চক্ষুর বিয়ে ~ তসলিম পাটোয়ারী




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

চক্ষুর বিয়ে

তসলিম পাটোয়ারী


বাবুরহাট। চাঁদপুর মহকুমায় পূর্ববঙ্গের এক সোনালী জনপদ। ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা সংস্কৃতি সাহিত্য খেলাধূলা চিকিৎসা সর্বদিক দিয়ে উজ্জ্বল প্রোজ্জ্বল। তার কোলে দোলে নয়নাভিরাম গ্রাম সিলন্দিয়া। 

এক সময় বাবুরহাট ও চাঁদপুর ছিলো বঙ্গোপসাগরের বেলাভূমি। কালে কালে কলো কলকল মন্দ্রে বেলাভূমে রন্ধ্রে রন্ধ্রে আছড়ে পড়েছে সাগরের উর্মিমালা। বালি ও পলি জমে জেগে উঠেছে চর ঘর চাঁদপুর শহর। নানান দিক থেকে এসেছে লোক লশকর, বেঁধেছে সুখের ঘর। এসেছে অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ থেকে; বর্গীর ভয়ে, দুর্ভিক্ষের ভয়ে, মোগল পাঠান যুদ্ধের ভয়ে। এসেছে দু'মুঠো অন্নের আশায়, একটু শান্তির আশায় শস্য শ্যামল ছায়া সুনিবিড় সিলন্দিয়ায়। তারা শুনিয়েছে শঙ্খ মঙ্গলধ্বনি, সুমধুর আজান বাণী। হিন্দু মুসলিম এখানে ভাই ভাই। 

বাবুরহাট অঞ্চলে কোনো কোনো হিন্দুবাড়িতে মাঘের শুরুতে কৃষ্ণপক্ষের তৃতীয়া তিথিতে হতো সঙ্কটপীরের পূজা। পুরোহিত মুসলমান। হিন্দু শুদ্ধাচারিণী ব্রতচারিণী যোগিনী ভগিনীরা পূর্বদিন সংযম করে পূজার দিন ছয়দন্ড রাত্রির পর একটা খোলা জায়গায় বরণডালা, ধূপদীপ, ধান চাল এবং খেজুরের গুড়, ঘি ও অন্যান্য উপকরণ দিয়ে তৈরি করা ঈষৎ পীতাভশুভ্র 'বোকরা-বোকরী' নামক নৈবেদ্য নিয়ে একত্রিত হতেন। মোল্লা পূজার স্থান থেকে দশ বারো হাত দূরে থেকে নামাজ পড়তেন, নামাজান্তে মুমুক্ষুদের জন্য দোয়া চাইতেন, দোয়া শেষে চলে যেতেন। 

বড়ো সুখের দিন ছিল সিলন্দিয়াবাসীর। ভারতের ভারপ্রাপ্ত গভর্নর জেনারেল চার্লস মেটকাফ বলেছেন, ভারতীয় গ্রামগুলি ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ; জীবন ধারনের জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার সবকিছুই গ্রামবাসী নিজেরা উৎপন্ন করতো। সিলন্দিয়ায়ও নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র প্রত্যেক গৃহস্থ বাড়িতে উৎপন্ন হতো। গৃহস্থের ছিল গোলাভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ, গোয়াল ভরা গরু। কিন্তু দিনে দিনে এখানে একটি সামন্ত শ্রেণি বিকশিত হয়। প্রতিষ্ঠা লাভ করে কয়েক ঘর বড়ো বড়ো তালুকদার। সেই সাথে একটি শ্রেণির গোলায় পড়ে টান। তারা আর্থ সামাজিক স্তরায়নের তলদেশে পড়ে যায়। কৈলাশ দপ্তরী তাদের একজন। কৈলাশ পর্বত যেমন ধরা ছোঁয়ার বাইরে উঁচুতে, কৈলাশও তেমনি ধরা ছোঁয়ার বাইরে বর্ণাশ্রমের নিচুতে। তিনি বাবুরহাট হাইস্কুলের দপ্তরী। ঘরে তার স্ত্রী, কন্যা চক্ষু, পুত্র নিমাই। 

চক্ষু বারো বছরের মেয়ে। শ্যামলা বরণ। সিলন্দিয়া মাইনর বালিকা বিদ্যালয়ে পড়ছিল। কিন্তু স্কুলটি ক'বছর চলার পর বন্ধ হয়ে যায়। শিক্ষা বিতরণ করে সক্রেটিস অর্থ নিতেন না, উপমহাদেশেও পন্ডিতগণ টোল খুলে পাঠদান করতেন গুরুদক্ষিণা নিতেন না। কালে কালে প্রচলন হলো গুরুদক্ষিণার। হালে গুরুদক্ষিণাই গুরুর জীবিকা। গুরুর বেতন ও স্কুলের বিবিধ ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে সিলন্দিয়া স্কুলের উদ্যাক্তাগণ কেঁদে ফেললেন। হাত পেতেও স্কুলটিকে বাঁচাতে পারলেন না তারা। তখনো পার্শ্ববর্তী দাসদি গ্রামে এবং আশিকাটি গ্রামে দু'টি মাইনর বালিকা বিদ্যালয় চলছিলো। কিন্তু সিলন্দিয়া থেকে ঐ দু'টি গ্রামে যাওয়া আসা করে পড়াশোনা করা ছোট ছোট বালিকাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়লো। সিলন্দিয়া গ্রামের অনেক মেয়ে তাই পড়াশোনা থেকে সরে গেলো বা ঝরে গেলো। চক্ষুও ঝরে গেলো। 

চক্ষু এখন সাথীদের সাথে হৈ হুল্লোড় করে, ঘুরে বেড়ায়। 'বাবুরহাট হিতকরীসভা' নামে একটি সংঘ গড়ে উঠে বাবুরহাটে। জনহিতকর কাজ করেন সংঘ। তারা বাবুরহাটে কৃষি ও শিল্প প্রদর্শনী বসান। উদ্বোধন করেন চাঁদপুরগান্ধী প্রবীণ জননায়ক হরদয়াল নাগ মহাশয়। দলে দলে লোক প্রদর্শনী দেখতে যায়, মহিলারা যায়, চক্ষুরাও যায়। দর্শনার্থীরা স্বাস্থ্য বিভাগ, কৃষি বিভাগ, কুটিরশিল্প বিভাগ, শিশু মঙ্গল বিভাগ, ছাতা প্রস্তুত বিভাগ, চিত্রকলা বিভাগ, সূচিশিল্প বিভাগ ঘুরে ঘুরে দেখে। হিতকরীসভা প্রদর্শনীতে রাতে নাটক মঞ্চস্থ করে। চক্ষুরা তাও দেখে। 

মঠখোলা নামক স্থানে বসে চৈত্র সংক্রান্তির মেলা। এটি শিববাড়ির মেলা বা 'গলাইয়া' বাজার নামে খ্যাত। পুরনো মেলা। লোকে বলে কোম্পানি আমল থেকেই এই মেলা। চারিদিকে বিস্তীর্ণ মাঠ, মাঝখানে একটু উঁচু স্থানে অশ্বত্থ গাছ। গাছতলায় হয় শিবপূজা আর মাঠে হয় মেলা। হিন্দু মুসলমানে গমগম মেলা। ডালা, কুলা, কাসা পিতল কাঠের জিনিসপত্র, মাটির হাঁড়ি, এনামেলের ঘটিবাটি, মাটির পুতুল, কাঠের পুতুল, দেবদেবীর ছোট ছোট মূর্তি আর নানান সম্ভারে ঠাসা মেলা। চৈত্রের কাঠফাটা রোদ নরম হয়ে যায় নানান ফল ও ফুলের গন্ধ মেশানো ঠান্ডা শরবৎ ও কচি ডাবের কাছে। তরমুজ, বাঙ্গি, ফুটি, রসগোল্লা, চিনির রসের জিলাপি, গুড়ের রসের জিলাপি, হালকা সাদা বিন্নির খৈ; কী নেই মেলায়। এক সের জিলাপি তিন আনা থেকে চৌদ্দ পয়সা। তিন সের রসগোল্লা এক টাকা। নয় কেন? এক সের চিনি যে চার আনা, এক সের গুড় দুই আনা, এক মণ ধান দুই টাকা, এক মণ উৎকৃষ্ট চাল তিন টাকা। 

মেলার অদূরে সুপারিবাগানের ভিতরে শহর থেকে আসা এক শ্রেণির ধুরন্ধর লোক জুয়ার আড্ডা বসায়। কুটির শিল্পের ফাঁকে ফাঁকে বসে নানান অপকৌশলের লটারিতে পণ্যের পসার। কিন্তু ছোট ছোট চক্ষুরা যায় নাগরদোলায় চড়তে, মুড়ি মুড়কি, জিলাপি, বাঁশের বাঁশী, তালপাতার বাঁশী, টিনের বাঁশী, সুগন্ধি তেল সাবান, আলতা নুপুর চুড়ি ফিতা কিনতে। 

চক্ষু ছোট ভাইয়ের জন্য আনে হরেক রকম বাঁশী, জিলাপি, গজা, খৈ, কদমা, চিনির খেলনা, তিলাই ইত্যাদি। মায়ের জন্য আনে এক কৌটা সিঁদুর আর মাটির সরায় অঙ্কিত লক্ষীদেবীর পটচিত্র। নিমাই হেসে খুন, কিন্তু মা আগুন। মা দাঁত কড়মড় করে বলেন, বেলাজা মাইয়্যা, হাঙ্গেদিন মেলাত কী? চক্ষুর বাবা বলেন, এতো বকিছ না তো, ছোড একটা মাইয়া, দলেবলে গেছে আরকি। চক্ষুর মা বলেন, চউখ খাইছেন আন্নে, কেউ কইবো মাইয়্যা বারো বছইরা? কইবো পোনরো ষোল বছইরা। বুঝেন না কা, গরীবেরই যতো দোষ, হোলা টোলা খোঁজেন। কৈলাশ স্ত্রীকে ধমকান, তোর মাথা খারাপ, এইটুক মাইয়্যার কী বিয়া! 

চক্ষুর মা বার বার বলেন, চক্ষুর বাবাও বার বার খেপেন। সেদিন খেপে বলেন, দুনিয়ার খবর জানস তুই? স্যারেরা কয় দুর্ভিক্ষ আইতে আছে, বিশ্বযুদ্ধ লাগদে আছে, অহন হোলা হাইবি কই, মুখ দিয়া বাইর করবি, আইবো দাবী, চাইবো পণ, কইতন দিবি তহন, যে মাইনা হাই, কোন মতে দুগা ডাইল ভাত খাই। 

তবুও চক্ষুর বিয়ে হয়ে গেলো। অল্প দূরে জামাই বাড়ি। জামাই গৃহস্থের ছেলে; সুঠাম সুদর্শন। তাদের সংবৎসরের খোরাক প্রায় হয়ে যায়। এর বেশি আর কী। চক্ষুর মা খুশি, কণে বিদায়ের ক্ষণে বলেন, কান্দিস না মা, তোর রাজকোপাল, হৌর হড়ি জামাই বাবা আর ছোড একটা দেওরের ঘর, মা লক্ষীর বরে তোর ঘরও অইবো লক্ষীঘর, মা লক্ষী আর সিন্দূরের কৌটাডা দিলাম, যত্ন কইরা রাহিছ, সইন্ধ্যায় গায়ত্রী মন্ত্রখান জপিছ। 

চক্ষু কয়েক দিন কেঁদেছিল খুব। কিন্তু সে বুঝলো মেয়েদের এটাই কপাল, মেয়েরা পৈতৃক ভিটাকে বলবে বাপের বাড়ি আর ছেলেরা পৈতৃক ভিটাকে বলবে নিজের বাড়ি। চক্ষু সংসারে হাত লাগায়। টালির চৌচালা আর ঝুরঝুরে মুলির বেড়ার ঘর। দরজার উত্তরে চক্ষুর নিজের কক্ষ। কড়িকাঠ থেকে ঝুলানো কাঁড়ে সে গুছিয়ে রাখে লেপ তোষক কাঁথা বালিশ। কাঁড়ের ডানে বেড়ায় গেঁথে রাখে লক্ষীদেবীর পটচিত্রখানি, বরাবর নিচে ছোট্ট একখানি টেবিলে রাখে আয়না চিরুনি তেল সাবান স্নো পাউডার, সিঁদুরের কৌটাখানি। শশুরের বাস্তুভূমি আছে একটু। গৃহস্থ বাড়িতে বাস্তুভূমির দেবীই মহতী দেবী। চক্ষু শাশুড়ির সাথে বাড়ির সন্মুখে কাফিলা গাছের তলায় বাস্তুপূজা করে। দুধ ও আতপ চালের প্রসাদ তৈরি করে রাখে সেখানে, পূজা শেষে পাড়ার প্রসাদাকাঙ্খী বালকরা নিয়ে যাবে। চক্ষুর মা শুনে হাসেন, তার চক্ষু পাকা গৃহিণী হয়েছে বলে। তিনি ভগবানের কাছে অবনত হন চক্ষুর সুখে। 

চক্ষু স্বামীর সোহাগে ভাসে। প্রত্যুষে টুপ করে ডুব দিয়ে রাতের সোহাগ ধুয়েমুছে কাজে ছুটে। কুকুর বেড়ালকে সে যেমন ভাত দেয় কাটা দেয় তেমনি ভাত চাল খুদ ছিটিয়ে দেয় কাক শালিক চড়ুইকেও। আনন্দে গদগদ পাখিগুলি এসে বসে উঠানে এবং চক্ষুর জানালার কপাটে। তারা কা কা কিচিরমিচির করে চক্ষুকে ভালোবাসা জানায়। কিন্তু একদিন হুলোটা হঠাৎ তার কাঁড়ের আস্তানা থেকে দেবীর পটচিত্রে পা ফেলে দরজায় ঝাপিয়ে পড়ে পাখিদের উপর। তার পদভারে পটচিত্রখানি টেবিলে আছড়ে পড়ে গুড়িয়ে যায়, সিঁদুরও ছিটকে পড়ে মাটিতে। চক্ষু হুলোটাকে ধাওয়া করতে করতে বকে, বদমাইশ আইজ খাইছি তোরে। বিড়ালের মুখে আর্তনাদ করা চড়ুই কে দেখে আফসোস করেন শাশুড়ি। বলেন, যতই খাওয়াছ কুত্তা বিলাইর স্বভাব পাল্টাইতো না বউ। তিনি ঘরে ঢুকে প্রলয় দেখে চড়ুইয়ের মতোই আর্তনাদ করে উঠেন, হতভাগী কল্লি কী! চক্ষু শাশুড়ির বকা খায়নি কখনো, তাই ভেলভেল চেয়ে থাকে শাশুড়ির দিকে। শাশুড়ি প্রশান্ত স্বরে বলেন, তোরে কইছি না মা, দেবী আর সিন্দূর সামলাইয়া রাহিছ। চক্ষু সরার ভগ্ন টুকরোগুলো জড়ো করে, সিঁদুর কাচিয়ে কৌটায় তোলে। 

মাস ছয়েক পরে দেশে প্রকটরূপে দেখা দেয় তেতাল্লিশের মহাদুর্ভিক্ষ বা পঞ্চাশের মন্বন্তর। বাবুরহাটে লাফিয়ে লাফিয়ে প্রতি মণ চাল হয়ে যায় চল্লিশ টাকা। নিম্নবিত্ত নিম্নমধ্যবিত্ত মধ্যমমধ্যবিত্ত পরিবারগুলো পড়ে মহাসঙ্কটে। তারা গরু গোঁতান থালা বাটি গয়নাগাটি বিক্রি করেও দু'বেলা দু'মুঠো ভাত খেতে পায় না। ঘরে ঘরে দুর্ভিক্ষ, গ্রামে গ্রামে দুর্ভিক্ষ। দরজায় দরজায় দাঁড়িয়েও ভাতের মাড় পায়না বুভুক্ষু মানুষ। কচু ঘেচু অখাদ্য কুখাদ্য খায়। একজনে বমি করে আরেকজনে তা খেয়ে বাঁচার চেষ্টা করে। দেখা দেয় ডায়রিয়া কলেরা, মৃত্যু আর মৃত্যু। পঞ্চাশ লক্ষ লোক মারা যায় বাংলা বিহার উড়িষ্যায়। ইংরেজ সরকার কোন দায়িত্ব নেয়নি। চক্ষুরা পেটে পাথর বেঁধে থেকেছে, এক বেলা আধাপেট খেয়েছে এক বেলা উপোস করেছে। কার্তিকে অঘ্রানে ধান উঠলে দুর্ভিক্ষ কমতে শুরু করে। 

আসে চৈত্র সংক্রান্তি। পার্বণ বাদ দেওয়া যায় না। চক্ষু সাতসকালে উঠে বসতঘর, রান্নাঘর, বাসনকোসন, পরিষ্কার করে। স্নানের আগে নিমপাতা আর হলুদ বাটা এগিয়ে ধরে শশুর শাশুড়ির সামনে, মেখে দেয় স্বামী ও দেবরের গায়, মাখে নিজের গায়। গাভীটাকে স্বামী স্নান করিয়ে আনলে চক্ষু তার গলায় পরিয়ে দেয় নিজ হাতে গাঁথা বনফুলের মালা। আচার মতো দুপুরে চক্ষু সবাইকে খেতে দেয় চিঁড়া দই মিষ্টি। স্বামীকে পাঠায় বাড়ির সামনে তেমাথায় 'শত্রুব্রত' পালন করতে। স্বামী বাম হাতে দু'পায়ের ফাঁক দিয়ে তিনবার ছাতু উড়িয়ে তা ধারালো ছুরি দিয়ে কেটে দেয়। শত্রু কাটা পড়ে যায়। 

কিন্তু রাক্ষস দানব ভূত পিশাচ সব শত্রু কাটা পড়লেও রূপকথার গল্পের মতোই তাদের রক্তবিন্দু থেকে তাদের পুনরুত্থান হয়। তারা ঘিরে ধরে চক্ষুকে। সারাদিনের আনন্দ যজ্ঞ শেষে রাতে নেতিয়ে পড়ে চক্ষুর স্বামী। জ্বর তাকে চেপে ধরে। পরদিন শশুরের শুরু হয় ভেদবমি। দুদিন পরে শাশুড়ি আর দেবরের হয় জলবসন্ত। চক্ষু একা সেবিকা, লেডি উইথ দ্য ল্যাম্প ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল এর অনুবর্তিনী। স্বামীর শুধু জ্বর নয়, ডাক্তার বললেন কালাজ্বর। তার সুঠাম বলিষ্ঠ দেহ ক'দিনেই শেষ। ম্যালেরিয়া ডায়রিয়া কালাজ্বর তখন ঘরে ঘরে। চাঁদপুর শহরে সামান্য খরচায় কালাজ্বরের ইনজেকশন পাওয়া যায়। কিন্তু এই জ্বরে ক'দিনেই রোগী এমন দুর্বল হয় যে চাঁদপুর হেঁটে গিয়ে রোগীর পক্ষে ইনজেকশন নেয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। রোগী জ্বরে পুড়ে আঙ্গার হয়। রোগীর পেটে অন্ন ঢোকার মতো জায়গা থাকেনা, যকৃত ও প্লীহা বড়ো হয়ে পুরো পেট দখল করে ফেলে। বাড়িতে বাড়িতে স্বজন হারানো মানুষের বুক ফাঁটা ক্রন্দন ধ্বনি উঠে। উঠে চক্ষুর শশুর বাড়িতে। লক্ষীদেবীর অভয়মুদ্রা সরে যায় চক্ষুর উপর থেকে। একদিন সন্ধ্যার অন্ধকারে চক্ষু বিধবা হয়ে যায়। 


স্বামীর শোকে চক্ষু পাথর হয়। অসুস্থ শাশুড়ি থেকে থেকে চৌকি থেকে নেমে তাকে বুকে ধরে গগনবিদারী চিৎকার করেন। বেড়ার গায়ে যেখানে দেবীর পটচিত্রখানি ছিল চক্ষু শুধু সেইদিকে তার পদ্মাক্ষ মেলে নির্নিমেষ চেয়ে থাকে। কৈলাশ বাবু মেয়েকে ফিরিয়ে নিতে এলে চক্ষুর শাশুড়ি কেঁদে বলেন, বেয়াই মশাই চক্ষু আমাগোও মাইয়্যা, কাঁচা বয়স, অর বিয়ার বেবস্তা কইরেন, খরচা পাতি আমরাও দিমু। চক্ষু শাশুড়িকে ছেড়ে যেতে চাইলোনা, কৈলাশ বাবু তবু তাকে টেনে বাড়ি নিয়ে গেলেন। 

চক্ষু এখন শান্ত প্রশান্ত। মায়ের কাজে হাত লাগায় আর দূর নীলিমার পানে চায়। কিন্তু নিজের অলখে তার শরীর যে আরো সুশোভিত হয়েছে। সে দিকে চেয়ে কাঁদেন তার মা। দিনরাত নরম হয়ে তিনি স্বামীকে বলেন, বিধবা মাইয়ার কী বিয়া অয়না, অয়তো, এট্টু খবর লন। 

স্যাররা বলেন, দেখো কৈলাশ, সারদা আইনে মেয়েদের বিয়ের বয়স চৌদ্দ থেকে আঠারো বছর হয়েছে, ছেলেদের আঠারো থেকে একুশ বছর হয়েছে। তোমার মেয়ের বয়স চৌদ্দও হয়নি, শুধু শুধু কেন ওকে বিধবা বানালে? আর ভারতবর্ষ কী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ছোঁয়ায় বদলে গেছে যে, কোনো এক উদার ছেলে এসে তোমার বিধবা মেয়েকে নিয়ে যাবে, যেখানে ঘরে ঘরে রূপবতী গুণবতী মেয়েরা আইবুড়ো হয়ে পড়ে আছে? 

মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াল রূপ শুরু হলো। সাঁই সাঁই করে বাবুরহাটের উপর দিয়ে মিত্র বাহিনীর জঙ্গী বিমান উড়ে যায় পূর্ব রনাঙ্গনের দিকে। বহুজাতিক পদাতিক বাহিনীর তাবু পড়ে বাবুরহাটে। কিংবদন্তি বাবুরহাট হয় বিবর্ণ, আতঙ্কিত। মানুষের পেটে ভাত নেই। গৃহস্থের অবস্থা শোচনীয়। কাজের সন্ধানে মানুষ শহরমুখী। তারা দৈনিক মজুরি ও কুলিগিরির উপর নির্ভরশীল। সন্ধ্যায় বাবুরহাটের বড়ো রাস্তায় দাঁড়ালে দেখা যায় দলে দলে সাধারণ গৃহস্থ লোক চাঁদপুরে বিভিন্ন কলে-কারখানায় কাজ শেষে সামান্য চাল নিয়ে বাড়ি ফিরছে। অর্থাভাবে অন্নাভাবে পিষ্ট গ্রামবাসীর হৃদয়ে আনন্দ নেই। মানুষের বেঁচে থাকাই দায়, চক্ষুর বিয়ের কথা নয়। তবুও কৈলাশ বাবু আপ্রাণ চেষ্টা করে চক্ষুর জন্য এক পাত্র জোটান। হিরোশিমা নাগাসাকি ধূলিকণায় পরিনত হওয়ার ক'দিন পর শুভক্ষণ ধার্য্য হয়।


বিশ্বযুদ্ধ ভাঙে তবু কুসংস্কার ভাঙে না। আলেকজেন্দ্রিয়া লাইব্রেরীর মতো বাবুরহাট হাইস্কুল যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেয় তার আলোতে বিভাসিত হয়ে উঠলেন কতিপয় হিন্দু সংস্কারমনা মানুষ। তারা স্বর্চি। তারা ব্রাহ্মণ্যবাদী কৌলিন্যের বল্লালী প্রথার জগদ্দল পাথর সরাতে শুরু করলেন। অবশেষে ব্রাহ্মণগণ চক্ষুর বিয়েতে মত দিলেন। কিন্তু সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে বিয়ের দিন বিকেলে পুরোহিত এলেন না। ভূমিকম্পে আলেকজান্দ্রিয়ার বাতিঘর যেমন নিভে যায় তেমনি ভূমিকম্পের মতো কেঁপে উঠলেন স্বর্চিরা। বুঝি দপ করে নিভে গেলো তাদের আশা। হায় চক্ষু! কিন্তু হাল ছাড়লেন না তারা। তাদের মুহূর্মুহু সম্ভূয়সমুত্থানে অতঃপর ব্রাহ্মণগণ দায়সারা হলেও বললেন, শুধু মালাবদল করে দিলেই হবে, বিয়ে সিদ্ধ হয়ে যাবে। এগিয়ে এলেন সিলন্দিয়া গ্রামের সন্তান চাঁদপুর গণি মডেল হাইস্কুলের হেডপণ্ডিত নলিনী কাব্যতীর্থ। তিনি পুরোহিতের কাজ করলেন। শুভক্ষণে চক্ষুর বিয়ে হয়ে গেলো। 

ঋভুদের জয় হলো। বাবুরহাট হাইস্কুলের খ্যাতিমান প্রধান শিক্ষক সারদা চরণ দত্ত বললেন, হিন্দু সমাজকে জাতের গোঁড়ামি আচারের গোঁড়ামি ত্যাগ করে উদার অন্তঃকরণে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে হবে, চারিদিক হতে গোঁড়ামি উঠে যাচ্ছে, বাবুরহাটকেও উন্নত সমাজের সাথে সমান তালে পা ফেলে চলতে হবে, যে শিক্ষার সমাজের গলদ দূর করার সামর্থ্য নেই সে শিক্ষার প্রয়োজন নেই। খাদি শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক সতীশ দাশগুপ্ত বললেন, মুসলিম সমাজের অনুকরনে অস্পৃশ্যতা ত্যাগ করতে হবে। 

আলেকিত জনের দাপটে সিলন্দিয়া থেকে হিন্দু সমাজের বহু শতাব্দীর অনিষ্টকর জাতিভেদ প্রথা দূরীভূত হলো। জগদীশ রায় চৌধুরী সকলকে ডাকলেন, খাওয়ালেন। ব্রাহ্মণ শুদ্র এক পঙক্তিতে বসে খেলো। সকল বর্ণের লোক মিলেমিশে খাবার পরিবেশন করলো। সকল বর্ণের লোক চন্দ্রমালীর বাড়িতেও আহার গ্রহন করলো। যোগেন্দ্র চক্রবর্তী, অশ্বিনী রায়, সোমেন্দ্র দত্ত, ভূপুদত্ত অন্ন গ্রহন করলেন। উৎপাদনের সাথে সম্পর্কহীন পরপোজীবী শ্রেনির কুলীনত্ব প্রচন্ড ধাক্কা খেলো। বাবুরহাটে বেজে উঠলো পাঞ্চজন্য শঙ্খ। 

(বিজয়া সন্মিলন শতবর্ষ স্মারকগ্রন্থ বাবুরহাট, অবলম্বনে) 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ