে বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে আজ থেকে ১০০০ বছর আগে অথচ বাংলা ব্যকরণ প্রথম রচিত হয় মাত্র পৌনে তিনশো বছর আগে।শুনলে অবাক হবেন প্রথম বাংলা ব্যকরণ লেখেন একজন সাদা চামড়ার সাহেব।নাম-মানোয়েল দ্য আস্সুম্পসাম।১৭৪৩সালে পোর্তুগালের লিসবন শহরে রোমান অক্ষরে তা ছাপা হয় কারন 'ছাপার' জন্য বাংলা অক্ষর তখনও তৈরি হয়নি।১৭৭৮সালে নাথানিয়েল হ্যালহেড নামের এক ইংরেজ ইংরেজি ভাষায় একটি বাংলা ব্যকরণ বই লেখেন যেখানে প্রথম ছাপার সময় বাংলা অক্ষর ব্যবহৃত হয়।

রাজা রামমোহন রায় হলেন প্রথম বাঙালি যিনি বাংলা ব্যকরণ বই লেখেন ১৮২৬ সালে।দুঃখের বিষয় এই বইটিও ইংরিজিতে লেখা।১৮৩৩সালে এই বইয়ের বাংলা অনুবাদ বাজারে প্রকাশিত হয় ও অচিরেই তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।(তথ্য সংগ্রহ-রণেন গুপ্ত-নবোদয় ব্যকরণ)।


ভাষার মূলত ছটি কাজ।


১) সৌজন্য সম্ভাষণ (phatic function) 

২)জ্ঞাপন ( communicative function) 

৩)প্ররোচনা মূলক (conative function) 

৪)আবেগ প্রকাশ করা( emotive function) 

৫)ভাষাকে সুন্দর করে প্রকাশ করা( aesthetic function) 

৬)ভাষা দিয়ে ভাষার কথা বোঝানো(metalinguistic function) 

(কৃতজ্ঞতা স্বীকার ঃ পবিত্র সরকার) 


বাংলা ভাষাকে প্রথম সংস্কৃত'র কাঠিন্য থেকে মুক্ত করেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। আমি মনে করি বিদ্যাসাগর না জন্মালে আধুনিক বাংলা ভাষার জন্ম হত না।সেই ভাষাকে আরো মনোগ্রাহী করে মানুষের কাছে পৌঁছে দেন রবীন্দ্রনাথ। এও আরেক যুগসন্ধিক্ষণ।রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছোটগল্প ও কবিতার মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছে গেলেন। রবীন্দ্রনাথের ভাষাকে আরো আরো সহজ করে আপামর খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। 

পরবর্তী কালে ভাষা নিয়ে নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়েছে।একজন লেখক হিসেবে অগ্রজ সাহিত্যিকদের লেখা পড়েছি ছাত্রের মত।

যেটা উপলব্ধি করেছি তা হল বিষয়ের গুরুত্বের নিরিখে ভাষার ব্যবহার পালটে যায়।যে ভাষায় প্রবন্ধ লেখা হয়, সে ভাষায় কবিতা  লেখা যায়না।ভ্রমণ কাহিনির ভাষা আবার সম্পূর্ণ অন্যরকম হওয়া উচিৎ। ঐতিহাসিক কাহিনির ভাষার সঙ্গে আজকের প্রেক্ষাপটের কোনো ভাষা একরকম হতে পারেনা।একজন লেখককে লেখবার সময় এই বিষয়গুলো মনে রাখতে হবে।

আমাদের বাংলা ভাষার মধ্যে আরবি,ফার্সি,পর্তুগিজ ও ইংরেজি ভাষার বহুল প্রয়োগ রয়েছে। আমূল বদলে গেছে সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের ভাষা।

আজকের সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের মধ্যে যাকে 'খিস্তি' বলা হয় তারও প্রয়োগ হচ্ছে।সবটাই বিষয়ের গুরুত্বের খাতিরে। 

সত্যজিৎ রায় তাঁর 'জন অরণ্য' ছবিতে একটি  ডায়লগ ব্যবহার করেছিলেন। নায়ক সোমনাথকে তার বন্ধুর বাবা বলছেন,

 ' আর বোলোনা বাবা,আজ একমাস ধরে রাস্তা খুঁড়ে রেখেছে বাঞ্চোতরা'।নাগরিক হতাশা, সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ পৌঁছে গেছে এক চরম পর্যায়ে। এইটা বোঝানোর জন্য এই ভাষার ব্যবহার। এতে আমার মতে কোনো অশ্লীলতা নেই। 

 নিজের ভাষাকে মাতৃভাষা বলে কে যে সম্বোধন করেছিল কে জানে,তবে এর চেয়ে মোক্ষম শব্দ আর নেই।মায়ের মতই প্রিয় হয় ভাষাও।আমার বড় গর্ব হয় আমি বাংলায় লিখি বলে।

 অথচ আমাদের ছেলেমেয়েগুলোকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াই বলে ওরা বাংলা ভাষাকে অপছন্দ করে,বাংলা পড়তে গেলে জ্বর আসে।ইংরিজি ওদের ভালবাসার ভাষা।ওরা ঠিক কতখানি বাংলা সাহিত্য পড়বে ও বুঝবে!আমাদের পরের প্রজন্ম বাংলা সাহিত্য সেভাবে পড়বেইনা।তারা বাঙালি লেখক বলতে বুঝবে অমিতাভ ঘোষকে।বাংলা সাহিত্যের এই বিপুল রত্নভান্ডার হয়তো ধুলি ধুসরিত হয়ে পড়ে থাকবে।এই অভিশাপের থেকে বোধহয় আমাদের পরিত্রান নেই।অত্যন্ত আতঙ্কিত হয়ে আমি দেখতে পাচ্ছি আজ থেকে পঞ্চাশ ষাট বছর পরে বাংলাভাষা শুধুই বেঁচে থাকবে বাংলাদেশে আর পশ্চিমবঙ্গে তৈরি হবে ইংরেজী ও বাংলা মেশানো এক জগাখিচুড়ি ভাষা।সেইসময় এক কিশোরী তার দাদুকে হোয়াটসঅ্যাপ করবে-"কখন থেকে ওয়েটিং ফর ইউ বাট তুমি আমাকে এখনও রেপ করলে না!

 দাদু হয়তো ভিরমি খেয়ে পড়তে পড়তে অবশেষে বুঝতে পারবে-রিপ্লাই এর ছোট সংস্করন হল রেপ।

 আজকের অধিকাংশ মা এর ঠাঁই যেমন বৃদ্ধাশ্রমে তেমনি মাতৃভাষাটাও বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই পাবেনাতো?অন্তত তার আগে যেন আমার মৃত্যু হয়।





আমাদের বাংলা ভাষা । সোমা ঘোষ



                     মায়ের কোল শিশুর কাছে পরম মমতার জায়গা তেমনি মাতৃভাষা আমাদের মায়ের কোলের মতো। আমরা আমাদের মায়ের কোল আদরে যত্নে আগলে রাখবো।

আজ ২১-শে ফেব্রুয়ারি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এই দিনটি প্রতিটি বাঙালির মনে জাগিয়ে তোলে এক আলাদা আবেগ।সে আবেগ আমাদের মাতৃভাষার জন্য।সে আবেগ বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য।


নিজেদের মুখের ভাষাকে অন্যের হাতে তুলে দেবো না এই শপথ নিয়ে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার প্রকাশ্য রাজপথে উঠেছিল জনজোয়ার। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে গুলিবিদ্ধ হয়ে কয়েকজন যুবককে প্রাণ দিতে হয়েছিল।সেই থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি হয়ে উঠছে  বাংলা তথা সমগ্ৰ বিশ্বের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।এই দিনটি অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন।আপন ভাষাকে মহিমান্বিত করে তোলার দিন।  


১৯৬১ সালের ১৯-শে মে শিলচরের প্রকাশ্য রাজপথে আরও একটা হত্যকাণ্ড ঘটেছিল।শুধু মাত্র মাতৃভাষা অধিকারের দাবিতে কয়েক জন যুবক যুবতীকে গুলিবিদ্ধ হতে হয়েছিল।শিলচরের প্রকাশ্য রাজপথে তাঁদের মর্মর মূর্তি থাকলেও মাতৃভাষার জন্য তাঁদের আত্মবলিদানের কথা আমরা ভুলতে বসেছি। 

আমাদের মনে রাখতে হবে হাজার হাজার মানুষ একত্রিত হয়েছিল এক অহিংস  সত্যাগ্রহের জন্য।  কিছু মানুষ দৃপ্তস্বরে বলতে পেরেছিলেন ভাষার অধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার।


যদি প্রতিটা দিন  আমরা আমাদের  মধুর ভাষাকে যত্ন ক'রে আগলে রাখতে পারি তবেই শহিদদের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করা হবে।

আমরা যেন এই ভাষার মাধুর্য দিয়ে  নিজেদের  ভরিয়ে রাখতে পারি। যে ভাষায় আমরা আমাদের প্রতিটা ক্ষণকে উপলব্ধি করতে পারি, সে তো আমাদের অন্তরের ভাষা। আর যিনি আমাদের সুখদুঃখ ভালোবাসা ভালোলাগাকে অন্তর দিয়ে  উপলব্ধি ক'রে ভাষা দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছেন- 

তিনি আমাদের প্রাণের ঠাকুর। আমাদের রবীন্দ্রনাথ ।


সমস্ত দেশের সব মানুষের নিজ-নিজ  মাতৃভাষার প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা জানিয়েই বলি আমার ভাষার মতো এতো মধু আর কোনো ভাষাতে নেই।

আমরা ভাষার প্রতি যত্নবান হই। শুধু গান কবিতা দিয়ে ভাষাকে সুন্দর করা সম্ভব নয়।

যদি চারপাশের মানুষজনকে  সুন্দর ভাষার মাধুর্যে ভরিয়ে দিতে পারলেই হবে  মাতৃভাষার প্রতি যথার্থ সম্মান জানানো।

আমরা শপথ করি এই মূল্যবান সম্পদ আগলে রাখবো। সুন্দর ভাষাকে বিকৃত হতে দেবনা।

বিদ্যাসাগর মশায়ের বর্ণপযিচয় হারিয়ে যেতে দেবনা।


জীবনে চলার পথে  সবাই মিলে ভাষাকে সন্তানের মতো যত্নে আগলে রাখি। তা না-হলে আমরা কী দেব আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে?  কী-ই বা আছে আমাদের যা রেখে যাবো।


আজ শুধু মাতৃভাষা দিবস পালন না ক'রে আসুন আমরা শুরু করি মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার বীজ সন্তানের মনে বুনে দিতে।


মাতৃভাষাকে আপন করে পাওয়ার জন্য যারা নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করে গেছেন তাদের সকলের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা ও প্রনাম।




ছোটগল্প 


।। স্থলপদ্ম ।। শান্তনু ঘোষ ।।


মাছের ঝোল থেকে আলুটা তুলে নিয়ে ভাতের সাথে মাখতে মাখতে আরিফ বলল, "আমাদের আধার কার্ড, প্যান কার্ড, রেশন কার্ড যা আছে সব খুঁজে বের করে রেখো, কখন কি দরকার পড়বে বলা যায় না।" 

রুখসানা নিজের থালাতে ভাত বাড়ছিল। আজ সন্ধ্যে থেকে ঝড় উঠেছে। আকাশ কালো করে এসেছে অসময়ের ঝড়। সেই ঝড় মাথায় নিয়ে আরিফ স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেছে। মেজাজটা আজ একটু তিরিক্ষে।  


"ও সব গুছিয়ে রাখাই আছে।" আরিফের দিকে না তাকিয়েই কথা গুলো বলল রুখসানা। 


"আচ্ছা, তোমার আব্বু-আম্মির কোন নথিপত্র নেই?" 


রুখসানার এইসব আলোচনা ভালো লাগছিলো না। আজ সাত বছর হল নিকা হয়েছে ওদের, আরিফ কে এতো চিন্তিত আর বিধ্বস্ত আগে কখনো দেখেনি সে।  


"তা জানিনা, তবে একদিন আম্মির একটা মার্কসশিট দেখেছিলাম স্কুল ফাইনালের। জানো, আম্মি অঙ্কে খুব ভালো নম্বর পেয়েছিল।" 


"মার্কসশিট দিয়ে কি হবে? এখানে তো সব অঙ্কের হিসাবই গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।" 


বাইরে ঝড়ের দাপটটা বেড়েছে।  ঘন ঘন মেঘ গর্জে উঠছে। সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছের একটা ডাল ঝড়ের প্রকোপে ভেঙে পড়ল। যখন থেকে খবরটা ছড়িয়েছে, সকলের চাউনি কেমন যেন বদলে গেছে। স্কুলের পিওনটা পর্যন্ত এখন আর ভালো করে কথা বলে না। ভাবে আমি যেন দু নম্বরি লোক। বিনা অনুমতিতে কারো বাড়িতে ঢুকে পড়েছি। অথচ এই দেশেতেই তো জন্ম আমাদের, আমার-রুখসানার! 


হঠাৎ গুরুত্বপূর্ণ কিছু যেন মনে পড়ে গেল আরিফের, "আচ্ছা, তোমার Birth Certificate টা  আছে?"  


"আছে।" 


"আর তোমার আব্বু-আম্মির?" 


"তা আমি জানি না।" বিরক্তি এলো রুখসানার, "আর যদি নাইবা থাকে, তাতে কি প্রমাণ হয়? দুটো কাগজ দিয়ে প্রমাণ করতে হবে নিজের জন্মভূমি কে ভালোবাসি কি না! এই দেশেই আমার জন্ম, এই দেশ আমারও।" 


পাঁচ বছরের মেয়ে আয়েশার খাওয়া হয়ে গেছে আগে। ও এতক্ষণ ছবি আঁকছিল একমনে। ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করল, "আমি কোথায় জন্মেছি আম্মি?"  


এখন ঝড় থেমে গেছে। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির আদর পেয়ে মাটি থেকে ভেসে আসছে সোহাগী গন্ধ। বাইরের বারান্দায় একটা চেয়ার টেনে বসল আরিফ।    


রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র ছিল আরিফ। মাথার মধ্যে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়া সমস্ত শিক্ষা এখন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। ধর্ম এবং রাষ্ট্র দুটো পৃথক নয় কেন! পৃথক হলেও সবসময় আমরা কেন গুলিয়ে ফেলি! ধর্ম যেখানে একটা বিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ, সেখানে রাষ্ট্র সম্প্রীতি আর সংহতির এক উজ্জ্বল প্রতীক। একটি বিশেষ ধর্মের প্রতি রাষ্ট্রের পক্ষপাতের সম্পর্ক কেন থাকবে? থাকাটা বাঞ্ছনীয় নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা যে রাষ্ট্রের নীতি নয়, সেটি কখনই আদর্শ রাষ্ট্র হতে পারে না।   


আঁকার খাতাটা নিয়ে এসে আরিফের চোখের সামনে মেলে ধরে আয়েশা, "আব্বু দেখো কেমন এঁকেছি ।" 


মেয়েকে কোলে তুলে নেয় আরিফ। আঁকার খাতায় একটা বড় ফুল গাছের ছবি, তার প্রতিটি শাখায় রংবেরঙের ফুল। কোনটা গোলাপি, তো কোনটা নীল, একটা হলুদ তো আরেকটা বর্ণহীন-সাদা। 


মেয়েকে আদর করে বলে, "এটা কি এঁকেছ? একটা গাছে এইরকম নানান রঙের ফুল কি কখনো হয়?" 


আয়েশা আধো আধো করে বলে, " হ্যাঁ, হয় তো আব্বু। আমি দেখেছি।" 


একরাশ বিস্ময় আরিফের চোখে, "কোথায় দেখেছ তুমি?" 


সরল উত্তর দেয় আয়েশা, "মনুদের বাড়িতে।" 


অবাক দৃষ্টি নিয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে আরিফ। বাইরে বৃষ্টি এখন থেমে গেছে। থোকা থোকা মেঘগুলো মাথার উপর থেকে দুরে ভেসে যাচ্ছে। অন্ধকার ক্রমশঃ ফিকে হয়ে আসছে। ভাঙ্গা কৃষ্ণচূড়ার ফাঁকে ফুটফুটে জ্যোৎস্না উঠেছে এবার।    





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ