দর্পণ || সাপ্তাহিক সেরা গল্প গুচ্ছ




পোস্ট বার দেখা হয়েছে

ভাড়াটে মা 

নভশ্রী 


বিয়ের আগেই বেশ কিছুকাল থেকে মাসের ওই কটা দিন খুব সমস্যায় ফেলতো পৃথাকে।

নিউইয়র্কের মতো জায়গায় থেকেও পৃথা কেন যে এভাবে অবহেলা করেছে বিষয়টাকে কোনো ডঃ কনসাল্ট না করে, এটাই আশ্চর্য।

আসলে আদতে মনে প্রাণে বাঙালী সাধারণ মেয়ের মতোই যাচ্ছি,যাবো করতে করতে ওই সময়টা পেরিয়ে গেলেই আবার ওখানকার অতিব্যস্ত জীবনে মিশে গিয়ে হারিয়ে যেতো ডঃ কনসাল্টেশনের ভাবনা।


বিয়ের সময় পৃথা-অরণি দুজনেই  এসেছিলো খুব অল্প সময় নিয়ে।

তাই এবার একটু বেশি সময়ের ছুটির ব্যবস্থা করেই দুটিতে প্রচুর প্ল্যান-প্রোগ্রাম নিয়ে কলকাতায় এসেছে কখনো দুই পরিবারের সবাইকে নিয়ে, কখনো বন্ধু-বান্ধব নিয়ে, কখনো একান্তে দুজনে কোথাও ...শুধু আনন্দ,খুশী,মজার হুল্লোড়ে মেতে থাকার জন্য।

কিন্তু ওই যে....কথাতেই আছে, "MAN PROPOSES, GOD DISPOSES."

একদিন হঠাৎই প্রচণ্ড পেটে যন্ত্রণা শুরু হয় পৃথার। পরিস্থিতি এতটাই মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছোয় যে ওকে হসপিটালাইজ্ড করতে হয়। 

ইউ.এস.জি. তে দেখা যায়

ইউট্রাসে কিছু সিস্ট ও বিপজ্জনক অবস্থায় একটি বেশ বড় টিউমার। ইমিডিয়েট অপারেশন প্রয়োজন।

অপারেশনে ডঃ-দের বহু চেষ্টা স্বত্বেও ইউট্রাস রাখা গেলো না পৃথার। অরণির কনসেন্ট চাইলে ও নির্দ্বিধায় সম্মতিসাক্ষর দিয়ে দেয়। পৃথার জীবনের মূল্য অরণির কাছে সর্বাধিক। 


শারীরিকভাবে সুস্থ হয়ে উঠলেও মানসিকভাবে উত্তরোত্তর বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে থাকে প্রাণবন্ত হাসিখুশী মেয়েটা। আর কোনোদিন ও conceive করতে পারবে না, এই ভাবনাটা ওকে ভেতরে ভেতরে দগ্ধাতে থাকে অহর্নিশ।

সন্তানধারণে ব্যর্থ পৃথা নিজেকে অপরাধী করে ক্রমশ ডিপ্রেশনে।

ওর মন ভালো করতে অ্যাডপ্টেশনের কথাও বলেছিলো অরণি। কিন্তু, পৃথা রাজি হয়নি।

মা-বাবা বলে ডাকলেও তার মধ্যে তো 

পৃথা-অরণি কারুর-ই তো জিন থাকবে না, তার শিরায় শিরায় বইবে না ওদের একজনেরও রক্ত...!!

পৃথার সবসময় মনে হবে বাচ্চাটার মা-বাবা ওরা নয়,অন্য কেউ। মায়া-মমত্ববোধ জন্মালেও,সন্তানস্নেহ-ভালোবাসা কখনোই দিতে পারবে না মন থেকে বাচ্চাটাকে।

সেটা তো বাচ্চাটার সাথেও প্রতারণা। পৃথা তা কখনোই পারবে না।

বহুভাবে বুঝিয়েও ব্যর্থ,ক্লান্ত অরণি যখন পৃথাকে নিয়ে দিশেহারা,  তখন ওর বন্ধু নিলয় ওকে আই ভি এফ স্যারোগেসির কথা বলে। 

ওদের বুকে জেগে ওঠে ক্ষীণ আশার আলো।

তাই তো, এদিকটা তো ভেবে দেখেনি ওরা!

এমন নয় যে অজানা বিষয়, তবু মনে হয়নি।

শুরু হয় ডাক্তারের কাছে যাতায়াত।

দুজনেরই নানানরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আসে স্যারোগেট মাদারের পর্ব। 

বিভিন্ন সূত্রে নিলয়ের সাহায্যেই কয়েকজন স্যারোগেট মাদারের খোঁজ পেলেও সমস্ত দায়িত্বগ্রহণ এবং অতিরিক্ত অর্থের বিনিময়েও কেউই বিদেশে যেতে রাজি নয়।


যদিও নিজের শরীরে পৃথা সন্তানকে লালন করতে পারবে না, তবুও ওর আর অরণির অংশ থেকেই তো জন্ম হবে তার।

এও কি কম ?!

অজান্তেই পৃথা খুব গোপনে ছোট্ট এক জীবনের স্বপ্নে মশগুল হতে শুরু করেছিলো।

কিন্তু,.... আবার নিরাশার মেঘ ভিড়তে শুরু করে দুটি কাঙাল বুকেই।

এদিকে ওদের ভিসা ফুরিয়ে আসছে দুজনেরই ছুটির সাথে। 


যখন সব আশা নিঃশেষ, তখনই ঈশ্বরের আশীর্বাদস্বরূপ একজনের সন্ধান মেলে, যিনি পুরো ব্যাপারটাতে সম্মত।


ভদ্রমহিলাকে ডঃ নিলাদ্রীর ক্লিনিকে আসতে বলা হয়,ওরাও যাচ্ছে।

ফোনে কথা হলেও সাক্ষাত পরিচয়টাও  প্রয়োজন। যেখানে উনি যাচ্ছেন ওদের সাথে।


ক্লিনিকে অপেক্ষারতা অনেকের মাঝে আপাদমস্তক বোরখা আর হেজাবে ঢাকা শুধুমাত্র দৃশ্যমান দুটি কাজলকালো চোখ মুহূর্তে কেমন দুলিয়ে দিলো অরণিকে।

বারংবার অবাধ্য দৃষ্টি এক অমোঘ আকর্ষণে মিলিত হচ্ছিলো ওই চোখে।

আশ্চর্য!!  যতবার অরণি তাকিয়েছে,ততবারই দেখেছে  চোখদুটিও ওকেই দেখছে...চোখে চোখ পড়াতে চকিতে সরিয়ে নিচ্ছে দৃষ্টি।

তবে কি সেই .....!!!

অনেকগুলো দিন জীর্ণ পাতার মতো ঝরে গেলেও ওই ভ্রমর চোখের দৃষ্টি কিকরে ভুলবে সে?! 

ভেতরে সুনামির আলোড়ন নিয়ে নিশ্চুপ বসে ভেতরে ডাকের অপেক্ষা করতে লাগলো অরণি। 


মেহেরুন্নিসা কেমন একদৃষ্টে দেখছিলো পৃথাকেও। কী যেন খুঁজছিলো ওর মুখে।

সবরকম ফর্মালিটিস,কথা-বার্তা শেষে চেম্বারের বাইরে এসে মেহেরুন্নিসা জিজ্ঞাসা করে, "আপনি কি পাঠভবনের 84এর ব্যাচ?"

অবাক পৃথা সম্মতি জানালে বলে, 

"আপনি মানে তুই পৃথা তো!"

"হ্যাঁ" বলতেই জড়িয়ে ধরে বিস্ময়বিহ্বল পৃথাকে। 

তারপর, হাসিকান্না মিশিয়ে বলে, "এই তোর বন্ধুত্ব!! চিনতেই পারলি না আমায!!"

মুখের ঢাকনা,হেজাব সরিয়ে নিয়ে বলে, দেখতো এবার চিনতে পারছিস কিনা?

খানিকক্ষণ তাকিয়ে পৃথা  চেঁচিয়ে ওঠে, "শবনম, তুই... !!!কোথায় হারিয়েছিলি রে? তোর ঠিকানা খুঁজেছি কত...পাইনি।"

পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে হারিয়ে পাওয়া এককালের দুই অভিন্নহৃদয় বন্ধু।

পাশে দাঁড়ানো অরণির অস্তিত্ব ওরা ভুলে গেছে বেমালুম। 


অরণির বুকেও থমকেছে সময়।

ওই চোখ এতকাল পরেও ওর চিনতে ভুল হয়নি। ওতেই যে হারিয়েছিলো নিজেকে।

কত ফেরারী স্মৃতি ভিড়ছে মনে।

বহু কষ্টে সময়ের পলল মৃত্তিকায় ঢেকে যাদের আড়াল চেয়েছিলো মন।


কেন যে শবনম হঠাৎ নিজেকে অরণির থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিলো সেদিন ....!!

নিয়তির বিচিত্র খেয়ালে সেই শবনমই আজ ওদের সন্তানধারনের জন্য স্যারোগেট মাদার হতে ওর সামনে!!

আবার পৃথা-শবনম বন্ধু ছিলো!!

অরণির ভেতর এই বিচিত্র যোগ-বিয়োগের অনুভবে তোলপাড়। 


শবনম ভাবতেও পারেনি অরণি-পৃথার সাথে এভাবে দেখা হবে, তদুপরি ওর অরণি ওরই প্রিয় বন্ধু পৃথার স্বামী।

আল্লাহ্ রসুলের কী অদ্ভুত বিচার...

যে অরণিকে ভালোবেসে ও পরিবারত্যাগ করতে চেয়েছিলো, সেই অরণির থেকেই নিজেকে চিরদিনের মতো সরিয়ে নিয়েছিলো আব্বা-চাচাজানের ভয়ে।

নইলে ওরা অরণিকে জানে মেরে দিতো।

এতকাল পর আল্লাহ্ ওকেই পাঠালো অরণি-পৃথার সন্তানধারণের জন্য!!!

ও-ও তো পারতো আজ অরণির সন্তানের সত্যিকারের মা হতে, স্যারোগেট মাদার হওয়ার পরিবর্তে!

আল্লা তালাহ্-র যেমন মর্জি।

ও জানে, কতটা ক্ষতবিক্ষত হয়েছে ওর জন্য অরণি।

নিজের যন্ত্রণা নিয়ে ও ভাবে না।

যন্ত্রনাও অভ্যাস হয়ে যায় একসময়।

তাছাড়া, যেভাবেই হোক অরণির সন্তানধারণের সাথে ওর জন্য কিছু করার সুযোগটুকু তো পেলো ও। হারিয়ে পাওয়া বন্ধু পৃথার জন্যও ...

আল্লা মেহেরবান।


অরণির চাপা আশঙ্কা ছিলো, শবনম এই স্যারোগেসিতে রাজী হবে না শেষপর্যন্ত।

সব দুঃশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়ে শবনম ওদের সাথে উড়লো আকাশে।

নতুন জায়গায় সুখ-বিলাসের প্রাচুর্য থাকলেও শবনমের ভালো লাগেনা।

অরণির সাথে পূর্ব-পরিচয় পৃথার অজানা।

অরণির দৃষ্টি-মনোযোগ ওর মনের একতারে সূক্ষ কাঁপন জাগালেও দুজন দুজনকে  এড়িয়েই চলে।

পৃথা-অরণি সকালেই বেরিয়ে যায় যে যার কাজে। সন্ধ্যা পর্যন্ত শবনম একাই।

কোনো কোনো দিন ওদের নিষেধ অমান্য করেই এটা ওটা রান্না করে রাখে শবনম।

ওরা ফিরে রাগ করলেও খুব তৃপ্তিসহকারে খায় দেখে শবনমের মন ভরে যায়।

আসলে ওরা শবনমকে এই অবস্থায় সম্পূর্ণ আরামটা দিতে চায়।


একদিন অরণি ফিরে বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেলো।

কতকাল পর শবনমের গান শুনছে ও...

কী অপূর্ব গাইতো শবনম।

সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত্রির চৌকাঠে পা রেখে সময় যেন মুগ্ধ-স্তব্ধতায় শুনছে শবনমের একলা মগ্নহঙ্গীত ....

"ভ্রমর কইয়ো গিয়া...

শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে আমার অঙ্গ যায় জ্বলিয়া রে ....ভ্রমর কইয়ো গিয়া..."

ওর ভেতরের সমস্ত কান্না যেন সুর হয়ে ঝরে পড়ছে চারদিকের নৈশঃব্দের আবহ বেয়ে।

নিজের অজান্তেই কখন যেন অরণি পায়ে পায়ে এসে দাঁড়িয়েছে শবনমের ঘরের দরজায়।

ঈষৎ সরানো পর্দার ফাঁক দিয়ে শবনমের সেই পিঠ-ছাপানো ছড়ানো চুলের রাশির খানিক এসে দরজার দিকে ফেরানো মুখের একাংশ দিয়েছে ঢেকে, মুদিত চোখ আর মুখের যেটুকু দৃশ্যমান, তার দিকে চেয়ে অশ্রুরাগের সুরের আবহে মুগ্ধাবিষ্ট অরণির বুকের মধ্যে কী ভীষণ চেনা-অচেনায় মেশা এক ঝড় ওলটপালট করে দিলো ওর অতীত-বর্তমান মিলিয়ে মিশিয়ে...

নিজেকে আর পারলো না ধরে রাখতে।

নিঃশব্দে ঘরের ভেতরে শবনমের খুব কাছে এসে দাঁড়ালো ও।

আশ্চর্য ... একেবারে নিঃশব্দপদচারণাতে এসে দাঁড়ালেও, প্রায় সাথে সাথেই শবনম গান থামিয়ে চমকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালো..."তুমি!!"

অরণি মন্দ্রস্বরে ডাকলো "শবনম..."  

বুকের অতল গভীর থেকে উঠে আসা মগ্ন প্রাণের ব্যাকুলতার মতো সেই ডাক আমূল কাঁপিয়ে দিলো শবনমকে দৃশ্যতই।

নিজেকে আড়াল করতেই অরণির সামনে থেকে তাড়াতাড়ি সরতে গিয়ে পড়েই যাচ্ছিলো ও, অরণি দুহাতে আগলে সামলে নিলো ওকে।

তারপর শবনমের দুই কাঁধের উপর নিজের দুটি হাত আলতো করে রেখে ওর চোখে চোখ রাখলো ... বয়ে যেতে লাগলো একাত্মযাপনের কত বেদনা-বিধুর, মিষ্টি-মধুর স্মৃতি বিজড়িত ভালোবাসার প্রথম কুঁড়ি ফোটার অনুভবময় মিষ্টি সকাল,উজ্জ্বল দুপুর,গাঢ় বিকেল, মায়াবী গোধূলী, হঠাৎ আসা কালবৈশাখী ঝড়ের দোলায় হারিয়ে ফেলা নিজেদের বিগত সত্তা, অথৈ শ্রাবণে ভালোবাসাসিক্ত  দুটি দেহ-মনের শিহরণ, মাতাল ফাগুনের ফাগে রঙীন হয়ে ওঠা ছেলেমানুষী পাগলামি, দোলপূর্ণিমার রাতে খোয়াইয়ে জ্যোৎস্না অবগাহন, শীতের সন্ধ্যায় পরস্পরের উষ্ণতা বিনিময়, মান-অভিমান,খুনসুটি,আরোও কত কী ... 

একান্ত নিবিড় সেই স্মৃতিযাপনে দুই বিক্ষত বিরহীসত্তা নিজেদের হারিয়ে ফেলে কখন যেন নিজেদের অজান্তেই।

শবনমের যুগান্তব্যাপী তৃষিত কম্পিত অধরে কখন যেন ডুব দিয়েছিলো অরণির বহু অভিমানাহত , তাপিত ওষ্ঠ।

বহু প্রতীক্ষিত, কাঙ্খিত, বিচ্ছিন্ন, বিক্ষত হৃদয়দুটির ক্ষণিক মিলনের জন্য আজ কোন অদৃশ্য জাদুকর যেন থামিয়ে দিয়েছিলেন সময়প্রবাহকে।

সেই তিনিই যেন হঠাৎই সম্বিত ফেরান শবনমের। 

ছটফটিয়ে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেয় অরণির থেকে।

আত্মধিক্কারে মরমে মরে যায় সে।

ছি ছি! এ আমি কী করলাম! 

বান্দার কসুর মাফ করো আল্লাহ্!

চোখ ভরে ওঠে জলে শবনমের।

অরণি নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে ব্যাকুল স্বরে প্রশ্ন করে শবনমকে, "কেন তুমি সেদিন আমায় হঠাৎই দূরে সরিয়ে দিয়েছিলে, তা আজ জেনে আর কোনো লাভ নেই জানি।

তবু, এটা জানা আমার বাকী জীবনের জন্যও বড্ডো প্রয়োজন শবনম। 

আমার উপর তোমার কোনো কারণে কি কোনো বিতৃষ্ণা জন্মেছিলো? না কি অন্য কেউ এসেছিলো তোমার জীবনে? " 

উত্তরের জন্য একটু অপেক্ষা করে নিরুত্তর অধোমুখী শবনমের পানের মতো মুখখানা নিজের দুহাতের পাতায় তুলে ধরতে অরণি দেখে তার নিমীলিত দু চোখ বেয়ে নোনাজলের ধারা।

আবারও হারিয়ে ফেলে অরণি নিজেকে নিজের ফেরারী ভালোবাসার কাছে...

বুকের মধ্যে দৃঢ়ভাবে জড়িয়ে ধরে কান্নাভেজা নরম মেয়েটাকে আর শবনমও এবার অঝোরধারা কান্নায় কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকে বহুকাল পর অরণির বুকের মধ্যে মুখ লুকোনোর ক্ষণিক আশ্রয় পেয়ে ... মনে হয় আর কখনো বিচ্ছিন্ন হবে না হারিয়ে পাওয়া বিক্ষত এই মানুষদুটি।

কিন্তু, তা তো হওয়ার নয়।

বিচ্ছিন্ন যে হতেই হবে ওদের। সেই অদৃশ্য নাট্যকারের নির্দেশনায় ওদের সাংসারিক মিলন যে হওয়ার নয়।


খানিক পরে শবনম জোর করে নিজেকে সামলে হাতজোড় করে অরণিকে... 

"তুমি চলে যাও এখান থেকে।

এমন কোরো না, প্লিইইইজ।

বাচ্চাটার কথা ভেবে, পৃথার কথা ভেবে, আমাদের সবার ভালোর জন্য আর কখনো এসো না এভাবে আমার কাছে।

আমিও তো সামলেছি নিজেকে, তুমিও তো তাইই চাও বলো!

তবে, নিজেকে আর সাথে আমাকেও দুর্বল হতে দিও না।

আমি জানি, তুমি পৃথাকে খুব ভালোবাসো।

ও-ই তোমার বর্তমান।

তোমাদের আগামী আসতে চলেছে।

সুখে থেকো তোমরা।"

অরণি জিজ্ঞেস করে,

 "আর তুমি?

তোমার সুখ?

তোমার বর্তমান... আগামী?

তোমার ভালোবাসা?"


শবনম শ্রাবণী পূর্ণিমার জ্যোৎস্নাময় এক অপূর্ব হাসি ভেজা ঠোঁটে উত্তর দেয়...

আমি না থেকেও রয়ে যাবো আরও বেশি করে তোমাদের আগামীর মাঝে। 


যা জানবো শুধুই আমরা দুজন। 

আর সেই জানাটাই আমার সুখ।


যাকে ভালোবাসি, তার ভালোতে বাস করার মতো ভালোবাসায় কাণায় কাণায় পূর্ণ যে আমার ভেতরঘর।

নাহ্, আর কথা হয় না ...হয়নি ওদের মাঝে আর কখনোও।


বহতা সময় আপন নিয়মে একদিন এনে দিলো সেই বহু প্রতীক্ষিত ক্ষণ।

শবনম জন্ম দিলো ফুটফুটে এক শিশুকন্যার।

পৃথা যখন বাচ্চাটাকে শবনমের থেকে কোলে নিয়ে হাসছে, আদর করছে মশগুল হয়ে, অরণি শবনমের দিকে তাকিয়ে দেখলো, ও ভাসছে নোনাজলে।

অরণিকে দেখেই মুখ ঘোরালো।


এবার ফেরার পালা শবনমের।

বন্ধুকে ছাড়তে নারাজ পৃথা আজ যেন  বেশীই আগ্রহী শবনমের ফেরাতে।

আপনমনে হাসে শবনম।

বোঝে পৃথার ভয়ের কারণ, পাছে সন্তানের উপর শবনমের টান বাড়ে...


একদিন ব্রেকফাস্ট টেবিলে শবনমের অনুপস্থিতিতে পৃথা ওকে ডাকতে গিয়ে শূন্য ঘরে দেখে টেবিলে শবনমকে দেওয়া চেক ও 

একটি কাগজ চাপা ....

পৃথাকে লেখা শবনমের ছোট্ট লেখা...


পৃথা রে,

সামনে থেকে বিদায় নিতে হয়তো দুর্বল হয়ে পড়তাম।

তাই এমনভাবেই চলে গেলাম।

কিছু মনে করিস না।

যেতে তো হতোই আমাকে, তাই না?

এই চেকটা তোদের মেয়ের জন্য আমার উপহার-আশীর্বাদ।

খুব খুব আনন্দে আর শান্তিতে ভালো থাকিস সবাই মিলে।

                                       ---- শবনম


পায়ে পায়ে বেরিয়ে নীলাকাশে ভেজা দৃষ্টি ছড়ালো অরণি।

আজ জীবনের একমাত্র অপূর্ণতাকেও পূর্ণতা দিয়ে গেলো শবনম। তা স্বত্বেও বুকের অতলে ভুলে থাকা সেই চিনচিনে ব্যথাটা কেন নিভৃত  কষ্টটুকু জিইয়ে রাখে এমন করে ....!! 

কেন....??!!


জীবন সত্যিই বড় আশ্চর্য।

এখানে যোগ-বিয়োগের হিসেব বোঝা বড্ড কঠিন।

জানা অংকও কখন যেন ভীষণরকম অজানা সংকেতে না মেলা উত্তর উপহার দিয়ে যায় ...

যোগের সাথে বিয়োগ যেখানে অনিবার্যভাবে জড়িয়েই থাকে ওতোপ্রোতো...

*****************

ভগবান

জয়ন্ত অধিকারি


"উফ, কী বৃষ্টি! বাপরে বাপ। আজকাল কি এখানে এরকম বৃষ্টি হয়?"

ফ্যাসফ্যাসে শব্দে বৃদ্ধ গাড়িটা স্টার্ট দিয়ে বলে, "বরফ আর যখন তখন বৃষ্টি! এই চলছে গত কয়েকবছর ধরে।"

"সেটাই দেখছি। সবে পাঁচটা, কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে গভীর রাত। ধুর! আপনি সুরভী নার্সিংহোম জানেন তো? আমি ওখানেই যাব।"

"সুরভী দিদিমণির নার্সিংহোম? আপনার কারোর কিছু..."

"হাহাহাহা। না না। আমি ওনার ছেলে। অনেকবছর পরে ফিরছি। হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করছিলাম।"

"সুরভীদিদি আর অম্লানদাদার ছেলে! ওনারা তো আমাদের ভগবান। এইরকম দুর্গম জায়গাতে নার্সিংহোমটা না থাকলে সবার খুব অসুবিধে হত। তারপরে, এই বৃক্ষরোপন। আমাদের পাহাড় এখন সবুজ হয়ে গেছে। কাল সকালে দেখবেন। সাদা ন্যাড়া পাহাড়ের মাথায় এখন সবুজ রঙের মুকুট।"

মিনিট চল্লিশেক পরে আঁধারে ঘেরা রহস্যে মোড়া কুয়াশার চাদরে ঢাকা পাহাড়ি পাকদন্ডী পেরিয়ে গাড়িটা অবশেষে এসে দাঁড়ায় সুরভী নার্সিংহোমের সামনে। গাড়ি থেকে নেমেই ছোটবেলার মত চেঁচিয়ে ওঠে রৌনক - মাআআ; বাবাআআ;

রাতে আটটার সময় মা বাবার সাথে খেতে বসে রৌনক। খেতে খেতে রৌনক বলে ওঠে, "উমমমম, কতদিন পরে তোমার হাতের রান্না খাচ্ছি মা। অসাধারণ। একটা অদ্ভুত ঝিম ধরানো নেশা আছে তোমার হাতের রান্নায়। কী অদ্ভুত লাল রংটা। ঠিক যেন রক্তের মত। নিশ্চয়ই কোনও লোকাল পাহাড়ি লঙ্কা বেটে করেছ!"

"নুন, মিষ্টি, সব ঠিক আছে তো রুনু?"

"পারফেক্ট বাবা। দশে একশো দিলাম মা'কে। বেশ নোনতা আর ঝাল ঝাল টেস্ট। পাহাড়ের এই ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে।"

ফোনটা বেজে ওঠে ঝনঝন করে। সুরভী ফোনে কথা সেরে টেবিলে এসে বসে বলে, "রূপার বাচ্চাটা ইনকিউবেটরে মারা গেছে। অম্লান, কাল ওই বাচ্চাটার উদ্দেশ্যে আবার আমরা একটা গাছ লাগাবো। রৌনক, তুই ও থাকিস সকালে আমাদের সাথে। এখন হসপিটাল থেকে ঘুরে আসি। রূপা খুব কাঁদছে। আহা রে..."

সামনে চলতে থাকা টিভিতে সাংবাদিক বলে ওঠেন, "ডক্টর সুরভী মিত্র আর অম্লান মিত্রকে পাহাড়ে বৃক্ষরোপন এবং ন্যূনতম মূল্যে চিকিৎসা করার জন্য, পাহাড়ের উন্নতির জন্য - পঙ্কজশ্রী পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। দেশের রাষ্ট্রপতির..."

অম্লান আর সুরভী তাকায় পরস্পরের দিকে। দুজনের চোখটা হঠাৎ জ্বলে ওঠে। সুরভী উঠে দাঁড়িয়ে হাসিমাখা মুখে বলে,"রুনু, যে কটা দিন এখানে আছিস, তোকে এইরকম নেশা ধরানো ভাল খাবার আরও খাওয়াব। কাল দুপুরে স্পেশাল সেলিব্রেশন। মাংস রান্না করব। এরকম নরম তুলতুলে, স্বাদে একটু নোনতা মাংস - তুই আগে কখনও খাস নি।"

********************

কাগের ডিম

বগের ডিম


অনিন্দ্য সান্যাল 


এই মাস ছয়েক আগেও এইক’টা কাকের ডিম ওইক’টা বকের ডিম বলে শুরু করলে, আগে কাগেদ্দি দাও এবার বগেদ্দি... কোনোভাবে একটা বেশী বগেদ্দি চলে গেলে মুখভার, তখন বলতে হতো কালকে ভোর ভোর কাক কে বলে একটা বেশী কাগেদ্দি নিয়ে আসা হবে। সাথে সাথে বলতো, দুতো দুতো। সে কি করে হবে বলো, ওকে তো তোমার মতো আরো কতজন-কে দিতে হয়। কি ভাবতো কে জানে! মুখের দিকে তাকিয়ে বলতো, ঠিত আতে, এটতাই বোলো, হ্যাঁ?

আস্তে আস্তে পাল্টে গেলো ছেলেভোলানো গপ্পো। এখন প্রায়দিনই জুল্লু গুন্ডা, ভুসো ভূত আর সাদা হাতির ভয় দেখিয়ে ঘনশ্যামকে খাওয়াতে হয়। ওই নামগুলো শুনলে ঘনশ্যাম হাঁ ক’রে এদিক ওদিক তাকায়। তখন চোখ গোল্লা গোল্লা থাকতে থাকতে একটা করে গোল্লা মুখে পুরে দিতে হয়। ঘুম পাড়ানো, দুষ্টুমি ছাড়ানোরও ওই একই খেলা, শুধু স্বরের একটু উঁচু নীচু। ঘনশ্যামের বাবা একদিন রাত্রে কোনো এক কারণবশতঃ দূরদর্শন বাকরুদ্ধ করে এই পাত্র পরিবর্তনের কারণ সম্বন্ধে প্রশ্ন করে বসলেন,

-- এই গুন্ডা, ভূত, হাতি এরা কাকবকের জায়গায় কেন আসছে আজকাল?

-- আরে কি করবো, এখন আর কাক বক কাজ করে না। এই ক’মাসে এতো ছটফটানি এসে গেছে ওর শরীরে। সামলাতে পারি না।

-- কিন্তু, এরা এলো কি ক'রে? পেলে কোথায়?

-- তুমি কি আমাকে একদম আনতাবড়ি ভাবো? একেক করে দেখিয়ে বুঝিয়ে তৈরী করেছি। জুল্লু এই কাছাকাছিই থাকে কোথাও, সেদিন উল্টোফুটের সোনার দোকানে অ্যাকশন করছিলো, দূর্দান্ত তেজ, দোকানের মালিককে কলার ধ’রে ডলাচ্ছিলো, তোমার ছেলে বারান্দা থেকে দেখে খুব ভয় পেলো, সেটা আমি তুলে নিয়েছি; ভূসো ভূত বেশ সহজ ছিলো, সন্ধ্যেবেলা বকুলগাছে একটা ন্যাকড়া মতো কিছু হাওয়ায় দুলছিলো, অত বোঝার বয়স হয়নি কি ঝুলছে কি দুলছে, ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললো, এটাও ছাড়িনি আমি; আর সাদা হাতির ব্যাপারটা ছিলো সবচেয়ে ক্রিয়েটিভ বুঝলে, ছবির বই দেখিয়ে শেখাচ্ছি আর মুখে গুঁজছি, হাতিতে এসে এমন আটকালো, ছাড়বেও না খাবে তো নাই ই, ওর নাকি একটা হাতি চাই এখনই, বললাম আছে তো তোমার পাপ্পু, কিছুতেই বোঝাতে পারি না, তার চলাফেরা লাইফ সাইজ হাতি চাই, তখন বানালাম সাদা হাতির গল্প, দেখলাম কালো দেখে অভ্যস্ত প্রাণীটাকে সাদা বলাতে ভাবতে না পেরে চোখ বড়ো ক’রে হাঁ ক’রে ফেললো মুখ।

-- হুমম, আরো ক’টা তৈরী ক’রে ফেলতে পারতে, আরো সহজ হতো, যখন যেটা মুখে আসতো...

-- মানে?

-- মানে এতো ভয় কেন শেখাচ্ছো ওকে?

-- অ্যাই, তুমি একদম ধেড়ে খোকাদের মতো ন্যাকামি কোরো না কিন্তু। কোন পৃথিবীতে থাকো তুমি? টিভি মিউট করে দিলে কি কিছু বোঝা যায় না? ওই যে বোমা পড়ছে একের পর এক, বাচ্চা-বুড়ো-জোয়ান পালাতে পালাতে তাদের পেছনে আগুন ঝলকাচ্ছে, টপাটপ পড়ে যাচ্ছে সব। দেখো ওই দুদিকের বাড়িগুলো, দোতলা ছিলো না তিনতলা বোঝার উপায় নেই, তোমরা রাস্তা বানাচ্ছো না স্মশান বোঝা যাচ্ছে না, এতো ধোঁয়া। ভয় ছাড়া আজকাল কিছু পাওয়া যায়? কোনো বুদ্ধিমান মানুষ ভয় ছাড়া বাঁচতে পারে আজকাল? আমি ভয় শেখাচ্ছি বেশ করছি। ওকে ভয় শিখেই বাঁচতে হবে, জানো না? নিজেকে ক’টা ভয় পেতে হয় প্রতিদিন?

বেচারী ঘনশ্যাম। হাঁ করে ব’সে দেখছে এইসব, কেউ একটা গোল্লা দেয় না তার মুখে। পট করে প্রিয় চিংড়ি টপিন' একটা গোল্লা মুখে পুড়ে আধা চিবিয়ে আধা গিলে বললো, কাকের ডিম। তারপর একটা অতিপ্রিয় ডিমের কুসুম টপিন’ দেওয়া গোল্লা মুখে পুরে আবার বললো, কাকের ডিম। এই রে, ভুল তুলেছে। ভারী উত্তেজনায় মুখের খাওয়ার ফুরফুরিয়ে ছড়িয়ে বললো, মা, কালকে বক’কে বললে দিয়ে যাবে তো একটা?

আশ্চর্য্য কাগেদ্দি বগেদ্দি কে কাকের ডিম বকের ডিম বলছে!

ঠাকুরদাদা খাওয়ার সময় এসে ব’সে প্রায়ই উপভোগ করতেন এত গপ্পোগাছা। কিন্তু এতদিনে এইসব গভীর ব্যাপারে একটি কথা বলেন নি। আজ তিনি বললেন,

-- আধোবুলি বোধহয় মিটলো বৌমা। বাবা বলতেন আড় ভাঙলে তবে আসল জীবন শুরু। কাল থেকে তুমি ওকে পাড়ার পার্কে খেলতে নিয়ে যেও।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ