দর্পণ || কবর ন্যাশনাল গার্ল চাইল্ড ডে ~ জয়ন্ত অধিকারি




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

কবর 

ন্যাশনাল গার্ল চাইল্ড ডে 

জয়ন্ত অধিকারি 


গল্প শুরু করার আগে কিছু তথ্য। আজ, 'ন্যাশনাল গার্ল চাইল্ড ডে'। আমরা তো ধুমধাম করে অনেক কিছুই পালন করি। কিন্তু বাস্তবে তার রূপটা কীরকম ? একটু দেখে নিই আগে। আমাদের দেশে মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার হার ৬৫%; যেখানে ছেলেদের ক্ষেত্রে সেটা ৮৩% ! ২০২২ সালে, কর্মক্ষেত্র থেকে মেয়েদের জন্য চাকরি প্রায় ১৮% কমেছে। বিভিন্ন রিসার্চে দেখা গেছে, ২০০০ থেকে ২০১৯ এর মধ্যে প্রায় ৯০ লক্ষ মেয়েদের কে জন্মের আগেই , বা জন্মের পরেই শেষ করে দেওয়া হয়েছে - অপরাধ ? তারা মেয়ে। ইউনাইটেড নেশনস এর রির্পোট বলছে গত পঞ্চাশ বছরে সারা বিশ্বে ১৪.২ কোটি মেয়েদের কে গর্ভে থাকতেই বা জন্মের পরেই শেষ করে দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে ৪.৫ কোটি মেয়েকে শেষ করে দেওয়া হয়েছে আমাদের দেশে। 


আমরা ঈশ্বর হিসেবে মাতৃ মূর্তি পুজো করি, কিন্তু ভেতরে ভেতরে হয়ত অন্য আর এক মনোভাব পোষণ করি।    


++++++++++++++++++++++++++++++


"কবর, কবর খুঁড়েছি আমরা ! সেই কবরের গর্তে নিজেরাই ঢুকে, বসে থাকব আমরা। একবার ভাল করে নিজেদের গায়ের গন্ধ শুঁকে দেখ ! পচা -  গলা - বাসী - পোকায় কাটা মৃতদেহের পচা গন্ধ আসছে ভেসে। পাচ্ছিস না তোরা সেই গন্ধ ? তোদের নাকগুলো কি গেছে ? " উঠে দাঁড়ায় চিরাগ কোনও রকমে। শরীরটা টেনে টেনে নিয়ে আসে সামনে বসে থাকা প্রায় দেড়শোজন বিভিন্ন বয়সের পুরুষদের সামনে।  


বেশির ভাগের-ই বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। রয়েছে কিছু ষাটোর্দ্ধ বৃদ্ধ , আর গুটিকয় বাচ্চা ছেলে। সবার গা-হাত-পা রোদে পোড়া। উদোম গা, কারোর পরণে পাজামা বা ধুতি বা লুঙ্গি। অধিকাংশের-ই নেশাতুর লাল চোখ। বুকগুলো হাপরের মতো ওঠানামা করছে ওদের এক ভীষণ কষ্টে। গ্রামের মাঝে, বড় বটের তলায় জড় হয়েছে ওরা আজ সবাই মিলে ! 


কিছু একটা করতেই হবে , এভাবে আর পারা যাচ্ছে না ! বেঁচে থাকাটাই, হয়ে উঠেছে ভীষণ কষ্টকর ! 


ওদের সবার রয়েছে জমি জায়গা , রয়েছে ঘর বাড়ি ; কিন্তু ওদের জীবনে নেই কোনও নারী ! নেই এমন কোনও নারী যে ঘর বাড়ি সামলাবে ; যাকে জড়িয়ে দু দণ্ড বসবে ওরা সবার অলক্ষ্যে, নিভৃতে , বলবে সুখ দুঃখের কথা , করবে প্রেমালাপ। নেই এমন কোনও মেয়ে, যে বাবাকে দেখে আসবে ছুটে,  ডাকবে ওদের বাবা বলে, জড়িয়ে ধরবে বাবাকে , কোলে উঠে খিলখিল করে উঠবে হেসে। নেই এমন কোনও নারী, যে মাতৃস্নেহে ওদেরকে টেনে নেবে বুকে, রোগজ্বালায় টেনে নেবে ওদের মাথা নিজের কোলে , ঘুম পাড়িয়ে দেবে পরম স্নেহে ! 


বুকের ভেতরে জ্বালা করে ওঠে শচীনের। মনে পড়ে যায়, অনেক অনেক বছর আগেকার একটা কথা , একটা ঘটনা। সেই অভিশাপ আজ ও বয়ে নিয়ে চলেছে ওরা। 


তড়াক করে উঠে দাঁড়ায় শচীন। এমনিতে ভীষণ কম কথা বলে ও , কিন্তু আজ আর পারে না সামলাতে নিজেকে। চিরাগকে ঠেলে সরিয়ে সবার সামনে এসে উঠে দাঁড়ায় গাছের নিচে বাঁধানো বেদীর ওপরে। সবার দিকে আঙুল তুলে ইশারা করে হিসহিস করে প্রচন্ড রাগে গর্জে ওঠে ও ,"সব কিছুর জন্য তোমরা দায়ী। আমার বাবা, আমার দাদু, দিদা, কাকু, কাকী , আর এই গ্রামের সব লোক, তোমরা সব্বাই দায়ী। সেদিনের সেই অভিশাপের বোঝা আজ ও বয়ে নিয়ে চলেছি আমরা। শেষ হয়ে যাব। সব শেষ হয়ে যাবে। এখনও সময় আছে ! " হাত জড়ো করে সবার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে শচীন। 


মুখ নিচু করে বিড়বিড় করে ওঠে, "এখনও সময় আছে , সময় আছে ! "  


ভেসে ওঠে অনেকদিন আগের কথা, ওর চোখের সামনে। চোখের কোণটা জ্বালা জ্বালা করতে শুরু করেছে....


শহর থেকে প্রায় দেড়শো কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ছোট্ট এই গ্রাম, টোরি। টোরি গ্রামে আজকের দিনে বসবাস করে আড়াইশো জন মানুষ। তার মধ্যে দুশো জন-ই পুরুষ ! রয়েছে প্রায় জনা পঞ্চাশেক মেয়ে। তারা ও সবাই এখন মৃত্যুর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। আশেপাশের আরও  অনেক গ্রামে একইরকম অবস্থা। আজ থেকে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগে, তখন শচীন পাঁচ বছরের ছোট্ট ছেলে , একদিন মায়ের কাছে ঘুরঘুর করছিল, মায়ের আশেপাশে। গ্রামের বেশ কয়েকজন পাঁচ, সাত আর নয় বছরের মেয়েরা সেদিন করছিল 'গৌরী ব্রত' ! 


ও মা কে জিজ্ঞেস করেছিল ,"মা, এই, দিদিরা  কী করছে ? কীসের পুজো ? " 


"না রে শচীন, পুজো নয় ! ওরা একটা ব্রত পালন করছে, গৌরী ব্রত ! আষাঢ় মাসের এই সময়ে, এই ব্রত পালন করলে, মেয়েরা বড় হয়ে  শিব ঠাকুরের মত বর পায়। আর এই সময় ওরা দিনে শুধু দুবেলা খায় - টমেটো, নুন দেওয়া খাবার, সব্জি এ'সব খাওয়া বারণ ! " উনুনের ধারে বসে কড়াইয়ের ওপরে খুন্তি নাড়তে নাড়তে উত্তর দেয় ওর মা। 


আবার একটু খেলে, বাইরে থেকে ঘুরে এসে, শচীন জিজ্ঞেস করে , "মা ! তুমিও করতে এই গৌরী ব্রত ? এখন কর না কেন ? " 


হেসে ওর মা বলে ওঠে , "ধুর বোকা ! আমি আর এখন কেন করব ? ও তো যাদের বিয়ে হয় নি, কম বয়সের মেয়েদের করতে হয়। তবে ছোটবেলায় , আমিও করেছি।  কত মজা করেছি তখন আমরা ! ভাবতাম সত্যিই শিব ঠাকুর এর সাথে বিয়ে হবে , আর আমি পার্বতী ! " 


আবার শচীন চলে যায় বাইরে , এদিক ওদিক একটু দৌড়োদৌড়ি করে। একটা কঞ্চি হাতে নিয়ে ভেতরে আসে, রান্নাঘরে মা কে দেখতে না পেয়ে, ওদের গ্রামের পুকুরের দিকে চলে যায়। মা আরও কয়েকজন কাকীমা সবাই জামা কাপড় ধোয়াধুয়ি করছে পুকুরের জলে। একটু পরে সবাই নাইবে ! মায়ের কাছে এসে চুপ করে বসে থাকে /


মা জিজ্ঞেস করে, "কী রে ? কিছু বলবি ? না হলে এখান থেকে যা তো বাপু ! আমরা নাইবো এখন ! " 


"মা, বলছি , বাবা কি শিব ঠাকুর ? " 


মা কিছু না বলে মুখ চেপে হাসতে থাকে। পাশ থেকে একজন কাকীমা চেঁচিয়ে ওঠে , "হ্যাঁ রে, তোর বাপ সত্যিই শিব ঠাকুর একটা। এবার তুই যা তো  !" 


শচীন চলে যায় ওখান থেকে । যাওয়ার সময় শুনতে পায়, পেছনে সবাই হাসাহাসি করছে। ওর মায়ের কাছে এসে, ঘিরে ধরেছে ওকে। কেউ একজন জিজ্ঞেস করে ভিড়ের ভেতর থেকে, "এই , তোর পেটের ভেতরেরটা ছেলেই হবে, তাই না ? আমাদের শচীনের একটা ভাই আসবে ! " 


কেটে যায় আরও কয়েকটা মাস। মায়ের পেট বেশ ফুলে উঠেছে। এখন আর ভাল করে হাঁটতে চলতে পারে না। হাঁটার সময়ে পেটের নীচের দিকে হাত দিয়ে হাঁটে, ধীরে ধীরে। বাবা শচীনকে বলে দিয়েছে মায়ের কাছে বেশি না ঘেঁষতে। যদি লেগে যায় ? শচীন কে ওর বাবা বলেছে, "তোর একটা ছোট্ট ভাই আসছে রে ! " 


শচীন বলেছিল, "না, আমার ভাই না ! আমার একটা বোন চাই ! ঠিক পুতুলে....." 


কথা শেষ হওয়ার আগেই একটা চড় এসে পড়ে ওর গালের ওপরে। রাগে চেঁচিয়ে ওঠে ওর বাবা, "বোন চাই ? খুব শখ হয়েছে, তাই না ? তোর একটা ভাই-ই হবে, বুঝেছিস ? " 


মা তাড়াতাড়ি কোনও রকমে উঠে এসে জড়িয়ে ধরে শচীন কে , "আহ, ও তো বাচ্চা ছেলে। ও কি বোঝে ? আর সত্যিই তো, যদি মেয়ে হয় ? কী  করবে তখন ? " 


"মেরে ফেলব, কেটে ফেলব। আগে ওই মেয়েটাকে, তারপর....তোকে ! বুঝেছিস ? " বাবা পা দাপিয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। বাইরে এসে দাদু আর কাকুকে বলে ওঠে , "ওই টুকু ছোট ছেলে, তার কী না বোন দরকার ? আমি বলে দিচ্ছি বাবা, যদি মেয়ে হয়, আমি মেরে ফেলব - দুটোকেই। আমার চাই না ওই বৌকে, আর ওই মেয়েকেও ! " 


দাদুও বলতে থাকে, "ঠিক বলেছিস। ছেলে না হলে কী করে হবে ? বংশ আগে বাড়বে কী করে ? ছেলে না হলে, বিয়ের সময় কী করে কুড়ি তিরিশ লাখ পাওয়া যাবে মেয়ের বাড়ি থেকে ? আর ওদিকে মেয়ে হলে ? আমাদের-ই দিতে হবে। না না ! আমরা মেয়ে চাই না , এই পুরো গ্রামে আমরা কেউ-ই চাই না কারোর ঘরে কোনও মেয়ে জন্ম নিক ! মেয়ে হলেই হাজার গন্ডা শুধু খরচ ! ছেলে রোজগার করবে, আর মেয়েরা শুধুই খরচ করাবে ! তবে আমি বলি কী ! মেয়ে হলে, মারবি কেন ? বেচে দে ওকে। ওই তো, কয়েকদিন আগে মুখিয়ার ছেলেটা, ওর সদ্যোজাত মেয়েটাকে শহরে বেচে দিয়েছে ! কত পেয়েছে জানিস ? সাড়ে চার লাখ ! মেয়েকে ভাঙিয়ে খেতে হবে তো ! মারিস না, মারিস না ওকে ! " 


কাকু সম্মতিতে মাথা নাড়ে ! "ঠিক বলেছ বাবা ! আমি মুখিয়ার ছেলের সাথে কথা বলে, ওই লোকটার নম্বর নিয়ে আসব ! আগে থেকে কথা বলে ঠিক করে রাখতে হবে সব ! " 


কেটে গেল আরও কয়েকটা দিন। গভীর রাতে মা খুব চিৎকার করতে শুরু করে ব্যথায় ! শচীনকে তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বের করে দেয় বাবা, কাকু গ্রামের ধাই মা কে ধরে আনে তাড়াতাড়ি। ঘন্টাখানেক পরে, হঠাৎ একটা বাচ্চার ট্যাঁ ট্যাঁ শব্দে পুরো পাড়া জেগে ওঠে। বাইরে থেকে সবাই হাসি মুখে, উদ্বিগ্ন চেহারায় জিজ্ঞেস করে, "কী হয়েছে ? কী হয়েছে গো ? " 


ধাই মা শুকনো মুখে একটা ছোট্ট বাচ্চাকে জড়িয়ে নিয়ে আসে ভেতরের ঘর থেকে বাইরে। সবাইয়ের দিকে তাকিয়ে, মাথা নিচু করে , বাচ্চাটিকে বাবার কোলে দিয়ে বলে ওঠে ,"মেয়ে হয়েছে ! "


বাবা ধুপ করে বসে পড়ে মাটিতে, আশেপাশের লোকজন মুখে ছিঃ ছিঃ করতে করতে চলে যায় যে যার বাড়ি ! কাকু তাড়াতাড়ি বাবার পাশে এসে বলে, "যা হওয়ার হয়ে গেছে ! চিন্তা করিস না ! আমি এক্ষুনি ফোন করে দিচ্ছি, কাল ভোরেই এই আপদ বিদায় হবে ! চিন্তা করিস না তুই ! "


শচীন ছুটে আসে বাবার কাছে, বাবার কোলে থাকা ওর বোনকে দেখতে চেষ্টা করে, ওর গায়ে জড়ানো কাঁথাটা সরাতে যায় ! জোরে ওর বাবা শচীনকে এক লাথি মারে, দূরে সরিয়ে দেয় ছেলেকে। শচীন ভেতরে মায়ের কাছে যেতে যায় , বাবা গর্জে ওঠে, "ওই ঘরে কেউ যাবে না ! বন্ধ করে দে ঘরের দরজা। দেখছি আমি কী করা যায় ! " 


বাচ্চাটাকে মাটির এক কোণে ফেলে রেখে বাবা বেরিয়ে যায় কাকু আর দাদুকে নিয়ে। সাথে পেছনে যোগ দেয় গ্রামের আরও কয়েকজন ! 


সকালে একটা গাড়ি আসে, সেখান থেকে নেমে আসে শহরের এক ভদ্রলোক । বাচ্চা মেয়েটিকে ভাল করে দেখে হাতে নিয়ে। উল্টে পাল্টে কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করে। হেসে কিছু টাকা দিয়ে, নিয়ে চলে যায় মেয়েটিকে। গাড়ির শব্দ মিলিয়ে যেতেই, আলুথালু বেশে ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে আসে শচীনের মা। 


চেঁচিয়ে ওঠে, "কোথায়? কোথায় আর মেয়ে ? এনে দে আমাকে ওর কাছে ! " শচীনের বাবার কাছে গিয়ে ওর সামনে অনুনয় করে, পায়ের কাছে পড়ে বলতে থাকে, "ওগো, আমার মেয়েকে এনে দাও ! ও যে তোমার ও সন্তান , আমাদের শচীনের মতো। " 


বাবা পা দিয়ে মায়ের পেটের ওপরে মারে জোরে জোরে ,"ওই পেট থেকে তোর মেয়ে হয়েছে, তাই না ? ওই পেট আমি কেটে ফেলব ! " 


প্রচন্ড ব্যথায় ককিয়ে ওঠে মা , তবুও কোনোরকমে হাত জোড়ো করে দাদুর কাছে গিয়ে বলে ওঠে , "বাবা , আমার মেয়ে, আমার মেয়েটাকে..." 


কথা শেষ হওয়ার আগেই দিদা মায়ের মাথার চুল ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যায় মাকে। সামনের উঠোনে জোরে ছুঁড়ে ফেলে মাকে ! চেঁচিয়ে ওঠে , "মেয়ের জন্ম দেওয়ার সময় মনে ছিল না তোর মুখপুড়ি ? আমার ছেলের ঘরে মেয়ের জন্ম দিয়েছিস তুই ? তোর সাহস হয় কী করে ? এ আমার ছেলের কাজ হতেই পারে না ! বল, বল শয়তানি। তুই কোন মরদের সাথে ফস্টিনষ্টি করে এসেছিস ! কার পাপ তোর পেটে ছিল ? আমার ছেলে, সাত রাজার ধন, মানিক আমার ! আমার এমন শিব ঠাকুরের মত ছেলেটা, একটু ভোলাভালা, কাজ নিয়ে মাঝে মাঝে শহরে যেত। সেই সময় তুই কার সাথে শুয়েছিলিস ? কার পাপের শাস্তি আমাদের দিয়েছিস তুই ? " 


মা কে মারতে থাকে ওর দিদা এলোপাথাড়ি ভাবে। একটু পরে মা কে ছেড়ে ভেতরে চলে যায় ওর দিদা, ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে। হাতে ছিল একটা পোড়া কাঠ। সেটা দিয়ে আবার পাগলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে মায়ের ওপরে। 


শচীন থামাতে যায়, ওর পিঠেও এসে পড়ে কয়েকটা ঘা ! প্রথমে মা চুপ করে মাটির ওপরে উপুড় হয়ে কাঁদছিলো , প্রতিটা মারের সাথে সাথে কেঁপে উঠেছিল মায়ের শরীর। মায়ের পেটের নিচ থেকে বেরতে শুরু করে রক্ত। রুক্ষ শুষ্ক মাটি ভিজে যেতে থাকে রক্তে ! হঠাৎ মা মুখ ঘুরিয়ে তাকায় দিদার দিকে। 


সেই দৃষ্টিতে এমন একটা কিছু ছিল যে ভয়ে দিদা ছেড়ে দেয় মাকে ! বাবার কাছে গিয়ে কিছু বলে। 


বাবা দৌড়ে আসে মায়ের সামনে। মায়ের পাশে বসে দুই গালে প্রচন্ড জোরে জোরে চড় থাপ্পড় মেরে বলতে থাকে, "নিজে দোষ করবি, অন্যের সাথে কী না কী করে বেড়াচ্ছিস, কার না কার পাপ নিজের পেটের ভেতরে রেখেছিস, আর এখন চোখ রাঙাচ্ছিস ? তোর খুব সাহস, তাই না ? খুব সাহস ? দাঁড়া, তোর ব্যবস্থা করছি ! " 


বাবা মোটা একটা দড়ি জোগাড় করে এনে মা কে বেঁধে ফেলে, টানতে টানতে নিয়ে যায় মা কে গ্রামের এক প্রান্তে। সেখানে একটা মোটা গাছের গুঁড়ির সাথে মা কে ভাল করে বেঁধে , লাঠি দিয়ে পেটাতে থাকে বাবা। গ্রামের বাকি লোকজন চলে আসে সেখানে। 


লোকজন কেউ বাবাকে থামানোর চেষ্টা করে নি সেদিন। নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল , "একদম ঠিক করেছে ! মেয়ের জন্ম দেওয়া যে কত বিশাল বড় অন্যায় - দেখুক। দেখুক পুরো গ্রামের লোকজন। মেয়ের জন্ম দিলে, মার খেতে হবে ! মেয়েগুলো হচ্ছে নরকের দ্বার, আর ছেলেরা হচ্ছে সব এক একটা হীরের টুকরো।" 


শচীন কিছুই বুঝতে পারে না সবাই মা কে কেন মারছে ! ও মায়ের কাছে যেতে চায় , জড়িয়ে ধরতে চায়। কিন্তু দাদু শক্ত করে ধরে রেখেছিল ওর হাতদুটো। 


মা হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে ," তুই নিজেকে মরদ বলিস ? নিজের বৌ কে এইভাবে সবার সামনে পেটাচ্ছিস ? খুব মরদ হয়েছিস, তাই না ? আমার লজ্জা হচ্ছে তোকে আমার স্বামী বলতে। এইরকম , এইরকম স্বামীর জন্য, আমি কখনও ব্রত পালন করতাম ? তোমার কথা ভেবে, তোমার মঙ্গল কামনায় আমি পুজো করতাম ? করওয়াচৌথ করতাম ? মঙ্গলসূত্র পরতাম ? থু ! থু ! " 


এক দলা থুতু ছিটিয়ে দেয় মা বাবার দিকে। রক্তচক্ষু করে বাবা দৌড়ে আসে মায়ের সামনে, গলা টিপে ধরে মায়ের। সবার সামনে চেঁচিয়ে ওঠে, "খুব বড় বড় কথা বলছিস যে তুই ? কে শিখিয়েছে ? ওই, তোর নাগর ? কে সে ? দাঁড়া , তোর মুখ বন্ধ করছি আমি। " 


একটা মশাল জ্বালিয়ে আনে বাবা কোথা থেকে। মায়ের কাপড়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে আগুন। পুড়ে যাচ্ছিল মা , জীবন্ত অবস্থায় সবার সামনে। প্রচন্ড গরমে , চামড়া পোড়ার কটু গন্ধে দাঁড়ানো যাচ্ছিল না সামনে ! তাকানো যাচ্ছিল না মায়ের জ্বলতে থাকা শরীরের দিকে। 


ওই অবস্থায় মা চেঁচিয়ে ওঠে ,"আমি অভিশাপ দিচ্ছি। এই গ্রামে, আশেপাশের প্রতিটা গ্রামে, তোরা সবাই একসময় মরবি, কোনও বৌ।  কোনও মেয়ে পাবি না তোদের সুখের জন্য ! তোরা যে মেয়েকে বেচে দিলি, যে মা কে জ্বালিয়ে দিলি, আজ সেই মা, সেই মেয়ে তোদের মুখের ওপরে বলছে - তোরা সবাই শেষ হয়ে যাবি ! অভিশাপ দিচ্ছি আমি ! " 


শচীন নিজের চোখের সামনে পুড়তে দেখে মা কে। দেখে মায়ের গায়ের চামড়া গলে গলে পড়ছে। মাংস চামড়া পুড়ে, ভেতরের মাংস পুড়ে যাচ্ছে। রক্ত বেরিয়ে আসছে, বেরিয়ে আসছে ভেতরের হাড়গোড়। ও আর পারে না নিজেকে সামলাতে। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল ও। 


আগে থেকেই মেয়েদের জন্ম নিয়ে গ্রামে একটা ভয়ের পরিবেশ ছিলো।  মায়ের মৃত্যুর পরে সেটাই যেন অলিখিত এক নিয়ম হয়ে দাঁড়ায় পুরো গ্রামে, আশেপাশের আরও অনেকগুলো গ্রামের মধ্যে। বাচ্চা জন্মানোর আগে, গর্ভবতী মায়েরা অনেক দূরে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে নির্ধারণ করত পেটের ভেতরে বড় হয়ে ওঠা বাচ্চাটা ছেলে না মেয়ে। যদি ছেলে হয়, সুখে, আনন্দে ফিরে আসত ওরা। আর মেয়ে থাকলে, উপড়ে টেনে ছিঁড়ে ফেলে দিত সেই ভ্রূণ কে। যে সব পরিবারের ওই পরীক্ষা নিরীক্ষা করার আর্থিক সঙ্গতি ছিল না , তারা ভাগ্যের ওপরে ছেড়ে দিত নিজেদের। কোনও পরিবারে মেয়ে জন্মালে, পুরো গ্রাম থেকে তাদের কে একঘরে করে দেওয়া হত , বা তাড়িয়ে দেওয়া হত গ্রামের বাইরে। 


ধীরে ধীরে পুরো গ্রাম থেকে মুছে যেতে থাকে মেয়েদের হাসির আওয়াজ। বিবাহযোগ্য মেয়েদের না পেয়ে গ্রামের ছেলেরা আশেপাশের গ্রামের দিকে তাকায়। সেই সব জায়গাতে ও একই অবস্থা। ওরা নিজেদের ডুবিয়ে দেয় নেশার মধ্যে। 


ঘোর বিষন্নতার কালো ছায়া নেমে আসে গ্রামের ওপরে। 


অবিবাহিত যুবক - পুরুষদের কবল থেকে মুক্তি পেল না গবাদী পশুরা ও ! 


শচীন চোখ মুছে , ধীরে ধীরে মাথা উঁচু করে , সোজা হয়ে তাকায় সবার দিকে। সবাই তাকিয়ে ওর দিকে। এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে চারদিকে। 


একটু দূরে একটা গাছের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে শচীন, "মনে আছে, মনে আছে ওই গাছটা ? ওই গাছের সাথে বেঁধে, আমার মা কে পোড়ানো হয়েছিল ? বাবা ? বাবা ? মনে আছে তোমার ? কী অপরাধ ছিল আমার মায়ের ? মেয়ের জন্ম দিয়েছে বলে এভাবে পুড়িয়ে মারলে ? আর আমার বোনটাকে ? বেচে দিয়েছ তুমি। বেচে দিতে পারলে ? বাবা হয়ে কী করে পারলে নিজের সন্তানের সাথে এই অন্যায় করতে ? আর মনে আছে তোমার ? তোমাদের সবাইয়ের মনে আছে কি হয়েছিল সেদিন ? যারা চুপচাপ ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছিলে সেদিন , সেদিনের সেই কথা মনে আছে ? মা সেদিন অভিশাপ দিয়েছিল সবাইয়ের ওপরে। তোমাদের এই অন্যায়ের জন্য, আজ আমাদের এই অবস্থা। আজ আমাদের গ্রামে নেই কোনও মেয়ে। আশেপাশের কোনও জায়গা থেকে কেউ আমাদের গ্রামের ছেলেদের সাথে তার মেয়ের বিয়ে দিতে চায় না! কেন ? কেউ জেনে শুনে তার মেয়েদের বিপদের মুখে ফেলে দিতে চায় না, চায় না তাদের মেয়েরা এখানে এসে বিয়ে করে মরে যায় ! বেশ করে তারা। আমরা কি মানুষ ? কিসের এত গুমোর আমাদের ? আমরা ছেলেরা হীরের টুকরো ? আর মেয়েরা ? ওরা ? ওরা হল সেই মানুষ, যারা সেই হীরেকে যত্ন করে রাখে নিজের কাছে, আদরে, ভালোবাসায় স্নেহে, মায়া, মমতায়, যত্নে ভরিয়ে দেয় জীবন ! এই সমাজ, সংসার, সব অসার - যতক্ষন না নারী আর পুরুষ একসাথে মিলিত হয়ে কিছু করছে। যে রকম সংসারে দরকার পুরুষের, তার থেকেও বেশি দরকার মেয়েদের , এক নারীর যে আমাদের এই সংসারকে সুন্দর, বাসযোগ্য করে তুলবে। তোমাদের অন্ধ বিশ্বাস,  কুসংস্কার এই সব কিছুই দায়ী আমাদের আজকের এই অবস্থার জন্য। তবে দেরি হয় নি এখনও। আমরা আমাদের করা ভুলগুলো সংশোধন করে নিজেদের মানসিকতা পরিবর্তন করার চেষ্টা করি। আমরা তো আমাদের সময় পার করে এসেছি। কিন্তু যারা এখনও ছোট, তাদের জন্য আমরা এগিয়ে আসি, ওদের জীবন একটু ভাল করার চেষ্টা করি। "


বয়স্করা রে রে করে তেড়ে আসে, "যেমন ছিল তোর মা, ঠিক তুই ও সেইরকম ! মার ওটাকে, মেরে ফেল। " 


শচীনের সামনে এসে রুখে দাঁড়ায় ওর বয়সী আরও ছেলেরা। ওদের সবাইকে একসাথে দেখে বাকি বয়স্ক গ্রামবাসীরা ভয়ে সরে আসে। সুনীল  ভিড়ের মধ্যে থেকে বলে ওঠে , "খুব কঠিন এই পথ ! অনেক দেরি হয়ে গেছে, কেউ আজ আমাদের বিশ্বাস করে না। তবে আমাদের হার মানলে চলবে না। আজ আমাদের এই আশেপাশের গ্রামে প্রত্যেক হাজার ছেলের জন্য রয়েছে মাত্র সাড়ে তিনশো মেয়ে ! আমাদের সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে, হাতে হাত মিলিয়ে। যেখানেই কোনও মায়ের ওপরে এরকম অত্যাচার হচ্ছে, কোনও মেয়েকে জন্মের আগেই মেরে ফেলার চক্রান্ত চলছে, সেখানে গিয়ে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। পৃথিবীটাকে সুন্দর করে সাজিয়ে তুলতে হবে আবার। না হলে সত্যি সত্যিই আমরা নিজেরা আমাদের নিজেদের কবর খুঁড়ে তার ভেতরে শুয়ে পড়ব। তোমাদের সবার জন্য আমরা আজ বেঁচেও মরে গেছি। মৃত মানুষের মত দিন কাটাচ্ছি। " 


সুনীল এগিয়ে আসে শচীনের দিকে। ওর কাঁধে হাত রেখে বলে ওঠে , "সেদিন পারিনি রে। ছোট ছিলাম আমরা অনেকেই। কিন্তু আর না ! এভাবেই সবার আশীর্বাদ কুড়িয়ে , কাকীমা, মাসী, পিসি আর ও অনেক অনেক মায়েদের অভিশাপ থেকে হয়ত মুক্ত হব আমরা। " 


সমাপ্ত 


বি : দ্র : - সত্য ঘটনার ওপরে লেখা , তেলেঙ্গানার ওয়ারাঙ্গালের অনেক গ্রামে আজকের দিনে এই অবস্থা চলছে , যেখানে মেয়েদের জন্মের আগেই মেরে দেওয়া হচ্ছে, বা বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। মেয়ের জন্ম যে দিচ্ছে, সেই মা কে মারা হচ্ছে পুড়িয়ে। (টাইমস অফ ইন্ডিয়া ; ১৫/৭/২০১৯ ) ! 


আমরা অধিকাংশরাই শহরে বা শহরের আসে পাশে থাকি বলে হয়তো এই ঘটনা গুলো জানতে পারি না! তবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সেক্স রেসিও খুব খারাপ। এটাই চলতে থাকলে, পুরো মনুষ্যজগৎ ধীরে ধীরে অবলুপ্তির পথে হাঁটবে !  সতর্ক হতে হবে সবাইকে, সচেতন করতে হবে ! এখনও হয়তো খুব দেরি হয় নি !

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ