আদমসুরত ~ তসলিম পাটোয়ারী




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

ছাইদল ও তার মা হাঁটে। হাঁটে আর হাঁটে। হাঁটে গ্রামে-গঞ্জে, নগরে-বন্দরে। তারা সাতসকালে নামে, দিন ফুরালে থামে। থামে যেখানে রাত হয়। সেখানেই তারা কাত হয়। কাত হয় কারো কাছারিঘরে, স্কুলের বারান্দায়, হাটবাজারের- চালপট্টি; কাপড়পট্টি' ইত্যাদির ছাউনি তলে, দোকানের চালার নিচে বা দোকানের চিপায়। 


মা ষাটোর্ধ, ছেলে চল্লিশের। দু'জনেই শুকনো কাঠি। মায়ের মেরুদণ্ড বেঁকেছে, ছেলের চুলদাড়ি একটু-আধটু পেকেছে। মায়ের কাখে মাঝারি ওড়া, ডানহাতে হাতের লাঠি। ছেলের মাথায় খড়ের বিড়া, বিড়ার উপর বড়ো ওড়া। ওড়ার মধ্যেই মা ও ছেলের সংসার। 


গ্রীষ্ম বর্ষা শরৎ হেমন্ত শীত ও বসন্তে তারা হাঁটে। হাঁটে উত্তরে মতলবগঞ্জের দিকে, পূবে হাজিগঞ্জের দিকে, দক্ষিণে চাঁদপুর শহরের দিকে। শুধু, হাঁটে না পশ্চিমে; সেদিক দিয়ে কল কল্লোলে বয়ে চলে কল্লোলিনী মেঘনা। মা-ছেলে দিনশেষে, দুই বা তিন-চারদিন শেষে ফিরে আসে কল্যাণদি গ্রামে; বাড়িতে। 


জনবহুল বাড়ি। একগাদা ছোটো ছোটো ঘর। একই ঘরানার ঘরগুলো- যেনো কোনো একজন ঘরামির নিপুণহাতের তৈরি। মাটির উঁচু ভিটির উপর কাঠের বা বাঁশের পালা, পালার উপর টিনের বা খড়ের দোচালা, বেড়াগুলো মুলির বা পাটখড়ির। বাড়িতে একটি ছেলে সোমত্ত হয়- একটি ঘর বাড়ে, কমে যায়- পগার, জঙ্গল, চাষের জমি। 


মা-ছেলের ঘরখানি গড়ের পাড়ে, পগারের ধারে, টিনের দোচালা, মুলির বেড়ার ঘর। এখন ঝুরঝুরে। ভাঙা চাল, ভাঙা বেড়া, যেনো জাফরিকাটা বুকের খাঁচা। চালের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় আরশ, বেড়ার ফাঁক দিয়ে সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা ধরণী। তবু তারা দুয়ারে খিল দিয়ে শোয়, ছিটকানি লাগিয়ে বের হয়। ঘরের ভিতরে সম্বল, দু'খানা চকি আর ইতস্তত বিক্ষিপ্ত লোটাকম্বল। তারা যখন সফরে থাকে, তাদের ঘরে ঢুকে মহা সুখে চকির উপর ঘুমায় কুকুর, কাঁড়ে উঠে মুমায় বাঘডাশা।  


বাঘডাশা তবু সহ্য হয় বুড়ির, কিন্তু কুকুর একদম সহ্য হয় না। কুকুর গু খায় বলে তাকে চোখের লীলায়ও দেখতে পারেনা বুড়ি, দেখলেই দূর দূর করে, হাতের লাঠি ছুঁড়ে মারে। বুড়ি একদিন ঘরে ফিরে দেখে তার চকিতে ঘুমিয়ে আছে কুকুর। ভীষণ রেগে যায় বুড়ি। মানুষের ঘরে কুকুর! কুত্তার বাচ্চা কুত্তা, খাড়া, বলে কুকুরকে সে কী তাড়া বুড়ির! 


দূরে জঙ্গলের কোলে ভাগে পাওয়া পৈতৃক ভিটায় ছাইদলের বাবা ঘর তুলেছিলো। ঘর উঠতে উঠতে এখন সেই ঘরের কাছে চলে এসেছে অনেক ঘর। সর্বশেষ এসেছে চাচা কদর আলীর মেঝো ছেলে এসকান্দরের ঘর। ঘর তোলার সময়ই ছাইদলরা বললো, এটা তাদের জায়গা, এসকান্দররা বললো, না, না, তাদেরই। এই নিয়ে দুই ঘরে কথা-কাটাকাটি, ঝগড়াঝাঁটি, চিৎকার চিক্কুর, খিস্তি-খেউড়। 


এসকান্দরের ছোট বোন হনুফা খিস্তি-খেউড়ে নেই। সে তার মতোই জেঠির ঘরে যায়। কিশোরীর স্বভাবসুলভ চপলতায় ভরে তোলে জেঠির ঘর; জেঠির সাথে কথা বলে আর নানান কাজ করে দেয় জেঠির- চুলায় জ্বাল ঠেলে দেয়, উঁকুন বেছে দেয়, চুলে তেল মাখে; কাঁকই চালায়। জেঠিও তাকে মায়া করে। কিন্তু জেঠির চোখে পড়লো, হনুফা একটু বেশিই করে ছাদুর সঙ্গে। জেঠি একদিন বলেই বসলো, এই গো হনু, বেডা মাইষের লগে এতো রংতামশা করিছ না তো। 


হনুফার মা একদিন দেখে ছাদু পিঁড়িতে বসে আছে, হনুফা পেছনে আরেকটি পিঁড়িতে বসে ছাদুর গায়ে লেগে ছাদুর ভাসাভাসা পাকা চুল বাছাবাছি করছে। ছেলের মেয়েঘটিত দোষ হলে ছেলের মা বলে, ছেলে তো.., একটুআধটু দোষ হয় ই। কিন্তু মেয়ের ছেলেঘটিত দোষ হলে মেয়ের মা'র মাথায় আগুন জ্বলে। হনুফার মা হনুফাকে ঘরে নিয়ে দেয় বকা- ধিঙ্গি মাইয়া, এত্তো বড়ো বেডার লগে কিয়ের ঢলাঢলি? দেইখ্যা লই আরেকবার, এক্কেবারে জ্যান্ত পুইত্যা লামু । 


এরপর কদর আলী একদিন ছাদুর মাকে বললো, অ ভাজ হুনেন, হনুফারে আন্নেগো বউ কইরা লন, সব ঠিক অইয়া যাইবো, আঙ্গো হোলারাও অগরে চাইবো। কিন্তু হনুফা একটু কালো, স্থূলাঙ্গী; ছিরিছাঁদ হীনা। ছাদুর মা মুখ বেঁকিয়ে জেদের বসে বলেই ফেললো, ইচ, এই ধুমসি রে.., কিয়ে আর কিয়ে, নাইল্লা হাগে আর ঘিয়ে। 


তারপর একদিন ঝগড়া হলো তুমুল। বেয়াদব বলে, ছাদুকে তেড়েফুঁড়ে গেলো চাচা, এসকান্দর করলো লাঠিপেটা। এরপর থেকেই ছাদু ঠান্ডা। সবাই অবাক! কী হলো! ছাদু সবাক নয় কেনো! ছাদুর মা অবিরাম কথা কয়, ছাদু কথা ই কয় না! সে মাটির দিকে চায়, আকাশের দিকে চায়, ফেলফেল তাকায়, একটু হাঁটে, একটু দাঁড়ায়, এমন কেনো! 


এমনি করে দিন যায়। ছাইদল হঠাৎ একদিন কথা বলে উঠে। তার অনেক দিনের অনেক কথা, পুঞ্জীভূত ব্যাথা, দপ করে বেরিয়ে আসে লাভার মতো, অনবরত তার মুখে শুধু কথা আর কথা, কথার খৈ ফোটে ঠোঁটে, দাঁড়ি কমা নেই তার। হনুফা দূরে দাঁড়িয়ে চোখ মোছে। 


বাড়ির লোকেরা, বউঝিরা বললো, মা-পুতে রে আলগায় পাইছে, নাইলে কেউ তাবিজ করছে। কেউ বললো, ছাদুর মা'র তো আগেত্তনই ছিট আছে, মা'র সবই ছাদু পাইছে। কেউ বললো, ছাদুর তালুডাত বাড়ি পড়ছে, অর ঘিলুডা লইড়া গেছে। কেউ বললো, ঘরভিটির শোকেই অর মাথাডা বিগড়ায়া গেছে। পণ্ডিতম্মন্যদের সাতকাহন চলতেই থাকে। ততোদিনে হনুফা সতীনের ঘরে, আর ছাদু ও তার মা নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে। পাড়াপড়শিরা বলে, মা-পুতে রে পাগলাগারদে পাঠাও। 


কিন্তু মা-পুতে কাখে ও মাথায় ওড়া নিয়ে অবিরাম কথা বলতে বলতে চলে। তাদের সামনে, পথের দু'ধারে, কতো মুখ, দুর্মতি, দুর্মুখ পড়ে, সে দিকে তারা ভ্রূক্ষেপও করেনা। কিন্তু কদর আলী কিংবা তার ছেলেরা দূর দিয়ে গেলেও মা বলে উঠে, ঐ কুত্তা যায়, ঐ ঐ। মা দূর থেকে লাঠি উঁচায়, ছেলেও লাথি উঠায়। কিন্তু তাতে কুত্তার কী। কুত্তা তার চিরবাঁকা লেজ তুলে লকলকে জিভ খুলে গন্তব্যে যায়। 


ছাইদলের দোস্ত সেদিন বললো, অ ছাদু কই যাছ? ছাদু ভুলে গেলো দোস্তকে। বললো, তোর ধনডাত যাই। দোস্ত বললো, ঐ বেডা, গাইল্লাইছ না, হুন, মঞ্জিল ভুঁইয়া গো বাইত মেজবানি আছে। ছাদু বললো, হাছা? মা বললো, হেদিন না খাইলাম! ছাইদলের দোস্ত বললো, দূরো চাচি, গেছে বছর খাইছো। অতঃপর তারা দক্ষিণে ভুঁইয়া বাড়ির দিকে ফিরে। 


সুন্দর পোশাকের মানুষগুলোর হাত চাটা শেষ হলে গরিব মিসকিনদেরকে ঢুকতে দেওয়া হয়। হুমড়ি খেয়ে ঢুকে বুভুক্ষু নরনারী। ছাইদল বলে, অ মা, তুই বেডিগো ভিত্তে হান্দা, আমি বেডাগো ভিত্তে হান্দাই। শীর্ণা বুড়ি ধাক্কার তোড়ে কোনমতে গিয়ে বসে হোগলায়। কতোদিন পরে মা ও ছেলে নুলো ডুবিয়ে খায়; আহা, কতোদিন পরে! 


এভাবেই আকিকা, বিয়ে, মেজবানির সংবাদ পেলে তারা যায়, ক'টা ভাত খায়, ঘরে ফিরে ঘুমায়, দু'দিন পরে আবার নামে। 


গৃহিণী তাদের টুকরিতে চাল ঢেলে দেয়। কিন্তু কার্তিক অগ্রহায়ণ না এলে গৃহস্থের মুখে হাসি থাকে না, গৃহিণী চালের মটকিতে হাতও দেয় না। বরং মা-ছেলেকে দেখলে বিরক্ত হয়। তাদের জন্য কাছারি ঘরের দরজাও খোলা রাখে না। মা-ছেলে নিরূপায় হয়। বুড়ি বিড়বিড় করে বলে, দূরো কুত্তাডি। ছাইদল কয়, অ মা গাইল্লাইছ না, গেরামের মাইষের অহন কষ্ট, ধান পান উডক আবার গেরামে নামমু, অহন শহরের মিক্কা ল, শহরে অভাব থাহে না। 


চাঁদপুর শহরে তারা হেঁটেও যায়, বাসেও যায়। অনেক কন্ডাকটর তাদেরকে নেয়, অনেকে নেয় না। যাত্রীরাও খিটমিট করে। ড্রাইভারও কন্ডাকটরকে বকে, ঐ বেডা, পত্যেকদিন বিনা ভাড়ায় কী? বরং অর্ধেক ভাড়ায় দুইডা ছাত্র ল, অরা দেশের কামো লাগবো, পড়ালেহা কইরা আমাগো লগেও ভালা ব্যবহার করবো। ফকির টকির লইয়া লাভ কী? এগুলি খালি খাইবোই। বুড়ি হয়তো ড্রাইভারের কথা বুঝে থাকবে, সে ড্রাইভারকে গালি দেয়, দূরো কুত্তা। 


শহরে আকাশচুম্বী সুন্দর সুন্দর অট্টালিকা। মা-ছেলের চোখ ছানাবড়া হয়। বুড়ি সিঁড়ি বাইতে পারে না। ছাইদল বায়। কিন্তু গ্রামের মতো ঘরের দুয়ার খোলা থাকেনা শহরে। ছাইদল বন্ধ দুয়ারে টোকা দিতে শিখেছে। সে টোকা দিয়ে কোথাও পায়, বেশির ভাগই পায় না। মা-ছেলে অবাক হয়, কিরে, এরাও কী অভাবী! 


তারা দালানের পর দালান বায়। কোথাও দারোয়ান ধমকায়, কোথাও মালিক ধমকায়। মা-ছেলে মঞ্জিল ভুইঁয়ার বাড়ি খুঁজে পায়। বাড়ির সিঁড়ির নিচে তারা ছোট্ট একটা সাদা লোমশ ছাগল ছানা দেখে দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু মা-ছেলেকে অবাক করে দিয়ে ছাগল ছানাটি ঘেউঘেউ করে উঠে। বুড়ি খ্যাপে উঠে; অ তুই ছাগল না, কুত্তা, তয় খাড়া! বুড়ি লাঠি দিয়ে কুকুরকে খোঁচা মারে। কুকুরের কুঁইকুঁই শব্দ শুনে দারোয়ান তেড়ে আসে, আসে গৃহিণী। গৃহিণী দারোয়ান কে বলে, দেখছিস কী, ডাইনিটাকেও একটা খোঁচা দে, বুঝুক কষ্টটা। দারোয়ান বুড়িকে ধাক্কা দেয়। বুড়ি পড়ে যায় ছেলের কোলে। বুড়ি মুখ ভেঙচিয়ে বলে, দূরো কুত্তা। 


মঞ্জিল ভুঁইয়া শহরে থাকে, তবে যাকাত ফিৎরা গ্রামের বাড়ি গিয়েই দেয়। সেদিনের কথা ভুলে বেহায়া মা-ছেলে ক'টি টাকা, একটি কাপড়, একটি লুঙ্গির আশায় ভুঁইয়া বাড়ি গিয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু তারা অবাক হয়। ভোর না হতেই এতো মিসকিন! মিসকিন দলে যায় মিসকিনকে। মা ছেলেকে টেনে রাখে, ছেলে মা'কে টেনে রাখে। তারা একপাশে সরে দাঁড়ায়। শেষে তাদের অনুমানই ঠিক হয়, অনেকের মতো তারাও শূন্য হাতে ফিরে। মা-ছেলে বিড়বিড় করে বলে, গেরামের বেকেই দেহি মিসকিন। ছাইদল তখনই আঙুল উঁচিয়ে দেখায়, অ মা, ঐ চা, কদর কাগু। বুড়ি বলে উঠে, অ খোদা, এল্লাইগ্গাই তো আমরা হাই না, তয় এইডায় খরাত করতো নামছে কা, কুত্তাডার লাইগ্গাই ঘর ভাঙছে হনুফার, কয়ডা টেহা চাইছিলো জামাই, কুত্তাডায় দিলোনা। ছাইদল বললো, অ মা, অর বলে আবুদ অয়না, এল্লাইগ্গা ছাড়ছে। মা বললো, না, অউগ্গা হোলা অইছিলো তো। ছাইদল বললো, হ হোলা তো মইরাই গেছে। মা বললো, অম্মা, তুই তো দেহি বেক খবরই রাহছ। 


ছাইদল হেসে বললো, মা, কামের কতা হুন, চানপুর গেছি, মতলব গেছি, এইবার আজিগঞ্জ ল। হিয়ানো বলে বড়ো মচ্ছিদের হুমকে বইলেই টেহা, টেরেনে যামু, টেরেনে আমু, হইসা লাগদো না। 


মা-ছেলে সাহাতলী গিয়ে ট্রেনে উঠে। তারা মেঝেতেই বসে। তবুও টি-টি-ই তাদের কাছে টিকিট চায়। কিন্তু হকাররা মা-ছেলের কাছের মানুষ। তারা আন্তঃনগর ট্রেনে উঠতে পারে না, লোকাল ট্রেনে হকারি করেই পেট চালায়। তারা বলে, স্যার, অরা আমাগো মতোই কাঙ্গাল, টিকেট কিনবো কী দিয়া, কতো সাবসুয়ায় বিনাটিকেটে চলে! টি-টি-ই মুখ বেঁকিয়ে তাদের ডিঙিয়ে চলে যায়। 


হাজিগঞ্জ বড়ো মসজিদে জুমার নামাজে বিশাল জামাত হয়। মুসল্লিতে ভরে যায় মসজিদের ভিতরবাহির। চাঁদপুর কুমিল্লা সড়কেও চলে আসে জামাত। নামাজান্তে বাইরে দুপাশে বসে পড়ে ভিক্ষুকের সারি, বসে পড়ে ছাইদল ও তার মা। তারা অবাক হয়, এতো ভিক্ষুক; দেশ কী তবে ভিক্ষুকেরই! তারা ভালোই পায়, মা-ছেলের মুখে হাসি খেলে যায়। এখন তারা বাস ভাড়া দিয়ে সিটে বসেই আসে যায়। 


কিন্তু বুড়ি রাগ করে বসে, আর যাবেনা হাজিগঞ্জ। যদি আবার কুকুরে কামড়ে দেয়! কয়েকদিন আগে শুক্রবার বিকালে মা তাগাদা দেয় বাড়ি ফিরার জন্য। ছাইদল মাকে থামায়, অ মা গজ্জ করিচ্ছা, ঐ যে রাস্তার উত্তুর পাশের নতুন তিনতালা মার্কেট, আইজগা হাইঞ্জার সময় হেইডা চালু অইবো, অরা মিলাদ হড়াইবো, বিরানি খাবাইবো, খাঁড়া তোরে আইজ বিরানি খাবামু। 


সন্ধ্যার সাথে সাথে শুরু হয় আলোর ঝলকানি। বুড়ির চোখে ধাঁধা লাগে। এটা আবার কোন দুনিয়া। মাইকে মিলাদ হয়। কথার ফুলঝুরি হয়। তবররুক বিতরন শুরু হয়। মা ও ছেলে গিয়ে লাইনে দাঁড়ায়। তারা দুইজনে দুই পেকেট বিরানি পায়। ভীষণ খুশি হয় মা ও ছেলে। রাস্তার দক্ষিণ পাড়ে এসে তারা ফুটপাতের কার্নিশে বসে। বুড়ি তার পেকেটটা খোলে। ঘ্রাণেই অর্ধেক ভোজন হয়ে যায় তার। সে পেকেটটা সামনে রেখে চোখ বুঁজে। কতো প্রশ্ন তার মাথায়! কেনো রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করে তারা? কেনো রাস্তার পাশে ময়লা আবর্জনায় খেতে বসে তারা? কেনো কুকুর বিড়ালের মতো তুচ্ছ জীবন তাদের? 


দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ খুলে বুড়ি দেখে তরতাজা এক কুকুর তার পেকেট খাচ্ছে। রাগে গরগর করে বুড়ি অমনি লাথি মারে কুকুরকে। কুকুরও গপ করে বুড়ির পা ঢুকিয়ে ফেলে তার মুখে। দাঁত বসায়নি কুকুর। বাজারের কুকুরগুলি এমনই, কামড় বসায় না, কাজ হাসিলের জন্য ভয় দেখায় মাত্র। কিন্তু মানুষ ভয়ও দেখায়, কামড়ও বসায়। যা হোক, কুকুরের কাজ কুকুরে করেছে। ছাইদল নিজের পেকেটটা খুলে বলে, অ মা, চাই আক্কর। মা কয়েক লোকমা খেয়ে বলে, অইছে, তুই খা। 


এমনই করে ছাইদল। মাকে গাছতলায় বা দোকানের ঝাঁপতলায় বসিয়ে সে রুটি নিয়ে আসে, দোকানির কাপে করে নিয়ে আসে চা। আগে মা'কে খেতে দেয় পরম আদরে; মা যেনো তারই ছোট্ট মেয়ে। মাও ছেলের মুখে খানা তুলে দেয়; ছাইদল যেনো আজো তার ছোট্ট ছেলে। ছাইদল মায়ের জন্য পিন্ধনবাস মেগে নেয়। মাও মেগে নেয় ছেলের জন্য লুঙ্গি জামা। মা-পুতের এমন বন্ধন- কেউ বলবে না তারা ছিটগ্রস্ত মানুষ। 


আড়ং বাজারের দোকানদার সোবহান একটি কুকুরকে খাবার দেয়। তার বিশ্বাস রাতে কুকুরটি তার দোকান পাহারা দেয়। বুড়ি বাগে পেয়ে কুকুরটাকে ইয়া জোরে বাড়ি দেয় যে, কুকুরের কান্না শুনে সোবহান দোকান থেকে বেরিয়ে আসে এবং বুড়িকে ও ছেলেকে যাচ্ছেতাই বকে। কিন্তু বুড়ি নিরুত্তাপ কন্ঠে বলে, এই কুত্তায় আমারে আজিগঞ্জ কামড়াইছে। সোবহান তেড়ে উঠে, কই আজিগঞ্জ আর কই আড়ং। সে কতক্ষণ বকবক করে শেষে, পাগলে কী না বলে, ভেবে চুপ হয়ে যায়। 


সেই সোবহানই ক'দিন পরে পৌষের রাতে দোকান বন্ধ করার সময় দেখে পাশের পরিত্যক্ত দোকানের ফ্লোরে পড়ে আছে বুড়ি। সোবহান এগিয়ে যায়। আহা, শীতে কাঁপছে বেচারি। সোবহানের দয়া হলো। সে তালা খুলে দোকানে ঢুকে তার কাঁথাটা নিলো। কিন্তু তার মনে পড়ে গেলো- তাকেও তো মাঝেমধ্যে দোকানে শুতে হয়, তখন! তাছাড়া কাঁথাটা যা-তা কাঁথা নয়, বউয়ের হাতের নকশীকাঁথা। সোবহান কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়। তবে, শেষ পর্যন্ত তার শ্রেষ্ঠ সত্তাই জয়ী হয়, সে আপন মনে বলে উঠে, ত্যাগও তো একটা ভালোবাসা। দু'চোখে তার ভেসে উঠে নুপুর- প্রিয়তমা স্ত্রী; পদ্মিনী বউ। সে ভাবে আজ রাতেই আনন্দকালে নুপুরকে সে বলবে এই কথা, নিশ্চয় নুপুর দুটো চুমু বেশিই দিবে- বলবে আরেকটা কাঁথা বানাবো শুধু তোমার জন্য। অনুরাগে অনুরঞ্জিত সোবহান প্রিয় কাঁথাটি বগলদাবা করে দোকান বন্ধ করে। তারপর কাঁথাটা বুড়ির গায়ে জড়িয়ে দেয়। সোবহান দেখলো খাম্বার বিজলি বাতিটার সমস্ত আলো যেনো বুড়ির মুখে। কী অপরূপ হাসি বুড়ির। 


ছাইদল রুটি নিয়ে এসে দেখে মা জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে। সে বুঝলো বুড়ি বাহ্য সারতে গেছে। ছাইদল ততক্ষণে শীতে জমে গেছে। সে মায়ের উল্টিয়ে যাওয়া কাঁথাটার ভিতর ঢুকে পড়ে। বুড়ি ফিরার সময় দূর থেকে দেখে একটি কুকুর তাদের ওড়ার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বুড়ি দূর থেকেই ক্রুদ্ধ হয়, কিন্তু কাছে এসে আর দেখতে পায়না কুকুরকে। তবে কাঁথাটা নড়ে উঠায় বুড়ি বুঝলো কুকুরটা কাঁথা আর ওড়ার মাঝখানেই আছে। বুড়ি অমনি, দূরো কুত্তা, দূরো কুত্তা, বলে পিটুনি শুরু করে। 


বেদম প্রহার খেয়ে ছাইদল কাঁথা সরিয়ে বললো, অ মা, আর মারিছ না মা, কুত্তা কই, আমি। বুড়ির জেদ থামলো না, বলে উঠলো, তুইও কুত্তা, অ কুত্তা, আইলি কা আমার লগে? ছাইদল সুস্থ মানুষের মতো বলে উঠলো, অ মা, তুই আনলি কা মা? তয়, এই কান ধইরা তোবা কল্লাম, আর আইতাম না মা, এই কুত্তার মেলো আর আইতাম না, তুইও আমারে আর আনিছ না মা। কুৃঁইকুঁই শব্দ করে কেঁদে উঠে ছাইদল। 


বুড়ি থেমে যায়। অবাক হয় সে, চারিদিক থেকেই যেনো তার কানে এসে পশছে কুঁইকুঁই শব্দ। বুড়ি চোখ ঘুরিয়ে দেখে পাশের টং দোকানের নিচে এলিয়ে আছে কুক্কুরি, তার বাচ্চারা কেউ কুঁইকুঁই করছে আর কেউ চুকচুক করে দুধ খাচ্ছে। 


হঠাৎ কী হলো বুড়ির! বুড়ি হাতের লাঠি ফেলে দিয়ে বসে পড়ে ছেলের পাশে। ছেলের মাথাটা কোলে তুলে নিয়ে কেঁদে উঠে। ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে, অ পুত ল বাইত ল, আঙ্গো ঘর আছে, দুয়ার আছে, আমরা বাইত যামু, ল বাইত দিগে ল। তারা নকশীকাঁথাটা বটে সোবহানের দোকানের সামনে রেখে হাঁটা শুরু করে। 


মা-ছেলের কথা চলতেই থাকে। মায়ের কথাগুলো আজ মমতাময়ী সুস্থ মায়ের যেনো। মা বলে, ও ছাদু, হনুফারে তোর বউ করুম। ছাদু বলে, দূর মা, অর বাপ ভাই বেক ইতর কেতর। মা বলে, হনু ভালা, তোরে ভালা জানে অয়। রাতের কালোয় ছাদুর হাসিমুখ দেখা গেলো না, তবে তার ললিত কন্ঠ থেকে বুঝা গেলো সে হাসি মুখেই বলছে, হাছা? মা বললো, হ হাছা। ছাদু বলে, তয় হনুফা কী আঙ্গো লগে আডবো? মা বলে, দূরো কুত্তা, আমিই আডমু, মাইগ্গা মাইগ্গা তোগরে খাবামু। ছাদু বলে, অ মা, এই চা আমার শইল্লও বল আছে, আমিও কাম করুম, তুই যেমনে কবি হেমনেই চলুম। 


মা-ছেলের কথায় যেনো বাতুলতা নেই। তাদের শারীরিক রোগও নেই যে মানসিক রোগ হবে। বঞ্চনার আতঙ্ক; জীবনের অনিশ্চয়তা; ওদের স্নায়ুকে নাড়িয়ে দিয়েছে তাই ওরা স্নায়ুরোগী। মানুষের অন্তরে হাসি থাকলে স্নায়ুরোগ হয়না- হেমায়েতপুর কিংবা রাঁচি'রও দরকার হয় না। 


ঘুটঘুটে অন্ধকারে মা-ছেলে দু'টি আদমসুরত হাঁটে আর হাঁটে। দেশ হাঁটে, জগৎ হাঁটে, কেউ তাদেরকে দেখতে পায়না, উপর হতে দেখতে পায় আদমসুরত। আদমসুরত তার বাম হস্ত প্রসারিত করে তার 'ওয়রিয়র উমেন' এই বৃদ্ধা কন্যাকে পথ দেখায়, আরো অনেক পথ যে হাঁটা বাকি আছে তার।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ