দর্পণ || নির্বাচিত সাপ্তাহিক সেরা কলম




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

বাংলা ভাষা 

তাপস দাস 


তোমাকে নিয়ে কী করি

তোমার বালুচরী অথবা জামদানি অথবা টাঙ্গাইল

আজ কেমন আটপৌরে, ময়লা, চারহাতি হয়েছে আমাদের হাতে

কত রঙ মেখে ভূতের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি মেলায়

শরীর উপচে দিয়ে তোমাতে, ভুলেছি ভৈরবী

অচেনা লাগে তোমায়

বিদেশের ভাষা এই সুযোগে শুরু করেছে উপনিবেশ আবার

আমাদেরই দোষ, এত মুখোশ! সব ভাষাই বড়ো 

ভাষা ভালোবাসি নাকো

সব অর্থ, অর্থ আর অর্থ

চুপচাপ ওৎ পেতে বসে আছি শিকারির মতো

শিকারও ধরা দেয়, তাদের অবৈধ অভিজ্ঞতা

জালে জালে, রহস্যে, নতুন অভিধান খুলে

তোমাকেই উলঙ্গ করে জিতে নিচ্ছে স্তাবকের দল

এর ফলাফল জানো তুমি 

বুঝেছ নিশ্চয় আজ তুমি নির্বাসনের পথে

যারা ভাষা বেচে খায়, জামা পরে, মদ জোটায়

দু চারটে পার্বণে পয়সা নিয়ে তোমায় কেনে

তারাই বেচে দিল পয়সার কাছে তোমায়

নতুবা বনলতার মতো কোনো এক স্বর্গীয় নারী হয়ে তুমি

জগৎ সংসারে চাঁদ হতে, মা


***************

শিবরাত্রির ফ্যাচাং  

চন্দন চক্রবর্তী 


আজ শিবরাত্রি । ভাবছি,তাতে কি ! আমিতো শিবরাত্রি করি না । ওমনি মনে হল,আরে ! ফেসবুকের কি হবে  ! কিছুতো একটা পোস্ট দিতেই হবে । ভাবতে ভাবতেই গিন্নির গলা ! ধুত্তেরিকা ! আর পারা যায় না । এক্ষণি বাজার যেতে হবে ! 

 

গিন্নি শিবরাত্রি করবেন । বাজারে গিয়ে বাবার উপকরণ,মানে বাবাকে ঠান্ডা রাখতে যা যা লাগে তাই কেনা কাটা করে শেষে বাবার দুধ,থুড়ি বাবার মাথায় ঢালার জন্য প্যাকেট দুধের দোকানে হত্তে দিয়ে পড়লাম । তাহলে বুঝুন । শিবরাত্রি মানে ঘরে বাইরে উৎচটাং ! মানে ? এইরে কিসব শব্দ আঙুলের মাথায় এসে যাচ্ছে ! আসলে মাথাটা গরম হয়ে আছে কি না !  


থাক,আবার কাজের কথায় আসি ।


দুধের গাড়ি রাস্তায় । আসতে হাফ এন আওয়ার । অগত্যা ফার্মেসিতে গেলাম মেডিসিন কিনতে । ফার্মেসি ফাঁকা দেখে প্রেসক্রিপশনটা এগিয়ে দিয়ে বসে পড়লাম । এই ফাঁকে বন্ধুদের পোস্টে লাইক কমেন্ট দিচ্ছি আর ভাবছি,আমি কি লিখি ! 


একটা স্কুল বাস পাস করছে । জানলা দিয়ে একটা বাচ্চা ওদেরই কাউকে বলছে,লুক লুক । কি লুকাবে কে জানে !


মাথায় একটা আইডিয়া এলো । বাংরেজি টাংরেজি বলার হ্যাবিট ট্যাবিটগুলোই সাবজেক্ট করব ।  শিবরাত্রির সঙ্গে ওগুলো পাঞ্চ করে পোস্ট দিলে বেশ ঝিক্কানাকা চিক্কানাকা লাগবে । যাক এবারের শব্দটা তবু বাংলা বাংলা মনে হচ্ছে ।


ফোনের ঘড়ি বলছে এক ঘন্টা কাবার করেছি । তাড়াতাড়ি গেলাম আবার দুধের দোকানে । সেই আবার হাফ এন আওয়ার !  কখন যে জিরো আওয়ার হবে ! অগত্যা আবার সেই আগের স্থানে ।


ফব খুলে আবার পোস্ট দেখছি । 


হাফ এন আওয়ার পরে আবার গেলাম । না উত্তর এবার পুরোপুরি নেগেটিভ,গাড়ি আসছে না । অগত্যা রিটার্ন করলাম । 


ভাবছি,গাড়ি হাইওয়ে বেয়ে আসতে কত বড় বড় শহর পড়েছে । সেখানে সব বড়লোকের বাস । তাদের ভক্তিটাও বড় । আমি থাকি ছোট শহরে । ছোট শহরে ছোটলোকের বাস । তাদের ভক্তিটাও ছোটই ! আজকাল ভক্তির আড়ম্বর দেখে ভগবানও চলেন কিনা !


বাড়ি এসে,আগেই যা ভেবে রেখেছিলাম,দই একশ গ্রামের মত ময়রার দোকান থেকে এনেছি,ওটাকেই জল দিয়ে ঘুটে দুধ বানিয়ে চুপ চাপ রেখে দিলাম । কাজের তালে গিন্নি খেয়াল করবে না । সবই ভোলানাথের কৃপা !


এতকিছু করে দেখি ঘড়িতে অনেক বেলা । এদিকে গিন্নি উপোস করে রান্না সামলাচ্ছে । বাড়ির কাজের যুবতী মেয়েটা ডুব দিয়ে কোন শিবের থানে জল ঢালতে গেছে,নাকি জ্যান্ত শিব খুঁজে বেড়াচ্ছে কে জানে ! কাজেই গিন্নিকে হাতে হাতে সামলে দিলাম । এই করতেই বেলা শেষ । এরপর আবার একটা ফসফট্যাং দিবা ঘুম আছে । এটা অবশ্য আমার নাকের আওয়াজ ।


বিকেলে চা খেয়ে মন্দিরে যাবার আয়োজন । । রেডি হয়ে বেরোতেই সন্ধ্যা লেগে গেল ।


মন্দিরে লম্বা লাইন । জল ঢেলে গিন্নি বেরিয়ে এলো আড়াই ঘণ্টা পরে । মনে ভাবি বাবার আবার সর্দি না লাগে ! নেহাত কৈলাসের ঠান্ডায় বাবার বিচরণ ! 


গিন্নি বেরিয়ে এসেই বলল,এই জানো দুধটা না কেটে গ্যাছে ! তাই'ই বাবার মাথায় ঢেলে এলাম । কি করব ! যা ভিড় । মনটা ক্ষুত ক্ষুত করছে। 


আমি নির্বিকার । সবই বাবার ইচ্ছা । মনে মনে বললাম,বাবা দোষ ধ'র না । কি করব বল ? তোমার ডটার,থুড়ি তোমার মেয়ে ধনলক্ষ্মী,কোনোদিন আমার দিকে ভালো করে তাকালেন না,নইলে চারগুন দামে বাজারে জল মেশানো দুধ পাওয়া যাচ্ছিল । কিন্তু পকেট তখন গড়ের মাঠ ।


এতক্ষনে বাড়ি এসে ফব খুলে বসলাম । বসলাম মানে,ঢলে পড়লাম,বা টলে পড়লাম বলা চলে । একটার পর একটা সুন্দরী আসছে আর আমি টলেটলে পড়ছি । খালি গার্ল ফ্রেন্ডদের শিবরাত্রি পালনের ছবি । কে কোন মন্দিরে গিয়ে জল ঢেলে এসেছে,তার ছবি । আবার কেউ বাবার ছবির পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছে,তার ছবি । তাছাড়া গৌরী গৌরী সেলফিতো আছেই । আহা মনটা জুড়িয়ে উল্কিঝুলকি করছে । ওই আবার কি একটা বেরল । 


হ্যা যা বলছিলাম,এখানে শুধু লাইক দিয়ে ছাড়া যায় ! মিষ্টি মিষ্টি মুখগুলোতে একটা কমেন্ট দেব না ! আমি কি এতটাই মিটকিলে । ওই আবার  ! আসলে এখানে দেখছি বারবার মনের ভাব বদল হচ্ছে,আর তখনই এগুলো লেখা হয়ে যাচ্ছে ! যাকগে যা বলছিলাম । অতএব কমেন্টও দিতে লাগলাম । 


কিন্তু মুশকিল হল বাবার বেলায় । স্রেফ এড়িয়ে যেতে পারতাম । কিন্তু বাপরে ! হাতে যা একখানা ত্রিশূল ! আর ধারও খুব ।  অতএব জয় ভোলানাথ টাইপ করে কপি পেস্ট দিয়ে সমস্যা মেটাতে লাগলাম । তাতে কিছুটা হলেও স্বস্তি । কিন্তু একটু ভয়ও করছে । বাবা হলেন অন্তর্যামী । এই অবহেলা কি ভাবে নেবেন,কে জানে ! বেশি সময় পেলাম না । রাতের খাওয়ার সময় হল । 


রাতেও নিরামিষ । ওবেলার রাঁধা খিচুড়ি খেয়ে শুয়ে পড়েছি । ঘুম আসছে না । একটু যেন অম্বল,অম্বল ভাব । নতুন গরম পড়েছে । খুব খারাপ ওয়েদার । এই ঠান্ডা,এই গরম । কম্বলটা গায়ে রাখা যাচ্ছে না । শেষ রাতে শীত করবে সে ভয়ও আছে । তাই সকালের যে জামাটা পড়ে বাজারে গিয়েছিলাম,গিন্নিকে আর অর্ডার করলাম না,আমি কানা মানুষ,ওটাই গায়ে চাপিয়ে ফ্যানটা ছোট করে চালিয়ে রাখলাম । পরে শোয়ার আগে ফ্যানটা অফ করে দেব । 


এখন বেশির ভাগ পোস্টে ভোলানাথ আসছেন । অগত্যা আবার সেই একটা পোস্টে জয় ভোলানাথ লিখে সেটাকে কপি করে,অন্যগুলোতে পেস্ট করা চলতে লাগলো ।


চোখটা বুঝি কখন লেগেছিল ! মনে হয় ডান দিকে পাশ ফিরে শুয়েছিলাম । চিত হয়ে শুতেই হঠাৎ পশ্চাৎ দেশে একটা খোঁচা ! বা দিকে পাশ ফিরলাম । এবার বাদিকেও হার্টে ওপর মোক্ষম একটা পাঞ্চ ! এরপরে আর ঘুম টেকে ! উঠে বসলাম । চোখ খুলে আমার আত্মারাম খাঁচা ! 


সয়ং দেবাদিদেব সামনে দাঁড়িয়ে !  


প্রনাম করে বললাম,বাবা খোঁচা দুটো কি জোরেই না দিলেন ! কাল বাজারে যেতে প্যান্ট গলালেই পাশ্চাৎ দেশে বড্ড জ্বলবে । আর বুকটাও ইক্কাইক্কা করছে । এইরে আবার কি একটা বেরল ! যাকগে যা ভাবছি,সকালে উঠেই বুকে নির্ঘাত ব্যাথা উঠবে  ! আজকে পুরো দিনটি আমার গৌরী আপনার জন্য ইনভেস্ট করেছেন । দুবেলা নিরামিষ খেতে হল । আপনার জন্যই না দিনটা পুরো ড্রাই গেল ! এখন যদি বুকে ব্যথা হয়,তবে কালকেও গৌরীকে বুক নিতে পারবো না । ডোন্ট মাইন্ড বাবা,আমার কসুর কি হল,জানতে পারি ?


বাবা বেশ রেগে,যা বললেন,এই একপাতা দুপাতা লিখতে,কি সব আগডুম বাগডুম লিখেছিস ! নিজের মাতৃভাষায় লেখার ক্ষমতা নেই তোর !  আবার ইংলিশে কমেন্ট লিখলি,কনগ্রাচুলেসন,নাইস,বিউটিফুল ! তোদের জ্বালায় আমাদেরও ভাষাটা চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে । সঙ্গে সঙ্গে আপডেট দিতে হচ্ছে । নইলে তোরাই আবার ব্যাক ডেটেড বলবি । তাছাড়া নতুন কিছু সংযোজন করলি দেখলাম । ওগুলোর মানে কি ! এইভাবে ভাষার পিন্ডি চটকাচ্ছিস যে !


আর তোদের ভক্তি ? নিজের মা বাবাকে করিস না,সেখানে আমরা । আগে একটু ভয় করতিস,তাই ভক্তিটা ছিল । এখন খালি বিপদে পড়লে যা ব্যা ব্যা করিস ।


ভাবছি আরো অনেক কসুরতো করেছি । বাবার পোস্টে স্রেফ জয় ভোলানাথ পেস্ট করেছি । এখন চেপে ধরলে আর রক্ষে নেই ।   


শোন । বাবা আবার শুরু করলেন । গৌরীকে মানে তোর বউকে মিথ্যা বলে আমার মাথায় যে দই ঢাললি ! কি করব বাবা,দুধ পেলাম না যে !  


হঠাৎ বাবার মুখটা কেমন নরম হল !


তা ভালোই করেছিস । ওই প্যাকেটের দুধের স্বাদ আছে না কি ! তার থেকে,ভাগ্গিস মিষ্টির দোকানের দইটা এনেছিলি । দইটাতে ভেজাল ছিল,কিন্তু স্বাদ ভালো । তা একটু চিনি মিশিয়ে দিলে পারতিস !  


না বাবা ওটা আপনার ভালোর জন্য । চিনি মেশালে সুগারের ভয় ! 


কি বললি ! সুগার ? জানিস আমি কৈলাশে থাকি,ওখানে সুগার ? আমার কোন রোগভোগ দেখেছিস ? আমাদের ডাক্তার আছে ? 

 

সত্যি বাবা,এটা ঠিক । আপনাদের ডাক্তার লাগে না । এত নেশা ভাঙ করেন,তবুও আপনার বডিটা হেবি ! তাই না মর্ত্যের মেয়ে বৌ'রা নিজেকে গৌরী মেনে আপনার জন্য হামলে পরে ! আমার বৌটাতো বাবা ভোলানাথ বলতে অজ্ঞান । 


কথা ঘোরাস না । ওই যে বললি নেশা করি ? চারিদিকে বরফ ঠান্ডা । নেশা না করলে ওখানে থাকতে পারতাম ! তোরাতো এই গরমের দেশেও ড্রিংক করে ঢলাঢলি টলাটলি কত কি করিস । আসার সময় দেখে এলাম আজকে আমার দিনে একদল ডিজে চালিয়ে টুম্পা নাচ্ছে !

 

ওসব দেখবেন না বাবা । ওদের কথা ছাড়ুন ! ওরা কিছুই মানে না,কাউকে জানে না । জানতেও চায় না । আচ্ছা বাবা একটা কথা বলব ?  আমি যদি আপনার সঙ্গে যাই আমাকে নেবেন ? জিনিসের যা দাম বাড়ছে, মাথাটা এই বয়সেই প্রায় ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে বাবা । এইভাবে চললে আর দুচার বছরে যে হার্ট এটাকে টেসে যাবো,সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত । 


বাবা কথাটা শুনেই ছিটকে উঠলেন । 


একদম নয় । তুইকি একা ? আমার ভক্ত সবাই । সবাই তোরা ওখানে গেলে কৈলাশের পিন্ডি চটকে ফ্লাটে ফ্লাটে ছয়লাপ করে ওর চূড়াটা নির্ঘাত ফ্লাট করে ছাড়বি । তারপর আছে প্রমোটারের ভয় । শেষে আমার সাধনার জায়গাটায় ওরা প্রধান কার্যালয় না বানিয়ে ফেলে !


হঠাৎ বাবা নেই ! বুকটা ধড়াস করে উঠল । না আর কোন সাড়া মিলছে না ! মনে হয় ওই যে আমাকে সঙ্গে নেওয়ার কথাটা বলেছি,শুনেই ভয় পেয়েছেন ।  এদিকে গলা শুকিয়ে কাঠ । উঠে আলো জ্বাললাম । 


বুকে হাত দিয়ে ম্যাসেজ করতে যেতেই,চমকে উঠলাম । জামার বাদিকের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দশটাকার সাতটা কয়েন টেনে বের করলাম  ! বাজার করতে কখন ভুল করে বুক পকেটে টাকাটা রেখেছি । ভাগ্গিস তখন মনে পড়ে নি ! নইলে ওটা জল মেশানো দুধ কিনতেই ফিনিশ হো'ত ।  


ঢক ঢক করে গলায় জল ঢেলে কি মনে হল, বিছানায় তাকিয়ে দেখি আমি যেখানে শুই ঠিক মাঝখানে চশমাটা রয়েছে । ওটার একটা ডান্ডা আগেই গ্যাছে । তার দিয়ে অপারেশন চালিয়ে ওকে সুস্থ করেছি । তাতে চোখের ওপরে একটু বাঁকা হয়ে ঝোলে । আহা তা হোক । কতদিনের সম্পর্ক ! খোঁচার কারণটা বুঝলাম । পশ্চাৎদেশের চাপে ওটা যে এখনও সুস্থ আছে,তাই যথেষ্ট । বাপরে থেবড়ে যে যায় নি ! সব বাবার মহিমা ! 


ভোলানাথকে বললাম,জয় বাবা তোমার কৃপায় তোমার মতই এই আত্মভোলা আজকে চশমার খরচ থেকে অব্যাহতি পেল ।  সত্তর টাকা রোজগারও হল । সবই তোমার মহিমা বাবা । এইভাবেই চিরকাল এই অধম ভোলাকে দেখো বাবা ।


আলো নেভাতেই,জানলার পর্দার ফাঁক গলে ভোরের আলো উঁকি মারছে । আর শুয়ে কাজ নেই । আবার আলো জ্বাললাম । তাড়াতাড়ি লেখাটা পড়ে দেখলাম শেষের দিকটা বেশ বাংলা বাংলা হয়েছে । বাবার নাম করে এটাই মুখানুরূপ বইতে ছেপে দিলাম । 


মুখানুরূপ বই মানে,ফেসবুকের বঙ্গানুবাদ আপসে আঙ্গুল থেকে বেরিয়ে এলো । জয় বাবা সবই তোমার কৃপা ।


লেখাটা কিন্তু শেষ হলো আগামী কাল সকালে,আর পোস্ট হয়ে গেল আজকে ভোরে,বেশ মজার তাই না । ফ্যাচাং তো সেটাই ।

***************

স্মৃতি হয়ে আছ

জয়া চক্রবর্তী সোমা 


বিরহ আর গানের একটা অদ্ভুত যোগ আছে জানেন। কোন কিছু হারানোর মুহুর্তে গানই আমাদের সঙ্গী হয়ে ওঠে। রীনাকে হারানোর পর থেকে আমিও তো এই গানকে আঁকড়েই আছি। দিন রাত গান শুনি। আগে কম্পিউটারে চালিয়ে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকতাম৷ কিন্তু গানের শব্দ বাড়ির অন্যলোকেদের অসুবিধার সৃষ্টি করে। বিশেষত আমার ঠাকুমার বয়স হয়েছে। তার শব্দে অস্বস্তি হয়। তাছাড়া আমার একার যন্ত্রণা তো আমার একারই। তার ভাগীদার অন্য কেউ নয়। তাই এই গানও আমার একার। সেই জন্যই এখন আমি হেডফোন লাগিয়ে গান শুনি। রীনাও গান খুব ভালোবাসত জানেন। ও নিজেও গান গাইত৷ আমাদের জীবনের সুখের মুহুর্তগুলো কত গানের সুরে সুরে বাঁধা আছে । সেই গানগুলোই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চালাই মোবাইলে। এক এক দিন রাতে মাঝ রাত পেরিয়ে যায়। আমার বালিশ ভিজে যায় চোখের জলে। চোখে ঘুম নামে না। গানই তখন আমার সঙ্গী হয়ে রাত জাগে আমার সঙ্গে। আবার কোন কোন দিন গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়েও পরি। মোবাইলের চার্জ শেষ হলে মোবাইল বন্ধ হয়ে যায় নিজে থেকে। 

গান আর আমি পরস্পরকে জড়িয়ে এভাবেই কাটছিল আমাদের জীবন। বাড়ি থেকে বিশেষ বেরোতাম না। বন্ধুদের সাথেও যোগাযোগ ছিল না বিশেষ। কোথায়ই বা যাব। সব জায়গায় মুঠো মুঠো রীনার স্মৃতি। আর বন্ধুদের সাথে দেখা হলেই হয় রীনার মৃত্যুর কথা জানতে চায়, নয় সহানুভূতি দেখায়। ভালো লাগে না। কিচ্ছু ভালো লাগে না। 

সেদিন রাতেও নতুন কেনা হেডফোনটা কানে গুঁজে মোবাইলে রীনা আর আমার পছন্দের গান চালিয়ে ঘর অন্ধকার করে শুয়েছিলাম। একটু তন্দ্রা এসেছিল বোধহয়। হঠাৎ মনে হল কানের কাছে রীনা ফিসফিসে স্বরে ডাকল-" তন্ময়"। দারুণ চমকে ঘুম ভেঙে গেল আমার। ধড়মড় করে উঠে বসলাম। দেখলাম আমার অজ্ঞাতেই মোবাইল কখন বন্ধ হয়ে গেছে। খুব অবাক লাগল আমার। আমি কী তবে ঘুমিয়ে পরেছিলাম? স্বপ্ন দেখলাম? রীনার গলার স্বর যেন তখনও আমার কানে লেগে আছে। 

দু'একদিন পর আর একদিন আমি দুপুরবেলা গান শুনছিলাম। আমার প্লে লিস্টে পছন্দের গানগুলো একের পর এক বাজতে থাকে। আমি চোখ বুজে শুনছিলাম। দুটো গানের পর একটা গান শেষ হল। আমার কেমন একটা অনভ্যস্ত অস্বস্তি হচ্ছিল। কী কারণে সেটা বুঝতে পারছিলাম না৷ হঠাৎ মনে হল এক্ষুনি যে গানটা শেষ হল সেটা তো মেইল ভয়েসেই ছিল। কিন্তু একটু আগে সেটা ফেমেইল ভয়েসে বাজলো কি করে। দ্রুত পিছিয়ে গিয়ে আবার চালু করলাম গানটা। না,  মেইল ভয়েসই তো। কিন্তু আমি স্পষ্ট ফিমেইল ভয়েসে শুনেছি। হঠাৎ আমার কেমন মেরুদন্ড বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে আসে। গলার স্বরটা আমার খুব চেনা ছিল। রীনার গলা। আমার জন্মদিনে এই গানটাই তো ও গেয়েছিল। তীব্র অস্বস্তিতে খুলে ফেললাম হেডফোন। সেদিন বিকেলে বহু মাস পরে ফ্ল্যাটের ছাদে গিয়ে দাঁড়ালাম। এই ছাদে কত সময় রীনা আর আমি এসে গল্প করতাম। ওই আলসের কাছে ঠেস দিয়ে বিশেষ ভঙ্গীতে দাঁড়াত রীনা। ভাবতেই চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। কিন্তু অবাক হলাম এত দিনের মধ্যে প্রথম আমার স্মৃতিকে পিঠ দেখিয়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করল না। বরং এগিয়ে গেলাম আলসের ধারে। হাত রাখলাম রীনার প্রিয় জায়গাটায়। রাতে কিছু খেতে ইচ্ছে করছিল না। প্রায় দিনই করে না। নেহাত মা কষ্ট পাবে বলে খাই। আজও তাই খেয়ে শুতে এলাম। আজ একটা অন্য গান চালালাম। এটাও স্যাড সং। কিন্তু আমাদের স্মৃতি বিজড়িত নয়৷ গানটা শুনতে শুনতে আমাদের ফেলে আসা দিনগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। মনে মনে বললাম-" ফিরে এসো রীনা। তোমাকে ছাড়া আমি অসহায়, আমার সবটুকু ভালোবাসা তোমায় ঘিরে।" হঠাৎ মনে হল গানের শব্দটা আস্তে হয়ে হেডফোনের মধ্যে দিয়ে কে যেন বলে উঠল-" আছি তো।" না আজ আমি একটুও তন্দ্রায় ছিলাম না। স্পষ্ট শুনেছি আমি। এতটুকু ভুল নেই। আমি ছিটকে উঠে দাঁড়িয়ে হেডফোনটা কান থেকে খুলে ফেললাম। মোবাইলের সঙ্গে হেডফোন কানেক্ট করা। তাই  গানটা বাজছে শব্দহীন। আমি গান বন্ধ করে দিলাম৷ সারা রাত ঘুমাতে পারলাম না। ছটফট করতে লাগলাম। রীনা কি আমার সাথে যোগাযোগ করতে চাইছে? আমি ভয়ানক আশ্চর্য হলাম যখন হঠাৎ অনুভব করলাম আমি কিন্তু আনন্দিত নই। বরং একটা শীত শীত ভয় আমাকে গ্রাস করছে। আমিই তো চেয়েছিলাম রীনা আমার কাছে ফিরে আসুক। তবে রীনা যদি আমার সাথে যোগাযোগ করতে চায় তাহলে আমার এত অস্বস্তি হচ্ছে কেন? হঠাৎ ভীষণ কান্না পেল আমার। চোখের কোল বেয়ে উষ্ণ জল গড়িয়ে পরা কান্না নয়। হা হা কার করে কান্না। এমন কান্না যা শ্মশানে শব দাহ করার পর মানুষ কাঁদে তেমন। পরের দু'একদিন গান শুনলাম না। যতবারই মোবাইল হাতে নিয়েছি কি এক অস্বস্তিতে রেখে দিয়েছি। ভিতরে একটা অদ্ভুত অপরাধ বোধ হয় আমার। রীনা কি আমার জন্য অপেক্ষা করছে? আমি কি এড়িয়ে যাচ্ছি। রীনার মৃত্যুর সময় আমি ওর চিতার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলাম -" কথা দিয়ে কথা রাখলে না। হাত ধরে থাকবে বলেও ছেড়ে গেলে।" কিন্তু আজ মনে হল রীনা নয় আমিই কি হাত ছাড়িয়ে নিচ্ছি না। সেদিন রাতে কাঁপা কাঁপা হাতে তুলে নিলাম মোবাইল। হেডফোনটা কানে গুঁজলাম। গান চালালাম। আমার সব ইন্দ্রিয় অতি মাত্রায় সজাগ। গানের একটা বর্ণও আমার কানে প্রবেশ করছে না। একটা তীব্র অপেক্ষা আমায় পাগল করে দিচ্ছে। তিন নম্বর গানটা থামল। কিন্তু আশ্চর্য ভাবে চতুর্থ গান শুরু হল না। অখন্ড নীরবতার কয়েকটা মুহুর্ত। আমার রগের শিরা দপদপ করছে। ঘাড়ে ব্যথা অনুভব হচ্ছে৷ এসির মধ্যেও আমি ঘামছি। তারপরেই আমার ভিতরের সমস্ত স্নায়ুকে নাড়িয়ে দিয়ে ভেসে এল তার গলা-" তন্ময় আছো?" আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। বহু দূর, বহু বহু দূর থেকে ভেসে আসা কন্ঠস্বর এ জগতের নয়। রীনাকে আমি চেয়েছিলাম ফিরে পেতে। কিন্তু রক্তমাংসে যেমন সে ছিল তেমন করে। এমন করে তো নয়। এই আসা যে আমি সহ্য করতে পারছি না। আতঙ্কে বিছানা থেকে নেমে দরজার কাছে সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি। মোবাইল থেকে কখন খুলে গেছে হেডফোন জানি না। তবু তার মধ্যে মৃদু গুঞ্জন। "তন্ময় আছ?" আতঙ্কিত চোখে সেটার দিকে তাকিয়ে আমি বিড়বিড় করে বলে চলেছি-" না নেই নেই আমি নেই। ফিরে যাও রীনা ফিরে যাও তুমি। ফিরে যাও প্লিজ।" 

এখন আমি আর পাঁচটা স্বাভাবিক মানুষের মত বেঁচে আছি। শোক বুকে আগলেই আছি। কিন্তু আছি। রীনার না থাকাটা মেনে নিয়েই আছি। ঘরবন্দী থাকি না আর। বন্ধুদের সাথে মিশি। হাসতে পারিনা আগের মত। তবে ওদের হাসি গল্প শুনি। রাতে মা বাবার সাথে খাবার টেবিলে একসাথে খাই। গান শুনি তবে কশ্চিৎকদাচিত। সেটাও লো ভয়েলুমে কম্পিউটারে চালিয়ে। হেডফোনটা আর কানে দিইনি। ফেলতেও পারিনি। রেখে দিয়েছি রীনার দেওয়া ছবি উপহারগুলোর সাথে। থাক ওটাও স্মৃতি হয়ে।

*************

একুশে  বাংলা 

শরণ্যা চক্রবর্ত্তী ( বয়স- 12 বছর)



     একুশ মানে বাংলা ভাষার জয়।

বাংলা ভাষা  রক্তাক্ত  এই একুশেই,

শান্তিময়  মিছিলে  উড়ছিল  কত পাখি,

হঠাৎ  চালালো  গুলি  কয়েকটি  পুলিশ  শিকারী!

আকাশ  উঠলো  কেঁপে,

সব পাখিরা উঠলো  খেপে।

আকাশের মিছিল  নামল  মাটিতে!

বাংলা দেশের সবাই নামল যুদ্ধে।

বাংলা  তাদের মা,

কিছুতেই নিজের মাকে করবে না দেশ ছাড়া।

মার কথা থাকবে মুখে, থাকবে না অন্য  কোনো  ভাষা।

শেষে  তারা মানল হার,হল বাংলার  জয়।

একুশে তাই  বাংলাকে বার বার সেলাম করা হয়।

এ দিনের ভাষা দিবস নামে পরিচয়।

***************

লাল তিলের অন্ধকার

সুব্রত হালদার


রাজশ্রী, 

একটু একটু করে পলাশরাঙ্গা দিনটা ক্রমশ ফিকে হয়ে আসে... 

ধূসর সোনালী আলো আমের মুকুল ছুঁয়ে ঝরে পড়ে বুনো ঘাসে... 

কিছু স্মৃতি ,কিছু বিস্মৃতি ভিড় করে আসে মনকেমনের  খাতায়...

ক্লান্ত কোকিল বসেছে জামের ডালে,এক ঝাঁক বন টিয়া উড়ে গেল  দিগন্ত রেখায়...  

গোধূলির এই কনে দেখা আলোয় আবারো তোমার দিকে  ফিরে তাকালাম ...

ঠিক তখনই এগোতে গিয়েই তোমার চিবুকের লাল তিলের অন্ধকারে পথ হারালাম ...


রাজশ্রী ,এই অন্ধকার বড় তুমিময়... 

টুকরো টুকরো আবেগের কোলাজ বাতাবি ফুলের মত তোমার নরম কোমল ঘ্রানে ভিজে ভিজে যায়...

আমি হাঁটছি চড়াই উৎরাই তোমার পায়ে পায়ে... 

তোমার ঐশ্বর্য নগরী, তোমার শ্যামল অরণ্য, তোমার উদাসী প্রান্তর ছুঁয়ে ছুঁয়ে ...

তারপর অজস্র ভুলভুলাইয়া পেরিয়ে অদ্ভুত এক নৈঃশব্দের ওপারে তারার আলোয় ভিজতে ভিজতে দেখি...

কেউ কোথাও নেই - 

শুধু তুমি আর আমি মুখোমুখি... 


হলুদ কলকে ফুলের মত ঝরে পড়ছে নক্ষত্ররা... 

অলৌকিক কুয়াশায় ঘিরেছে চারপাশ.... 


ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলে, "কি চাও তুমি? "


বাতাসে বেজে উঠল আশ্চর্য এক স্বর্গীয় সিম্ফোনি...


সম্মোহিতের মত আমি বললাম, "অনুরাগের অন্তরালে তোমার অনুচ্চারিত অভিমানটুকু  !".


তুমি বললে, " শুধুই অভিমান ? আর কিছু  না?"


গলনাংক থেকে শুক্লা চতুর্দশীর চাঁদ গলে গলে পড়ে ..

দিগন্ত থেকে  অলৌকিক রূপকথা করে আসে ভিড় ...


রাজশ্রী ,অভিমান বলে দেয়  ভালোবাসা কতটা গভীর... 

কিচ্ছু চাই না আর.. 

আর যদি পারো দিও সম্মোহনে মোড়া তোমার চিবুকের  লাল তিলের নিবিড় অন্ধকার 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ