ভ্রমণ ও ফটোগ্রাফি || গণপতিপুলে এসেছিলাম ~ সুজিত চক্রবর্তী




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

         হঠাৎই ঠিক করে ফেললাম সপরিবার গণপতিপুলে যাব , যদি অবশ্য ট্রেনে টিকিট পাওয়া যায় ! শেষ পর্যন্ত পছন্দসই টিকিট পাওয়াও গেল। মুম্বইয়ের ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ টার্মিনাল থেকে গোয়ার মারগাও পর্যন্ত যে ' জন-শতাব্দী ' এক্সপ্রেস যায় তার সেকেন্ড ক্লাস সিটিং কোচে । এই ট্রেনে এটাই সবচেয়ে সস্তা টিকিট। আর সবচেয়ে দামি টিকিট থাকে ' ভিস্তা ডোম ' কোচে । আবার এই রুটে 'তেজস্ এক্সেপ্রসে'র মতো দ্রুতগামী ট্রেন আছে এবং বলা বাহুল্য সেই ট্রেনে ভিস্তা ডোম কোচের টিকিটের দাম আরও বেশি। গুগুলে জানাচ্ছে এই রুটে সর্বমোট আটাত্তরটি ট্রেন চলাচল করে। এখানে প্রকৃতপক্ষে কোঁকন রেলওয়ে দিয়ে আমাদের ' রত্নগিরি ' স্টেশন পর্যন্ত যেতে হবে । আর , যেহেতু এই রেলপথ গেছে পাহাড় জঙ্গলের বুক চিরে আর অজস্র সুরঙ্গ বা টানেলের মধ্যে দিয়ে সে কারণে পয়সা খরচ করে কেউ ভিস্তা ডোম কোচে যেতেই পারেন , যাঁরা যাবেন তাঁরা  সত্যি  উপভোগ করতে পারবেন দুপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। ট্রেন ছাড়া মুম্বই-গোয়া হাইওয়ে ধরে গাড়িতে বা বাসে রত্নগিরি পৌঁছনো যায় অথবা চিপলুন অবধি এসে সেখান থেকেই গণপতিপুলের রাস্তায় যাওয়া যায় ।

   

 (2) : রত্নগিরি রেল স্টেশন 


             যাই হোক , ফিরে আসি আমাদের ভ্রমণ বৃত্তান্তে। জন শতাব্দী এক্সপ্রেস সকাল পাঁচটা দশ মিনিটে মুম্বই-এর ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করে দশটা কুড়ি মিনিটে , অর্থাৎ পাঁচ ঘন্টা দশ মিনিটে পৌঁছে যায় রত্নগিরি স্টেশনে । নিরিবিলি শান্ত স্টেশন রত্নগিরিতে নেমে আমরা অটো রিকশা করে এলাম পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত আমাদের গন্তব্য গণপতিপুলেতে । ভাড়া নিয়েছিল সাতশো টাকা। এইখানে বলে রাখি আসার সময় একই রাস্তা ছ'শো টাকায় এসেছি।  কিছু কিছু জায়গায় রাস্তা বেশ খারাপ ছিল।  তবে গণপতিপুলের কাছাকাছি এলে পথের ধারে পড়বে বেশ কয়েকটি নির্জন সমুদ্র সৈকত ( কাজিরভাটি  , আরে ওয়ারি ইত্যাদি) যাদের সিলভার স্যান্ড বীচ্  বা ভার্জিন বীচ্ বলা  যেতেই পারে। এই পথ অটো রিকশায় যেতে সময় লাগে মোটামুটি এক ঘন্টা।  


 ( 3) : জনশূন্য কাজিরভাটি সৈকতে 


                মহারাষ্ট্র পর্যটন দফতরের ( MTDC ) কটেজে আগাম বুকিং করে রাখা আমাদের সি-ফেসিং রুমে যখন পৌঁছলাম তখন ঘড়িতে সময়  দুপুর বারোটা। পশ্চিম দিকের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে যখন বাইরে তাকালাম সত্যি মন ভরে গেল। সারি সারি নারকেল গাছের ফাঁক দিয়ে সমুদ্র সৈকত চোখে পড়ে সেখান থেকে । ফটাফট কিছু ফটো আমার মোবাইলে তুলে ফেললাম। বাঁ দিকে কয়েকটি ওয়াটার স্পোর্টে যারা রাইড করছে তাদের দেখা যাচ্ছে আর ডান দিকে ( ভৌগলিক বিচারে এটা উত্তর দিক ) সাদা বালিয়াড়ির মধ্যে সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে যেখানে জন-মনিষ্যি নেই বললেই চলে।  এরপর স্নান সেরে এলাম কটেজের সামনে তরঙ্গ রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ সেরে ফেলার উদ্দেশ্যে।   

(4) : MTDC কটেজের ব্যালকনি থেকে সমুদ্র দর্শন। 


                      বেশ কিছুক্ষণ পরে বেরিয়ে পড়লাম ওখানকার গণপতি মন্দিরে যাব বলে।  MTDC রিসর্টের পাশেই মন্দির । একদম আরব সাগরের তীরে মন্দিরের অবস্থান । পাহাড়ের গায়ে এই মন্দিরের সৌন্দর্য বরাবরই মুগ্ধ করে গণপতির  ভক্তদের। বিচে দোকান ঘরের ছায়ায় বসে সুস্বাদু মালাইওলা ডাব খাওয়া গেল। ডাবের দাম মুম্বইয়ের মতোই --- একটা পঞ্চাশ টাকা। একদিকে সমুদ্র সৈকতে উট , ঘোড়া,  স্কুটার চলছে অন্য দিকে শ্রী গণেশজীর মন্দির । সমুদ্রের জলে আছে বিভিন্ন ওয়াটার স্পোর্টস-এর আয়োজন।  সবচেয়ে পপুলার মনে হলো স্পিড বোটে চড়ে ঢেউ ভেঙে দুরন্ত গতিতে  ছুটে চলার খেলাটি। এটাই একটু অন্য রকম করে একটা ভাসমান সোফার ওপর যাত্রীদের বসিয়ে ছুটে চলা সমুদ্রের ওপর । আছে প্যারাসেইলিং ( parasailing ) বা প্যারাকাইটিং (parakiting) যাতে সমুদ্রের ওপর স্পিড বোটে যাওয়ার পরে প্যারাসুটে উঠে মানুষ যেন অনেকটা  ঘুড়ির ( kite ) মতোই আকাশে উড়তে পারে ।  



(5) : সমুদ্র সৈকতে অপেক্ষারত স্পিড বোট ।


                এবার দেখা যাক মন্দিরের ভেতরে। কথিত আছে  বহুকাল আগে গণপতি বাপ্পা এখানে পাহাড়ের গায়ে স্বয়ম্ভু ( স্বয়ংজাত বা স্বয়ং আবির্ভূত) মূর্তি হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছেন। মন্দিরে দেখতে পাবেন কমলা রঙের গণেশজীর মূর্তি পাথরের গায়ে।  এই মন্দিরের বিশেষত্ব হলো এখানে দেবতা সমুদ্রের দিকে অর্থাৎ পশ্চিম দিকে মুখ করে অবস্থান করছেন । এটা বিশেষ ঘটনা এই কারণে যে এ অঞ্চলে দেবতা বসেন পূর্ব দিকে মুখ করে ! আর একটা কথা বলি,  এখানে ভগবান দর্শনের জন্য  কোনও প্রতিযোগিতা বা দীর্ঘ লাইন দেখি নি কখনও , যেটা এ দেশের অনেক মন্দিরেই দেখা যায়।  সন্ধ্যা সাতটায় আরতি শুরু হয়ে গেল। আমরা আরতির সময় গণপতি বাপ্পার আরাধনায় অংশ গ্রহণ করে পরদিন সকালে অভিষেক পুজোর জন্যে বুকিং করে এলাম।  আর হ্যাঁ ,  অভিষেকে বসার জন্য পুরুষদের ধুতির সঙ্গে চাদর গায়ে জড়িয়ে বসা বাধ্যতামূলক এবং মহিলাদের কেবলমাত্র শাড়ি পরেই আসতে হয়। আমাদের সময় ছিল সকাল ন'টা । পুজোর পর মন্দির পরিক্রমার রীতি প্রচলিত আছে এখানে। পাহাড়ের গায়ে এক কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে সম্পূর্ণ মন্দিরের পরিক্রমা করে আনন্দ নেওয়া গেল। লাড্ডু ( মারাঠি ভাষায় লাড়ু) প্রসাদ বিক্রি হয় প্যাকেটে। এক প্যাকেটে থাকে দুটি লাড্ডু --- দাম পঁচিশ টাকা। এছাড়া মন্দিরে প্রসাদী অন্নদানের ব্যবস্থা আছে , এরজন্য কোনো মূল্য দিতে হয় না। দুপুরে খিচুড়ি ,  রাতে পোলাও-- ওই দিন দুটোই খেয়েছি --- অপূর্ব স্বাদ ! অন্নদানের জন্যে ভক্তদের  অনুদান গ্রহণের যথাযথ ব্যবস্থা আছে মন্দিরে। 



 (6) : মন্দিরের ভেতর থেকে সমুদ্র দর্শন। 


       এই দ্বিতীয় দিন কোথা দিয়ে যেন কেটে গেল সমুদ্র আর মন্দির দেখে । সমুদ্রের জলের স্বচ্ছ নীল যেন দিগন্তে গিয়ে নীল আকাশে মিশে একাকার হয়ে গেছে। মাঝে ঢেউয়ে ভেসে যাওয়া বোট,  আকাশে ভাসমান প্যারাকাইটিং করতে থাকা মানুষের ছোট ছোট মূর্তি দর্শন করতে করতে যেন কোন রূপকথার জগতে প্রবেশ করেছি তখন । মনে পড়ে যাচ্ছিল সেই বিখ্যাত বাংলা গানের কলি : 

" আমি শুনেছি সেদিন তুমি 

   সাগরের ঢেউয়ে চেপে 

 নীল জল দিগন্ত ছুঁয়ে এসেছো। "

( 7 ) : নীল জল দিগন্ত ছুঁয়ে এসেছ। 


        মূলত মানুষের ভীড় কম হওয়ায় এখানকার সমুদ্র সৈকত খুব পরিষ্কার থাকে। সোনা রঙের বালিয়াড়ির শেষে দেখা যায় দীর্ঘ রূপালী বালুচর মিশেছে সমুদ্রের নীলে। দেখতে দেখতে সূর্য ডোবার সময় আসে । আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি প্রকৃতির রূপ আকাশে , জলে ও স্থলে কেমন যেন এক মায়াজাল বিছিয়েছে ধীরে ধীরে।  

 (8) : সূর্যাস্তের আগে। 


             পরদিন অনেকেই বলল কাছাকাছি দুটো জায়গা দেখে আসতে  ---- প্রাচীন কোঁকন মিউজিয়াম ও তার পাশে ম্যাজিক গার্ডেন। গেছিলাম তৃতীয় দিনে। প্রাচীন কোঁকন মিউজিয়ামে কোঁকন অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার ইতিহাস ধরে রাখা হয়েছে বিভিন্ন মূর্তির মাধ্যমে। খোলা আকাশের নীচে এই মিউজিয়ামটি সম্পূর্ণ ঘুরে দেখতে সময় লাগে একঘন্টা। ব্যাখ্যা করে দর্শকদের বুঝিয়ে দেওয়ার জন্যে গাইড আছে। ম্যাজিক গার্ডেন কম বয়সীদের কাছে বেশি আকর্ষণীয়।  

 
( 9 ) : প্রাচীন কোঁকন মিউজিয়ামে কোঁকন অঞ্চলের জীবনযাপনের ব্যাখ্যা করতে স্থাপন করা মূর্তি।  

      রোজ রাতে লজে নিজেদের রুমে এসে কান পেতে শুনি অন্ধকার সমুদ্রের গর্জন। এখানে সমুদ্রে স্নান করার কিছু নিষেধাজ্ঞা আছে, কারণ সমুদ্র  বিপজ্জনক। বর্ষায় বেশ ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে সাগর , একথাও শুনেছি । যাইহোক, এমনি করে তিন রাত কেটে গেল এখানে। চতুর্থ দিন সন্ধ্যায় মুম্বইগামী  ট্রেনে বসে পড়লাম। এর আগে গেছি , তবু এরপরেও আবার গণপতিপুলে যাওয়ার ইচ্ছা রয়ে গেল। 

(10 ) : সূর্যাস্তের পর গণপতিপুলের সমুদ্র সৈকতে।  

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ