পথ ও পথিকের পাঁচালী ~ সুজিত চক্রবর্তী




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

      পথ ও পথিক প্রসঙ্গে বাংলা সাহিত্যে এত কিছু  বলা আছে যে এ ব্যাপারে কিছু বলতে গেলে  মনে হয় কেউ যেন কানে কানে প্রশ্ন করছে , " পথিক, তুমি পথ হারাইয়াছ ? " 


       পথ হারিয়ে যাওয়া পথিক হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো তার চোখের সামনে এক ফুলের উপত্যকা বা valley of flowers পেয়ে যাবে , এমন ঘটনা যে নিত্যদিন ঘটে না সেকথা বলাই বাহুল্য। আমরা জানি সাধারণত পথ হারিয়ে যাওয়া পথিক পথের সন্ধানে হয়রান হয়ে ঘুরে বেড়ায়। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে যায় আমার ছোটবেলায় পড়া অনবদ্য এক বাংলা কবিতার লাইন  : 

" দেখবে সেথায় ডাইনে বায়ে পথ গিয়াছে কত , 

 তারি ভিতর ঘুরবে খানিক গোলকধাঁধার মত । " 

        ( ঠিকানা  : সুকুমার রায়  ) 


   

   কোনও পথিক কি পথ হারাবে বলেই পথে নামে ? একথা মনে হতেই পারে এ এক অবাস্তব রোমান্টিক অনুভূতি অথবা অকারণ দুঃখ বিলাস ! পাঠককে মনে করিয়ে দিই বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের ( 1958 ) এক জনপ্রিয় বাংলা গানের কলি  : 

" পথ হারাবো বলেই এবার পথে নেমেছি 

  সোজা পথের ধাঁধায় আমি অনেক ধেঁধেছি " 

( গীতিকার : সলিল চৌধুরী। কন্ঠ শিল্পী: হেমন্ত মুখোপাধ্যায়) 

অভিজ্ঞ মানুষ মাত্রই জানেন , চেনা পথের এমন গোলকধাঁধার মধ্যেই অবলীলায় হারিয়ে যায় অনেক মানুষের যাত্রাপথ । আর একটা কথা বলে রাখা ভালো। মনে করুন , পথনির্দেশের বিধি ও লাল বাতির শাসন মেনে অনেক গাড়ি সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে হঠাৎ দেখা গেল একটি গাড়ির সাহসী চালক তার গাড়ি নিয়ে সিগন্যাল ভেঙে খালি রাস্তায় হৈ হৈ করে বেরিয়ে গেল। যাঁরা তখনও লাল বাতির সামনে ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করছেন এবং মনে মনে ভাবছেন ওই ধাবমান গাড়ির চালক অনৈতিক কাজ করছে , তাঁরাও কিন্তু অনুভব করছেন এবং নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছেন সিগন্যাল যে ভাঙতে পারে সেই কেবল এগিয়ে যেতে পারে।  



       চলমান জীবনের গান আর যানবাহন প্রসঙ্গে আর একটা ভীষণ রোমান্টিক গানের কথাও এসে পড়ে । প্রবীণ বঙ্গ সন্তানদের তো বটেই , অনেক নবীন প্রজন্মের Bongকেও মুগ্ধ করেছে এই গান ! 

     " এই পথ যদি না শেষ হয় 

       তবে কেমন হতো তুমি বলো তো ? " 

( ছবির নাম  : সপ্তপদী। 1961 l কথা : গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার।  কন্ঠ শিল্পী: হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ) 


মনের মতো সঙ্গী আর মসৃণ রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে মনে হতেই পারে যে এই পথ যেন কখনও না ফুরিয়ে যায় । আবার ঠিক এর বিপরীতে ( আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদের নীতি মেনে ) কখনও এমন হয় যে কৃচ্ছসাধনের পথ কবে শেষ হবে সেকথা ভেবে মানুষ ঈশ্বরের শরণাপন্ন হয় । তেমনই কথামালায় সাজানো গত শতাব্দীর আর একটা বাংলা ছায়াছবির গানের লাইন পাঠককে স্মরণ করিয়ে দেওয়া যাক । 

" পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহ ভরা কোলে তব 

  মাগো , বলো কবে শীতল হবো 

  কত দূর আর কত দূর বলো মা ! " 

( ছবির নাম : মরুতীর্থ হিংলাজ।  1958  l 

কথা  : গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার। কণ্ঠশিল্পী : হেমন্ত মুখোপাধ্যায়) 

এই গানেরই পরের লাইন : 

" আঁধারের ভ্রূকুটিতে ভয় নাই 

 মাগো তোমার চরণে জানি পাবো ঠাঁই " 

এখানে পেয়ে যাই বাঙালির আত্মনিবেদনের সেই চির পরিচিত ছন্দ।  সঙ্গে আছে এক সুগভীর প্রত্যয় , যেমনটা বাঙালিকে  শিখিয়েছিলেন স্বামীজি  : লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগে তোমরা কখনও  থেমে যেও না ! 


        স্বামী বিবেকানন্দর কথা উঠলে তাঁর গুরু ,  প্রেমের ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণর কথা এসে পড়াটা  যেন অনিবার্য। দক্ষিণেশ্বরের রাণী রাসমণির প্রতিষ্ঠা করা ভবতারিণীর মন্দিরের এই পুরোহিত বাঁধা ছকের পুজো পদ্ধতির অনুসরণ না করে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনলেন বাঙালির অধ্যাত্ম চিন্তায় একথা সবাই জানে। প্রথাগত শিক্ষার বাইরে থেকেও তিনি মানুষকে অন্য এক চৈতন্যের হদিশ দিলেন। এই যেমন চারটি শব্দের মাধ্যমে কত সহজে জানিয়ে দিলেন : " যত মত , তত পথ " ! অর্থাৎ ঈশ্বরকে পাওয়ার জন্য মানুষের সামনে অনেক পথ খোলা আছে এবং এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে মানুষে মানুষে সমন্বয়ের মন্ত্র। এখানেই আমাদের চৈতন্য লাভ হলো এই ভেবে যে ' সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। ' 

( কবি বড়ু চন্ডীদাস) l 


        এমনি করেই আমাদের মনোজগতে পথের সন্ধানে এগিয়ে চলে এক জাগ্রত বোধ , যা বারবার মানুষের মাঝে ঈশ্বরের অস্তিত্ব আবিষ্কার করে ঋদ্ধ হতে চায় , প্রচলিত আর প্রথাগত শিক্ষা  ব্যবস্থার সিগন্যাল ভেঙে বেরিয়ে আসে ' পথে নেমে পথ চিনে নেওয়ার ' আকর্ষণে। তাই দেখুন , ইতিপূর্বে লক্ষ্মীর পাঁচালীতে মগ্ন থাকত যে বাঙালি তার হাতে সেই কতদিন আগে এসে গেছিল  বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা উপন্যাস " পথের পাঁচালী " ! এ এক স্বতন্ত্র জীবন যাপনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নবনির্মাণ মাত্র নয় , চলমান জীবনের এক অনবদ্য জলছবিও বটে। 


       এখানেই শেষ নয় , পথের পাঁচালীর লেখক অন্যদের থেকে আলাদা করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন এক ভিন্ন অবস্থানে। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলি অতি সাধারণ এবং সবার পরিচিত হয়েও তাঁর কলমের গুণে হয়ে গেল অসাধারণ । বিশেষ করে দুর্গা। সমাজ-সংসার হয়তো দুর্গাকে  এতটুকু মূল্য দিতেও রাজী নয় , তবু তার লোভ , তার স্বপ্ন নিয়ে সে আপন গরিমায় মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকে পাঠকের মনে । আর , এভাবেই জীবনের পথ চলা হয়ে যায় অন্তহীন। মাঠ , ঘাট , নয়ানজুলি পার হয়ে সে পথ চলে যায় দূর থেকে আরও অনেক দূরে ! এখানে মনে পড়ে যায় , রবি ঠাকুরের অনুভূতির কথা । সে অনুভূতি বলে , পথ আমাদের যেমন কাছে নিয়ে আসে তেমনি দূরেও নিয়ে যায় ! হয়তো জীবন কখনও আমাদের সামনে হাজির হয় অবিশ্বাস্য এক বিস্ময়কে সঙ্গী করে  :  " পথের শেষ কোথায়, শেষ কোথায় , কী আছে শেষে ! " এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে  গিয়েই মনে হয় আদি মানুষ জ্ঞান বিজ্ঞানের পথে তার যাত্রা শুরু করেছিল ! সন্ধান করেছিল অসীম রহস্যের সমাধানের , যার পোশাকি নাম ' গবেষণা ' ।



           শুরুর দিকে বাংলা ভাষায় ' নন্সেন্স ভার্সের ' জনক সুকুমার রায়ের উদ্ধৃতি দিয়েছি । শেষে স্মরণ করিয়ে দেওয়া যাক তাঁর সুযোগ্য পুত্র সত্যজিত রায়ের অবদানের কথা , যিনি পথের পাঁচালীর সার্থক চিত্র রূপ দিয়ে বাংলা চলচ্চিত্রকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিলেন । দুর্গা মারা গেছে। বহু দিন পর বাড়ি ফিরেছে পিতা হরিহর। আমরা বিস্মিত দর্শক দেখলাম ছবিতে একবারের জন্যেও কন্যার মৃত্যু সংবাদ পিতাকে দেওয়া হলো না । এমনকি মা সর্বজয়ার কান্না বলে যেটা ভ্রম হয় , জানা গেল সেটা ধ্রুপদী সঙ্গীতের বিরল প্রতিভা , পন্ডিত রবি শংকর কৃত এক অসাধারণ শৈল্পিক মূর্চ্ছনা। এর পরের ঘটনা তো সবার জানা । ভিটে মাটি ছেড়ে পরিবারের বাকি তিন জীবিত সদস্য কাশিবাসী হওয়ার জন্য পথে নামল । পথের কি সত্যি কোনো শেষ আছে ? মনে তো হয় না ! রবীন্দ্রনাথের কথায় , 'যেখানে তুমি থামবে সেখানেই তোমার মৃত্যু । কারণ তুমি একাই থামবে , আর কেউ থামবে না। ' এই বাক্যবন্ধ  আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়  পথের শেষ নেই , সে অনন্ত কাল সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। কবি- সাহিত্যিক সেই পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালোবাসেন । আর সেই জন্যেই বুঝি এমন গান লেখা হয়ে যায় : 

" আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ l

খেলে যায়  রৌদ্র ছায়া ,  বর্ষা আসে  বসন্ত ll "

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ