দর্পণ || সাপ্তাহিক নির্বাচিত গল্প




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

 
অন্তর্দাহ

 রূপম পট্টনায়ক 

 

                              -  এক - 


পশ্চিমের কোণে সূর্যটা গা ঢাকা দিয়েছে বহু আগেই, গ্রাউন্ড ছেড়ে ছেলেগুলি নিজের নিজের বাড়ি ফিরে যাচ্ছে, দূর রস্তার থেকে থেমে থেমে ভেসে আসছে হর্ণের শব্দ। মোবাইল জ্বালিয়ে একবার সময়টা দেখে নিল সমরেশ, তার মনের ভেতর যে প্রশ্নটি ছুটাছুটি করছিল এতক্ষণে সে তার উত্তর পেল বোধহয়। উঠে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলতেই সমরেশের কানে ভেসে এল কয়েকটি ছেলে মেয়ের কথোপকথনের শব্দ, নিশ্বাস বন্ধ করে ভালোভাবে শুনে বলল যাক! অবশেষে এল তবে, আর একটু হলেই তো… কথাটি সম্পূর্ণ না করেই আবার যথাস্থানে বসে পড়ল সমরেশ। কয়েক মিনিটের মধ্যেই দুটি ছেলে ও দুটি মেয়ে যে যার মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট নিয়ে প্রতিদিনের ন্যায় এসে সমরেশের বাঁ দিকে কিছুটা দুরত্বে গোল হয়ে বসলো। সমরেশ এদের প্রত্যেকেরই নাম জানে কিন্তু সে তাদের পরিচিত নয়। শহরে এসে সপ্তাহ যেতে না যেতেই প্রাণ হাঁপিয়ে উঠেছে সমরেশের। এখানকার কোনোকিছুই তার মনোমত নয় সে মনেকরে এই শহরের বুকে একমাত্র সে-ই বেমানান, ঠিক যেমন সাদা জামায় লাগা ছোটো একটা দাগ। সাড়ে ছ-টায় কারখানার ডিউটি শেষ করে রোজই এই ফুটবল গ্রাউন্ডে আসে সমরেশ, ইস্পাত কারখানায় চাকরি পেয়ে গত সপ্তাহে যেদিন অদূরে গ্রাম ছেড়ে বিধবা মা’কে নিয়ে সুদূর এই কলকাতা শহরটিতে এসেছিল তখন থেকেই তার একাকীত্ব ঘিরে ফেলে তাকে। সারাদিনে বারো ঘন্টা কাজের পর সন্ধ্যে বেলায় একা এইখানে এসেই সেদিনও বসেছিল সমরেশ আর আজকের মতোই তার বাঁ দিকেই বসে তারা গিটার আর ফ্লুট বাজিয়ে গান গাইছিল। আজকে যেন ওরা সমরেশের প্রতি কেমন একটা দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে, দেখতে পেয়ে ইতস্তত করে অন্যদিকে মুখ ফেরালো সমরেশ একটু পরেই বুঝতে পারল ওপার থেকে কেউ একজন তার দিকে এগিয়ে আসছে, পায়ের শব্দ কাছে আসতেই তার হ়দস্পন্দন বেড়ে গেল তবুও সে সেদিকে তাকালো না অনড় তেমনই বসে রইল। পায়ের শব্দটা ঠিক তার পিছনে এসেই থেমে গেল। 


এই যে ভাই, তোমার সমস্যাটা কি বলো তো?


গত আট দশ দিন যাবত ওদের কথাবার্তা আর গান শুনে আসছে সমরেশ তাই আওয়াজটা চিনতে দেরি হলনা তার, এই ছেলেটি টিমের গিটারিস্ট অনিত। নিজেকে সংযত করে মুখ না ঘুরিয়েই সমরেশ বলল কই কিছু না তো, এমনিই বসে আছি। অনিত হাঁটুমুড়ে সমরেশের কাঁধে হাত দিয়ে বসে বলল, এমনি এমনি বসে আছো বলেই তো জিজ্ঞাসা করছি।


সমরেশ। মানে?


এইবার সমরেশ মুখ ফিরিয়ে ছেলেটির চেহারাটা দেখে নিল, তার একচুলও ভুল হয়নি অনিতই এসেছে কিন্তু কেন? কই এর আগেও তো রোজ সে এখানেই বসে থাকত তখন তো এরা কেউ কিছু বলেনি, আজকেইবা হল কি? ঠিক এগুলোই ভাবছিল সমরেশ।  


অনিত ইয়ার্কর ছলে বলল মানে এই যে তুমি পাঁচ ছয় দিন ধরে এখানে আসছো, রোজই চুপচাপ একা বসে থাকো, মোবাইলও দেখো না এটা বর্তমানে দুটো কারনে মানুষ করে থাকে। এক, হয় লোকটির মোবাইল ইন্টারনেট সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই আর দুই হচ্ছে খুব টেনশনে আছে। তা তোমার কোনটা বলো? এক না দুই? নাকি অন্য মতলব? 


ধরে নাও তিন, বলেই সমরেশ উঠে যেতে চাইতেই অনিত হাত টেনে আবার বসিয়ে বলল ভাই তোমার গলার আওয়াজটা দারুণ তো, তা গানটান করো নাকি? সমরেশ একটু যেন লজ্জা পেল বলল ওই একটু আধটু, সেভাবে শিখিনি কখনও।


গান সমরেশ শেখেনি ঠিকই কিন্তু গাইতে সে বেশ ভালোই পারে। গ্রামে একবার পূজোর সময় বন্ধু তাতাইয়ের অনেক অনুরোধের পর নবমীর সন্ধ্যা বেলায় সমরেশ “ও মাঝি রে” গানটা গেয়েছিল, গ্রামের ধনি ব্যাক্তি মোহিত চক্রবর্তী নগদ পাঁচশ টাকা পুরস্কারও দিয়েছিলেন। এসব অনেক আগের কথা কিন্ত আজ সেই দৃশ্যটাই তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। 


সমরেশের ডান হাতটা ধরে অনিত বলল আমদের টিমে আসবে অ্যাজ আ সিঙ্গার?। এই কথা শুনে সমরেশের আনন্দের আর অবধি রইলনা, এই একাকীত্ব কাটাতে সমরেশ একটা বন্ধুই খুঁজছিল। আজ চারজন বন্ধু হাতের কাছে পেয়ে সে আর কিছুতেই না বলতে পারলো না, সে জানে এই সুযোগ আর ফিরবার নয়। সমরেশ বলল সিঙ্গার হতে চাইনা, সে ইচ্ছাও নেই শুধু বন্ধু করলেই ঢের। 


অনিত। ঢের? বলছো যখন তবে চলো বাকিদের সাথে আলাপ করিয়ে দিই। 


এক এক করে সকলের সাথেই পরিচয় হল সমরেশের। সকলের নাম সে জানে তবুও শৈলশীখা নামটা একবারই নতুন লাগলো তার। এই দলের চারজনকেই সে প্রথমদিন থেকে দেখে আসছে ঐশি, সৌমিক, তৃণা আর অনিত কিন্তু শৈলশীখাকে সে কখনো দেখেনি এদের সাথে।


তা বন্ধু তোমাকে সমু বলে ডাকলে অসুবিধা নেই তো? বলল সৌমিক


- না কোন অসুবিধা নেই। সত্যি বলতে মা সমু বলেই ডাকে আমাকে।


- সত্যি কথাটি বলতো এইবার ভাই সমু, গার্লফ্রেন্ড ছেড়ে গেল কেন? 


- গার্লফ্রেন্ড এসেছিলই কখন যে ছেড়ে যাবে ভাই।


ঐশি গানের শেষ লাইনটা লিখে ডায়েরিটা বন্ধ করে বলল তোমার কি মনে হয় আমরা কিছু বুঝিনা নাকি? নিশ্চয়ই সুইসাইডের চিন্তা করছিলে একা একা এতক্ষণ কিন্তু আমাদের দেখে আর সেটা করতে পারলে না। তোমার ধন্যবাদ জানানো উচিৎ আমাদের জন্য তোমার প্রানটা বেঁচে গেল।


সমরেশ মৃদু হেসে বলল যা বুঝেছো সম্পূর্ণ ভুল বুঝেছ তুমি ঐশি। এসব কিছুই ভাবছিলাম না আমি।


তৃণারও এই একই ধারণা বলল হতেই পারেনা ভুল। ওই যে তোমার পাশে বসে সিগারেট টানছে না ওরও একই কেস হয়েছিল, ব্রেকআপ। নেহাত আমি ছিলাম তাই অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে ডিপ্রেশন থেকে বারকরে এনেছিলাম।


আর তার ফল কি হলো শেষে তোরই গলাতেই ঝুলছে বলে হি হি করে হেসে নিল ঐশি। সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে অনিত অর্ধেকটা সমরেশের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল ওদের কথা বাদ দাও, নাও কাউন্টার মারো। সমরেশ দু-তিনটা টান দিল। সৌমিক বলল যদি তোমার মনের মধ্যে সেরকম কিছু আছে তো শেয়ার করো, বন্ধু যখন হয়েছি তখন আর সমস্যা নেই নিশ্চয়। সমরেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল তার কথাগুলে ভালো করে সাজিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করলো। বাবা ছিলেন গ্রামের মন্দিরের নিত্যপূজারি, বাড়িতে মা আর আমি মিলিয়ে তিনজন লোক, অসুবিধা সেরকম হতো না। সরকারি স্কুল থেকে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে যেদিন কলেজে ভর্তি হলাম সন্ধ্যেবেলায় বাবা ডেকে বললেন দেখ সমু কলেজের খরচ অনেক তুই জানিস সে কথা।


বললাম হু জানি।


আমার রোজারগারও তেমন কিছু নয়, কোন ঠিক ঠিকানা নেই যখন যেমন হয়। যদি তুই কিছু একটা করিস তাহলে তোর পড়ার খরচটা আমার পক্ষে কিছুটা কম হবে। যদিও এখন তোর কাজ করার বয়স নয়, কিন্তু……। বাবা মাথা নিচু করে চুপ হয়ে গেল।


আমি জানি যে বাবার এই কথাগুলো বাবাকে ভেতরে ভেতরে কতটা কষ্ট দিচ্ছে এখন। যে বাবা আমাকে কোনদিন একটা খড়ের টুকরো পর্যন্ত হাতে করে সরাতে দেয়নি এমনকি মা যদি কখনও কিছু কাজ বলতো তাহলেই বাবার সাথে ঝগড়া হতো। বাবা বলতো ওকে কেন বলছো? ও পড়ুক, আমি করছি কি করতে হবে বল? মা বলতো দু -মিনিট বই ছেড়ে উঠলে বিরাট কিছু ক্ষতি হবেনা ওর। বাবা রেগে বলতো তুমি কি বোঝো পড়ার? ওকে একজন ভালো শিক্ষক হতে হবে, শিক্ষক হতে কত পড়তে হয় জানো? মা বলতো কত পড়তে হয় জানিনা কিন্তু কত টাকা লাগে তুমি জানো? বাড়িতে একটা লোক এলে চালে টান পড়ে, ছেলেকে করবে মাস্টার। এই শুনে বাবা আরও রেগে যেত বলতো কিডনি বেঁচব প্রয়োজন হলে। তোমাকে ভাবতে হবে না। সে কি যে যুদ্ধ বাঁধতো বলে বঝানো যায় না। শেষে কোনমতে আমি হাতে পায়ে ধরে চুপ করাতম। সেই বাবা আজ নিজের মুখে কাজ করতে বলছে, অবাক হইনি বরং খুশিই হলাম। বললাম আমিও এই কথাই ভাবছিলাম, পাশের গ্রামের রমেন কাকু তার দুটো ছেলেকে পড়াতে বলছিল, তুমি বললে হ্যাঁ বলে দিই? ববা মুখ তুলে বলল কত দেবে?


বললাম দুজন তো, তিনশ টাকা দেবে। একজন সেভেনে পড়ে, আর একজন ফাইভে আর কত দেবে। তারপর আরও কয়েকটা ছেলে জুটলে আর ভাবতে হবে না মাসে হাজার খানেক টাকা হবেই। বাবা বলল তাই কর।


 


নিজের পড়াশোনা আর টিউশান নিয়ে দারুণ রকম ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। আরও সাত আটটি ছেলেও জুটেছিল মাসখেনেকের মধ্যেই। সবকিছু ভালোভবেই চলছিল, একদিন রাত্রিবেলা পড়া সেরে খেতে বসেছি, প্রতিদিন বাবা আর আমি একসাথেই খাই আজ বাবাকে দেখতে না পেয়ে মাকে জিজ্ঞাসা করলাম বাবা খাবে না? মা আমার থালায় ভাত দিতে দিতে বলল তোর বাবার শরীরটা তেমন ভালো নেই বলছিল তাই আগেই খেয়ে শুয়ে পড়েছে। বাবার সাথে আর আগের মতো তেমন সময় কাটানো হয়না, শুনে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। খাওয়া শেষে বাবার কাছে গেলাম, বিছানায় একটা চাদর ঢাকা নিয়ে বাবা শুয়ে আছে, পা টিপে বাবার কাছে গেলাম।


কে সমু নাকি?


তুমি ঘুমাও নি বাবা? আমি তো ভাবলাম ঘুমিয়ে পড়েছ।


না রে ঘুমাই নি, আয় বোস।


বাবার পাশে গিয়ে বসলাম দেখলাম খাটের পিছনের জানালায় অনেকগুলো খবরের কাগজ থাক করে রাখা আছে। বললাম বাবা খবরের কাগজ পড়ছো কবে থেকে?


বাবা বলল ওটাই এখন আমার সময় কাটানোর সঙ্গী। তুই সারাদিন কলেজে থাকিস সন্ধ্যে হলে পড়াতে যাস, যখন বাড়ি আসিস তখন নিজের পড়া করিস। একা একা কি করবো তাই ওইগুলো পড়ি। 


নিজেকে কেন জানিনা অপরাধি মনে হতে লাগলো। মনে মনে ঠিক করলাম সারাদিন যতই ব্যস্ততা থাক আধঘণ্টা সময় বাবার জন্য বার করবই রোজ। বাবার গা হাত ছুঁয়ে দেখলাম একটু জ্বর আছে তাই আর বেশি কথা না বাড়িয়ে বললাম তুমি শুয়ে ঘুমাও এখন কাল আমার কলেজ ছুটি আছে দুজনে সারাদিন কথা বলবো কেমন। বাবা একদম আস্তে বলল একটু জল দে তো খুব তেষ্টা পাচ্ছে। পাশেই বোতলে জল ছিল তা-ই দিলাম বাবা একটু খেয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়লো।


সেদিন সারারাত চোখে পাতায় এক হলোনা আমার কিসের জন্য জানিনা, ভোরের দিকে কখন একটু চোখ লেগেছিল বুঝতে পারিনি চোখ খুললো মায়ের ডাকে। দরজা খুলতেই মা আমাকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদতে লাগলো। মায়ের চোখের জল ভিজিয়ে দিল আমার গোটা বুকটা, চামড়া চুঁইয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে লাগলো সেই জলের অসহ্য ব্যথা। মাকে প্রশ্ন করলাম কি হয়েছে? বাবা ঠিক আছে তো? মা বলল তোর বাবা আর নেই। 


 


এতদূর বলেই সমরেশ আকাশের দিকে চেয়ে একটা বড় নিশ্বাস ছাড়ল। কি হয়েছিল তোমার বাবার? অনিত প্রশ্ন করলো। সৌমিক, ঐশি, তৃণা অপলক চোখে চেয়ে আছে সমরেশের দিকে। সমরেশ ডান চোখের কোনের জলবিন্দু মুছে বলল ঘুমের মধ্যেই হার্টফেল করেছিল বাবা।


অনিত বলল ওহ্ সো স্যাড। তারপর?


সমরেশ একটা বড় শ্বাস নিয়ে বলল তারপর ঘরের আর পড়াশোনার খরচ সামাল দিতে না পেরে পড়া ছেড়ে দিলাম।


ঐশি বলল কিন্তু তোমার বাবা চাইতেন তুমি টিচার হবে, তাহলে পড়া ছাড়লে কেন?


সমরেশ বলল টিউশান পড়িয়ে মাসে দু হাজার টাকা পেতাম তার মধ্যে পড়ার নোটস কিনতেই সাতশ আটশো টাকা খরচ হতো বাকি বারোশ টাকায় আমাদের দুটো মানুষের তিনবেলা খাওয়া-পরা চলবে কি করে ভেবেই পড়া ছাড়লাম। 


তৃণা প্রশ্ন করলো গ্রাম থেকে কলকাতায় এলে কিভাবে? 


সমরেশ বলল টিউশনি পড়িয়ে যা পাচ্ছিলাম তাতেই চলল মাস আটেক তারপর আস্তে আস্তে ছাত্র কমতে শুরু করলো রোজগারও কমল। একদিন হাঠাৎ এক স্কুলের বন্ধুর দেখা মিলল ওকে একটা কাজের জন্য বললাম, বর্তমানে এই ইস্পাত কারখানার কাজটা ওরই করে দেওয়া। এই সাতদিন আগে কলতায় এলাম মাকে নিয়ে। নতুন সহর নতুন লোক সব নতুনের মধ্যে পরিচিত একমাত্র মা, একদিন যখন জীবন অতিষ্ট হয়ে উঠলো রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম, কোন গন্তব্য নেই উদ্দেশ্যও নেই, হাঁটতে হাঁটতে বোধহয় পথ ভুল করেই এই মাঠে এসে পড়লাম। তোমরা সেদিন এই চারজনই ছিলে অনিত গিটার বাজাচ্ছিল আর তৃণা আর সৌমিক গাইছিল, ব্যস বসে পড়লাম আর কি।


সৌমিক বলল তারপর থেকে রোজ আসতে শুরু করলে তাই তো?


সমরেশ বলল হ্যাঁ। আজ আস্তে দেরি হচ্ছে দেখে আমি তো চলেই যাচ্ছিলাম হঠাৎ তোমাদের দেখতে পেয়ে আবার বসে পড়লাম। 


অনিত গিটারটা কোলে তুলে বলল দূরে বসে রইতে কেন? কাছে এসে কথাবার্তা বললেও তো পারতে, নাকি কাছে এলে আমরা তোমাকে খেয়ে ফেলবো ভাবতে?


সমরেশ একটু হেসে বলল হয়তো তাই, ঠিক মনে পড়ছে না। সমরেশের কথা শুনে সবাই হেসে উঠলো।


ঐশি হাতের ঘড়ি দেখে বলল চল, সাড়ে ন টা বেজে গেছে বাড়ি যাবি না তোরা?


সবাই যে যার জিনিস পত্র নিয়ে উঠে গেল, যাওয়ার আগে সৌমিক বলল সমু আজ উঠলাম, কাল আাবার এখানেই দেখা হচ্ছে তো?


সমরেশ তখনও বসে আছে, হেসে বলল নিশ্চয়। 


সমরেশের এতদিনের জীবনকাহিনীর সমস্তটাই সে বলল শুধু বলেনি তার দিদি পূর্ণার কথা। তার বাবার কাছে পূর্ণা ছিল সমরেশের চাইতেও বেশি আদরের। তার প্রত্যেকটি আবদার, বায়না সবকিছুই তিনি পরম স্নেহের সাথে পুরণ করতেন। পূর্ণা যেদিন ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে গ্রাজুয়েট হয়ে বাড়ি ফিরলো বাবা মাথায় হাত রেখে বলল তুই আমার নাম উজ্বল করলি মা আাশির্বাদ করি সারা জীবন যেন তুই সুখি থাকিস, তোর সকল ইচ্ছা পূর্ণ হোউক। পরদিন সকালবেলা পূর্ণা বাবার নিত্য পূজার ফুল তুলে বাড়ি ফিরলে পূর্ণার মা ডেকে বলল তোর বাবা বলছিল একজন ভালো ছেলের সন্ধান আছে, সরকারি চাকরি করে মাস গেলে চল্লিশ হাজার টাকা বেতন পায়। তুই বললে হ্যাঁ বলে দিই?


পূর্ণা বলল না মা আমি অন্য একজনকে বিয়ে করতে চাই, আমি তাকে ভালোবাসি।


পূর্ণার মা রেগে বলল এই জন্যই তোর বাপকে আমি বলেছিলাম মেয়েকে নজরে নজরে রাখবে বড় হচ্ছে তখন আবার বড় গলায় বলতো আমার মেয়ে ভুল কোন কাজ করবে না সে আমার বিশ্বাস আছে, দেখ এবার বিশ্বাস কোথায় নিশ্বাস নিচ্ছে। তা বলি ছেলেটি জাতের না অজাত? 


মায়ের কথা শুনে পূর্ণাও আর রাগ সামলাতে পারলো না সেও একটু জোর গলাতেই বলল জাত এখন কে দেখে মা? তাছাড়া ওরাও ব্রাহ্মণ তার চেয়েও বড় কথা কোটি টাকার ব্যবসা আছে ওদের আমাদের মতো হাভাত নয়।


চিৎকার শুনে সমরেশের বাবা ও সমরেশ দুজনই উঠোনে বেরিয়ে এল, সমরেশের বাবা বলল কি হয়েছে? মা মেয়েতে সকাল সকাল চেঁচামেচি করছো কেন?


পূর্ণার মা বলল চেঁচামেচি করছি কি আর সাধে, এই যে তোমার আদুরে মেয়েটি কোন ছেলের সাথে ভাব করেছে তাকেই নাকি বিয়ে করবে। এবার গাঁয়ের লোকে বলে বেড়াবে অমুকের মেয়ে ভাব করে বিয়ে করেছে। লোকের মুখে ছি ছি তোমার শুনতে ভালো লাগবে? 


সমরেশ পূর্ণার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল কেউ ছি ছি করবে না মা, তুমিই ভুল ভাবছো। এখনকার দিনে বেশিরভাগ লোকই লাভ ম্যারেজ করে এতে কারোও মান সম্মান যায় না। লোকের সাথে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিদির জীবনটা শেষ করে দিও না ওকে ওর মতো করে বাঁচতে দাও।


সেদিন অনেক কষ্টে বোঝাবুঝি করে পূর্ণার তার পছন্দের ছেলেটির সাথে বিয়ে দেওয়ার  জন্য মা কে রাজি করিয়েছিল সমরেশ। 


সৌমিক, তৃণা, ঐশি, অনিত সবাই চলে যাওয়ার পর একলা মাঠে শুয়ে শুয়ে এসবই ভাবছিল সমরেশ, ধ্যান ভাঙ্গলো একটা বড় ট্রাকের জোরালো হর্ণের শব্দে। সময় অনেকটাই গড়িয়ে গেছে তখন, দশটা বাজে। বাড়ি ফিরে দরজায় দুবার নক্ করতেই একটি বছর পনেরো বয়সের মেয়ে দরজা খুলে বলল সমুদা সেই এলিই যখন তাহলে দেরি করলি কেন? 


মেয়েটিকে সমরেশ আগে কখনও দেখেনি, বলল আমাকে তুই বলছিস যে, আমি তোর থেকে কত বয়সে বড় জানিস? কে তুই? কি নাম? সমরেশের মা রান্নাঘর থেকে একটা বাটিতে আলুর দম নিয়ে বেরিয়ে এসে মেয়েটির হাতে দিয়ে বলল যা তুই ওখানে বসে খা মা।  সমরেশকে দেখতে পেয়ে বলল কি রে এত দেরি করলি কেন? আমার কত চিন্তা হচ্ছিল। সমরেশ তার মা কে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই বলল আরে সেসব পরে বলছি আগে বল ওই মেয়েটি কে? মেয়েটি আলুর দম খেতে খেতে বলল সব বলবো আগে ভেতরে আয় বোস জল খা তারপর বলবো। সমরেশ জুতো খুলতে খুলতে বলল দেখছো মা কি রকম আমাকে তুই-তাকারি করছে। পূর্ণার কথা মনে পড়াতে সমরেশের মনটা এমনিতেই বিগড়ে ছিল তারপর বাড়িতে এসে ছোটো মেয়েটির মুখে তুই শব্দটি শুনে ওর রাগ আরও বেড়ে গেল। ভেতরে এসে মেয়েটিকে বলল তুই আমার বাড়ি আসবি না কোনদিন, পাজি মেয়ে কোথাকার, বদমায়েশ। যা চলে যা এখুনি। 


মেয়েটির মুখ লাল হয়েগেল নিমেষেই, চোখ থেকে বড় বড় জলের ফোঁটা গড়িয়ে এলো থুঁতনির ওপর, কয়েককটা টপকে পড়লো হাতে ধরা আলুর দমের বাটিটাতে। বাঁ হাতে চোখ মুছে বলল, আমার নিজের দাদা থাকলে কি আমি তাকে তুমি বলতাম? না তোমার বোন থাকলে সে তোমাকে তুমি বলতো বলো? আমি চলে যাচ্ছি আর কখখনও আসবো না এই ঘরে। বলেই, মেয়েটি অবশিষ্ট আলুরদম সমেত বাটিটা চেয়ারের নিচে রেখে এঁঠো হাতেই বেরিয়ে গেল। সমরেশের মা বলল, এটা কি ঠিক করলি তুই সমু? আহা অমন লক্ষি প্রতিমার মতো দেখেতে একটা বা্চ্চা মেয়েকে ওভাবে কেউ কাঁদায়। কত আবদার করে একটু আলুর দম খেতে চাইলো তুই সেটাও খেতে দিলিনা মেয়েটাকে, ছি ছি। সে রাতে মা মুখভার করেই রইল, আর কোনো কথাই হলো না।


পরদিন সকালবেলা সমরেশ সময়ের আগেই ঘুম থেকে উঠেছে কারণ রাত্তিরটা তারও ভালো যায়নি। মেয়েটিকে বলা কাথাগুলো বারবার তাকে বিঁধেছে। মা এসে চা দিয়ে গেল এখনও মুখ ভার তার দেখলো সমরেশ। সে বুঝতে পারছে মেয়েটিকে ওই কথাগুলি বলা তার ঠিক হয়নি কিন্তু এখন তার চেয়ে মা কে আগে খুশি করতে হবে এই ভেবে সমরেশ বলল মা আজ চল কোথাও ঘুরে আসি না। উত্তরে মা কিছুই বলল না। সমরেশ জানে যতক্ষণ না মেয়েটি হাসিমুখে আবার তার বাড়িতে আসছে ততক্ষণ মা খুশি হবে না। সে আজ মাঠের আড্ডায় বেশিক্ষণ রইলো না, ফেরার পথে একখানা ক্যাডবেরি সেলিব্রেশন প্যাক নিয়ে এসে মা কে বলল। একবার ওকে ডাক না মা?


মা গম্ভীর স্বরে বলল কি হবে? আবার কথা শোনাবি নাকি?


না গত রাতে যে ভুল করেছি তার ক্ষমা প্রার্থনা করবো।


সত্যি তাই করবি?


হ্যাঁ  তাই করব, শুধু একবার ডাকো না তাকে। 


আচ্ছা, আমাদের নিচের বাড়িতেই থাকে। ডাকছি দাঁড়া। বলে সমরেশের মা চলে গেল। সমরেশ মায়ের মুখে সেই হাসিটা আবার দেখতে চায় যেটা তার মা’র মুখে সে গত রাতে দেখেছিল আর দেখেছিল যখন পূর্ণা মা’র কাছে ছিল। এ হাসির বর্ণনা করা যায় না, এ অমূল্য। একটু পরে মা মেয়েটিকে সঙ্গে করে নিয়ে এল, সে সমরেশকে একবার দেখে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়াল। সমরেশ মেয়েটির কাছে এসে বলল খুব রেগে আছিস না আমার ওপর? 


মেয়েটি তেমনিই মুখ ফিরিয়ে বলল না।   


সমরেশ বলল না বললেই হলো, আচ্ছা চল সরি বললাম, এবার খুশি তো? দেখ তোর জন্য কি এনেছি বলে চকলেটের প্যাকেটটা মেয়েটির দিকে বাড়িয়ে দিল।


এইবার আর সে রাগ করে রইতে পারলো না প্যাকেটটা হাতে নিয়ে বলল নিচ্ছি, কিন্তু রাগ এখনও আমার ভাঙ্গেনি। আগে বল তুমি কাল বকলে কেন?


এই তুমি বলছিস কেন রে তুই?


লে, কাল তুমিই তো বললে বড়দের তুমি বলতে হয় তাই বলছি।


আর তুই কি বলেছিলি মনে নেই তোর?


তুই বলেছিলাম, মনে আছে তো।


না, বলেছিলি নিজের দাদাকে বা বোনকে কেউ তুমি বলে না।


সে বলতে পারি, তুমি বকবে না তো আর?


বকব বৈ কি, এবার থেকে তুমি বললেই বকব।


যা তো, আমার তুমি বলতে দায় পড়েছে তোকে।


সমরেশ একটু হেসে বলল তোর নামটা তো বললি না বোন। 


রিতা, কেউ কেউ রিত বলেও ডাকে ।


সমরেশের মায়ের চোখ দুটো জলে ভরে গেছে, পাশেই দাঁড়িয়ে সব দেখে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে রিতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল তোদের এই ভাই বোনের জুটি যেন কোনদিন না ভাঙ্গে। ভগবান তোদের মঙ্গল করুক। বলে শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে নিজের ঘরে চলে গেল। সমরেশ জানে তার মায়ের যখন পূর্ণার কথা মনে পড়ে তখনই মা এইভাবে কাঁদে, এই প্রথম দেখলো তা নয় এর আগেও দিনের পর দিন রাতের পর রাত এমন সময় সে মায়ের পাশে থেকে সান্তনা দিয়েছে বহুবার। রিতা বলল এই সুমুদা তোর ঘরে যে বইগুলো আছে ওগুলো কি গল্পের?


সমরেশ নিচু গলায় বলল হু, তুই নিবি?


আমি নিয়ে কি করবো? বাংলা পড়তেই পারিনা। ইংরেজি হলে হতো।


বাংলা পড়তে পারিসনা কেন?


আমি তো ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ি। 


সেখানে বাংলা সাবজেক্ট পড়ায় না? 


পড়ায় তো, কিন্তু বাড়িতে কে পড়াবে? মা ইংরেজি পড়তে পারে বাংলা পারেনা তাই আমারও বাংলা পড়া হয়না। 


তোর বাবাও পারে না বাংলা পড়তে?


কি জানি পারে হয়ত।


তুই জানিস না?


জানবো কি করে। এবার রিতা নিরাশ স্বরে বলল সেই যে বাবা কি কাজের জন্য গেল আর এলই না।


শুনে সমরেশের মনে কষ্ট হল কারণ বাবা হারানোর ব্যথা সে জানে, বলল আচ্ছা আমি গল্পগুলো পড়বো তুই শুনবি কেমন। পরে তোকে বাংলা লিখতে পড়তে শিখিয়ে দেব।


মেয়েটি খুশি হয়ে বলল আজই একটা গল্প শোনা তবে। 


রিতা বইয়ের কভারের ছবি দেখে একটা বই বেছে নিল। সমরেশের গল্পটি পড়া শেষ হল যখন সময় দশটা বেজে গেছে। রিতা গল্পের কি বা কতটুকু বুঝলো বলা মুশকিল, আস্তে করে বলল সমুদা আমাকে একবার গ্রামে নিয়ে যাবি? খুব ইচ্ছা গ্রাম দেখার। সমরেশ ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে বলল সে না হয় নিয়ে যাব কিন্তু এখন তুই ঘর যাবি তো নাকি? দেখেছিস রাত দশটা বাজে।


রিতা বোধহয় তখনও খোলা চোখে গ্রামের স্বপ্ন দেখছিল, আনমনে বলল এখন গিয়ে কি করবো? মা আসবে তো সাড়ে দশটায়। সমরেশ বইটা যথাস্থানে রেখে ফিরে এল।


তোর মা কোথায় যায়?


লোকেদের বাড়ি, কাজ করতে। 


তুই বাড়িতে কি করিস তখন?


আমি স্কুলে যাওয়ার পর মা যায় আর আসার আগেই চলে আসে তারপর বিকেলে আবার যায় আমি তখন কখনও পড়ি আর যখন পড়তে আর ভালো লাগেনা তখন একা একা বাইরের দিকের জানলাটা খুলে তাকিয়ে বসে বসে কি ভাবি কে জানে? তারপর সন্ধ্যে হলে হাতমুখ ধুয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে পড়তে বসি আবার, কখনও কখনও ঘুমিয়ে যাই পরে মা সেই রাতে দশটা এগারোটায় এলে আমাকে তোলে, তখন উঠে খাবার খাই আবার শুয়ে পড়ি। রিতা একটু দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করলো, বিরতিতে সমরেশও কিছুই বলল না অপলক রিতার দিকেই তাকিয়ে রইল। বলল, বেশি কাজ থাকে দূর্গা পূজার সময় তখন আমিও মায়ের সাথে যাই, মা ওদের সব কাজ করে দেয় রান্না করে, ঘর মোছে, সব কাজ করে আর আমি ওদের চেয়ার, টেবিল সোফা এসব মুছামুছি করি। ফেরার সময় ওরা আমাকে দুটা তিনটা জামা দেয় আর হাতে একশ দুশ টাকাও দেয়। রিতা কিছুক্ষণ চুপ করে কি যেন ভাবলো তারপর দুচোখ জল নিয়ে বলল যদি বাবা ফিরে আসতো তাহলে আমাকে ওই জামা পরতে হতো না। ওগুলো পুরোনো, পরতে আমার একদম ইচ্ছে হয় না কিন্তু কি করবি মায়ের অত টাকা কই। রিতা আবার চুপ হয়ে গেল। একটু পরেই তার মুখটা জ্বলে উঠল একটা আনন্দে, বলল, জানিস সমুদা এই তো আর কদিন পর দূর্গাপূজা মা বলেছে এবার নতুন একটা ড্রেস কিনে দেবে। এবার রিতা একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল এই বছর আর লোকের পুরোনো জিনিস পরতে হবে না।


সমরেশের গত রাতের কথা মনে পড়লো ভাবলো এই মেয়েটিকে সে রাগে কত কিই না বলেছে, রিতাও তার মতই একাকিত্বে ভুগছে, এ যে একটা ভালোবাসার কাঙাল ছাড়া আর কিছুই নয়। এইটুকু মনে এতটা কষ্ট চেপে রেখে সে কিভাবে অমন খিলখিল করে হাসতে পারে আমি জানিনা কই আমি তো পারিনি একটা সময় আমিও একাকিত্বের শিকার ছিলাম। মনে মনে বলল ওর এই হাসার ক্ষমতা ইশ্বর এমনিই রাখো চিরদিন, এই গরিব মেয়েটির সহায় হও ভাগবান তাকে আর কষ্ট দিও না। 


সমরেশ আনমনা হয়ে পড়েছিল তাই দেখে রিতা একটু ধাক্কা দিয়ে সমরেশকে ডেকে বলল কি ভাবছিস রে তুই?


সমরেশের চোখদুটি জলে টলমল করছে রিতার এই একটু আলতো ধাক্কাতেই রিতার হাতের ওপর টপ টপ দুটো ফোটা পড়ল। রিতা তা লক্ষ্য করেই বলল এ মা তুই কাঁদছিস কেন রে? সমরেশ উত্তর দিলনা প্রশ্নটা এড়িয়ে চোখ মুছে বলল, কাল যাবি আমার সাথে?


কোথায়?


গেলেই দেখতে পাবি, যাবি?


আইসক্রিম খাওয়ালে যেতে পারি।


যত খাবি খাওয়াবো, যাবি তো?


আচ্ছা, কিন্তু মা যদি যেতে না দেয়?


আমি তোর মা কে বলে দেব।


হুম ঠিক আছে।


সমরেশের মা দুটি থালাতে খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকলো। কি রে তোদের খিদে পায়নি নাকি? সময়টা দেখেছিস তোরা? বলেই খালাদুটি দুজানর হাতে দিয়ে বলল তোরা খা আমি জল নিয়ে আসছি। 


রিতা বলল কিন্তু একটু পরেই মা আসবে খাবার নিয়ে, এখন খেলে তখন খেতে পারবো না তো জেঠিমা।


মা বলল তখন না খাস না খাবি, এখন না খেয়ে তোকে কিছুতেই যেতে দেবো না আমি।


রিতা বলল আচ্ছা রাগ করো না জেঠিমা, দাও খাচ্ছি। 


খাওয়া শেষ করে হাত মুখ ধুয়ে শমরেশ বলল চল তোকে রেখে আসি।


রিতা বলল রেখে আসতে হবে কেন আমার ঘর কি দশ কিলোমিটার দূর? একাই যেতে পারবো এই তো তোর নিচেই থাকি। জানিস না?


হুম সে জানি। কিন্তু তোর মায়ের সাথে কথা বলতে হবে যে, কাল বেরোবো না তুই আর আমি?


ও হ্যাঁ তাই তো, চল তবে।


নিচে এসে দরজার পাশের জানলার কপাট ঠেলে চাবি বের করে দরজা খুলল রিতা।


আয় সমু দা। মা এল বলেই, তুই একটু বোস আমি জানলাগুলো খুলে দিই ঘরটা বড্ড গুমোট হয়ে গেছে। বলেই, রিতা এক এক করে সব জানলা খুলতে শুরু করলো। ঘড়িতে এগারোটা পনেরো, একজন চল্লিশ -পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সি মহিলা ঘরে ঢুকে সমরেশকে দেখে থমকে দাঁড়ালো। সন্দেহ গলায় বলল, কে? কে আপনি? রিতা কই? সমরেশ কিছু বলার আগেই রিতা পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল মা ও সমু দাদা, আমাদের ওপর তলায় থাকে। রিতার মা জোর গলায় বলল সে যে দাদাই হোক। তোকে বলেছি না আমি বাড়িতে না থাকলে কাউকে ঢুকতে দিবি না। রিতার মুখ শুকিয়ে গেল সে মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে রইল কিছুই বলল না। 


সমরেশ বলল কাকিমা ভুল বুঝবেন না, আমি সাতদিন হলো ওপর তলার ঘরটা ভাড়া নিয়েছি, আমি আর আমার মা থাকি। রিতাকে আমি নিজের বোনের মতই দেখি। আপনার সন্দেহ হওয়াটা স্বাভাবিক কিন্তু আপনি আমাকে নিজের ছেলে ভাবতে পারেন।


রিতার মা বলল আচ্ছা, কিছু মনে করো না বাবা যা দিন কাল পড়েছে! ভাবতে বাধ্য হই।


রিতার মা হাতের কালো প্লাস্টিকটা টেবিলে রেখে বলল রিতা নিশ্চয় তোমার ঘরে গিয়েছিল?


হ্যাঁ তা গিয়েছিল বটে তাতে কি কোন দোষ হয়েছে কাকিমা? 


না বাবা দোষের কথা বলছি না।


তবে?


আগে যারা ওই ঘরে থাকতো রিতা সময় কাটাতে তাদের কাছে যেত প্রথম প্রথম সব ঠিক ছিল কিনতু পরে যখন ওরা জানতে পারলো আমি লোকের বাড়িতে কাজ করি তখন আর ওরা রিতাকে দেখতে পারতো না। অমুকের মেয়ে তোসুকের মেয়ে লে কথা শোনাতো। আচ্ছা কাজের কি ছোট বড় হয় তুমি বলো? সবাই পেটের জ্বালা মেটাতে কাজ করে কেউ ভালো কেউ খারাপ। আমি তো খারাপ কিছু করি না লোকের বাড়ির ঝি – এর কাজ করি এতে লজ্জার কি আছে বলো? রিতার মা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলো। সমরেশ একটু ইতস্তত করে বলল আপনি কাঁদছেন কেন? চোখ থাকলেও সবাই সমান দেখে না কাকিমা, মনে রাখবেন লোকের কথায় নিজেকে কষ্ট দেওয়া নিতান্তই বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। আপনি কাঁদবেন না।


সে আমি বুঝি বাবা, তবুও তো, মেয়ে বড় হয়েছে আর অবুঝ নেই সে এই সব শুনলে আমাকে কি ভাববে বলো তো? ওর বাবা নেই, একা হাতে কত কষ্ট করে মানুষ করেছি মেয়েকে, সেও যদি ভুল বুঝে বসে কখনও আমার মরা ছাড়া আর কি রাস্তা আছে বলো? 


রিতা পিছন থেকে মা কে আলিঙ্গন করে বলল উুঁ, লোকে বললেই শুনবো কেন আমি। আমি জানি ইউ আর দ্যা বেস্ট। 


সমরেশ বলল কিছু মনে করবেন না কাকিমা, বলতে পারেন রিতার বাবা কোথায় গেছে? আপনার কপালে এখনও সিন্দুর আছে ……। সমরেশকে কথাটা সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই রিতার মা বলল ছেড়ে চলে গেল অনেকদিন আগে।


ছেড়ে গেল কেন কাকিমা? 


সে অনেক কথা, পুরোনো ঘা খুঁচিয়ে লাভ কি? তার চেয়ে বরং আমার দুঃখ আমারই থাক।


বললে মন হালকা হয় কষ্টও কমে কাকিমা, দ্বিধা বোধ না করলে বলতে পারেন। আচ্ছা আর একটা কথা বলার আছে কাকিমা, কাল রিতাকে নিয়ে পূজার বাজার করতে যেতে চাই যদি আপনি সম্মতি দেন তো।


ওই দেখ, এতে আমার মতের কি দরকার? দাদা বোন ঘুরতে গেলে মায়ের অমত কি থাকাতে পারে বাবা। যাও না, ঘুরে এসো। 


রিতার মা আরও একবার আঁচলে চোখ মুছে বলল মেয়েটাকে আজ অবধি তো কিছুই দিতে পারিনি, না ভলো মন্দ দুটো খাওয়াতে পেরেছি না পরাতে পেরেছি। মেয়ের আমার সত্যিই তুলনা হয়না, যা পেয়েছে যতটুকু পেয়েছে তাই দিয়েই দিন কাটিয়েছে ভুলেও কোনদিন কোন অভিযোগ করেনি। আজ ভগবান তার দিকে চেয়েছেন তার কপালে ভালো কিছু জোটাতে চাইলে আমি অভাগীনি বাধা দেব কেন বল।


সমরেশ বলল আচ্ছা কামিমা আজ আসছি তবে। রিতার দিকে তাকিয়ে বলল কাল বিকেলে পাঁচটায় তৈরি থাকিস।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ