দর্পণ || সাপ্তাহিক নির্বাচিত নিবন্ধ || কবি অতুল প্রসাদ সেন : দাম্পত্য জীবন ~ সৈয়দ সওকাত হোসেন




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

কবি অতুল প্রসাদ সেন : দাম্পত্য জীবন             

সৈয়দ সওকাত হোসেন 

              

অতুল প্রসাদ সেন আবার বিলেত যাত্রা করলেন , এবার সঙ্গে হেম কুসুম । স্কটল্যান্ডের গ্রেট নাগরীন , এই গ্রামে তাঁদের বিবাহ পর্ব সাঙ্গো হল । বিয়ের পর তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তাঁরা দেশে আর কখনও ফিরে যাবেন না । কিন্তু বাস্তব বড়ো কঠিন । লন্ডন শহরে অতুল প্রসাদ সেনের প্র্যাক্টিস জমলো না , অর্থসংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হলো । এরইমধ্যে ১৯০২ সালে যমজ দুই ছেলে দিলীপ কুমার ও নীলিপ কুমারের মধ্যে নীলিপ কুমারের অকাল মৃত্যু ঘটলো । ছেলের মৃত্যুতে অতুল প্রসাদ সেন একদম ভেঙে পড়লেন একেবারে ।  অবশেষে বিধ্বস্ত অবস্থায় বাধ্য হয়ে কোলকাতা ফিরলেন ।  

কোলকাতায় ফিরলেন বটে , তবে এখানে চারিদিকে ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ, নিন্দা আর সমালোচনা । বিরক্ত বিধ্বস্ত অতুল প্রসাদ সেন এবার কোলকাতা ছাড়লেন সপরিবারে । তিনি সপরিবারে চলে গেলেন লখনৌ শহরে ।

                      হ্যাঁ , একথা সত্যি যে লখনৌ শহরে তাঁর পশার জমে উঠেছিল , শহরের কেশরবাগ অঞ্চলে সেযুগের তেত্রিশ হাজার টাকা খরচ করে রাজপ্রাসাদের মত একটা বাড়ি তিনি তৈরি করেছিলেন । অল্পসময়ের মধ্যেই তিনি বার কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন । অসাধারণ সব দেশাত্মবোধক গান , ভক্তিরসের গান , প্রেমের গান লিখে সুর দিয়ে বাংলা গানের সম্ভারে হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মূর্ছনা প্রবেশ করিয়ে নতুন বাংলা গানের ধারা তৈরি করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন শহরের বিদ্বোজনের মাঝে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র । 

                     এ সবই সত্য , কিন্তু আর্থিকভাবে সচ্ছল হলেও , সামাজিকভাবে বিপুল প্রতিষ্ঠা লাভ করলেও তিনি কোনোদিন মানসিক শান্তি স্থিরতা অর্জন করতে পারেন নি । অপ্রত্যাশিত এক যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয়ে উঠেছিল তাঁর জীবন , এর মূল কারণই ছিল ক্ষত বিক্ষত তাঁর দাম্পত্য জীবন । সামাজিক পারিবারিক সমস্ত বাধা উপেক্ষা করে তিনি যাঁকে বিয়ে করেছিলেন , সেই হেম কুসুমের সাথে সুখের স্বছন্দের জীবন যাপন করা তাঁর পক্ষে আর সম্ভব হলো না । এই অশান্তির মূল কেন্দ্রে ছিলেন তাঁরই মা হেমন্ত শশী দেবী । মায়ের দ্বিতীয় স্বামী দুর্গা মোহন দাসের মৃত্যু হলে অতুল প্রসাদ সেন তাঁর মাকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছিলেন লখনৌতে । আর তখন থেকেই জ্বলে উঠেছিল সাংসারিক অশান্তির লেলিহান শিখা । 

                     হেম কুসুম , তিনি ছিলেন অত্যন্ত স্বাধীনচেতা । বিয়েকে কেন্দ্র করে আত্মীয়স্বজনদের যে আচরণ , বিশেষ করে হেমন্ত শশী দেবীর যে শক্ত বাধা , সমালোচনা , তিরস্কার তা কখনওই তিনি ভুলতে পারেন নি । এমন শাশুড়ির সঙ্গে কোনরকম তিনি সম্পর্ক রাখতে রাজি ছিলেন না । ফলে অচিরেই শুরু হয়েছিল শাশুড়ি পুত্রবধূর ভয়ংকর সংঘাত । বলা বাহুল্য অতুল প্রসাদ সেন সেই সংঘাতের কোনো কূলকিনারা করতে পারেন নি । মাকে যেমন তিনি শান্ত করতে পারেন নি তেমনি স্ত্রীকেও সংযত করতে পারেন নি , মাঝখান থেকে তিনি বারবার হয়েছিলেন যন্ত্রণাবিদ্ধ , গভীরভাবে বেদনাবিদ্ধ । অবশেষে স্ত্রী বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে লখনৌ শহরে আলাদা বাড়ি ভাড়া করলেন । একই শহরে তাঁরা রয়েছেন , কিন্তু আলাদা আলাদা বাড়িতে । সে এক দুসহ বিচ্ছেদের জীবন । অথচ তাঁদের মধ্যে ছিল ভালোবাসার পূর্ন পাত্র , এমনও হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য বাসর কিংবা গানের আসর , স্ত্রী হেম কুসুম , তিনি এসে সমস্ত আয়োজন করেছেন হাসিমুখে নিজের হাতে , আবার অনুষ্ঠান শেষে ফিরে গেছেন তাঁর সেই ভাড়া বাড়িতেই । আবার কখনও স্বামী অসুস্থ হয়েছেন স্ত্রী ছুটে এসেছেন , সেবা করেছেন , আবার স্ত্রী অসুস্থ হয়েছেন , স্বামী ছুটে এসে পাশে দাঁড়িয়েছেন । কিন্তু সেসবই ছিল সাময়িক , আসলে দাম্পত্য জীবনের সম্পর্কে যে চিড় ধরেছিল তা কখনওই আর জোড়া লাগে নি । বিচ্ছেদের সেই সুদীর্ঘ কালে স্ত্রী হেম কুসুমের কণ্ঠে ঠাঁয় পেতো স্বামীর অতুল প্রসাদের গান , আর স্বামী তিনিও স্ত্রীর বিরহে বহু বিনিদ্র রাত কাটিয়েছেন চোখের জলে , গান লিখে , গানে সুর দিয়ে , গান গেয়ে । মনে পড়ে যায় তাঁর সেই বিখ্যাত গানটির কথা - ' বন্ধুয়া নিন্দ নাহি আঁখি পাতে , আমিও একাকী তুমিও একাকী আজই বাদল রাতে ...' । 

                      জীবনের অপরাহ্নে ক্ষত বিক্ষত দাম্পত্য জীবনের যন্ত্রণায় অতুল প্রসাদ সেনের জীবনীশক্তির ক্ষয় হয়েছিল । একেবারে শেষের দিকে অসুস্থ শরীরে তিনি হাওয়া বদলের জন্য পুরী গিয়েছিলেন । পুরী থেকে কিছুটা সুস্থ হয়ে ফিরলেও আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন । লখনৌর বাড়িতে একে একে সবাই তাঁকে দেখতে আসতেন । কিন্তু স্ত্রী হেম কুসুম , তিনি আসলেন না । অবশেষে সমস্ত অভিমান ভুলে হেম কুসুম যখন আসলেন , তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে । তখন এই পৃথিবীতে তিনি আর নেই , পড়েছিল তাঁর নিষ্প্রাণ নিথর দেহ । 

                       ১৯৩৪ সালে ২৬ শে আগস্ট ৬৩ বছর বয়সে অতুল প্রসাদ সেন গভীর রাতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন । তাঁর মৃত্যুর সাথে তাঁর দীর্ঘ দুঃখ যন্ত্রনার সমাপ্তি ঘটল । যে দুঃখ যে যন্ত্রনা তাঁকে সৃষ্টির পথে চালিত করেছিল আজীবন ।


        ( সমাপ্ত )

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ