প্রথম মৌলিক ~ কবি বন্দনা পাত্র




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

প্রথম মৌলিক কবি

বন্দনা পাত্র


বাংলা কবিতার ইতিহাসে সবচেয়ে  বেশি উচ্চকন্ঠ কবি হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম।বিংশ শতকের তৃতীয় ও চতুর্থ দশকের সবচেয়ে বেশি সমাজ ও স্বকাল-সচেতন কবি ছিলেন তিনি।

রবীন্দ্র-বিদ্রোহের ধ্বজা না তুলেই তিনি রবীন্দ্রনাথ থেকে স্বতন্ত্র একটি পথের সন্ধান দিয়েছিলেন।রাজনৈতিক বিষয়কে কবিতা করে তুলতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত।বুদ্ধদেব বসু তাঁকে চিহ্নিত করেছিলেন 'রবীন্দ্রনাথের মুঠো থেকে'পালিয়ে যাওয়া 'প্রথম মৌলিক ' কবি হিসেবে : "---রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা ভাষায় তিনিই প্রথম মৌলিক কবি।---রবীন্দ্রনাথের পরে অন্য একজন কবি---ক্ষুদ্রতর নিশ্চয়ই,কিন্তু নতুন।"স্বতন্ত্র জীবন -অভিজ্ঞতার রূপায়ণই তাঁকে স্বতন্ত্র কবি হিসেবে গড়ে তুলেছিল।তিনি ছিলেন বিদ্রোহী কবি।


মাত্র এগারো বছর বয়স থেকেই লেটোর দলে গান লিখিয়ে হিসেবে তাঁর সাহিত্য জগতে আত্মপ্রকাশ ঘটে। কবি হিসেবে তাঁর আবির্ভাব  ১৯১৯ সালে 'বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য ' পত্রিকায় 'মুক্তি' কবিতার  মধ্য দিয়ে।১৯২২সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ"অগ্নিবীণা"প্রকাশিত হলে পাঠকসমাজ চঞ্চল হয়ে ওঠে।

তারপর একের পর এক প্রকাশিত হয় _ "দোলন চাঁপা",(১৯২৩)"বিষের বাঁশি"(১৯২৪),"ছায়ানট"(১৯২৪),"ভাঙার গান"(১৯২৪),"পূবের হাওয়া"(১৯২৫),"সাম্যবাদী"(১৯২৫)ইত্যাদি।


বাংলা কবিতায় তিনিই প্রথম বিদ্রোহ,পৌরুষ ও যৌবনের উত্তাপ সঞ্চার করেন।তাঁর বিদ্রোহ চেতনা পরবর্তী কবিদের কাছে আলোর দিশা হয়ে উঠেছে।

তাঁর কবিতার সূচনায় ছিল তীব্র আবেগ,পরে বিদ্রোহে উৎসাহদান এবং শেষে বিদ্রোহী রূপে তাঁর নিজের আত্মপ্রকাশ ঘটে।'আনোয়ার' ও 'কামালপাশা' কবিতায় আছে বিদ্রোহে উৎসাহদান আর 'বিদ্রোহী' কবিতায় আছে বিদ্রোহ ঘোষণা।

বুদ্ধদেব বসু লিখলেন,"বিদ্রোহী পড়লুম ছাপার অক্ষরে মাসিক পত্রে- মনে হ'লো এমন কখনো পড়িনি।অসহযোগ অগ্নিদীক্ষার পরে সমস্ত মন-প্রাণ যা কামনা করছিলো, এ যেন তা-ই,দেশব্যাপী উদ্দীপনার এ-ই যেন বাণী"।এই কবিতায় কবির বিদ্রোহী সত্তার প্রকাশ:


                 "বল বীর--

               বল উন্নত মম শির

           শির নেহারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!"


আসলে নজরুলের মধ্যে  চির জাগরূক ছিল স্বাধীনসত্তা।অসহ্য ছিল পরাধীনতার শৃঙ্খল।আবার ধর্মের ভন্ডামি,জাতের বজ্জাতির বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন খড়্গহস্ত।তাঁর বিদ্রোহ কৃত্রিম নয়,সময়ের তাপেই বিদ্রোহী হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে।নিপীড়িত সমাজ ও জনমানসের প্রতিভূরূপে তিনি বিদ্রোহী সত্তার উদ্বোধন ও জয়ঘোষণা করেছেন।সামাজিক অসাম্য ও অত্যাচারের অবসানই তাঁর বিদ্রোহের লক্ষ্য।'লাঙল','ধূমকেতু' প্রভৃতি সাম্যবাদী পত্রিকার সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন।শ্রেণি চেতনা আর সাম্য চেতনা তাঁর সাহিত্যের দুটি মৌল উপাদান।নারী চেতনাও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ:

"বিশ্বে যা কিছু  মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর,

অর্ধেক তার করিয়াছে নারী,অর্ধেক তার নর"।"

তাঁর কাব্যের আর একটি লক্ষণ হল অসাম্প্রদায়িকতা:

"মসজিদ এই,মন্দির এই,গীর্জা এই হৃদয়,

এইখানে বসে ঈসা মুসা পেল সত্যের পরিচয় "।


নজরুলের কবিতায় প্রকাশের নানান ত্রুটি হয়তো আছে,ভাবের অসংযমও আছে,কিন্তু তাঁর ভাষা বলিষ্ঠ,বেগবান ও স্পন্দিত।বাধা-বন্ধনহীন যৌবনের আবেগ-উচ্ছলতা ও প্রাণচাঞ্চল্য তাঁর কবিতার সম্পদ।তাঁর কবিতাতেই প্রথম গণসাহিত্য হয়ে ওঠার প্রতিশ্রুতি ছিল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ