দর্পণ | সাপ্তাহিক নির্বাচিত কলম | কবিতা, প্রবন্ধ ও গল্প




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

 



কবিতা - 


'ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে আজো' / শৌভিক গাঙ্গুলী 

 

খোঁজ শেষ হবেনা কোনদিন। জীবন বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে ফিরে চলছে অনন্তের পথে। যে শব্দ গুলো পরম ব্রহ্ম এর সন্ধানে ঘুরেফিরে আজো ক্লান্তি হীন তারাই বলে যায়, 


"ব্রহ্ম সত্য জগত মিথ্যা, জীব ব্রহ্মৈব না অপরো।" 


আসলে জীবনের অন্বেষণ বিরামহীন। পেয়েও হারিয়ে ফেলি, আবার পাওয়ার জন্য ফিরে আসি বারে বারে। খ্যাপা সন্ন্যাসীর সত্যানুসন্ধান সভ্যতার পরতে পরতে ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছে।

নায়ক, খ্যাপা সন্ন্যাসী জীবনভর নিরলস পরিশ্রম করে, সন্ধান করে ফেরে জীবনের মূল মন্ত্র ধ্বনি। হ্যাঁ, জীবন এক খোঁজ। জন্ম থেকে মৃত্যু ছুটে চলেছি, মাঝে একটা আইসোমেট্রিক গিফ্ট হলো আপাত সম্পর্ক গুলো। আঁকড়ে ধরে শেষে হতবাক!


 প্রাণের ঠাকুর তাই বলেছেন, 


"অর্ধেক জীবন খুঁজি/কোন ক্ষণে চক্ষু বুজি/ স্পর্শ লভেছিল যার এক পলভর,/ বাকি অর্ধনগ্ন প্রাণ/ আবার করিছে দান/ফিরিয়া খুঁজিতে সেই পরশপাথর।"


খ্যাপা সন্ন্যাসীই আসলে সেই মানব শিশু,ছুটে চলেছে করায়ত্ত করতে ক্ষমতার চাবিকাঠি। অবোধ বোঝেনা, বেলা বয়ে যায়। সোনার হরিণের পিছনে ছুটে অবহেলা করে হারিয়ে যায় একে একে সুকুমার বৃত্তি গুলো। আসলে সম্পর্কের মোহিনী বুননের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসার পাসওয়ার্ড গুলো এতো কাছে তবুও কতো দূরে। জানি না কি চাই অথবা যা পাই কখন হারাই। তাহলে স্বার্থকতা কিসে, বলা মুশকিল। আরো চাই! আরো দৌড়াই! সভ্যতার বাইপাস গুলোতে যে কয়েকটা নিরুত্তাপ কোণে পলভর অনুরণন হয় জীবনের 'ইলতেমাস',  চোরাবালিতে নিশি যাপনের মোহিনী হাতছানিতে ডুবে যাওয়ার আগের মুহূর্তে বিদ্যুতঝলকের মতো আবিষ্কার করে, 'পেয়েছিল আগে, অজ্ঞাতে।'

খ্যাপা বোঝেনি আজও, অসুন্দরের মধ্যেই সুন্দর; অবিশেষের মধেই বিশেষ। 

ঐ পরশপাথর ক্ষেপার চরম কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য। অনুসন্ধানে কাটে সময়, অজ্ঞাতে। আরো বেশি লাভের উদ্দামতা সহজ বাস্তবতাকেও দূরে ঠেলে দেয়। আসলে ছোট ছোট সুখ দুঃখের অনুভূতি গুলোই চিরন্তন, সীমার মধ্যেই অসীমের খোঁজ। অবহেলা করে মানুষ।

একা শুধু নিজের জন্য নয়, সংসার, সমাজ, দেশের মধ্যে ই আছে মহামিলনের হাতছানি। বুঝে নিতে হবে, সময় থাকতে।


'এ জীবন চলে গেলে পাবে না তো আর'।



শিলাইদহ_থেকে_রূপনারায়ণ / সুমনা_ভট্টাচার্য্য 


এসব মেঘে কবিতানাম  নেই , এরা যেন সেই বাঁশিতে বাঁধা সুর -

যে  সুরে কথা দুঃখভোজী বুকে বুনছে বাঁশিওয়ালা  দূর থেকে দূর.. 


এসব মেঘ বড়োই পরিযায়ী,  ভ্রমণ অভ্যেসে সে খোঁজে সরাই -

একলা চিলেকোঠা বৃষ্টি  ঝরঝরে  জাগছে তৃষ্ণা লিখে খোয়াই


এসব মেঘ এক নিমেষে পড়ে নেয় একলা দৃষ্টির সাময়িকী -

মেঘও জানে  কেন নিভৃত অভিলাষী মিছিলে হেঁটে চলা বার্ষিকী 


এসব মেঘ যেন তাঁরই ছায়াপট -সময় খোঁড়ে যে সম্মোহন -

হাওয়া-সখ্যতা  সেলাই করে শিলাইদহ  থেকে রূপনারায়ণ


এসব মেঘে আবেগ শিরোনাম , চির আবাসিক  সে ভুল ঠিকানার -

ক্যাফেটারিয়া জানে সে গাঁয়ের সাকিন যাদের নাম আজো খঞ্জনা


তাঁর কথায় সাজে ব্যথার আলাপ -জানে দু'পা হাঁটাই পরিশিষ্ট -

বলছে স্মৃতি -কড়ি ও কোমলে বিষাদ এসব মেঘে এসে যে মিশত...



 প্রবাসী রাত / মধুপর্ণা বসু


ঘুম আসেনা চোখের পাতায়,

নিঃশব্দে ছায়ারা কনীনিকা কাঁপিয়ে দেয়।

অভ্যাসে জেগে থাকে ইনসমনিয়া মন।  বারোয়ারী রাতে খঞ্জনী বাজিয়ে দেশোয়ালি গান গাইছে বিহারি চৌকিদার, 


রাতের ব্যক্তিগত ভাষা তার জানা নেই...

সাদা বিছানার চাদরে ফিকে ফুলপাতা, 

কবেই ভুলে গেছে, 

এলোমেলো বিক্ষিপ্ত জলের আলপনা।

রাতের নীল আলো, সবুজ কমলা হতে হতে

আজ অদৃশ্য কালো পতাকা ঝুলিয়ে ইস্তফা দিয়ে গেছে। 

 সেই গোলাপি রাত্রিবাসটিও...  চালসে পড়া মাঝবয়েসী মুখে আলমারির কোণ নিয়েছে জড়িয়ে।

নিয়মমাফিক টিকটক ঘড়িতে বার্ধক্য বাস করে, 

মাঝে মাঝে ভাবতে ইচ্ছে করে, কেন এই অসময়ে পরবাস?

শরীরের থেকেও জরা ধরা মনে কিছু উত্তর খুঁজে পাওয়া নিতান্ত বাতুলতা।




তবুও বাঞ্ছা কল্পতরু ! / রীনা নস্কর



শক্তিশালী অন্ধকারের কবলে পড়ে

অসহায় উপন্যাসের অশ্রু ঝরে,

যন্ত্রণার আঁতুড়ঘরে ভালোলাগা গুলো মৃত,

কিছু দগদগে ঘা

নিশুতি রাতের সঞ্জীবনী সোহাগে এখনও জীবিত।

প্রৌঢ় পৃথিবী বয়সের ভারে

সবে নত হতে শুরু

আশার শুষ্ক লতা পোড়ার গন্ধ,

তবুও বাঞ্ছা কল্পতরু !

থিতিয়ে যাওয়া আস্বাদ

কর্তব্যের কাঁটাবনে ফেঁসে !

নীরব অন্বেষণ অহর্নিশ,

অদৃষ্ট কেবলই ওঠে হেসে !!



  

ছোট গল্প -


 “ মাটির টান ” / অসিত চ্যাটার্জী  


    “  চিরসখা , হে ছেড়ো না মোরে , ছেড়ো না ” -  উধাত্ত কণ্ঠে কে এই নির্জন বনজঙ্গলে  রবিঠাকুরের গান গাইছে ? এ যে পরম বিষ্ময় ?- থমকে দাঁড়ালো সুবিনয় , দেখতে হচ্ছে ব্যাপারটা বলে গলার স্বর অনুসরণ করতে করতে হাঁটতে লাগলো ছোট ছোট পাহাড় ঘেরা বনজঙ্গলের মধ্যে । ভোরের আলো ফুটে সকাল হয়েছে সবে , নরম সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়েছে গাছের পাতায় , পাহাড়ের গায় , বড় উৎফুল্ল লাগছিল এই বনভূমিকে , মনে হচ্ছিল বনের গাছপাতা , লতাগুল্ম , পাহাড় সব যেন উন্মুখ হয়ে শুনছে আর মূর্ছিত হচ্ছে সেই সুরের মূর্ছনায় ও ভাবের গভীরে । 

কিছুদুর যেতেই চোখে পড়ল , উঁচু ঢিপির মত একটা পাথরের উপর বসে একজন মানুষ , সুবিনয় পা টিপটিপে হাঁটতে যাতে কোন শব্দ না হয় । তারপর তার পিছনে এসে দাঁড়াল , হাতে একটা ছোট্ট বীণার মত বাদ্যযন্ত্রে সুর তুলে , চোখ বন্ধ করে গেয়ে যাচ্ছেন , কোনদিকে তার ভ্রূক্ষেপ নেই ।  যেখানে বসে গান করছেন , তার কিছুটা নীচে একটা পাহাড়ী ছোট্ট একটা নদী , খরধারা নয় , খুব মিষ্টি , শান্ত হয়ে বয়ে চলেছে , নদীর ওপারে একটা পাহাড় , বেশি উঁচু নয় , কিন্তু প্রস্থে বড় , পাহাড়ের গায়ে বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে আছে ছোট ছোট গাছ , পাহাড়ের পাদদেশে ছোট ছোট জঙ্গলি ফুল , অপরূপ , মনোরম পরিবেশ , সত্যি এই পরিবেশে গানই মানায় । গান শেষ হতে সুবিনয়ই কথা বলল - নমস্কার , আমি সুবিনয় রায় , এখানে বেড়াতে এসেছি , এই নির্জন বনজঙ্গলে হঠাৎ বাংলা গান তাও রবিঠাকুরের ! বিষ্ময়ে হতবাক হয়েছি , তাই এই বিষ্ময়ের ঘোর কাটাতে গলার স্বর অনুসরণ করতে করতে এখানে এসে পৌঁছেছি , চমৎকার গান করেন তো আপনি ? যেমনি আপনার গলা , কি আবেগ নিয়ে গান করছেন , মুগ্ধ হয়ে যেতে হয় । প্রতিত্তরে ভদ্রলোক বললেন - আমার নাম প্রতীক চৌধুরী । সুবিনয় বলল - আপনিও কি আমার মত বেড়াতে এসেছেন ? প্রতীকবাবু বললেন - না , আমি এখানেই থাকি । শুনে সুবিনয়ের বিষ্ময়ের ঘোর আরো বেড়ে গেল , বলল - এই এখানে আপনি থাকেন ? এই নির্জন জায়গায় ? প্রতীকবাবু বললেন - হ্যাঁ । আপনি তো আরো অবাক করে দিলেন - সুবিনয় বলল । প্রতীকবাবু বললেন - এতে অবাক হওয়ার কি আছে ? এই জঙ্গলে জন্তু জানোয়ার , পশুপাখি , বিষধর সাপ আছে , তো মানুষ কেন থাকতে পারবে না ? শুনুন জন্তুজানোয়াররা কিন্তু মানুষের থেকে কম হিংস্র , ওদের ডিসটার্ব না করলে ওরা কাউকে ডিসটার্ব করেনা । সুবিনয় বলল - মানলাম , কিন্তু দিনের পর দিন এই নির্জন বনজঙ্গলে থাকা যায় ? প্রতীকবাবু বললেন - থাকা যায় , চলুন । সুবিনয় বলল - কোথায় ? প্রতীকবাবু বললেন - এখানে বসেই সব কথা শুনবেন , চলুন একটু কফি খাওয়া যাক , আসুন , আপনি তো আমাদের অতিথি , আমাদের এখানে এসেছেন , এই জঙ্গলের হয়ে নাহয় আমিই অতিথি অ্যাপায়ন করলাম । শুনে দুজনেই হো হো করে হেসে উঠলো । প্রায় মিনিট দশ পনেরো হেঁটে , একটা ছোট্ট বাড়ির সামনে ওরা হাজির হলো , গেট খুলে সুবিনয়কে আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রতীকবাবু বললেন - আসুন । সুবিনয় প্রতীকবাবুকে অনুসরণ করল । ঘরে ঢোকার আগে একটা বারান্দা , বারান্দার নীচের অংশ সিমেন্ট বালি ইটের গাঁথনি আর উপরের অংশটা বাঁশের বাতা দিয়ে ঘেরা , টবে লাগানো লতানো গাছ বাঁশের বাতা ধরে উঠেছে , বনজঙ্গলের সঙে সংগতি রেখেই  বোধহয় এই কর্মকাণ্ড , বেশ ভাল লাগছিল , জঙ্গল ছেড়ে এলেও তার অস্তিত্বকে সঙ্গে নিয়ে থাকা । বেতের একটা চেয়ার আর গোল টেবিল বারান্দায় রাখা ছিল , জঙ্গল থেকে বেড়িয়ে এসে জিরিয়ে নেবার জায়গা কিংবা সন্ধ্যা যখন নেমে আসে , তখন চা বা কফি হাতে বারান্দার নরম আলোয় অন্ধকারে নিস্তব্ধ , বনজঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া লোকালয়শূণ্য জায়গাটার রূপ অনুভব করা , কিন্তু দিনের দিন এই নিস্তব্ধতা , উদাসীন নিরাবতা কি কোন সময় অসহ্য মনে হয়না - এই চিন্তায় ডুবেছিল সুবিনয়  । ‘ ভোলা ’ বলে হাঁক ছাড়লেন প্রতীকবাবু , প্রায় দৌড়ে এল , একটি ছোটখাটো মানুষ , বয়স পঁচাশ হবে , বলল - বলুন দাদাবাবু । প্রতীকবাবু বললেন - একটা চেয়ার দিয়ে যা আর আমাদের জন্য দু কাপ কফি করে নিয়ে আয় , তারপর সুবিনয়কে ইশারা করে বসতে বললেন । সুবিনয় বলল - ঠিক আছে , চেয়ারটা আসুক , একসঙেই বসবো । ভোলা চেয়ার নিয়ে আসতেই দুজনে একসঙে চেয়ারে বসল । তারপর প্রতীকবাবু বললেন  - তা , সুবিনয়বাবু হঠাৎ এখানে কেন , এখানে তো কেউ  সচরাচর বেড়াতে আসেনা , এটা তো সেরকম বিখ্যাত জায়গার মধ্যে পড়েনা ? সুবিনয় বলল - আমি ভ্রমনপিয়াসী মানুষ , দেশের সব জায়গায় ঘুরে বেড়াই , বিশেষ করে অখ্যাত জায়গায় ঘুরতে আমি অন্যরকম ফিলিংস অনুভব করি , জানার ইচ্ছা ও সংশয় এই দুটো মিলিয়ে এক অদ্ভুত অনুভূতি থাকে , আমার ভাল লাগে । 

প্রতীকবাবু বললেন - বুঝলাম । ইতিমধ্যে ভোলা ট্রে তে করে দু কাপ কফি সঙ্গে বিস্কুট নিয়ে টেবিলে নামিয়ে দিয়ে গেল । প্রতীকবাবু বললেন - নিন , কফি খান । কফি আর বিস্কুট খেতে খেতে সুবিনয় বলল  -   If you don't mind , একটা personal কথা জিজ্ঞেস করতে পারি ? জানিনা এটা কতটা সমীচীন হচ্ছে , আসলে প্রচন্ড আগ্রহ হচ্ছে জানতে , ইচ্ছে করলে আপনি উত্তর না দিতেও পারেন । প্রতীকবাবু বললেন - না , না , সেটা কোন ব্যাপার নয় , আমি বুঝতে পারছি আপনি কি জানতে চাইছেন ? তারপর বললেন - এতে কোন লুকোবার কিছু নেই । প্রত্যেক মানুষ স্বতন্ত্র চিন্তাধারায় বাস করে , তাদের বেঁচে থাকার অর্থও ভিন্ন , তবেও এটা ঠিক অনেকসময় , অনেকসময় কেন বলবো প্রায়সই মানুষ compromise formula তে চলতে বাধ্য হয় বা মেনে নেয় , যেমন ধরুন আপনার কথা - এই যে আপনি এদেশ ওদেশ একা ভবগুরের মত ঘুরে বেড়াচ্ছেন , মনে হয় বিয়েথা করে সংসার করেন না অন্য পাঁচজনের মত , আপনার হয়তো এভাবেই জীবনটা উপভোগ করতে ভাল লাগে , আমারও ঠিক এইরকম ব্যাপারটা , তবে একটু তফাৎ আছে আমি কিন্তু বিবাহিত মানুষ তবে এখন অবিবাহিত জীবনযাপন করছি কারণ এটা আমার ভাল লাগছে । কফিতে চুমুক দিয়ে একটু থেমে বললেন - এখানে আমি আর ভোলা থাকি , ওই রান্নাবান্না , ঘরের সব কাজ করে । আমার স্ত্রী ও এক পুত্র আছে , তারা থাকে আমেরিকার লসএঞ্জেলসে , স্ত্রী ও পুত্র সুপ্রতিষ্ঠিত । আমি জীবনের অনেকটা সময় বিদেশেই কাটিয়েছি , কলেজ জীবন পর্যন্ত এখানে কাটিয়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছিলাম উচ্চশিক্ষার জন্য , ওখানে ভাল অফার পেয়ে যাই , তাই ওখানেই থেকে যাই , বিয়ে করি , সংসার হয় , তারপর পুত্রসন্তান হয় । ছেলে বড় হয় , ও এখন ভাল চাকরি , আমার মিসেস খুব active , ও এখনও চাকরি করে । আমি চাকরিসূত্রে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি - বার্লিন , প্যারিস , লন্ডন , কানাডা , আর দিলদার enjoy করেছি । আমেরিকাতেই পাকাপাকিভাবে থাকবো এটাই মোটামুটি ঠিক ছিল , citizenshipও ছিল ,  তারপর একদিন দেশে একটা seminar এ attend করতে এলাম , কাজের ফাঁকে একটা পাহাড়ী জায়গায় ঘোরার ব্যবস্থা ছিল , বিদেশেও অনেক পাহাড় জঙ্গলে ঘুরেছি , কিন্তু এখানে এসে  অন্যরকম লাগলো , একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা , একটা উদাসীন নির্জনতা , অনেককিছু থাকা সত্বেও কিছু চাইতে ইচ্ছে করে যা তার কাছে নেই । কাজ আর কাজ , সময় শুধু বোঝে কাজ , এই কর্মব্যস্ত জীবনে কেন সেদিন মনে হলো , কে যেন বলল - ‘ অনেক ছুটেছো , একটু থামো , বড় শ্রান্ত তুমি ’। মা বাবাকে অনেকদিন হারিয়েছি , এরকম কথা মা ছাড়া আর কে বলবে ? মনে হলো - আমার অন্তর আত্মা বলছে - ফিরে আয় । ঠিক যেমন অনেকদিন পর ছেলেকে পেয়ে মা আঁকড়ে ধরে রাখে , যেতে দিতে চায়না , মাটি আজ মা হয়ে আমাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইছে । প্রতীকবাবু অনেকক্ষণ কথা বলে এবার একটু থামলেন । সুবিনয় বলল - বাহ্ , খুব interesting লাগছে । আমরা যাই বলিনা কেন মাটির টান একটা আছে , কেউ উপেক্ষা করে , কেউ পারেনা বা আবার কারোর ইচ্ছে থাকলেও বাধ্য হয় পরিস্থিতির জন্য । যাক , তারপর বলুন কি হলো , খুব ভাল লাগছে শুনতে । প্রতীকবাবু স্মিত হেসে বললেন - হুঁ । তারপর আমেরিকায় ফিরে এলাম , আবার কাজে ডুবে গেলাম , কিন্তু মনে কেমন একটা অশান্তি সবসময় , মাঝেমাঝে রাত্রে স্বপ্নে সেই পাহাড়ী জায়গাটা ভেসে আসে ,বারবার টানে জায়গাটা আমাকে , মনে হয় ওখানে গেলেই  বোধহয় আমি শান্তি পাব , ঘুমটা ভেঙে যায় । মিসেস একদিন সব কথা খুলে বললাম । বললাম - আমি দেশে ফিরে যাব , দেশ আমাকে ডাকছে , অনেকদিন তো বিদেশে কাটালাম , চাইলে তোমরাও আমার সঙ্গে যেতে পারো । শুনে তো মিসেস ভীষণ অবাক হলো , বলল - সে কি , এখানে এত টাকা খরচা করে বাড়ি , ঘর দোয়ার করলে , এসব ছেড়েছুড়ে যাওয়া কি সম্ভব ? তোমার কথা বাদ দিলাম , কিন্তু আমি ও ছেলে এখানে চাকরি করি , ছেলে খুব ভালভাবে এখানে established হয়ে গেছে , তাছাড়া এত amenities ওখানে কোথায় পাবো ? তোমার দেশের প্রতি টান জেগেছে , তুমি যাও , আমরা এত সুখ , সুযোগসুবিধা ছেড়ে যেতে পারবো না , ছেলেরও তাই মত ।  শেষে একদিন ওখানকার সব মায়া কাটিয়ে দেশে ফিরে এলাম , মাটির টানে ।



প্রবন্ধ - 


রবীন্দ্র সাহিত্যে নারী

মমতা শঙ্কর সিনহা(পালধী)


      

          রবীন্দ্র লেখনীতে বারংবার বিভিন্ন নারী চরিত্র বিভিন্ন রূপে নানা আঙ্গিকে প্রকাশিত হয়েছে।তাঁর সৃষ্টিকর্মের শৈল্পিক নৈপুন্যতায় জন্ম নিয়েছে অসংখ্য মানস নারী চরিত্র। যারা আজ যেনো বাস্তবের নারী চরিত্রের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়েগেছে।রবীন্দ্র সাহিত্যের নারী চরিত্রগুলি যেমন রোমান্টিকতায় পরিপূর্ণ তেমনি অন্যদিকে নারী চরিত্রগুলির মধ্য দিয়ে অনেক নিগূঢ় তত্ত্ব প্রকাশিত হয়েছে।"মানসী" কবিতায় নারীত্বের, নারী চরিত্রের এক সুন্দর সৌন্দর্য মন্ডিত অসাধারণ ব্যাখা করেছেন কবি গুরু।যা পাঠ করে আমাদের অন্তরে অপূর্ব এক ভাবাবেশের সৃষ্টি হয়।আবার "চোখের বালির" বিনোদিনীর অন্তরে আশালতার প্রতি সমাজের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের ফলে সৃষ্ট প্রতিহিংসাপরায়ণতার আগুন প্রজ্জ্বলিত হয়েছে।যাতে দগ্ধ হয়েছে আশালতা ও মহেন্দ্রের সংসার জীবন।

বিশ্ব কবির হাত ধরে বাংলা সাহিত্যে সৃষ্টি হয়েছে অবিস্মরনীয় কিছু নারী চরিত্র। শেষের কবিতা, নৌকা ডুবি, চোখের বালি,দেনাপাওনা, হৈমন্তী,স্ত্রীপত্র।

"শেষের কবিতা" উপন্যাসে লাবণ্য চরিত্র চিত্রনের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিংশ শতকের বঙ্গীয় সমাজে নব্যশিক্ষিত উচ্চ সম্প্রদায়ের নারীর জীবনকথা অতি বাস্তব সত্য রূপ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন ।শিলং পাহাড়ের মত দৃঢ়চেতা লাবণ্য কিন্তু দীঘির জলের মত যাকে বাঁধা যায় না কিন্তু তাতে উচ্ছল ভাবে সাঁতার কাটা যায়।

        আবারও ফিরে আসি কবি গুরুর সেই বিখ্যাত উপন্যাস "চোখের বালির" দৃশ্যপটে।এখানে সমাজ,যুগান্তরের রূপান্তর,পিতৃ-মাতৃহীন, স্বামী-সন্তান ,সহায়সম্বলহীন নারী যে চেতনে অবচেতনে বারংবার তার "বালি" অর্থাত মহেন্দ্রের সহজ-সরল স্ত্রী আশালতাকে হিংসা করেছে।

      আমাদের জীবনের চলার পথ থেকে শুরু করে সাহিত্য, নাটক, নোবেল, উপন্যাস সবেতেই এক এক সময় এক একটি ট্রাজিক চরিত্রের আবির্ভাব ঘটেছে।তেমনি এক ট্রাজিক চরিত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা বিখ্যাত উপন্যাস "চোখের বালির" বিনোদিনী। 

       উপন্যাসের ট্রাজিক নায়িকা বিনোদিনীর হিংসার আগুনে জ্বলে শেষ হয়ে গিয়েছিলো মহেন্দ্রের নিরীহ নিষ্পাপ স্ত্রী আশালতার জীবন। আশা তার মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলো তার সই "বালি" অর্থাত বিনোদিনীকে।

     কিন্ত সরলমনের আশালতার সাথে বিনোদ এহেন হিংসাত্মক আচারন করলো কেনো?আশার নিষ্পাপ, সহজ-সরল হৃদয় তার সইয়ের মনের গূঢ় মনস্তত্বকে বুঝে উঠতে পারেনি।এই মনস্তত্বকেই কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস "চোখের বালি"।

         হ্যাঁ হিংসা সকলের মনেই আছে,সকল হিংসার ধরন এক নয়।মানুষের চরিত্রের পার্থক্যে হিংসাও নান ধরনের হয় ।এক একপ্রকার হিংসার জন্ম এক একরকমের পরিবেশ পরিস্থিতি হয়।কখনো প্রবল হতাশা,কখনো ক্ষোভ, দুঃখ, শোক কিংবা জীবনের বিষাদময় কোনো অধ্যায়ারে থেকে সৃষ্ট হয়।জীবনে কিছু জিনিস পেতে করতে হয় প্রচুর কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যাবসয়। কিন্তু কিছু মানুষ জীবনে অতি সহজেই সব কিছুই পেতে চায়।অপরের সুখ,শান্তি নিজের করে পেতে হয়ে ওঠে প্রতিহিংসাপরায়ণ। 

    নিয়তিই মানুষের হার,জিত, সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে।অনাথ ব্যক্তি বাবা-মার ভালোবাসা পাওয়া আহ্লাদি মানুষকে দেখে হিংসা করে,অকাল বৈধব্য যন্ত্রনাকাতর নিঃসঙ্গতার নারী স্বামী সোহাগিনী স্ত্রীকে হিংসা করে।সন্তানের থেকে অবহেলা পাওয়া বাবা-মা অন্যের বাধ্য সন্তানকে দেখে অসহায় বোধ করে সেই সন্তানকে অনেকক্ষেত্রে হিংসাও করেন।

        সে যাই হোক বিনোদিনীর ক্ষেত্রেও এইরকম অসহায় অবস্থার শিকার হয়েই কিন্তু আশালতার উপর তার হিংসার উদ্রেক হয়েছে।যে হিংসা সবদিক থেকেই আশাকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলো।বিনোদিনী তার মায়ের সইয়ের ছেলে মহেন্দ্রের সহজ-সরল, অশিক্ষিত ,ঘরোয়া স্ত্রী আশালতার সুখী বৈবাহিক জীবন মেনে নিতে পারেনি।বিনোদ যেনো তার মনের অজান্তেই বারংবার আশাকে ঈর্ষা করেছে।

         এইরকম হিংসার শিকার আমরা কেউ কি কখনও হই না?

নিজের অজান্তেই অনেক সময় এইরকম হিংসার প্রতিফলন ঘটে আমাদের অনেকেরই জীবনে।কখন আমরা আমাদের জীবনের অনেক অনেক অপূর্ণ আশার বেদনায়,প্রিয়জনকে হারানোর কান্নায় জীবনের খালি জায়গাটা পূরণ করার অছিলায় রাগে,ক্ষোভে, দুঃখে,কান্নায় হতাশাচ্ছন্ন হয়ে কোনো কোনো মানুষের প্রতি হয়ে উঠি চরম হিংসাত্মক। 

      তাই আমরা অকালবৈধব্য যন্ত্রনা কাতর, ভাগ্যহীনা,পিতৃ-মাতৃহীন,অসহায়,সর্বহারা বিনোদিনীকে ঘৃণার চোখে দেখতে পারিনা ।

      হ্যাঁ বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় দাঁড়িয়ে দেখলে আমরা হয়তো তার হৃদয়ের ব্যথা কিছুটা হলেও উপসম করতে সক্ষম হতাম।কিন্তু তৎকালীন সমাজবন্ধনের নাগপাশে আবদ্ধ সমাজ তার সেই চরম হতাশাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে---তার হৃদয়কে ক্ষত-বিক্ষত করেছে।বিনোদিনীর অন্তরের সুপ্ত হিংসাকে মারাত্মক প্রতিহিংসায় পরিণত করেছে।যার জন্য বারংবার চেষ্টা করেও বিফল হয়ে বিনোদিনী বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পুরুষের---প্রথমে মহেন্দ্রো ও পরে মহেন্দ্রের ভাতৃসম বন্ধু বিহারীর প্রেমে পড়েছে। 

        "চোখের বালি"উপন্যাসে বিহারী বিনোদিনীকে বলেছিলো--"বিনোদ আমি তোমাকে ঘৃণা করি,কিন্তু তার থেকে বড় সত্য---আমি তোমায় ভালোবাসি।"

      এই কথার অর্থ কি জানেন--এর অর্থ বউঠান অর্থাত মহেন্দ্রের স্ত্রী আশালতার প্রতি বিহারীর গূঢ়শ্রদ্ধা ও বউঠানের ভালোবাসার মর্যাদাহীনতা---যা আশার "বালি" তার সাথে করেছিল--মহেন্দ্রোকে আশালতার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চেয়ে ।বিহারীর কথায় তাই এই ঘৃণার উল্লেখ ঘটেছে।কিন্তু বিনোদিনীকে ঘৃণা করা সত্ত্বেও তৎকালীন সমাজ তার মত বুদ্ধমতি, শিক্ষিতা, সুন্দরী অসহায় নারীর অকাল বৈধব্য যন্ত্রনা সমাজের অবহেলার কথা--সকল দিক থেকে বিচার বিবেচনা করে বিহারী তাকে ভালোবেসেছিল। 

      আমারও উপন্যাসটি পড়ে বিনোদিনীর চরিত্রটি পড়ে তাকে বিহারীর মত ভালোবাসি ও তার ট্রাজিক চরিত্রের প্রতিটি মুহূর্তকে উপলব্ধির চেষ্টা করি। 

    তাই যখনই মনে কোনো হিংসার উদ্রেক হবে জোড় হাতে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করব,নিজের চোখ বন্ধ করে বলব---"প্রভু দাও মোরে আরো চেতনা"।

       নৌকাডুবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আর একটি অবিস্মরনীয় উপন্যাস। তাঁর লেখা তেরোটি উপন্যাসের চতুর্থ উপন্যাস এটি।এখানে রোমান্টিকতার সাথে সামাজিক বন্ধনের মিশেলে কবি এক অপার চরিত্র চিত্রায়িত করেছেন।এই উপন্যাসের উপজীব্য ছিলো ভাগ্যের সাথে নিয়তির নিঠুর খেলা।মনের কুটিলতা, জটিল মনস্তত্ব,হিংসা-বিদ্বেষ এর জায়গায় ফুটে উঠেছে দুই মানব-মানবীর আদিম ও সূক্ষ্ম অনুভূতি।উপন্যাসে রমেশ দুর্বল ছিলো হেমামালিনীর প্রতি আর সেখানে বাঁধ সাধে নিয়তি। 

       অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের নারী চরিত্র শুধু কোমলতা,স্নেহ,প্রেমের মূর্তি নয়।সে নারী বীরঙ্গনাও। চিত্রঙ্গদা চরিত্র তার প্রমাণ।সে রাজনন্দনী হয়েও বীর যোদ্ধা অতচ সে বলছে সে একজন সমান্যা নারী।কবির সৃষ্ট চিত্রাঙ্গদা এক অনন্য নারী চরিত্র। রাবেন্দ্রীক নারী চরিত্রেরা পুরুষের ছায়ামাত্র নয়।বরং সে সকল চরিত্ররা তৎকালীন যুগ অপেক্ষা যথেষ্ট অগ্রসর নব-নবীন নতুনত্বের তরে তাদের চরিত্র বৈশিষ্ট্যে।হয়তো ঠাকুর বাড়ির অনেক নারীর মধ্যে এই সকল বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করে ছিলেন বলেই তাঁর সাহিত্যে নারী চরিত্রগুলি এত স্বতন্ত্রবৈশিষ্ঠ্য মন্ডিত।ব্যক্তি জীবনেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পেয়েছেন অনেক নারী সান্নিধ্য। কাদম্বরী,জ্ঞানদানন্দনী,স্বর্ণকুমারী,সরোলা ঘোষাল,ইন্দিরা দেবী,স্ত্রী মৃনালিনীদেবী,কন্যা মাধুরীলতা,রেণুকা,মীরাদেবীর মত প্রতিভাময়ী, সাধারণ অতচ অসামান্য সকল নারী চরিত্রগুলি আপন ব্যক্তি সত্ত্বতায় ভিন্ন ভিন্ন নামে স্থান পেয়েছে।

       কাদম্বরীদেবীর নিঃসঙ্গ জীবন, কবির নিঃসন্তান কন্যা মাধুরীর অকাল মৃত্যুর সব যেন কবিকে বিস্মিত ভাবে নাড়া দিয়েগেছে প্রতি মূহুর্তে।আর তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে কবির লেখনীর মধ্য দিয়ে।

       বিশ্ব কবির কন্যাদের দাম্পত্য জীবন খুব একটা সুখকর ছিলো না।সেই অসুখী দাম্পত্যের প্রতিফলন ও কাদম্বরীদেবীর আত্মহত্যা জন্য যে প্রবল অভিমান তার প্রকাশ ঘটেছে কবির সৃষ্টির ভুবনে বিরাজিত নারী চরিত্র চিত্রায়নে।বৈচিত্র্যের দিক থেকে রাবেন্দ্রীক নারী চরিত্র অসামান্যা। 

       এবার আসি দেনাপাওনার সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের পিতা রামসুন্দরের আদরের মেয়ে নিরুপমার কথায়। জমিদার রায়বাহাদুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পুত্রের সাথে নিজের সাধ্যাতীত পণ দিয়ে একমাত্র সুন্দরী কন্যা নিরুপমার বিয়ে দিতে রাজি হন রামসুন্দর।শাশুড়ির কাছে নিরুপমার রূপ অপেক্ষা পণের অর্থই বেশী প্রাধান্য পেয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলি কবির কন্যা মাধুরীলতার স্বামী শরৎবাবু ছিলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ।বেশ মোটা অঙ্কের যৌতুক দিয়ে কন্যা মাধুরীর বিবাহ দেন কবি।স্বামীর ভালোবাসা পেলেও নিঃসন্তান মাধুরীলতা শ্বশুরালয়ে শাশুড়ির কাছে নিগৃহীতা ছিলেন।তিনি অতি অল্প বয়সেই যক্ষা রোগে আক্রান্ত হয়ে শ্বশুরালয়ের অবহেলায় অকালেই মারা যান।কবির সাথেও মাধুরীলতার শ্বশুরবাড়িতে যথেষ্ট শীতল ব্যবহার করা হত।তাঁকে বাইরের ঘরে দীর্ঘক্ষণ কন্যার সাথে দেখা করার অনুমতির জন্য অপেক্ষারত থাকতে হতো। তারপর তিনি দেখা করার অনুমতি পেতেন আদরের কন্যা মাধুরীলতার সাথে।এই ঘটনারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে কবির লেখা দেনাপাওনা গল্পের মধ্য দিয়ে।

      হৈমন্তী চরিত্রটি নিরুপমার থেকে একটু অন্যরকম। সে যথেষ্ট ব্যক্তিত্বের অধিকারী।সে ছোটবেলায় মাতৃহীনা হয়ে পিতার ছত্রছায়ায় বড় আদরে মানুষ হয়েছে।এই হৈমন্তী চরিত্রের মধ্যেও মাধুরীলতার চরিত্র ফুটে ওঠে।সুন্দরী হৈমন্তী তার বাবার পরম স্নেহ ভালোবাসায় পাহাড়ের কোলে মুক্ত পরিবেশে মানুষ হয়েছে।তার বাবা গৌরসুন্দর যেনো কবিরই প্রতিচ্ছবি।এখানে বাবা-কন্যার স্নেহ ও বন্ধুত্বের সম্পর্কের মাঝে কবি ও কবিকন্যার সুমধুর সম্পর্ক প্রতিফলিত হয়।

      গৌরসুন্দর বাবু বিবাহের পণে টাকা না দিতে পারায় স্বামী অপু হৈমন্তীকে ভালোবাসারেও শ্বশুরালয়ে অবহেলার শিকার হয় তরুণী হৈমন্তী।গৌরসুন্দর বাবু সম্পর্কে অপুর বাবা-মার ধারনা ছিলো হৈমন্তীর বাবা ধনী ও বড়চাকুরে।কিন্তু সে যে মিছে ভাবনা যার জন্য পণের টাকার।

সে যে মিছে ভাবনা হৈমন্তীর বাবা যে তাদের আশানুরূপ বড়লোক নন।এ বিষয় রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ছিলো।এর কারণ কবি গুরু জমিদার হলেও ঠাকুর বাড়ির সকল সম্পত্তি দিয়ে কবি তার প্রাণের প্রতিষ্ঠান শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা করেন।আর তাঁর জন্য সামান্য অর্থই রেখে ছিলেন কবি। কবির মানস কন্যা হৈমন্তীর মত তাঁর নিজ কন্যা মাধুরীলতাও বড় হয়ে উঠেছিল শিলাইদহের সুন্দর মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে স্বাধীনভাবে।

      নিরুপমার থেকে হৈমন্তী দৃঢ় স্বভাবের।সে সবকিছু হেসে উড়িয়ে দিলেও অপমানের কন্টক শয্যায় শায়িত থাকার ফলে ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ে।এক সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে এই প্রবল আত্মবিশ্বাসী নারী।

       হৈমন্তীর জীবদ্দশায় সে প্রত্যাহিক নিপীড়নের থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি।যা সম্ভব হয়েছিলো স্ত্রীপত্রের মৃনালের দ্বারা।স্ত্রীপত্রের মৃনাল বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য সম্পদ।সে ছিলো অজপাড়াগাঁ থেকে আসা একটি সাধারণ মেয়ে---যার বাড়ি পূর্ববঙ্গের গ্রামে ।সে বাঙাল হওয়ায় তার রান্না করা বাঙাল খাবার নিয়ে তাকে শ্বশুরালয়ে অনেক কথা শুনতে হতো।এখানে কবি পত্নী মৃনালিনীর চরিত্র চিত্রায়িত হয়েছে কবির লেখনীতে।ঠাকুর বাড়ির অন্দরমহলে কবি পত্নী বাংলাদেশের মেয়ে বলে প্রায়ই তাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে।


      জমিদার বাড়ির মেজোবৌ মৃণাল ছিলো অপূর্ব সুন্দরী।সেটা তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন ভুলে গেলেও এটা তারা ভুলতে পারেনি যে মৃনাল বুদ্ধমতী। মৃণাল ছিলো সহজ স্বাভাবিক বুদ্ধির অধিকারী।তাই সে অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেই তাকে শ্বশুরবাড়িতে প্রতি পদে হেয়েও করার চেষ্টা চলতো।সে তার প্রতিবাদ স্বত্তাকে বজায় রেখে নিরাশ্রয় মেয়ে বিন্দুকে আশ্রয় দেয়।মৃণালের শ্বশুরালয়ের লোকেরা বিন্দুকে এক পাগলের সাথে বিয়ে দিয়ে বাড়ি থেকে তাড়ায়।বিন্দু সেখান থেকে পালিয়ে এলে বাড়ির লোকের সাথে রীতি মত যুদ্ধ করে মৃণাল তাকে আশ্রয় দেয়।শেষপর্যন্ত অপমানিত,লাঞ্ছিত বিন্দু আত্মহত্যা করে ।নারীর অবস্থান যে কতটা দুর্হ এ সংসারে তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে মৃণাল। এক সময় সাংসারিক বন্দীদশা থেকে মুক্তির পথ বেছে নেয় মৃণাল পুরীর তীর্থক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে।তৎকালীন বাঙালি ঘরের এক গৃহবধূর এহেন সাহসী পদক্ষেপ সত্যিই চমকপ্রদ ছিলো ।মৃণাল আত্মহত্যা করে নয় স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে চেয়েছে তীর্থক্ষেত্রের উদ্দেশ্য রওনা হয়।

বিশ্ব কবিও তাঁর গল্প, কবিতা,উপন্যাসে তাঁর সৃষ্টি মানস কন্যাদের মুক্তির পথ অন্বেষণ করেছেন।নারীর নারীত্বের মূল্যায়ন কি শুধুই পণের অর্থেই করা চলে? সে কি সংসারের যাঁতাকলে সারা জীবন পিষ্ঠ হয়েই চলবে? তার চিন্তার,ইচ্ছা-অনিচ্ছার, প্রেমের ভালোবাসার, ভালোলাগার, সর্বোপরি এ সমাজে কি নারী তার স্বাধীন সত্ত্বা নিয়ে বাঁচতে পারবে না কখনো?    

        নারীকে রাঁধার পর খাওয়া আবার খাওয়ার পর রাঁধা সংসারের এই মনস্তত্ব থেকে মুক্ত হতে হবে।আর এ কাজের জন্য তাকে শিক্ষা,চেতনে, মননে,শৈল্পিক ধ্যান ধারায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে।স্বাধীন ভাবে অধিকার তাকেই ছিনিয়ে নিতে হবে সমগ্র বিশ্বের কাছ থেকে।

        কবির লেখা উপন্যাস "অপরিচিতা'র" কল্যাণী খোঁজ করে স্বাধীন ভাবে বাঁচার পথের। এই উপন্যাসে আমরা দেখতে পাই ডাক্তার পিতা শম্ভূনাথ তার মাতৃহীনা শিক্ষিতা সুন্দরী আদরের কন্যা কল্যাণীকে নিয়ে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তরে থাকেন।তারা বাবা ও মেয়ে দুজনেই দৃঢ় মনোভাবের মানুষ। 

        ডাক্তার পিতা শম্ভূনাথ তার একমাত্র আদরের কন্যার বিবাহে পাত্রপক্ষের ইচ্ছা অনুযায়ী যৌতুক দিতে রাজি হলেন।যথা সময়ে বিয়ের দিন পাত্রের মামা যখন কল্যাণীর গা থেকে সব গহনা খুলে মেপে দেখতে চান যে পরিমান গহনা তারা চেয়েছেন তা যথাযথ আছে কি না?তখন তিনি দেখেন পাত্রীর পিতা তাদের চাহিদা অপেক্ষা বেশী পরিমান গহনাই দিয়েছেন।এই সব দেখে শম্ভূনাথ পাত্রপক্ষকে জানান "আমার কন্যার গহনা আমি চুরি করিব এ কথা যাহারা মনে করেন তাহাদের হাতে আমি কন্যা দিতে পারি না।"মেয়ের বিয়ে না দিয়ে তিনি পাত্রপক্ষকে বিয়ের আসর থেকে বিদায় করে দেন।

       কল্যাণীর যে পাত্রের সাথে বিবাহ ঠিক হয়েছিলো সেই পাত্র অনুপম মা ও মামার বড়ই সুবাধ্য ও ভালোমানুষ ছিলো।তার সাথে কল্যাণীর বিবাহ না হলেও সেই কল্যাণীর খোঁজ শুরু করে অবশেষে সে যখন কল্যাণীর সন্ধান পায় তখন কল্যাণী নারী শিক্ষার ব্রত গ্রহণ করেছে।কল্যাণী অনুপমের সাথে আর বিবাহের বন্ধনে আবদ্ধ হতে চায় না।তখন অনুপম কল্যাণীর সাথে সামাজসেবামূলক কাজে সহযোগী হয়।

        শোনা যায় কবির ছোটমেয়ে মীরাদেবীর বিবাহের দিন এই রকম একটি গন্ডগোল হয়েছিলো।মীরাদেবীর স্বামী ছিলেন উদ্ধত প্রকৃতির মানুষ। তিনি বিবাহের আসরে কবির সাথে দুর্বিনিত আচারন করেন।বিয়ের আসরে স্বংয় রবীন্দ্রনাথের সাথে এই রকম অভদ্রতা ও পরর্বতিতে মীরাদেবীর সাথে দুর্ব্যবহার এর ফলে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে।মীরাদেবীর অসুখী দাম্পত্য জীবন পিতা রবীন্দ্রনাথকে প্রায়ই পীড়া দিত।তিনি ভাবতেন সেই আসরই যদি তিনি কন্যার বিবাহ বন্ধ করে দিতেন তাহলে এ যন্ত্রনা তাঁকে ও তাঁর কন্যাকে সহ্য করতে হতো না।সেই ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটেছে "অপরিচিতা" উপন্যাসে।

         কল্যাণী নারী শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের ও অন্যান্য অনেক নারীর মুক্তির পথ খুঁজেছে ।কিন্তু নারী মুক্তির পথ কোথায়? প্রেম,ভালোবাসা,ঘর,সংসার,ধর্ম না সমাজসেবায়? না কি উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে স্বাধীনভাবে বাঁচার?তার জন্য "পয়লা নম্বরে" অনিলা স্বামীর ঘর ছেড়েছে---স্বাধীনভাবে বাঁচার আশায়।

          অনিলার স্বামী অদ্বৈত ছিলো স্ত্রীর প্রতি উদাসীন। সে সব সময় তার পড়াশুনা,বন্ধুবান্ধব নিয়ে ব্যস্ত।সংসারের আয়ব্যায়,অভাব অভিযোগ কোনো কিছুতেই তার মন নেই।কয়েকজন শিষ্য গোছের বন্ধুদের নিয়ে সে ব্যস্ত।অনিলার পাশের বাড়ি ---গলির ঠিক মোড়ে পয়লা নম্বর বাড়িতে বাস করতো সুদর্শন ধনী জমিদার সীতাংশুমৌলী।যে অনিলার প্রেমে পড়ে ।তাকে চিঠি পাঠায়।কিন্তু অনিলা সে চিঠির কোনো উত্তর করে না।ইতি মধ্যে অনিলার একমাত্র ভাই আত্মহত্যা করে।অনিলার উদাসীন স্বামী অদ্বৈত সে খবরও রাখে না।চরম মনোবেদনায় অনিলা একদিন গৃহত্যাগ করে।অদ্বৈত মনে করে সে সীতাংশুর সঙ্গেই চলেগেছে।এর অনেক বছর পর অদ্বৈত জানতে পারে সেদিন অনিলা সীতাংশুর সাথে সংসার ছেড়ে চলে যায়নি।অদ্বৈতর চরম উদাসীনতায় প্রবল মনোবেদনায় নিজের স্বাধীন ইচ্ছায় অনিলা সেদিন ঘর ছেড়ে ছিলো। অনিলা একরকম দুটি চিঠি অদ্বৈত আর সীতাংশুকে লেখে।সেখানে সে তার খোঁজ নিতে বারন করেছে একদিকে অদ্বৈত অপরদিকে সীতাংশুকে।

          রাবেন্দ্রীক সাহিত্য চর্চার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাঠককে বোঝাতে চেয়েছেন শিক্ষা,স্বাধীনতা আর নিজগুণে প্রতিষ্ঠিত জীবনে রয়েছে প্রকৃত মুক্তির আস্বাদ। আমারও তাই রবীন্দ্র রচনাবলীতে পেয়েছি একজন স্বাধীন মানুষ হিসাবে এ বিশ্বসংসার মাঝে নারীর তার নিজ আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার বাস্তব প্রয়াস।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ