চলার পথে হঠাৎ দেখা ~ সুজিত চক্রবর্তী




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

চলার পথে হঠাৎ দেখা 

সুজিত চক্রবর্তী 



         শুরুতেই বলে রাখা ভালো আমার জীবনের বহু দিন ও রাত ট্রেনে কেটেছে। তার মধ্যে লোকাল ট্রেন যেমন আছে , তেমনই আছে দূরপাল্লার রেলগাড়ির স্মৃতি। আর  বিভিন্ন রুটে চলার পথে যে বহু মানুষের সাথে দেখা হয়েছে সে কথা তো বলাই বাহুল্য ! এইসব মানুষের মধ্যে অধিকাংশই সাধারণ হলেও , দু'একজন বিখ্যাত ব্যক্তিও আছেন বৈকি। তবে এমন একজনের সাথে ট্রেনে পরিচয় হয়েছিল যাঁর সাথে দেখা হওয়া বা  কথোপকথনের স্মৃতি এ জীবনে  ভুলে যাবার নয়। কেন একথা  বলছি সেটা পরে বলব , আগে তাঁর সাথে দেখা হওয়ার ঘটনা যথাসম্ভব অল্প কথায় বলা যাক।


              সাতাশ বছর আগের একটা ঘটনা । তারিখ : পঁচিশে জানুয়ারি । সে সময় আমার  চাকুরিস্থল ছিল জলপাইগুড়ি। কলকাতা থেকে সেদিন জলপাইগুড়ি আসব বলে সস্ত্রীক হাজির হয়েছি শিয়ালদহ  স্টেশনে তিস্তা তোর্সা এক্সপ্রেস ধরব বলে। শ্বশুর-শাশুড়ি স্টেশন অবধি আমাদের সঙ্গে  এসেছেন। তখন ওরা তিনজনে স্লিপার কামরার ভেতরে বসে আছে , আমি ছিলাম  স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। নিজের জন্য একটা চা নিলাম আর ওদের তিনটে চা ট্রেনের জানলা দিয়ে বাড়িয়ে দেওয়ার পর খেয়াল করলাম আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে , যাকে খুব চেনা চেনা লাগছে কিন্তু মনে করতে পারছি না ঠিক কোথায় দেখেছি ! স্বল্প উচ্চতার একজন বয়স্ক মানুষ , মাথায় টুপি। বললাম , " চা খাবেন ? " বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ প্রশ্নের উত্তরে হ্যাঁ কিম্বা না শোনা যায়। ইনি এ দুটোর কোনওটাই বললেন না ! বললেন,  " চা আমি খাই না।  এতে ক্ষুধা মইরা যায়। "  আমার বিস্মিত জিজ্ঞাসা , "আপনি কে বলুন তো ? আপনাকে খুব চেনা চেনা লাগছে ! "

          বললেন , " আমার নাম মনোহর আইচ্।  দমদমে থাকি । " এবার আমার স্মৃতিতে ভেসে উঠল টিভিতে দেখা বিশ্বশ্রী মনোহর আইচের মুখ। সেসময়ে আরেক বাঙালি বিশ্বশ্রী মনোতোষ রায়ের সঙ্গে দূরদর্শনের পর্দায় প্রায়ই তর্ক-বিতর্ক  করতে দেখা যেত এনাকে।  


             জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম স্লিপার কোচের যে ছ'জনের খোপে আমাদের দুজনের সিট ওনার স্লিপারটিও সেখানেই। খুশি হয়ে  বললাম , " ঠিক আছে। তাহলে আজ অনেকটা সময় আপনার সাথে কাটানোর সুযোগ পাবো। "

তখন আমার বয়স কম ছিলো এবং সত্যি কথা বলতে কি বৃদ্ধদের খুব একটা ভালো লাগতো না । কিন্তু , এটা বুঝতে পারছিলাম এই ভদ্রলোক ভীষণ রকমের ব্যতিক্রমী পুরুষদের একজন। পরে জেনেছিলাম যে সে সময়ে ওনার বয়স ছিলো চুরাশি বছর । চলেছেন কোচবিহারে , পরদিন ছাব্বিশে জানুয়ারি একটা শোতে অংশ গ্রহণ করার জন্য। একথা জানার পরে অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিলাম, " এই বয়সে আপনি শো করেন ? " 


     বললেন,  " অবশ্যই করি । না করলে আমাকে খাওয়াইব কেডা ? তুই ? কেউ খাওয়াইলেই বা আমি খাব ক্যান্ ? " অবশ্য এই কথোপকথন বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর হয়েছে , ততক্ষণে আমাদের মধ্যে অনেক কথাই হয়ে গেছে এবং তাঁরই নির্দেশ মেনে 

 ওনাকে মনোহরদা বলে ডাকতেও শুরু করেছি । 


            শুরু থেকেই নিজের জীবনের নানারকম সংগ্রামের ইতিহাস বলে যাচ্ছিলেন মনোহরদা। এমন বিখ্যাত ব্যক্তি  এত সরল আর খোলা মনের হতে পারে একথা ভেবে বিস্মিত হয়েছিলাম সেদিন। নিজেই বললেন যে চার ফুট এগারো ইঞ্চি হাইটের কেউ মিস্টার ইউনিভার্স হতে পারে একথা কোনও পাগলেও বিশ্বাস করতো না । আমার কাছে সেদিন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেটা মনে হয়েছিল তা হচ্ছে যে বছর তিনি " বিশ্বশ্রী " খেতাব জয় করলেন তার আগের বছর (1951) ওই  প্রতিযোগিতায় প্রথমবার  অংশগ্রহণ করে দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন আর সে বছর মিস্টার ইউনিভার্স  হয়েছিলেন আরেক বঙ্গ সন্তান , মনোতোষ রায় ।  এরপর তাঁর মানসিক অবস্থা এবং কপর্দকশূন্য হয়ে যাওয়ার কারণে দেশে ফেরার সমস্যার বর্ণনা। তাঁর বক্তব্য ছিল যে তিনি ভেবেছিলেন সে বছর বিশ্বশ্রী খেতাব জয় করবেন এবং তারপর তাঁর আর অর্থের অভাব হবে না। কিন্তু সেটা না হওয়ায় কী বিপদের মুখে পড়তে হয়েছিল তাঁকে সেসব কথা বিস্তারিত জানিয়েছিলেন সেদিন । সে কাহিনী কোনও থ্রিলারের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। 


            এইসব শুনতে শুনতে মনে পড়ে গেছিল আর্নেস্ট হেমিংওয়ের লেখা " দ্য ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সি " উপন্যাসের একটি বাক্য : " Man can be defeated but never destroyed ! " মানুষ কখনও হেরে যেতে পারে কিন্তু কখনও  ফুরিয়ে যায় না। হেরে যাওয়া মানুষ আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে এবং পরের বার হয়তো জিতেও যায়, ঠিক যেভাবে পরের বার ( 1952 ) বিশ্বশ্রী খেতাব জয় করেছিলেন মনোহর আইচ। আমার মুখে হেমিংওয়ের এই উদ্ধৃতি শুনে খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল তাঁর মুখ এবং এরপর তিনি তাঁর সহযাত্রী দুয়েকজনকে আশপাশে এদিক ওদিকের সিট থেকে ডেকে এনে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। জানতে পারলাম এনারাও বডি বিল্ডিংয়ের প্রাক্তন রাজ্য চ্যাম্পিয়ন বা এইরকম কিছু। বললেন,  " শোন্ ,  সুজিত কী বলছে !"  আমি যে তখন কতটা রোমাঞ্চিত , তা বোধহয় সহজেই অনুমান করা যায়। 

         পরে একসময় কথায় কথায় আমার কাছে একটা প্রশ্ন করলেন , " আমাকে অমুক  সার্কাস-ওয়ালারা ডাকছে ওদের সার্কাসে যোগ দেওয়ার জন্য। আমি কি যাব ? মানে যাওয়া ঠিক হবে ? " এ প্রশ্ন শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। যদিও জানতাম আমার উত্তরের ওপর নির্ভর করে তিনি সার্কাসে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন না , তবু বিস্মিত হওয়ার কারণ ছিল অন্যত্র । প্রথমত , বয়সে তিনি আমার চেয়ে প্রায় পঞ্চাশ বছর বড়। দ্বিতীয়ত, আমি ট্রেনে কয়েক ঘন্টা আগে আলাপ হওয়া এক অতি সাধারণ সহযাত্রী ছাড়া আর কিছুই নয়! 


             এমনি করে রাতে শুতে যাবার আগে পর্যন্ত শুনে গেলাম মনোহরদার জীবনের নানান বর্ণময় কর্মকাণ্ড। জানতে পারলাম  তাঁকে হাজতবাসও করতে হয়েছে এবং জেলে বসেও তিনি শরীরচর্চা বন্ধ রাখেন নি । জানলাম সত্তরের দশকে সল্ট লেকে SAI এর  (Sports Authority of India) মধ্যে তাঁকে ' বডি বিল্ডিং ' বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয় ( ভালো অঙ্কের সাম্মানিক সহ ) কিন্তু সে চাকরি তিনি করেন নি। কারণ এই বিভাগে নাকি সেই সময়ে কোনও শিক্ষার্থী যেতই না। বললেন,  " হারামের পয়সা আমি  নিবো ? "  


       বুঝতে পারলাম তিনি শুধু সরলই নয় , যথেষ্ট সততার সঙ্গে তিনি জীবন অতিবাহিত করেছেন। প্রায় সব কথাই আজও মনে আছে। কিন্তু সেসব বলতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে।এ গল্প এখানেই শেষ করব উপসংহারে  পরবর্তী কালে এই হঠাৎ দেখার প্রভাব আমার জীবনে ঠিক কতখানি তার সামান্য ইঙ্গিত দিয়ে। 


            আমি নিজেও সেদিন বুঝতে পারি নি যে মাত্র কয়েক ঘন্টার এই আলাপচারিতা আমার জীবনে এক চিরস্থায়ী পরিবর্তন আনবে। তার চেয়েও বড় কথা হলো এমন যে হতে পারে সেটাই হয়তো তার আগে বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু অনুভব করতে লাগলাম সেটাই হচ্ছে। মনের গভীরে একটা শক্তির অস্তিত্ব আবিষ্কার করে ঋদ্ধ হতে লাগলাম এবং সেইসঙ্গে হয়তো কিছুটা আত্মসমালোচনা করার দিকে ধীরে ধীরে মনোনিবেশ করলাম। মনে হতে লাগল , আমারও অনেক কিছু করার আছে এই পৃথিবীতে। সত্যি বলতে কী আজও আমার অন্তরে সেই সততা আর সংগ্রামের প্রদীপ অনির্বাণ , অবিনশ্বর হয়ে আছে। 

দুহাজার ষোলোর জুন মাসে একশো চার বছর বয়সে মনোহরদা স্বর্গবাসী হয়েছেন। 

এই সুযোগে আরও একবার প্রণাম জানাই হার না মানা সেই ব্যাক্তিত্বের উদ্দেশ্যে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ