রানির মা ~ তসলিম পাটোয়ারী।।




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

রানির মা। রাজরানির মা নয়। মেয়ের নাম রানি বলেই সে রানির মা।


তেরোচৌদ্দ বছরের রানি। পড়শির চোখে সুন্দর, কিন্তু মায়ের চোখে সর্বাঙ্গসুন্দর, পাড়ার আট-দশটা মেয়ের চেয়ে সুন্দর। রানির মা রানির বাবাকে বলে, যেরুম সোন্দর অইছে রানি, হেরুম সোন্দর কোয়াল অর অইবো নি জানি! রানির বাবা বলে, দেহিছ, আল্লায় দিলে অর কতো সম্বন্ধ আইয়ে। 


কিন্তু রানির মা'র ভয়, সম্বন্ধের আগেই যদি কিছু হয়! এতোদিন ছোট বোনটা ছিলো, তার বিয়ে হয়ে গেছে, এখন একলা বাড়িতে রানি কেমন করে থাকে। সে মেয়েকে ঘরেও রেখে যেতে পারে না, সাথে করেও নিয়ে যেতে পারে না। রেখে গেলে ভয়- বাবার পঙ্গুত্বের সুযোগে যদি কিছু হয়, গৃহস্থ বাড়িতে ভয়- সে থাকবে কাজে, তার অগোচরে যদি কিছু হয়। শয়তান ছেলে-বুড়া সবখানেই আছে। রানির মা অনেক ভেবেচিন্তে দেখলো, সীমানার বলই বল- বাড়িতে বিপদ হলেও ওর বাবার চিৎকারে পড়শিরা আসবে, কিন্তু পরের বাড়িতে কাজের বেটির চিৎকারে কে আসবে। রানির মা মেয়েকে তার বাবার কাছেই রেখে যায়। সে ঘর ছাড়ার সময়- আল্লারে কয়; রানি যেন্ সহিসালামতে রয়, স্বামীরে কয়; অরে ডাইক্কা ডুইক্কা রাইখ্যেন, যেন্ চোক্ষের সামনে রয়। 


এই সেদিনও রাজারা, জমিদাররা, প্রজাদের উঠানে আঙিনায় জলসা বসাতো। তাদের পাইক পেয়াদারা সেখান থেকে সুন্দরী মেয়েদের তুলে নিয়ে যেতো, মেয়েদের কেউ কেউ রানিও হতো! কিন্তু দেশে এখন যে তন্ত্রই থাকুক সেই রাজতন্ত্র, জমিদারতন্ত্র নেই। থাকলে একদিন রানিও হয়তো হতে পারতো হেরেমের মহারানি বা রানি বা উপরানি; জিন্দেগীভর থাকতে পারতো গা গতর ছড়িয়ে, পুষ্পশয্যায় গড়িয়ে। তবে রাষ্ট্র যদি, 'অফ-বাই-ফর দি পিপল' হয়, তবে যে কোনো রানিই হতে পারে সোনার কন্যা, রাজলক্ষ্মী, লক্ষ্মীস্বরূপিণী। মেয়ের এমন সৌভাগ্য সব মা-বাবা ই চান। 


রানি যখন পেটে ছিলো, তখন তাদের উঠানের উপর এসে ভনভন করছিলো মৌমাছিরা। রানির বাবা ঘরের পিঁড়ায় বসে বিড়ি টানছিলো। রানির মা খেপে বললো, বিড়িডা নিবান ত, মধুহোক গুলি বইবো লাগে, ধুমা লাগলে যাইবো গিয়া। রানির বাবা সঙ্গে সঙ্গেই পিঁড়ার মাটিতে বিড়ি গুঁজে বললো, হুন্, মধুহোকেগো একজন রানি থাহে, রানি যেমি যায় প্রজারাও হেমি যায়, রানি যিয়ানো বইয়ে প্রজারাও হিয়ানো বইয়ে, রানিরে আগে বওয়া; ঢেহিত কয়ডা পাহার দে গিয়া, দেহিছ রানি বইয়া হড়বো। রানির মা গিয়ে ধুপ ধুপ ঢেঁকিতে ক'টি পাড় দেয়। তাতেই ফল হয়, মৌমাছিরা বসে পড়ে। 


মক্ষীরানি হয়তো ভেবেছিলো, সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ যেমন পলাশিতে তোপ দাগিয়েছিলো সুবে বাংলাকে দখল করতে, তেমনি তার চৌহদ্দির মধুপুষ্পরাজ্য দখল করতে কোনো অপশক্তি এসে বুঝি তোপ দাগিয়েছে। প্রতিরোধের ছক কষার জন্য রানি তাই বসে পড়ে। দু'শ বৎসর বসে বসে ছক কষে কষে যেমন ইংরেজ প্রতিরোধ করেছিলাম আমরা। 


মক্ষীরানি বসে পড়লো রানির মা'র ঘরের উপরের উঁচু আমগাছটার বাঁকা মোটা ডালে। মৌমাছিরা তাকে ঘিরে বসলে মধুজালক বড়ো হয়ে উঠলো- রানির মা'র পেটের মতো। রানির মা মুচকি হেসে স্বামীকে বললো, পাহার দেওনে কাম অইছে, তয় হুনেন, আমনে যে নামডা কইলেন 'রানি', নামডা খুব সোন্দর, আঙ্গো যদি মাইয়া অয়, তয় নাম রাহুম রানি, আর যদি পোলা অয়, নাম রাহুম রাজা। স্বামী হেসে বললো, অইলো, রাহিছ। 


ইংল্যান্ডের রানির মধু আহরণ ক্ষেত্র এতো বড়ো ছিলো যে, তার মধুজায় সূর্যাস্ত যেতো না। কিন্তু এই মক্ষীরানির মধুজা বড়োজোর দশবারো মাইল। নারী মৌমাছিরা গিয়ে ভোঁ ভোঁ করে জাগিয়ে তোলে ফুলেদের। পুরুষ ফুলের রেণুদন্ডে লেগে রেণু মেখে নেয় হাতে-পায়। সে রেণু স্ত্রী ফুলের যোনিমুন্ডে ঘষে ঘষে ঢুকায়- গর্ভাশয় হয়ে উঠে ফল, ডিম্বগুলি বীজ। খুশিতে গদোগদো ফুলেরা ঘটকী মধুকরীদেরকে বখশিশ দেয় রেণু রেণু মধু। সেই মধু নিয়ে মধুপবনে ভেসে ভেসে মধুপেরা ফিরে আসে মৌচাকে; মধু ঢেলে দেয় প্রকোষ্ঠে প্রকোষ্ঠে; টইটুম্বুর হয়ে উঠে মধুকোষ। 


ঝানু মৌয়াল বললো, রানির বাপ, চাকটা কলসির মতনই- উরপের দিগডা ভারি অইছে, নিচের দিগডা চিক্কণ ই, রংডাও অইলদা অইছে, কাডনের সময় অইছে। দুই দিন পরে সন্ধ্যায় মৌয়াল আসে। সে ও রানির বাবা খড় দিয়ে  কিশোরীর বেণির মতো বেণি বানায়-  তাতে ধোঁয়া করবে, ধোঁয়া দিয়ে মৌমাছি তাড়াবে, তারপর ভাঙবে মধুসিন্ধুক। 


রানি তখন মায়ের পেটে হরদম ঘাই মারছিলো। রানির মা বুঝলো, মৌচাকের মতো উপুড় হয়ে থাকা তার জরায়ু কলসিটাও ভেঙে যাওয়ার সময় হয়েছে। হয়তো তাই মৌমাছিদের জন্য তার মায়া জেগে উঠে। সে স্বামীকে বললো, চাইয়েন একটা মধুহোকও যেন্ না মরে, দরকার অয় দুইডা কামড় খাইয়েন, মধু ডইল্লা দিলে ঠিক অইয়া যাইবো। স্বামী বললো, বুঝ্ঝি, পোকজোঁক বেকই অহন তোর কাছে পেডের আবুদের লাহান। 


মৌয়াল বললো, ঠিকই বইন, আমাগো মতন অগও পরান আছে, কিন্তুক আমরা অগরে মারি, জোর কইরা খেদাই, আমরা যতই কই- মধুর এই গুণ আছে, মধুর হেই গুণ আছে, গুণতো থাকবোই, তয় হাচা কতা অইলো আমরা তিল তিল কইরা অগো জমানো মধু চুরিই করি, ডাহাতিই করি, এই জন্যই মধু খাইয়া মাইষে চোর হয়, ডাহাইত হয়, দুধ দোয়ানের সময় গাইয়ে তার ডেহার লাইগ্গা ওলান খিচ্চা দুধ রাহে, আমরা গাইয়েরেই কই দুধ চোর, অরে পিডাই, গরুর দুধ অয় অর বাছুরের লাইগ্গা, জোর কইরা হেই দুধ আমরা খাই, এইজন্যই আমরা গরু অই, একজন আরেকজনেরে গুতাই।


মৌয়ালের কথায় হেসে উঠে সবে। মৌয়াল আরো রস করে বলে, তয় মৌমাছিও কম না, মধুচোরেগরে ধরে ঠাইস্যা,  অগ কামড়ে মানুষও মরে, বোবা পশুও মরে। মৌয়ালের কথায় রানির মা কুপি ধরে ধরে গরুঘরের বড়ো বড়ো ফুটাগুলি ছালার টুকরা ও পুরান কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয়, যাতে তার গাই ও বাছুরটিকে এবং দু'টি ছাগী ও ছাগশিশুদেরকে মৌমাছিরা কামড়াতে না পারে।  


অনেক যত্ন করে মৌচাক কাটা হলো। তারপরও বহু মৌমাছি মারা পড়লো। আগুন লাগা ঘরে ধোঁয়ার ভিতরে দম নিতে না পেরে আমরা যেমন ছটফট করে মারা পড়ি, অনেক মৌমাছি সেভাবেই মারা পড়লো। জীবন বাঁচাতে অন্ধকারে উড়ে উড়ে গাছের ডালে, ঘরের চালে আঘাত পেয়েও অনেকে মারা গেলো। সম্পদ লুট হওয়ার পরও জীবিতরা আঁধারে হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে ব্যথিত হৃদয়ে আবার মৌরানির পাশে গিয়ে বসলো। রানির নির্দেশে আবার বাসা মেরামত শুরু করলো। হত্যার হাত থেকে বেঁচে যাওয়া যেসব মৌশিশুরা মৌচাকের অন্য প্রকোষ্ঠে বেড়ে উঠলো, সেসব নব প্রজন্ম সহ তারা আবার মধু আহরণ শুরু করলো। 


খাঁটি মধু বলে আশেপাশের বাড়িতেই তাদের সব মধু বিক্রি হয়ে গেলো। ভালো দাম পেলো তারা। রানির মা বললো, আল্লার রহমতে হোকগুলি আবারো বইছে, আবারো কাডন যাইবো মধু। স্বামী বললো, তুই তো কইছিলি ঘরের উরপের ডাইলাডা কাইড্ডা দেন, ঝড়-তুফানে ভাইঙ্গা হড়লেই ঘরডা শেষ, অহন দেখলি। 


একসপ্তাহ পরেই এলো রানি। তাকে বেশি কাঁদতে দেয়া হলো না। বেশি কাঁদুনে মেয়েরা ছিঁচকাঁদুনে হয়, ঝগড়াটে হয়। তাই জন্মের পরপর তাদের মুখে মধু দিতে হয়। রানির জন্য এক শিশি মধু রাখা হয়েছিলো। একফোঁটা মধু দেওয়া হলো তার চঞ্চুতে। ফুলটুশি রানি, মৌটুসীর মতো চুকচুক করে চুষে খেলো মধু। 


দ্বিতীয়বারও মধু কেটে দিয়ে গেলো মৌয়াল। কিন্তু তৃতীয়বার রানির বাবা বললো, সে ই কাটবে এবার, দু'বার মৌয়ালের কাছ থেকে সব কৌশল শিখে নিয়েছে। তাছাড়া মৌয়ালকেও অনেক মধু দিতে হয়, এবার দিতে হবেনা। 


রানির বাবা তার দোস্ত কুসুমের বাবাকে নিয়ে গাছে উঠে। কুসুমের বাবা ধোঁয়া লাগায় ও বালতি ধরে। রানির বাবা টর্চলাইট মেরে ধারালো কাস্তে দিয়ে মৌচাকে পোঁচ দেয়। অমনি বালতিতে পড়ে মৌচাক। কিন্তু কিছু ক্ষিপ্ত মৌমাছি এমন ভাবে রানির বাপের চোখেমুখে হুল ফোটাতে লাগলো যে, সে দুই হাতেও মৌমাছি ঠেকাতে পারলো না। শেষে দিশেহারা হয়ে গাছ থেকে পড়েই গেলো। মাগো বলে, সে জোরে একটা চিৎকার করলো। পড়ার শব্দ ও চিৎকার শুনে রানির মা দ্রুত উঠানে নামে। সে কুপি উঁচিয়ে দেখে একদলা মাংসপিণ্ড হয়ে পড়ে আছে রানির বাপ। আল্লারে.., বলে সেও চিৎকার করে উঠে। কুসুমের বাপ গাছ থেকে নেমে পাঁজাকোলা করে তাকে ঘরে নিয়ে যায়। কিন্তু রানির বাপের ঘাড় মটকে যায়, মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। 


রানির মা রাতভর কান্নাকাটি করলো, ভোরে সবার পরামর্শে কুসুমের বাপকে ধরে, তার সাথে স্বামীকে ঢাকায় পঙ্গুহাসপাতালে পাঠিয়ে দিলো। স্বামীকে এগিয়ে দিয়ে আঙিনায় ফিরে সে চোখ মুছতে মুছতে গাছের দিকে চেয়ে দেখলো, মৌচাকের চিহ্নও নেই গাছে, ঘরে ঢুকে দেখলো বালতিতে আছে গোটা মৌচাক- সামান্য মধু আর অসংখ্য মৌমাছির মৃতদেহ। সে বুঝলো, রানি মৌমাছির মৃতদেহও আছে এখানে, আর রানির শোকে জীবিতরা চলে গেছে যত্রতত্র। 


রানির বাবার চিকিৎসায় রানির মা অবহেলা করেনি। সে ছাগল বেচে দিয়েছে, গাই বেচে দিয়েছে, মোটা মোটা গাছ বেচে দিয়েছে, পাড়াপড়শির কাছে ধার করেছে, হাত পেতেছে। অনেক দিন পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীকে ছেড়ে দিয়েছে, সঙ্গে একখানি হুইলচেয়ার দিয়ে বলেছে, বাকি জীবন তাকে এর উপরই থাকতে  হবে। 


সেই থেকেই রানির মা'র হাড়ভাঙা শ্রম। দক্ষিণের খাল পেরিয়ে সে চলে যায় পাটারি বাড়ির বড়ো বড়ো গৃহস্থ ঘরে। ঢেঁকিতে ধান ভানায় তার সুনাম। ঘন্টার পর ঘন্টা সে বারা ভানে- ধান কুটে, চিঁড়া কুটে, পিঠার চাল গুঁড়ি করে, মরিচ দুপে, হলুদ দুপে। বারা ভানার কাম না থাকলে- ধান সিদ্ধ করে, ধান শুকায়, ঘরদোর ঝাড়ু দেয়, লেপামোছা করে, রান্নাবান্না করে, থালাবাটি ধোয়। বিনিময়ে যা পায় ওবেলা, আঁচলে নিয়ে ফিরে। 


বর্ষায় সে খাল পার হয় কলাগাছের ভেলায়। সুদিনে কুঁচকি সমান পানি পার হয় পেটিকোট ভিজিয়ে, কেউ না থাকলে পেটিকোট না ভিজিয়েই। তাতে শরম লাগেনা তার- শরীরের প্রতি আর মায়া নেই বলে। পুরুষ মৌমাছিরা রানিমৌমাছিকে খোঁজে, গুণগুণ গান গায়, মিলিত হয় তার সাথে। চোখের সামনে মুরগিকে আদর করে মোরগ, হাঁসিকে আদর করে হাঁসা, বর্ষার নতুন জলে কোলাব্যাং সাথীকে কোলে ধরে রাখে। গৃহস্থ ঘরে তার বয়সী বউরা সাজে সকাল সাঁঝে- স্বামীর সাথে খুনসুটি করে, খিলখিল হাসে- দরজায় খিল দেয় দিনদুপুরে। কিন্তু তার সাথী তাকে আদর করতে পারেনা। তার জীবনের রজতজয়ন্তী গেলো বছর তিন চারেক সবে, কিন্তু রজ বন্ধ হলোনা আরবার, আর মা হতে পারলোনা সে। 


রানির মা'র কাছে তখনই আসে প্রস্তাব। এক গৃহস্থের ঘরে সতীন হওয়ার কথা পাড়ে তার বান্ধবী। কিন্তু রানির মা চোখ বুঁজে। ভেসে উঠে তার চোখে সেই রানির বাপ, সেই সক্ষম স্বামী, স্বামীর আদর- কতো মধুযামিনী; আদরে আদরে কোল জুড়ে আসা মেয়ে। রানির মা চোখ খোলে; দেখে আছে তার স্বামী, আছে রানি, আছে স্বামীর একগন্ডার ছোট্ট ভিটাখানি। এই ভিটায়- স্বামী তাকে জ্বালায়নি, পাড়াপড়শি তেড়ে আসেনি, হামলে আসেনি ইন্দ্রিয়াসক্ত কোনো মধুকৈটভ। শান্তশিষ্ট চিরসুন্দর এই উত্তরপাইকাস্তা গ্রাম। এখানে সে যেনো এক স্বাধীন সার্বভৌম সাম্রাজ্যের রানির মা। এই ভিটামাটি, গাছপালা, তরুলতা, আকাশ-বাতাস, চেনা মুখ ছেড়ে, দুটি অসহায় মানুষকে ছেড়ে, সে কেনো যাবে? রানির মা তোবা তোবা বলে নিজের গালে নিজেই চড় খায়, হাত তুলে বলে, আল্লা এই মাডিতই যেন্ দম যায়। 


নিজের কথা ভুলে, রানির মা এখন মেয়েকে দেখে অন্তর খুলে। দিন দিন খোলতা হচ্ছে মেয়ে। যেমনি সে চন্দ্রমুখী, তেমনি মধুরিমা তার চন্দ্রপ্রভা ফুলের মতো; তেমনি সে মধুকণ্ঠী। ওকে একটা ভালো ছেলের হাতে তুলে দিতে পারলেই সে বাঁচে। কিন্তু কুসুমের বাপের কোলপোঁছা ছেলে সাগরকে নিয়ে কথা আসে তার কানে। সে ভাবে, যা রটে তার কিছুটা নিশ্চয়ই বটে; তবে কী তার আশংকাই সত্য হলো! কিন্তু কোনো আলামত তার নজরে পড়লো না কেনো? তবে কী সাগর চুপিসারে আসে অভিসারে? বাইরে যাওয়ার মধ্যে রানি শুধু যায়, ঐ রাস্তার মোড়ের দোকানটায়, বাবার জন্য বিড়ি আনতে। তবে কী, আসাযাওয়ার পথের ধারে হয় তাদের মনবিনিময়? 


রানির মা সেদিন সকালে বাড়িতেই ছিলো। তার কানে এলো কেউ রানি রানি বলে ডাকছে। রানির বাবা বললো, সাগরের গলা। কিন্তু রানির মা লক্ষ্য করলো তাতে রানি যেনো কেমন ভেবাচেকা খেলো, তার চোখ ছানাবড়া হলো। রানির মা যা বুঝার বুঝে গেলো। সে চুপ করে রইলো। 


সাগর দু'জন লোককে নিয়ে ঢুকলো। লোকদেরকে বললো, এইডাই রানিগো ঘর। লোক দু'জন হেসে কুটিকুটি;  বললো, এইটা রানির ঘর! সাগর বললো, জে। 


কুঁড়েঘর। ঘর তো নয়, যেনো গৃহস্থ বাড়ির একখানা বড়ো রসুইঘর। মাটির ভিটা, ছনের দোচালা, গোবর লেপানো পাটকাঠির বেড়া, দুই পাল্লার সাদামাটা একটি কাঠের দরজা। 


সাগর বললো, রানি, হেরা আদম শুমারীর লোক, তোগরে গনতো আইছে। 


রানির বাবা উঠানে হুইলচেয়ারেই ছিলো। লোক দু'জনকে তার পাশে মোড়ায় বসানো হলো। রানির বাবা বললো, আমি মরা মানুষ, আমারে গইন্না লাভ কী? তারা বললো, সাহায্য একদিন পেতেও পারেন। রানির বাবা হেসে বললো, আমি অইলাম রানির বাপ, সিঙ্গাসনে বইয়া আছি, আমারে আবার কে সাহায্য করবো! সাগর বললো, আন্নেরা কিছু মনে কইরেন না, কাগায় অনেক দুক্ষে এগুলি কয়, এই যে ঘরে পইড়া রইছে এট্টুও খবর লয়না কেউ, কাকীই দুক্ষে কষ্টে সংসার চালায়। গণনাকারীরা রঙের কৌটা খুলে দরজায় নম্বর লাগিয়ে চলে যায়।


রানির মা হাজার বার খাল পার হলো, গৃহস্থ বউঝির পুরনো বস্ত্রে মা-মেয়ে গা ঢাকলো, মা-মেয়ে মিলে হাঁস-মুরগির শত শত ডিম খোঁয়াড় থেকে বের করে বিক্রি করলো, কাঁদি কাঁদি কলা ও বীচিকলা বিক্রি করলো, আয় দিয়ে রানির বাপের অষুধ কিনলো, শাক ভাত খেলো, তবু এলো না সাহায্য। রানির মা গৃহস্থ বাড়িতে শুনেছে, সাহায্য আসে গরিবের জন্য। সে প্রশ্ন করে জনে-জনে, আর কতো গরিব হলে সাহায্য পায় তারা!


ক'দিন পরে রাতে রানির কক্ষে রানি ঘুমিয়ে গেলে রানির বাবা ফিসফিস করে রানির মাকে বলে, হুন, দুপুরে কুসুমের বাপে আইছিলো, দোস্তে কয়, রানির বাপ, কুসুমের মায় সাগরের লাইগ্গা রানিরে পছন্দ করছে, দিয়ালাও ভাই, অয়তো আমাগো মাইয়াই। 


রানির মা বললো, বুঝ্ঝি, তয় সাগরেরে আন্নেই পশ্রয় দিছেন। রানির বাবা বললো, কা, তোর মনে নাই, রানি তহনো পেডে, সাত আষ্ট বছইরা সাগর আমাগো বাইত আইতো যাইতো, হুন, হোলাডা ভালা, রাজমেস্তরি কাম জানে। রানির মা চুপ করে থাকে। রানির বাবা বললো, রানি ই যহন আমাগো একমাত্র সন্তান, তয় জামাই লইয়া রানি এই বাইত ই থাকবো, আমি আর কয়দিন, তোরই ভালা অইবো, মাইয়াডাও নিজের বাইত গলা বড়ো কইরা থাকবো। 


রানির বাবা যা বলেছিলো, সাগর তা ই। সে শাশুড়িকে মা বলতে মরিয়া, শশুরকে বাবা। রানিও তাতে খুশি। রানি পাড়ার শেষ প্রান্তে শশুরবাড়ি যায় আর নিজের বাড়ি ফিরে। সে যখন শশুরবাড়িতে থাকে, তার মা থাকে বাড়িতে। সে যখন বাড়িতে থাকে, মা তখন কাপড় ভিজিয়ে খাল পার হয়। কিন্তু সাগর বলে, মা আর যাইয়েন না হেই দিগে, বাইত ই থাহেন, বাবারেও দেহেন। তবুও রানির মা'র ডাক পড়লে সে খাল পার হয়। 


এমনি করেই দিন যায়। রানি রাঁধে বাড়ে খায়। তার শশুর এসে তার বাবার সাথে পান বিড়ি খেয়ে যায়। বৎসর শেষে রানির কোলে আসে রাজপুত্তুর। রানির বাবা রানির মাকে বললো, নাতি যহন রানির ছেলে, তয় হ্যার নাম রাজাই রাখ, নামডা ত তোরই পছন্দের। রানির মা অবাক হয়, হেই কবেকার কতা, অহনও মনে রাখছে হ্যায়। 


তুরীয়ানন্দে রাজা আকাশ বাতাস মুখরিত করে। তার বাবা জমানো টাকায় তার প্রথম জন্মদিনে আকিকার ব্যবস্থা করে। দুপুরের অনুষ্ঠান। রানির মা জামাইয়ের দেওয়া নতুন কাপড় পরে পরিপাটি হয়। তারপর উঠান থেকে স্বামীকে এনে চৌকিতে শুইয়ে দেয়। রানির বাবা বলে উঠে, কাহড়ডা বড়ো ঢহের, তোরে মানাইছে খুব। রানির মা হেসে হেসে স্বামীর মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে, চোখে চোখ রাখে। যুগযুগান্তরের পুঞ্জিত সোহাগ যেনো উথলে উঠে দু'টি বুকে। স্বামী হাত বাড়ায়, স্ত্রী নুয়ে যায়। সময় গড়ায়, তবু চুমু না ফুরায়। স্ত্রীর তপ্ত অশ্রুতে স্বামী যখন ভেসে যায়, স্ত্রী মাথা তুলে দেখে স্বামীরও সমানতালে অশ্রু গড়ায়। পরম আদরে তারা একে অন্যের অশ্রু মোছে। 


কী অপূর্ব ভালোবাসা স্বামী-স্ত্রীর। শারীরিক সম্পর্ক থাকে কয়েক রেণু-ডিম্ব কাল, ভালোবাসা থাকে অনন্তকাল।


রানির মা চোখ মুছতে মুছতে বললো, আন্নে থাহেন, আমি যামু আর আমু। রানির বাবা বললো, পিডা বানাইছিলি, দই পাতছিলি, সব লইছত নি। রানির মা বললো, হ লইছি। সে দরজা টেনে উপরের শিকল লাগিয়ে চলে যায়। 


রানির বাবা কতো কী ভাবে, শোয়া-বসা, ঘর-উঠানই আজ তার দুনিয়া, সে আজ জীবন্মৃত; নির্জন দ্বীপে নির্বাসিত। অনুষ্ঠানে যেতে পারলে কতো জনের সাথে দেখা হতো, ভাই বন্ধু বলে জড়িয়ে ধরতো কতোজনকে। সে সিথানের পাশ থেকে বিড়ি-ম্যাচ নিয়ে বিড়ি ধরায়, একটার আগুনে আরেকটা ধরায়। জ্বলন্ত বিড়ির গোড়া আনমনে টোকা মেরে ছড়ায়, যেমনটি উঠানেও করে। কিন্তু হঠাৎ গোবর পোড়া গন্ধে তার খবর হয়। সে অনেক কষ্টে ডানে তাকায়। হায়! তার ঘরের বেড়া থেকেই তো পোড়া গন্ধ। ঘটনা বুঝে সে অদূরে রাখা হুইলচেয়ার খানি পেতে চায়; দুখানি হাতে ভর দিয়ে চৌকি থেকে নামার চেষ্টা করে। কিন্তু তাতে তার নিম্নাঙ্গ মাটিতে আছড়ে পড়ে। তার কোমর ও ঘাড়ের জোড়া ছুটে যায়। সে ককিয়ে উঠে, তবু দু'হাতে মাটি খামছিয়ে এগুতে চেষ্টা করে। ততক্ষণে বেড়ার গায়ে দপ করে আগুন জ্বলে উঠে; আগুন উঠতে থাকে উপরে। সে যতো জোরে পারলো অবশেষে চিৎকার করলো। কিন্তু চিৎকার ঘরের বাইরে গেলোনা। ক্রমে দলা দলা অগ্নিগোলা ঝরে পড়তে থাকলো সারা ঘরে, পড়তে থাকলো তার গায়। 


আকাশে ধোঁয়ার কুন্ডলী দেখে ছুটে আসে লোকে। তারা বের করে আনে রানির বাবাকে। খবর পেয়ে রানির মা ছুটে আসে। ততক্ষণে ছাই হয়ে গেছে তার ঘর। কিন্তু তার সাথী? সে কেনো লম্বা হয়ে উঠানে পড়ে আছে? ও রানির বাপ., বলে রানির মা চিৎকার করে উঠে। তার গগনবিদারী চিৎকারে আল্লাহর আরশ কাঁপে, তবুও কথা বলে না রানির বাপে। 


স্বামীর দাফনের পর শূন্য পোড়া ভিটায় দাঁড়িয়ে আবারো বিলাপ শুরু করে রানির মা। তার কষ্টের, তার দুঃখের, কী শান্তনা? সাগর আস্তে করে রাজাকে নানির কোলে তুলে দেয়। নানিও কাঁদে, নাতিও কাঁদে। নানিও থামে, নাতিও থামে। হঠাৎ নাতির খিঁচা খিঁচুনি দেখে নানি তাকে হাতের তালুতে বসিয়ে হিচ্ হিচ্ শব্দ করে। সঙ্গে সঙ্গে নাতির মূত্র সবেগে ছুটে। মুত গিয়ে পড়ে আধপোড়া দরজার চৌকাঠের উপর। মুতের স্রোতে ইষত স্পষ্ট হয়ে উঠে আদম শুমারীর সেই নম্বর। রানির মা ঘৃণায় মুখ ফিরায়। এ নম্বর দিয়ে তার কী হবে?


জোনাথন সুইফট এর ক্লাসিক সাহিত্য 'গালিভারস্ ট্রাভেলস্' এ 'লিলিপুট' এর রাজপ্রাসাদেও একদিন আগুন লেগে গিয়েছিলো। দর্জির আঙ্গুলের অঙ্গুস্তানা সমান বালতি দিয়ে বালতি বালতি পানি ঢালা হচ্ছিলো, আগুন নিভছিলোনা। গালিভার বুদ্ধি করে প্রাসাদের উপর সবেগে প্রস্রাব করে দেয়। আগুন নিভে যায় তাতে। কিন্তু অশোভন ভাবে প্রাসাদ রক্ষা করায় গালিভার ট্রায়ালে পড়ে যাচ্ছিলো, ভাগ্যিস কৌশলে সে 'ব্লেফুসকু' দেশে পালিয়ে যায়। 


রানির মা চেয়ে থাকে নাতির দিকে। এরা পালাবে না। এরা নতুন প্রজন্ম। সে শুভ আশীষ মাগে তার জন্য- তারা জনগণমনঅধিনায়ক হবে, জনগণমঙ্গলদায়ক হবে, নতুন করে মৌচাক বানাবে; প্রতি প্রকোষ্ঠে লাগাবে নতুন নম্বর; দু'টো ভাত, একটু কাপড়, একটু চিকিৎসায় টইটম্বুর থাকবে সেই মৌচাক।  

---

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ