দর্পণ || গল্প || বুলেট-আংটি ~তসলিম পাটোয়ারী




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

বুলেট-আংটি 

তসলিম পাটোয়ারী


ও বাজানরে..বাজান, বেবাক মাইনষে হিরা আইলো, তুই আইলি না রে বাজান.., মা'র কতা মনে হড়ে না তোর.., তুই বড়ো পাষাণরে..,তুই বড়ো পাষাণ। 


মায়ের এই বিলাপ সইতে পারে না জেবুন্নেছা। সে খেপে উঠে মামুনকে থাপ্পড় মারে। চোখ রাঙিয়ে বলে, পাজি, এত্তো কইরা কই মুক্তিযুদ্ধের গান গাইছ না, মুক্তিযুদ্ধের কতা বা গান হুনলেই মা'র ছন্নতা বাড়ে, আবোলতাবোল কয়, বুঝছ না কা? ফাজিল! 


কাল স্কুলে বিজয় দিবস পালিত হয়েছে। তার রেশ কাটেনি মামুনের। সে ক্ষণে ক্ষণে গেয়ে উঠে, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা, আমরা তোমাদের ভুলব না..। ঘরের কোণে আলোআঁধারির মাঝে চৌকিতে শুয়ে থাকা মায়ের কানে যায় সে গান। বাড়ে মায়ের আনচান, বিলাপের টান। 


দশ বছরের মামুন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিল দেড় বছরের। এখন বুবুর হাতের লাঠি। বুবু আদরও করেন বেশি, বাঁদরও বলেন বেশি। তাই বুবুর চড় থাপ্পড় কানমলা চুলটানা হেসে উড়িয়ে দিয়ে ফের বুবুকেই মামুন জিজ্ঞেস করে মুক্তিযুদ্ধের কথা, মিয়াভাইয়ের কথা। বুবুর কাছে শুনে শুনে মিয়াভাই শহীদ মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম বাচ্চুকে কল্পনা করে সে, শ্রদ্ধাভরে মাথা নত করে বীরশ্রেষ্ঠ, বীরউত্তম, বীরবিক্রম, বীরপ্রতীক, বীরমুক্তিযোদ্ধাগণের প্রতি। 


বাচ্চুরা একাত্তরে ক্লাস টেন পড়ছিলো। শুরু হয় বাঙালির গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ। বাচ্চুরা ঝাঁপিয়ে পড়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে। নয়টি মাস ধরে তাঁরা গ্রামে গঞ্জে শহরে বিজয়ী হয়, প্রতিরোধ গড়ে, তাড়িয়ে চলে পাক-হানাদার বাহিনী। কিন্তু বিজয়ের প্রাক্কালে কমান্ডার শফিক উদ্দিন নিয়ে আসেন দুঃসহ দুঃসংবাদটা। বাচ্চুর মা বাজানরে বলে গগনবিদারী একটা চিৎকার দিলেন, তারপর হো হো করে হেসে উঠলেন, বলা শুরু করলেন কথা। কতো কথা, সে কথা আর থামলো না। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি কথা: অ বাপ আজান দিছে উইড্ডা যা, অ বাচ্চু ইসকুল যাইতি না- ভাত অইছে- ডুব দিয়া আয় বাপ, রাইত অইছে হুইয়া থাক মনা। মা দেখতে পান বাচ্চুকে, জেবুন্নেছা দেখতে পায় না মিয়াভাইকে। 


মাঝেমধ্যে গভীর রাতে বাচ্চু এসে দেখা দিয়ে যেতো, বেঁচে আছে জানিয়ে যেতো। তার কাঁধে থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, মাথায় বাঁধা গামছার উষ্ণীষ। জেবুন্নেছা ছুঁয়ে দেখতো রাইফেলটা। একদিন সে দেখলো মিয়াভাইয়ের আংটিটা। অপূর্ব সুন্দর রূপার আংটি। কারুকাজ করে আংটির পিঠে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ক্ষুদ্র এক বুলেট। বিলের মাঝখানে গ্রাম্য বাজার পিংরাবাজার, মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের পাশে। সেখানে মাঝেমধ্যে চা খেতে বসতেন বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ। পাশেই ছিল স্বর্ণকারের দোকান। যুদ্ধের স্মারক এবং বাজারের স্মৃতি স্বরূপ সবাই একটি করে অনুরূপ আংটি বানিয়ে নেন তারা। জেবুন্নেছার খুব পছন্দ হয় আংটিটা। মিয়াভাই তা খুলে দিয়ে বলেন, আংটিডা লগে থাকলে সাহস বাড়ে রে জেবু, ধর, যত্ন কইরা রাহিছ। 


স্বাধীনতার পরপর গাছের বুকে, টিনের চালে, ঘরের জানালায়, দরজার পাল্লায় বিদ্ধ বুলেট পাওয়া যেতো। বাড়িতে, মাটিতে, জমিতে, পথে প্রান্তরে, পাওয়া যেতো বুলেট ও বুলেটের খোল। ওসব পেলে অনেক কিশোরকিশোরী জেবুন্নেছার আংটির মতো আংটি বানিয়ে কিংবা লকেট বানিয়ে পরতো। কিন্তু জেবুন্নেছার আংটিটা আলাদা, চকচকে, চন্দ্রকান্তি দ্যুতি ছড়ায়। মামুনের ভাষায় এটি বুলেটআংটি। সে টানাটানি করে পরার জন্য। জেবুন্নেছা বলে, বড়ো অইলে পরিছ, থাক অহন আমার হাতেই, এইডা মিয়াভাইয়ের স্মৃতি, এইডা দেখলে আমি মিয়াভাইরে দেহি। জানছ কী সোন্দর আছিল মিয়াভাই? মাঝারি সাইজ, শ্যামলা বরণ, সুঠাম শরীল, হাসিখুশি। বেকে পছন্দ করতো মিয়াভাইরে। মামুন বলে উঠে, ইস বুবু, তহন যদি বড়ো থাকতাম, মিয়াভাইর লগে আমিও যাইতাম, একটা অইলেও পাকিস্তানি মেলিটারি খতম করতাম; শালারা আমগো ত্রিশ লক্ষ মানুষ মারছে, দুই লক্ষ মা বইনরে বেইজ্জতি করছে, বাড়িঘর লুটতরাজ করছে, পোড়াইছে, এক কুটি মানুষেরে ভারতে শরনার্থী করছে। জেবুন্নেছা হাসে, অইছে, বড়ো অইয়া ল, দেশের বহুত শত্রু আছে; কম্বল চোর, রিলিফ চোর, গদি চোর, ধর্মের লেবাসধারী, অভাব নাই কোনোডার, তাগরে খতম করিছ। 


স্বাধীনতার পর আট বৎসর যায়। মা'র প্রলাপ কিছু কমে। মা এখন বকেন সজ্ঞানে। বুঝেন বাচ্চু নেই। থাকলে সে ফিরে আসতো, পুত্রবধূ হয়ে আসতো পাশের বাড়ির ফর্সা মিষ্টি মেয়ে আঙ্গুরী। ওদেরকে দেখে মা মুখ টিপে হাসতেন। কী সুন্দর লাগতো দুজনকে। ওরা হাসতো খেলতো বেড়াতো। মা বলতেন, আঙ্গুরীরে ই রাইখ্যা দিমু বাচ্চুর লাইগ্যা। সেই আঙ্গুরী শশুরবাড়ি যাওয়ার আগে এসেছিল বাচ্চুর মা'কে সালাম করতে। বর্ষার আকাশেও এতো জল ছিল না আঙ্গুরী ও বাচ্চুর মা'র চোখ বেয়ে ঝরেছিল যতো জল। 


এখন জলে ভরা থাকে জেবুন্নেছার আঁখি। বাবা শয্যাশায়ী, মা এলোমেলো, মামুন ছোট। জায়গাজমি নেই বললেই চলে। অথৈ সাগরে ভাসছে তারা। দিগন্ত হতে মাস্তুল উঁচিয়ে উঠে আসা জাহাজের মতো একটি একটি করে উঠে আসে চাহিদা, অন্ন বস্ত্র চিকিৎসা শিক্ষা। কান্ডারি জেবুন্নেছা। সে দিনরাত ভাবে, কী করবে। কয়েকটা ছেলেমেয়ে পড়িয়ে চলা যায় না। বিলের জমি গেছে। মায়ের কুন্ডল, হাতের রুলি, গলার হাঁসুলি সব গেছে। এখন সামান্য যে জমি আর বাস্তুভিটা আছে তাও যাবে। কঠিন যুদ্ধ জেবুন্নেছার। এ যুদ্ধে পরাস্ত হলে সব শেষ- বাবা, মা, ছোট ভাই এবং নিজে। 


একসময় জেবুন্নেছাদের সব ছিল। সোনালী ধানের ক্ষেত, প্রভাতের লাল সূর্যের প্রথম চুম্বনে বনবিথী আর পুস্পের হাসি, পুকুরের জলে শাপলার পদ্মের কলমির নাচন, কুহু কূজনে থৈথৈ বসন্ত, অবারিত জোছনায় প্লাবিত আঙিনা, সব ছিল। মাথায় হাত রাখার মতো বড়ো ভাই ছিলেন, বুকে আগলে রাখার মতো মা ছিলেন, ছায়াদানকারী শক্ত-সামর্থ্য বাবা ছিলেন। আজ সব মায়া মরীচিকা। 


জেবুন্নেছার বাবা চাঁদপুর শহরে একটি বাড়ির কেয়ারটেকার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় সে বাড়ির সবাই জান নিয়ে ত্রিপুরা চলে যায়, স্বাধীন হওয়ার পর ফিরে আসে। কিন্তু দৈন্যের দায়ে তারা বাড়িটি বিক্রি করে দেয়। ফলে বাবার চাকরি শেষ হয়। তারপর বাবা মহামায়া বাজারে মুদি দোকান করেন। একদিন আগুন লেগে বাজারটি ছাই হয়ে যায়। বাবা সব হারান। জ্ঞান ফিরলে হারান মাথা, মুখ, ডান হাত, বাম পা। এখন তার মুখ বাঁকা, কথা অস্পষ্ট, থরথর কাপে দেহ। একটু বসতে চান ঘাটলায় গিয়ে, পারেন না, ফিরে যান শয্যায়, লম্বা হয়ে শুলেই আরাম। তবুও বাবা যখন ঘর থেকে বের হন লাঠি ঠুকে ঠুকে, জেবুন্নেছা বাবার দিকে চেয়ে থাকে বিস্ময়ে। কী মনোবল বাবার, শরীর ভেঙেছে তবু যেন মন ভাঙেনি। জেবুন্নেছা বুক বাঁধে, বাবাকে দেখে হিম্মত আনে বুকে। 


চাচা ও আত্মীয় স্বজন অনেকে অনেক সম্বন্ধ এনেছিলেন, কিন্তু জেবুন্নেছা রাজি হয় নি। বাবা অনুমান করেন মতলবগঞ্জের ঐ মাস্টার ছেলেটাকেই বুঝি পছন্দ করে মেয়েটা। বাবার তখনই ইচ্ছা করে উড়ে যান ছেলেটার কাছে। গিয়ে বলেন, আমার আদরিনীকে তুমি নিয়ে যাও বাবা। বাবা জেবুন্নেছার মাথায় হাত রেখে বলেন, মা রে তুই নিজে নিজে তোর সংসারখান পাততি পারস না, মা। জেবুন্নেছা বলে, পারি বাবা, এট্টু সবুর করো, একটা কাম কাইজের ব্যবস্তা অউক আগে। বাবা উপরের দিকে তাকান। কী করবে এতোটুকু মেয়ে। বিএ পাশ, এমএ পাশ ছেলেমেয়েরাই বেকার, আর সে তো মাত্র এইসএসসি পাশ। তবু থাকতো যদি হিতৈষী কেউ, আয়া বুয়া পিওনের একটা চাকরি হয়তো পেয়ে যেতো সে। 


কয়টা বাচ্চা পড়ানো আর ক্ষেত লাগানোর সামান্য টাকায় চলছে জেবুন্নেছারা। মামার বাড়ির ওয়ারিশও আনা হয়ে গেছে। মামাদেরও সাহায্য করার মতো অবস্থা নেই। জেবুন্নেছার ঘুম হয় না। কী করে বাঁচবে সবাই। মামুন স্কুলে ভালো ছাত্র, এখন চতুর্থ শ্রেণিতে। ছেঁড়া মলিন শার্টপ্যান্ট পরলে ওর মুখখানাও মলিন হয়ে যায়। বুবুকে বলেছে সে, বুবু এইবার শার্টপ্যান্ট দিবা। লজ্জায় কেঁদেছে বুবু। একটা শার্টও যদি না দিতে পারে ছোট ভাইকে, তবে আর বড়ো হওয়া কেন? জেবুন্নেছা তবুও দিতে পারেনি। হয়তো সেই খেদে মামুন একদিন উধাও হয়ে যায়। টেবিলের উপর বইগুলো যত্ন করে রেখে যায়। যেন ব্যর্থ রাষ্ট্রশাসকের কাছে এক বস্তা বিদ্যা সমর্পণ করে চলে যায় ভিন্ন কোনো জনবাদী দেশে। 


যে যেখানে বলেছে মামুনকে সেখানেই খুঁজেছে জেবুন্নেছা। শেষ বিকালে বাড়ির পাশের এক বৃদ্ধ বলেন, মহামায়া বাজারে মামুনের মতো একটি ছেলেকে তিনি দেখেছেন এক রেস্টুরেন্টের সামনে টিউবওয়েল চাপতে। অমনি দৌড় জেবুন্নেছার। বৃদ্ধের অনুমান ঠিক হয়। 'ভাই ভাই হোটেল' এর সামনে বুবুকে দেখেই মামুন ঝাপিয়ে পড়ে বুবুর কোলে। অঝোর ধারায় ঝরে জেবুন্নেছার চোখের জল। মামুন বলে, বুবু, এই হোটেলেই কাম করছি সারাদিন। জেবুন্নেছা খিঁচে চড় মারে মামুনকে, তারপর নিজেই কেঁদে উঠে, বুকে চেপে ধরে ওকে। মামুন বলে উঠে, বুবু, কাম না করলে আমরা বাচুম কেমনে? জেবুন্নেছা আরো জোরে চেপে ধরে ভাইকে। 


বাবা অস্পষ্ট দৃষ্টি মেলে হাতড়ে ফিরেন ফিরে পাওয়া ছেলেকে। সর্বংসহা মাটিতে হাতের লাঠিখানা চেপে ধরেন। মাথা তার ঘুরে পৃথিবীর মতো জোরে। এইটুকু ছেলে গেছে কাজে! তিনি অস্পষ্ট উচ্চারণে চিৎকার করে উঠেন আল্লারে, আমার মরণ হয় না কা। জেবুন্নেছা বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে, চুপ করো বাবা। 


জেবুন্নেছার কথা আলাদা। সে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার বোন। কোনো না কোনো ঘরের ছেলে বা মেয়ে পড়ে তার কাছে। পাড়ায় তার সন্মান আছে। কিন্তু সমাজ? নিজেদের এলাকা তবু গ্রামের রাস্তায় মেয়েরা চলতে পারে না। ছেলে বুড়ো সবাই যেন মেয়েদেরকে গিলে খায়। শিক্ষিত অশিক্ষিত সব যুবক রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, সুরে বেসুরে গান গায়। সংসারের চিন্তা নেই ওদের। ইচ্ছা হলে ওরা বাবার সাথে ক্ষেতে খামারে যায়, নয়তো আড্ডাবাজি করে বেড়ায়। আড্ডার চমৎকার ক্ষেত্রও তারা পেয়ে যায়। সারাদেশে মফস্বল শহরগুলিতে জমজমাট মেলা বা এক্সিবিশন বসে। এক্সিবিশনের অনুষঙ্গ জুয়া, হাউজি, যাত্রা, লটারি, প্রিন্সেসদের উদাম নর্তন কুর্দন। টাকা লাগে তা উপভোগ করতে। কে দেবে টাকা? মানি ইজ নো প্রবলেম। টাকা দেবে গৌরিসেন। হাড়জিরজিরে অসহায় বাবারাই গৌরিসেন। গোলার ধান, গোয়ালের গরু, ছাগল ভেড়া হাঁসমুরগি, সব যায় এক্সিবিশনে। তারপর মায়ের, বউয়ের, হাত কান গলা যায়, রাজপথের পথিকের পকেট যায়। বাপের বাড়ি গিয়ে হাত পাতে মেয়ে। সে হাত পুড়ে যায় বাবা মা'র অভাবের আগুনে। এমনও ঘটেছে যে, স্বামীকে টাকা নিয়ে দিতে না পারায় একদিন মেয়েকেই ফিরতে হয়েছে বাপের বাড়ি চিরতরে। 


এমন গজব কেনো এলো দেশে? বৈশ্য দেশের দস্যুরা এদেশ লুট করেছে, দেশে চরম অভাব হয়েছে, তবুও স্বভাব খারাপ হয়নি বাঙালির, উচ্ছৃঙ্খল হয়নি বাঙালি। মদ জুয়া হাউজি-ফাউজি জানা ছিল না কারো। আজ বৃদ্ধের চোখে করুণ প্রশ্ন, বুদ্ধিজীবীর গালে হাত, মোল্লা মৌলবী হতবাক। শুধু ক্ষমতায় থাকার জন্য জাতির পায়ে এমন কুড়াল মারা! হুর-পরী শরাবের প্রস্রবণ দেখিয়ে যুব শক্তিকে আন্দোলন বিমুখ রাখা! পায়ের নখকুনিতে সৃষ্ট ক্ষত এখন মাথা অবধি ছড়িয়েছে। নষ্ট করা হয়েছে যুব সমাজকে। অথচ রাজধানী থেকে রেডিওতে ভেসে আসে ভাষণ, গোয়েবলসীয় ভাষণ। 


সেনগাঁও গ্রামে কাগজ আসে না, চাচার রেডিওই ভরসা। ভাগ্যিস চাচাজান বিয়েতে এটি পেয়েছিলেন। নতুবা কান কথাই হতো খবরের উৎস। কিন্তু সময় মতো রেডিওর খবর শুনতে পায় না জেবুন্নেছা, রেডিওর ব্যাটারি থাকেনা বলে। চাচা চাঁদপুরে জুটমিলে কাজ করেন। নাইট ডিউটি তার। তার টর্চের ব্যাটারি পুরনো হলেই আসে রেডিওতে। কিন্তু খবর কই? চাকরি বাকরির খবর নেই, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের প্রসঙ্গ নেই। আছে শুধু ভাষণ আর প্যানর প্যানর ঘ্যানর ঘ্যানর- বড়ি নিন, কনডম নিন, দুটি সন্তানই যথেষ্ট, পরিবার পরিকল্পনা গ্রহন করুন। ছোটদের কানে বড়োদের কথা, শরম কথা। আর আছে ইরানে ইসলামি বিপ্লব, আফগানিস্তানে রুশ আগ্রাসন, চাদে গৃহযুদ্ধ, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধ। 


এমন নৈরাজ্যকর সময়ে জেবুন্নেছাদের হেডস্যার খবর পাঠালেন, জেবুন্নেছাদেরই জুনিয়র গার্লস হাইস্কুলে গণিতের একজন জুনিয়র শিক্ষিকা নেওয়া হবে। যোগ্যতা বিএসসি, তবে অভিজ্ঞ প্রার্থীর বেলায় শিথিলযোগ্য। বুক বাঁধে জেবুন্নেছা। এসএসসিতে গণিতে তার লেটার মার্কস আছে। অনেক দিন থেকেই সে নিজের ঘরে সিক্স টু এইট কয়েকটি ছেলে মেয়েকে সকল বিষয় পড়িয়ে আসছে। এটি তার অভিজ্ঞতা। সে আবেদন করবে, এই অভিজ্ঞতা উল্লেখ করবে। 


হিতৈষীরা বলেন, তোমার স্কুল, তুমি এই গ্রামের মেয়ে, শহীদ মুক্তিযোদ্ধার বোন, কর্তৃপক্ষের সহানুভূতি তুমিই পাবে। হেডস্যারের ছাত্রী জেবুন্নেছা। স্যার বললেন, আবেদন করো, আমি দেখছি। কেউ কেউ বললেন, আল-আমিন মিয়া নয়া সমাজহিতৈষী, সবখানে ওনার হাত আছে, ওনাকে ধরো, হেডস্যারের থেকেও ওনার দাপট বেশি। জেবুন্নেছা যায় তার কাছে। তিনি বলেন, চেষ্টা করবেন। জেবুন্নেছা খুশি হয়। বাবা দোয়া মাঙেন, অউক মা অউক, মাস্টোরি বড়ো সম্মানি পেশা, সব পেশার সেরা পেশা। 


মামুন উল্লসিত। মা'কে বলে, মা বুবুর চাকরি অইবো, আমগো আর অভাব থাকতো না, কাপড়চোপড় বই খাতা কোনডার না। জেবুন্নেছা মামুনের মাথায় হাত বুলায়, হ রে পাগল হ, আগে অউক। ছোট ছোট টিলার মতো ছোট ছোট স্বপ্ন জেবুন্নেছার। মাস্টারি ও টিউশনি দিয়ে সে সংসার চালাবে, বিএসসি পড়বে, বিএড পড়বে, একদিন সংসারী হবে। সে নামাজ পড়ে, কোরান পড়ে, মোনাজাত ধরে, ইন্টারভিউর জন্য তৈরি হয়। 


ইন্টারভিউ হয়। হেডস্যার বলেন তোমার ইন্টারভিউ ভালো হয়েছে জেবু, তবে একজন বিএসসিও আছে, তারও ভালো হয়েছে। জেবুন্নেছা হাল ছেড়ে দেয়। কিন্তু ক'দিন পরেই হেডস্যার জানান ঐ মেয়েটি শহরের একটি স্কুলে যোগ দিয়েছে, এখন তোমার ভাগ্য, আল্লা আল্লা করো, দেখা যাক, আমি লেগে আছি। 


সময় গড়ায়, জেবুন্নেছার মোনাজাত বাড়ে। কেউ কেউ বলেন, দিনকাল বড়ো খারাপ জেবুন্নেছা। এখন আল্লাও লাগে ইল্লাও লাগে। তুমি বরং শিক্ষা অফিসের সাথে যোগাযোগ রাখো। জেবুন্নেছা মেনে নেয়, সব মানুষ সোজা নয়, কারো কারো মন গলাতে হয়। কিন্তু তার তো চুলা ই জ্বলেনা, মন গলাবে কী দিয়ে। আল-আমিন মিয়া বলেন, হেই চিন্তা আমার, তুমি শুধু আমার লগে সদরে চলো, তোমারে একবার দেখলে, আর তুমি শহীদ মুক্তিযোদ্ধার বইন জানলে, শিক্ষা অফিস নরম অইবো। 


জেবুন্নেছা নির্ধারিত দিনে আল-আমিন মিয়ার বাড়ি যায়। দরজায় টোকা দেয়। আল-আমিন মিয়াই দরজা খোলেন। সালাম দেয় জেবুন্নেছা। আল-আমিন মিয়া চোখ রগড়াতে রগড়াতে বলেন, ওয়ালাইকুম সালাম, অ-তুমি, বইয়ো, কেবল হুইছিলাম, কাইল রাইতভর একটা সালিশ বৈঠক করছি তো। 


এই প্রথম নয়। একটুকরো চাকরির আশায় জেবুন্নেছা আরো কয়েকবার এসেছে আল-আমিন মিয়ার বাড়ি। কিন্তু আজ বাড়িটা কেমন নিরব, জনশূন্য। জেবুন্নেছা ভাবী ভাবী বলে ডাকলেও ভাবীর বা বাচ্চার কোনো সাড়াশব্দ পেল না সে। সে ইতিউতি চায়। তার গা ছমছম করে উঠে। আল-আমিন মিয়া খিড়কি পুকুরে হাত মুখ ধুয়ে আসেন। এসে বলেন, শিক্ষা অফিসে গিয়া হুনলাম, তুমি এক নম্বরে আছো, তাইলে আর তদবির দরকার নাই, লেমু বেশি চিপলে তিতা অইয়া যায়। জেবুন্নেছার অন্তরে আনন্দ দোল খায়। সে চোখ বন্ধ করে, অন্তর্দৃষ্টি মেলে দেখতে থাকে উপরওয়ালাকে। 


কিন্তু আল-আমিন একদৃষ্টে চেয়ে থাকেন জেবুন্নেছার দিকে। ছিমছাম জেবুন্নেছা, সাজগোছ নেই তবু হুর-পরী, ভুরু ললাট কপোল চিবুক অপূর্ব, শাপলা ফুলের অন্তস্থ পাতলা পাপড়ির মতো ঠোঁট, সরু নাক, মেঘবরণ চুল, দামিনী চমকিত সীমন্ত, পিঠে সর্পিল বেণী, চেকশাড়ি ছাপিয়ে উঠেছে তার দেহবল্লরী। আল-আমিন বলেন, বাহ্ তোমারে তো খুব সোন্দর লাগতাছে। আল-আমিন এগুতে থাকে জেবুন্নেছার দিকে। জেবুন্নেছা দাঁড়িয়ে যায়। সে এতক্ষণে আঁচ করতে পারে লোকটার উদ্দেশ্য। সে পিছনে সরতে থাকে। তার পিঠ ঠেকে যায় দেয়ালে। মুহূর্তেই দানবের থাবা পড়ে জেবুন্নেছার দুই বাহুতে। দানবের আচমকা টানে সে থেতলে যায় দানবের বুকে। তার পতাকারং শাড়ির আঁচল খসে যায় বক্ষ হতে। মহামানবের মহাশিশুর জন্য যে অমৃত আছে নারীর বক্ষে, তার সে অমৃত ভান্ড বুঝি ভেঙে যায়। দানবের নোংরা চঞ্চু তার পবিত্র ঠোঁট ঘষে যায়। জেবুন্নেছা দাঁতে দাঁত খিঁচে, সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সে দরজায় ঠাসা ডাঁসাটার দিকে তাকায়। একবার ধরতে পারলেই হলো। তখনই সে দেখতে পায় দরজায় তার মিয়াভাই। অপরাজেয় বাংলা ভাষ্কর্যের মাঝখানের বীরমুক্তিযোদ্ধা যেন মিয়াভাই। মিয়াভাই চেঁচিয়ে বলছেন, জেবু, গুলি কর, গুলি কর পশুটাকে, অস্ত্র আছে তোর হাতে। জেবুর সাহস বেড়ে যায়। সে ফোঁস করে উঠে। চোখ বিস্ফারিত করে ডান হাত মুঠ করে। ভেসে উঠে তার মধ্যমায় আংটির সেই বুলেট। জেবু বুলেট দিয়ে একের পর এক প্রচন্ড জোরে ঘুষি চালাতে থাকে পশুটার চোখে, মুখে, মাথায়।অতঃপর জেবুকে ছেড়ে দেয় পশুটা। সে দুহাতে আপন চোখ-মুখ বাঁচাতেই মরিয়া। তার মুখমণ্ডল বেয়ে ঝরঝর ঝরে রক্ত, নোংরা রক্ত। সে উহ্ বলে লুটিয়ে পড়ে জেবুর পায়। জেবু কষে পদাঘাত করে রাক্ষস মুখে। চিৎকার করে বলে শুয়রের বাচ্চা..,আমি শহীদ মুক্তিযোদ্ধার বোন! মুক্তিযুদ্ধ আমার শিরায় শিরায়! কে আছো, দেইখ্যা যাও তোমাগো হর্তাকর্তাবিধাতা, লাত্থি মাইরা মুখ ভাইঙ্গা দিছি তার। 


উন্মাদিনী জেবুন্নেছা, হাঁপাতে হাঁপাতে আসে বাড়ি। ধপাস করে বসে পড়ে বারান্দায় বিছিয়ে রাখা পাটিতে। বাবা জিজ্ঞেস করেন, কী অইছে মা? মা জিজ্ঞেস করেন ও জেবু কী অইছে তোর? কী উত্তর দেবে জেবু। কই, রাজা রামচন্দ্র, সিংহাসন ছেড়ে নেমে এসো গণমানুষের কাতারে, নিষ্পাপ অহল্যাকে ছুঁয়ে তার পাষাণত্ব অপনোদিত করো। জেবুর মুখ খুলে দাও। ওকে শোনো, ও বলছে, আমার সোনার বাংলা কয়টা নোংরা লোকের দ্বারা নষ্ট হতে পারে না, এসো তবে বাসযোগ্য, জনকল্যাণমুখী, শোষণমুক্ত স্বদেশ গড়ে তুলি, অবাক তাকিয়ে রবে বিশ্ব, তবেই শান্তি মিয়াভাইয়ের, মুক্তিযোদ্ধাগণের। 


বেঁচে থাকার নাম জীবনসংগ্রাম। কঠিন কঠোর দুর্গম বন্ধুর পথ সামনে। সেদিকেই একদৃষ্টে তাকিয়েছিল জেবুন্নেছা। কিন্তু তার চোখে পড়ে মামুন। সে দৌঁড়ে দৌঁড়ে আসছে। তার পিছনে পিছনে আসছে স্কুলের সেই বৃদ্ধ পিওন। মামুন চিৎকার করে বলতে বলতে আসছে, বুবু তোর চাকরি অইছে, বুবু তোর চাকরি অইছে, এই দেখ চিডি। জেবুন্নেছা গলা বাড়িয়ে এপোয়েন্টমেন্ট লেটারটা দেখতে পায়। তার চোখে আনন্দাশ্রু। সে মামুনকে জড়িয়ে ধরে, চুমোয় চুমোয় ভাসিয়ে দেয় তাকে। বিড়বিড় করে বলে, স্কুলের সব মেয়েরে আগে বুলেট-আংটি বানাইতে কমু।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ