দুখুমিঞার 'প্রমীলা' ~ অদিতি সেনগুপ্ত




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

দুখুমিঞার 'প্রমীলা'

অদিতি সেনগুপ্ত


প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বমহিমায় যাঁরা উদ্ভাসিত, সেইসকল উজ্জ্বল জ‍্যোতিস্কের আলোর ছটার নেপথ‍্যে থেকে যান কিছু মানুষ, যাদের অকৃত্রিম সাহচর্য না পেলে হয়তো মেঘে ঢাকা তারা'র আলো অনেকাংশে ক্ষীণ হয়ে পৌঁছতো মানুষের কাছে। আজ বলবো তেমনই এক মানুষের কথা। তিনি হলেন  দুখুমিঞার 'প্রমীলা'। সালটা ১৯২১, নভেম্বরের ২১ তারিখে ভারতে আগমন ঘটেছিল প্রিন্স অফ ওয়েলসের। সারা দেশ এর প্রতিবাদে জায়গায় জায়গায় শুরু করেছিল হরতাল। এই হরতালে যোগ দিতে দ্বিতীয়বার কুমিল্লায় এলেন আমাদের দুখু মিঞা, কাজী নজরুল ইসলাম। বেরিয়ে পড়লেন হারমোনিয়াম কাঁধে। কন্ঠে স্বরচিত গান 'জাগরণী'। প্রথমবার কুমিল্লা আসার সময়েই ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল এখানকার কান্দীর পারের সেনগুপ্ত পরিবারের সঙ্গে। দ্বিতীয়বারও দেখা করেছিলেন সেনগুপ্ত পরিবারের সঙ্গে।১৯২২ সালে তৃতীয় বারের জন্য নজরুল এলেন কুমিল্লায়। সেইসময় গিরিবালা দেবীর আত্মজা সেনগুপ্ত পরিবারের মেয়ে আশালতার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে দুখুমিঞার। আশালতার আরো একটি নাম ছিল দোলন। আদরের ডাকে তা হয়ে যেত দুলি। দিন যায়, রং বদলায় সম্পর্কের, কবির কলম থেকে জন্ম নেয় কবিতা 'বিজয়িনী'। এরপর 'দৈনিক-সেবক' পত্রিকায় যোগদানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে কলকাতায় ফেরেন নজরুল। অবশেষে আসে সেই দিনটি, ১৯২৪ সালের ২৫শে এপ্রিল। দিনটি ছিল শুক্রবার। এই দিন কলকাতার ৬নং হাজী লেনের বাসায় গিরিবালা সেনগুপ্ত তাঁর একমাএ কন‍্যা আশালতাকে সঁপে দেন কাজী নজরুল ইসলামের হাতে। ওই সময়ে দাঁড়িয়ে একাকী এক হিন্দু বিধবার পক্ষে খুব সহজ ছিল না এক মুসলিমের সঙ্গে নিজের একমাএ মেয়ের বিয়ে দেওয়া। কিন্তু সকল বিরোধ কে দূরে ঠেলে গিরিবালা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে এই বিদ্রোহী কবিটিকে নিজের জামাইয়ের আসনে বরণ করে নিয়েছিলেন স্বচ্ছন্দে। বিয়ের পর কবি আশালতার নতুন নাম দিলেন 'প্রমীলা'। বিয়ে তো হলো কিন্তু বিরোধিতা বন্ধ হলোনা। এই সময় নবদম্পতির পাশে দাঁড়ালেন কবির মাতৃস্বরূপা হুগলি নিবাসী মিসেস এম রহমান। এই মাতৃস্বরূপা নারীর প্রতি কবি তাঁর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করলেন তাঁর কাব‍্যগ্রন্থ 'বিষের বাঁশি' উৎসর্গ করে। ওই মিসেস রহমানেরই সহায়তায় যুগলে বাসা বাঁধলেন হুগলিতে। বিয়ের পর থেকেই প্রভুত আর্থিক সঙ্কটের সম্মুখীন হয় দুজনে। কিন্তু একফোঁটা অভিযোগের সুর বাজেনি কবির প্রমীলার কন্ঠে।অসামান্যা সুন্দরী প্রমীলা মনেপ্রাণে এতোটাই ভালোবেসেছিলেন কবিকে যে তাঁর দুঃখ কষ্টকেও আপন করে নিয়েছিলেন হাসিমুখে। কতটা ভালোবাসা থাকলে অমন সুন্দরী এক হিন্দু যুবতী সমাজের রক্তচক্ষু অগ্রাহ্য করে একজন বাউন্ডুলে মুসলিম যুবককে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন! আর এমন একজন মানুষ যদি চলার পথের সাথী হয় তাহলেই আকাশের বুকে জ্বলজ্বল করে নজরুলের মতো তারারা। সারাটাজীবন অসাম্প্রদায়িক জীবন কাটিয়েছিলেন প্রমীলা দেবী। তাঁর এই উদার মানসিকতা গড়ে ওঠার পেছনে ছিলেন তাঁর মা গিরিবালা দেবী। নজরুল এবং প্রমীলা দেবী চারটি পুত্র সন্তানের জনক-জননী হয়েছিলেন। তাঁরা হলেন, আজাদ কামাল(কৃষ্ণ মহম্মদ), অরিন্দম খালেদ (বুলবুল), কাজী সব‍্যসাচী (সানি) ও কাজী অনিরুদ্ধ (নিনি)। এই চারজনের মধ‍্যে বুলবুল ছিলেন কবির প্রিয়তম সন্তান। সুর-তাল-লয় ছিল তাঁর জন্মগত। ছোট্ট বুলবুল বলে দিতে পারত যেকোনো গানের 'রাগ'। প্রায়ই নানান সভাসমিতিকে তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন কবি। এহেন প্রিয় পুত্রের অকাল বিয়োগে শোকে মুহ‍্যমান হয়ে পড়েছিলেন দুখুমিঞা। কালের নিয়মে সময় এগোয়। একবার কাজী নজরুলের পরম বন্ধু পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের বড় মেয়ের বিয়েতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গেছিলেন কবি ও প্রমীলা দেবী। নিমন্ত্রণ খেয়ে বাড়িতে ফেরার পর পোশাক পরিবর্তন করে শুয়ে পড়লেন কবিপত্নী। সেই যে শুলেন পরের দিন সকাল থেকে আর বিছানা ছেড়ে ওঠার ক্ষমতা থাকলো না তাঁর। সময়টা ১৯৪০ সাল, পক্ষাঘাতগ্রস্থ হলেন তিনি। আমৃত্যু এভাবেই কেটে গেছিল তাঁর। প্রমীলা দেবীর পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হওয়ার পর কেটে গেছে দুটো বছর। সাল ১৯৪২, ১০ই জুলাই হঠাৎই দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত কবি একেবারেই হারিয়ে ফেলেন তাঁর   বাকশক্তি। এদিকে পক্ষাঘাত গ্রস্থ কবিপত্নী। প্রায় দীর্ঘ বাইশ বছর শয‍্যাশায়ী ছিলেন প্রমীলা দেবী। ১৯৬২ সালের ৩০শে জুন মৃত্যু হয় তাঁর। এই দিনটিতে ঘটেছিল এক হৃদয় বিদারক ঘটনা। কবিপত্নীকে চুরুলিয়ায় সমাহিত করা হয়েছিল। তাঁর পার্থিব শরীরটিকে যখন বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ফিরেও তাকাননি স্থবির কবি। কবির বন্ধু তাঁর উদ্দেশ্যে চেঁচিয়ে উঠলেন,"ওরে হতভাগা, একটু কাঁদ চোখের জল ফ‍্যাল, হাউ ভাউ করে কাঁদ্---তোর দুলিকে নিয়ে যাচ্ছে আর দেখতে পাবি না কোনদিন।" কিন্তু চ‍্যাঁচানোই সার! কোনো কথাই স্পর্শ করলো না ভাবলেশহীন কবিকে। প্রমীলা দেবীর মৃত্যুর ১৪ বছর পর ১৯৭৬ সালের ২৯শে আগস্ট, হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় মৃত্যু হয় কবি নজরুল ইসলামের।।

_________________________________

তথ‍্যসূত্রঃ অন্দরের নজরুল বাইরের নজরুল - চিন্ময় চৌধুরী।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ