দর্পণ || নির্বাচিত সাপ্তাহিক গল্প




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

গয়নার বাক্স 

(অণুগল্প )

জয়ন্ত অধিকারি 


"তোমার বাবার মত কিপটে লোক আমি দেখি নি। তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, তবুও তোমার মায়ের গয়নাগুলো নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। বলি ওগুলো নিয়ে কি স্বর্গে যাবে ? কয়েকদিন পরে নাতনীর বিয়ে। গয়নাগুলো তো দিয়েও দিতে পারে।" 


"এরকম করে কেন বলছ রোমা ? মা তো রুমকির বিয়ের জন্য কিছু গয়না দিয়ে গেছে। তোমাকে ও তো..." 


"শুনেছি ওই গয়নার বাক্সে তোমার মায়ের সাতনরি হার আছে। আর ও শুনেছি একটা জড়োয়ার নেকলেস ও আছে ! সেগুলো কে পাবে ? উনি যাওয়ার পরে তো আমাদের কাছেই আসবে। এখন দিয়ে দিতে কী হয় বাপু ? তুমি জানো ? মাঝে মাঝে তোমার বাবা ঘরের দরজা বন্ধ করে ওই বাক্সটা বের করে হারগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখে ! জানি...মায়ের স্মৃতি। তবুও...যাই হোক। শনিবার একটু আমাদের নিয়ে বেরতে হবে। রুমকির বিয়ের কিছু কেনাকাটা করতে হবে। "


মাস ছয়েক পরে বাবা মারা যাওয়ার পরে বাবার ঘরে বসে পুরনো জিনিসপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে গয়নার বাক্সটা দেখতে পেয়েই আমি ডাকি রোমাকে। রোমা মুখভর্তি হাসি, চকচক করতে থাকা বড় বড় দুটো চোখ নিয়ে তাকায় গয়নার বাক্সের দিকে। কানের পাশে ফিসফিস করে বলে, "খোলো, খোলো তাড়াতাড়ি। " ওর কথার মধ্যে চাপা উত্তেজনা, উল্লাস। 


সাবধানে আমি খুলি গয়নার বাক্সটা। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে মায়ের অল্পবয়সের একটা ফটো, আমার কয়েক মাস বয়সের রং উঠে যাওয়া জামা প্যান্ট। আর একটা সাদা রুমাল। রুমালের মাঝে মা নিজের হাতে সুঁচ সুতো দিয়ে লিখে দিয়েছিল, 'ভালবাসি'...


সমাপ্ত


(অণুগল্প )

লক্ষ্মীমন্ত

রত্না চক্রবর্তী 


এই পুরোনো পাড়ায় আসতে পুরোনো বাড়িতে বসে এতকালের বন্ধুর সস্থে আড্ডা দিতে অখিলবাবুর বড় ভালো লাগে। এখানে এলে তিনি যেন প্রাণ ফিরে পান। প্রায়দু-বছর হলো ওনারা নতুন পাড়ায় ফ্ল্যাট নিয়ে উঠে গেছেন। সাজানো গোছানো ঝকঝকে বাড়ি আকাশী-সাদা রঙের আকাশের কাছাকাছি অনেকটা, চারতলা! তবে মাটির থেকে অনেকটা দূরে। সুন্দর গাছ দিয়ে সাজানো লন কিন্তু সেই বাড়ির চেয়ে এই চার ভাড়াটে এক উঠান, শ্যাওলা ধরা কলতলা খুপরি  খুপরি  আধা-অন্ধকার ঘরের এই বাড়িই তাকে টানে বেশী। তাই তিনি প্রতিদিনই ছেলে-বৌ অফিস বেড়িয়ে যাবার পর এ বাড়িতে চলে আসেন, বিপুলের ঘরে। পাশাপাশি চল্লিশ বছর কাটিয়েছেন। বিপুলও তো অনেক দিন রিটায়ার করেছে।দুই নিস্কর্মায় মিলে বড় সুন্দর সময় কাটে। বিপুলের ভাগ্যটাও বড় ভালো,  এমন গুনী লক্ষ্মীশ্রী বৌমা পাওয়া ভাগ্যে থাকা চাই। বাড়িতে ফ্রিজে ঝোল তরকারী রাখা থাকে, খাওয়ার টেবিলে ভাত ঢাকা থাকে কিন্তু অখিলবাবু খান না। রোজই টিফিনকৌটো ভরে ভাত নিয়ে হাজির হন বিপুলের বাড়ি। বৌমার রান্না অমৃত। শুক্তো, এঁচোড়, মোচার ঘন্ট অমনটি এ যুগে কেউ পারবে না। কুঁচো-চিংড়ি দিয়ে লাউ যা বানায় মুখে লেগে থাকে। চালতার টকটা তো ঠিক তার মায়ের মত। আর বাপের বাড়ি অনেক দূরে, অবস্থাও তেমন ভালো নয় বলে বাপের বাড়ি যাওয়ার ঝামেলা নেই। নাতনীকে বিপুলই ইস্কুলে দিয়ে আসে। বৌমা ঘরেই থাকে, একহাতে সংসার সামলায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন অখিলবাবু। সন্ধ্যাবেলা দুহাত তাস খেলে বাড়ি ফেরেন তিনি।


বিপুলবাবু তখন আসেন অখিলবাবুকে ছাড়তে নাতনীর হাত ধরে, একটু হাঁটা হয়, বৌমার কাজ সারার সুবিধাও হয়। কি সুন্দর জায়গায় বাড়িটা কিনেছে! দেখলেও চোখ জুড়ায়। বাড়ির সামনেই সুন্দর পার্ক, অখিলের বারান্দায় দাঁড়ালেই দেখা যায়।কি বড় বড় জানলা!কিব্যবস্থা, আলো ঢোকে কিন্তু রোদ ঢোকে না, তুমি সবাইকে দেখতে পাবে কিন্তু তোমায় কেউ দেখতে পাবে না। কোন শব্দ নেই, ক্যাচক্যাচানি, কোঁদল নেই, কি শান্তি। বুক ভরে শ্বাস নেন নাকি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন বোঝা যায় না। অখিলের ব্যালকনিতে বসে দামী কাপে সুগন্ধি চায়ে চুমুক দেন। অখিলের নাতি ক্রেশে থাকে, বৌমা অফিস থেকে আসার সময় নিয়ে আসে। বূড়ো শ্বশুরের ঘাড়ে কোন দায়িত্ব নেই। খানিক বসতে খুব ভালো লাগে কিন্তু নাতনির টিউটর আসবে উঠতে হয়। ভাবেন আসলে অখিলের উপর লক্ষ্মীর অসীম দয়া। নাহলে তার বাবুয়া আর অখিলের বাবান তো একই বয়সী, একই চাকরি করে, ছোটখাট প্রাইভেট ফার্মে। কিন্তু ওর বৌমা ভালো সরকারী চাকরী করা মেয়ে। ওদের লাভম্যারেজ। বৌমাই লোনে ফ্ল্যাটটা কিনেছে। বড় বিবেচক মেয়ে, শ্বশুরকে ফেলে চলে যায় নি। সকাল আটটায় অফিস যায়, অনেকটা দূর তো। অখিলের উপর  কোন কাজ চাপায় নি, হোম ডেলিভারি খাবার আসে, ছুটির দিনে ওরা বাইরে খেতে যায় আর অখিলের খাবারটাও নিয়ে আসে। খুব পরিশ্রমি মেয়ে,আবার প্রমোশনের পড়া ও পড়ছে। সংসারকে দাঁড় করাবার আপ্রাণ চেষ্টা।বড় লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে ।।


(নতুনদের জন্য)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ