২২শে শ্রাবণ শ্রদ্ধার্ঘ্য ২০২২ || পর্ব -৩




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

মরমি তান

মেখলা ঘোষদস্তিদার 


ভাবতে ভাবতে দেখি চেয়ে

ভানুর ছটা ফুল উপচার

দিগ দিগন্তে আঁকা ছবি

গুচ্ছ গল্পের উপহার,

তোমার চিঠি গোপন ছড়ে

রেখেছি ধরে অন্তরে নিয়ে

কাঙ্খিত শব্দ ভেলায়

গিয়েছি দ্বার পেরিয়ে,


মুহূর্ত শ্রান্তি রেখায়

হেঁটেছি সে কষ্ট ভুলে

গেঁথেছি  যে করবী আলোয়

পরশে তুমি হৃদ কূলে,


আজ ভরা শ্রাবণ বেলায়

ঝরবে জল আবেগ যতো

ফিরে ফিরে আসবে আবার

মল্লারে রাগ মনের মতো,


বন্দর রিক্ততা ঘিরে

ভিজবে তন একলা মন

রাত্রি শেষে অন্য বেশে

ছন্ন যোগে নীরব ক্ষণ,


পড়ে থাকা ভোর আঙিনায়

দহনে জ্বলনে গলা মোম

তবুও হৃদয়ে রঙ বোনা

মুছে ফেলি ব্যথার জখম,


তোমার শরণে থাকি বেঁচে

স্মরণেই জেনো আছি টিকে 

এমন দিনে মেঘলা শেজে

মরমি তানে বাইশ তারিখে।

====

প্যাস্টেল 

শর্মিষ্ঠা ঘোষ


অরগ্যাজমিক আকাশ ইজেল

অবয়বহীন যন্ত্রণা 

     শূন্যের নীরব ধার ঘেঁষে 

বেনামী চোট

শব্দের আনচান 

কিনেছে দূরত্বের আলোকবর্ষ, দিনরাত রুদ্ধশ্বাসে

      ডাগরচোখ জুড়ে অধীর কান্নাফোঁটা


হে অক্ষয় পুরুষ 

কাঙ্ক্ষিত মোলাকাতের মোচড়হীন

জলবুক হুইসেল শব্দে 

কালোত্তীর্ণ ঘ্রাণ 

     সুড়ঙ্গশেষ ফুলেল খোয়াই 


হে গভীর বৃষ্টি 

দোঁহার আত্মা থৈথৈ আনন্দ, শিকড়স্থির

অস্থির অথচ অভিযোগহীন

এমন কিছু 

চেনে না বিচ্ছেদ 

জানে না শূন্যতা

ইহলৌকিক ম্লান পিছুডাক

ক্ষুধিত পাষাণ...

====

রবি অস্তমিত 

( নিবন্ধ) 

সুজিত চক্রবর্তী  


       বাইশে শ্রাবণ প্রসঙ্গে প্রথমেই মনে পড়ে যায় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত কবিতা 'রবিহারা'র কথা। এই কবিতায় বাইশে শ্রাবণের বর্ণনা দিতে গিয়ে নজরুল বলছেন, 


" আজ বাংলার নাড়িতে নাড়িতে বেদনা উঠেছে জাগি' ; 

কাঁদিছে সাগর নদী অরণ্য , হে কবি, তোমার লাগি'।" 


    গুরুদেবের মৃত্যুর পর , এই কবিতাটি নজরুল ইসলাম অল ইন্ডিয়া রেডিওতে পাঠ করেন । জীবনে প্রথমবার সেই পাঠ শুনে যখন মুগ্ধ হয়েছিলাম সেসময়ে মুখমণ্ডলে গোঁফ-দাড়ির আবির্ভাবে ' বড়-হচ্ছি ' জাতীয় একটা অনুভূতি মনের ভেতরে গোপনে অঙ্কুরিত হচ্ছে । কবিতাটিতে একটি আক্ষেপ ধ্বনিত হয়েছে  : 


" ভারত-ভাগ্য জ্বলিছে শ্মশানে, তব দেহ নয়, হায় ।

   আজ বাংলার লক্ষ্মীশ্রীর সিঁদুর মুছিয়া যায়। "

    বেশ মনে আছে, সেই বয়সে ' আজ বাংলার লক্ষ্মীশ্রীর সিঁদুর মুছিয়া যায় ' এই শব্দমালার অর্থ হৃদয়ঙ্গম করে চমকে উঠেছিলাম এই ভেবে যে ,  তাহলে এভাবেও কবিতা লেখা যায়!


         পরবর্তীতে বছর বছর বাইশে শ্রাবণ এসেছে।  সে সময়ে পঁচিশে বৈশাখের উদযাপনে বাংলায় একটা সাজো সাজো রব উঠলেও , বাইশে শ্রাবণে কখনও কোনও অনুষ্ঠানে গেছি বলে মনে পড়ে না। তবে , আমার বাসস্থান থেকে নিমতলা ঘাট শ্মশান বেশি দূরে ছিল না বলেই হয়তো কোনো কোনো বছরে এই দিনে সেখানে গিয়ে ' প্রেমের ঠাকুরের ' উদ্দেশ্যে প্রণাম জানিয়ে আসতাম।  


               এরপর হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার পরে অখন্ড অবসরে পড়লাম বুদ্ধদেব বসুর তিন খন্ডে লেখা আত্মজীবনী । এর মধ্যে ' আমার যৌবনে ' পেলাম কবির বাইশে শ্রাবণের স্মৃতিকথা। সেই লেখা পড়তে পড়তে আমি যেন চোখের সামনে দেখতে পেলাম সেই বাইশে শ্রাবণের দিনটিকে। আছে তাঁর লেখা ' বাইশে শ্রাবণ ' কবিতা। কি বলেছেন বুদ্ধদেব ? 


            " অগণিত আমরা তখনও কি সেই প্রত্যাশা করছি না যে , পরমাশ্চর্য কোনো প্রত্যাবর্তন ঘটবে। 

....... জীবন মরণের সীমানা ছাড়িয়ে কম্পিত পায়ে তিনি তো আগেও এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রান্তিক এক বিন্দুতে । কিন্তু ফিরেও তো এসেছিলেন আবার।  ইতিহাস কি নিজেকে আবৃত করতে পারে না আবার ? পারে হয়তো , করে নি । খবরের কাগজের বিশেষ সংস্করণে সেই অমোঘ সত্যটাকে শিরোধার্য করে বেরিয়ে এসেছিল, রবি অস্তমিত। "


                বাবার মুখে শুনেছি , ইংরেজ আমলেও দুপুরে খবর আসার সঙ্গে সঙ্গে সরকারি অফিসে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। বুদ্ধদেব বসু জানাচ্ছেন,  


             "  মুহূর্তে সব কাজ থেমে গেল। কলকাতা শহর উপচে পড়ল রাস্তায় , স্কুল কলেজ শূন্য, রাজকার্য অর্থহীন হয়ে গেল। " 


                পুত্র রথীন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত শ্মশানে প্রবেশ করতে পারেন নি , তাই পিতার মুখাগ্নিও করতে পারেন নি --- এ কথাও পড়েছি।  


                অনুভব করতে পারি , এর পরে , এক অসীম শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে বাঙালির মনোজগতে এই ভেবে যে , রবীন্দ্রনাথ নেই। তাঁর বিকল্প না হলেও , তাঁর কাছাকাছি পৌঁছানোর মতো কোনও প্রতিভাকে পাওয়ার আশায় বসে থাকতে থাকতে বাঙালি হয়তো বুঝেছে সম্ভব নয়, সেটা সম্ভব নয়।


     আমাদের কালের কবি মন্দাক্রান্তা সেন ' বাইশে 

শ্রাবণ ' কবিতায় লিখেছেন  : 

     " ... বাইশে শ্রাবণ তাই নয় শোক 

        বাইশে শ্রাবণ জানে দুই চোখ ... " 


      আর , মৃত্যুর একাশি বছর পরে তিনি বাঙালি জীবনে এমনভাবে জড়িয়ে আছেন , তাতে একথা বুঝতে কারও অসুবিধে হয় না, যে তিনি সত্যিই

 ' মৃত্যুঞ্জয় ' ! জীবদ্দশায় অজস্র মৃত্যুর মিছিল কবিকে কীভাবে ঋদ্ধ করে তাঁকে মৃত্যু চেতনার নতুন দিগন্তের সন্ধান দিয়েছে , সে কথাও সর্বজন বিদিত । তাই তাঁরই ' মৃত্যুঞ্জয় ' কবিতার শেষ লাইন স্মরণ করে এই রচনার ইতি টানছি  : 


" আমি মৃত্যু-চেয়ে বড়ো এই শেষ কথা বলে 

 যাব আমি চলে । " 

=====

বাইশে শ্রাবণ 

লেখা মন্ডল

                                            

ওই দূর গগনপারে ঘর বেঁধেছো তুমি,

আমায় একটু দিও আলো, কিছু কথাকলি।


তোমার অফুরন্ত ভান্ডারে রত্ন রাশি রাশি,

দীন আমি,তোমার আশিস মাগি।


আমার কাব্যের মরুভূমিতে শব্দের বৃষ্টি নামে না,

আমার মনবিতানে কাব্যের ফুল ফোটে না।

চাতকের মত থাকি অপেক্ষায়,

আসবে কবে বাইশে শ্রাবণ,

তোমাতে করবো আত্মসমর্পণ।


আমার কাব্য-মরু পাবে শ্রাবণধারা,

অন্তর পাবে তোমার করুণাধারা।


নিত্য প্রবাহে নিত্য ধারায়,

তুমি মিশে আছো মোর চেতনায়।


হে প্রাণময়,জ্ঞানময় চিরন্তন,

তুমি চির নিদ্রিত অনিবার্য মৃত্যুর শীতল শয়নে।

তবু সফলে-বিফলে অনুভবে পলে পলে,

আছো কালজয়ী হয়ে হৃদ-পুষ্পে।

অঞ্জলি তবে পদে।

====

বাইশে শ্রাবণ 

হামিদা বানু


রবি ঠাকুর ভাবতেন,বৃহত্তর

 মানবিকতার কথা

শিক্ষা দানের উপায় হোক সহজ মাতৃভাষা।

স্যাডলার কমিশনের প্রতিবেদনে প্রশংসনীয় গুনি

বুদ্ধির বিকাশ আলোকিত হোক, স্বপ্ন বোনেন তিনি।

স্বাধীন ভাবে চিন্তা করা সহজ সরল নীতি

সাধনায় মুক্তিলাভ তাঁর ই জ্ঞানরীতি।

গল্প, নাটক, গান, কবিতায় দিলেন ভুবন ভরে

এক রবিতে জগৎ আলো সহজ পাঠের ঘরে।

এক জীবনে অনেক জীবন আলোর ঝরনা ধারা

স্ত্রীর পত্রে করলেন দান আধেক আকাশ ভরা।

শেষের খাতায় গেলেন লিখে মজার প্রানে গড়া

নাতনিকে উপহার হাল্কা খুশির ছড়া।

" ঘড়ি ধরা নিদ্রা আমার/ নিয়ম ঘেরা জাগা

এতটুকু তার সীমার পারেই/ আছে তোমার রাগা"

পুবের স্রোতে বিশ্বকবি কপালে নিলেন হাত

অস্তমিত হলেন রবি, সৃষ্টির সুপ্রভাত।

মানুষের ঢল নেমেছে পথে, ফুলভারে কবি শয়ানে

''নয়ন তোমারে পায়না দেখিতে রয়েছ নয়নে নয়নে"।

"জীবন মরনের সীমানা ছাড়ায়ে" বনস্পতির গমন

স্নিগ্ধ স্নাত চোখের জলে অমর ২২  শে শ্রাবণ।।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ